ছোটগল্প- অন্ত্যেষ্টিযাত্রা- জাকির তালুকদার
এতক্ষণ যদিও বা চাকা ঘুরছিল জিপের, কিছুক্ষণ পর পর গর্তে পড়ে ঝাঁকি খেতে খেতে পাছার ছাল-চামড়া উঠে যাবার জোগাড় হলেও, এগুনো যাচ্ছিল অন্তত। কিন্তু এখন আর সেটাও ঘটছে না। চাকার নিচে ইট কিংবা শক্ত মাটি আর নেই। বরং এঁটেল মাটি ভিজে এমন পিছলে হয়ে আছে যে জিপের চাকা কিছুতেই দাঁত বসাতে পারছে না। ভচ ভচ করে কাদা ছিটিয়ে চাকা ঘুরছে বটে কিন্তু এগুচ্ছে না একবিন্দুও। সেপাই চারজন নেমে গিয়ে জিপের পেছন থেকে এবং পাশ থেকে “জোরসে মারো হেঁইও” বলে প্রাণপণে ঠেলতে শুরু করলেও জিপ এগোয় না। এবার নেমে গেল তহসিলদার নবাব আলিও। হাত লাগাল সেপাইদের সাথে। কিন্তু লাভের মধ্যে বনবনিয়ে ঘোরা চাকার ঘায়ে ছিটকে আসা কাদা মাখাই সার। জিপের মধ্যে ততক্ষণে ঘেমে উঠেছে সুলতান আহমেদ। হিসাবমতো তারও এখন নামা উচিত। কিন্তু সে নামলে ঐ নামা পর্যন্তই। সে তো আর জিপ ঠেলতে পারে না। হাজার হলেও সে একজন ম্যাজিস্ট্রেট। এই এলাকার সহকারী কমিশনার (ভূমি)। সে যদি এখন জিপ ছেড়ে নেমে দাঁড়ায়, জিপটা হয়তো একটু হালকা হবে। কিন্তু নামা বললেই তো নামা যায় না। নামবে তো পা রাখবে কোথায়? এমনই প্যাকপেকে কাদা যে পা নামালেই মনে হচ্ছে জুতো ডেবে যাবে কাদায়। আর একবার কাদা মাখা মানেই তার ফরেন চামড়ার জুতোর দফা-রফা। শুধু কী জুতো! তার এক্সিকিউটিভ কাটের প্যান্ট কিংবা ধবধবে ইজিপসিয়ান কটনের সার্টেরও যে কাদা মেখে যাচ্ছেতাই অবস্থা হবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কী! সে এইসব ভেবে-চিন্তে জিপের মধ্যে বসে থাকাকেই সঠিক বলে মানে এবং বসেই থাকে।
তহসিলদার নবাব আলি ড্রাইভারের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করে যে চাকার তলায় কাঠ পেতে দিলে ফার্স্ট গিয়ার চেপে জিপ নড়ানো সম্ভব। সেই কথামতো দুই সেপাইকে সবচেয়ে কাছের বাড়ির দিকে রওনা করিয়ে দিয়ে সুলতান আহমেদ ফস করে সিগারেট জ্বালায়।
অস্বস্তি বেড়েই চলে। বগলের তলায়, পিঠে, কপালে ফুটে ওঠে বিনবিনে ঘাম। বাধ্য হয়ে তাকে জিপ থেকে নেমে এসে রাস্তার ধারের ঘাসের চাপড়ার ওপর দাঁড়াতে হয়। মাঝে মাঝে ঘাসপচা-গোবরপচা বাতাস এসে গায়ে ঝাঁপটা মারে। বাতাসে চামড়ায় আরাম বোধ হলেও দুর্গন্ধে পেটের নাড়ি অল্প মোচড় দেয়। সুলতান আহমেদ তখন সিগারেটে ঘন ঘন দীর্ঘ টান দিয়ে দুর্গন্ধ আড়াল করার চেষ্টা করে। দুই সেপাই কখন তক্তাসহ ফিরে আসে তার ঠিক নেই। সে একটু পর পর তাদের ফিরে আসা দেখার প্রত্যাশায় পথের দিকে তাকাতে থাকে। মাথার মধ্যে বিরক্তি দাঁত ফোটাচ্ছে। এই এক নতুন ডিউটি যোগ হয়েছে তার। মাসের মধ্যে দুই-চার বার মরালাশকে স্যালুট ঠুকতে বেরিয়ে পড়তে হয়। কোনো মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হলে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করতে হবে। তার কর্ম এলাকায় রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব মূলত তাকেই করতে হয়। ইউএনও তার ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে নিজে কেটে পড়ে। যেহেতু সে ইউএনও-র নিচের অফিসার, আর তার নিচে কোনো অফিসার নেই; ইউএনও তো কথায় কথায় বলে যে জাঙ্গিয়ার নিচে কোনো পোশাক নেই আর সহকারী কমিশনারের নিচে কোনো অফিসার নাই। ফলে তার পক্ষে অর্ডার আরেকজনকে ডেসপ্যাচ করে দেবার সুযোগ নেই। এই কাজে তাকেই দৌড়াতে হয়। জাতীয় পতাকা নিয়ে, গার্ড অব অনার দেবার পুলিশ নিয়ে, জাতীয় সংগীত বাজানোর বিউগল বাদক নিয়ে তাকে ছুটতে হয় কোনো মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর খবর পেলে। তবে আজ যে অবস্থায় পড়েছে, এত দুর্ভোগ, এমন কাদামাখা রাস্তায় আটকে পড়ার ঘটনা তার খুব কমই ঘটেছে। এই মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলি, যার শেষকৃত্যে তাকে যেতে হচ্ছে, তার বাড়ি যে এত রিমোর্টে তা-ই বা কে জানত! আর লোকটা যদি গ্রামের বাড়িতে না মরে সদরে মরত, তাহলেও এত হ্যাপা তাকে পোয়াতে হতো না। ইউএনও এইসব হ্যাপা এড়ানোর জন্য খুব মিষ্টি করে তাকে বলেছিল– যাও সুলতান ঘুরে এসো। কাজটাও সারা হবে আবার এই সাথে গ্রামের রিয়েল চিত্রও দেখতে পাবে।
গ্রামচিত্র যেন সুলতানের দেখা নেই! নিজে ঠিক গ্রামের ছেলে না হলেও বিসিএস পাশ করার আগে একটা এনজিওতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার সুবাদে গাইবান্ধার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিছুদিন থাকা হয়েছিল তার। ঐ দেখাই তার জন্য যথেষ্ট। শহরের লোকের ধারণা, গ্রামের মানুষ খুব সহজ-সরল। আর সেখানে জীবনযাত্রা নিস্তরঙ্গ শান্তিময়। সেই লোকেরা কিছুদিন গ্রামে থাকলে টের পেত গ্রামবাস কারে কয়! সুলতান জানে। একটা ঘটনা বললেই বোঝা যাবে অবস্থাটা কী! ঘটনাটা ধর্ষণের। গ্রামে-গঞ্জে ধর্ষণ ডাল-ভাতের মতো ব্যাপার। পেপার-পত্রিকায় আর কটাই-বা আসে! এক ক্ষেতমজুরের মেয়েকে পাটক্ষেতের মধ্যে ধর্ষণ করেছিল এক যুবক। মেয়েটার মা তাদের এনজিও-র সদস্য। ঋণ-টিন নিয়েছিল। কাজেই এই ব্যাপারটাতে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল তাকেও। আর সদ্য ভার্সিটি থেকে বেরুনো সে, রক্ত তখনো গরম। পারে তো তোলপাড় করে ফেলে সমস্ত এলাকা। কিন্তু ইউপি চেয়ারম্যান ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করল নিতান্ত নির্বিষভাবে। শ পাঁচেক টাকা বোধহয় পেয়েছিল মেয়েটা। আইন-আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারেনি ব্যাপারটা। সে হতভম্ব হলেও ফুঁসে উঠেছিল। চেয়ারম্যান তাকে ডেকে খুব স্বাভাবিকভাবে বলেছিল– দ্যাখেন যুবক বন্ধু, হামি জানি ব্যাপারডা আসলেই ঘটিছে। এট্টু ঘাঁটাঘাটি করলে সাক্ষী-পরমাণও জুটান যায়। আর আইনও হামি কম জানি না। ধরেন, দুষি ছোলডার ফাঁসি না হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান আছে আইনোত। এখন হামি হচ্ছি গাঁয়ের চেয়ারম্যান। দুই পক্ষই আসিছে হামার কাছত। আর তা আসবিই। হামার কাছত চোরও আসবি, গিরস্তও আসবি। তা এখন শুনেন। হামার অবস্থাখান আন্দাজ করেন। দুই পক্ষই হামার ভোটার। ঐ মিয়্যাডা গরিবের গরিব, হদ্দ গরিব। তাগের বাড়িত ভোট হলো মোট তিনখান। আর ঐ ছোলডা, যে ধর্ষণ করিছে, তার বাপ হলো গাঁয়ের মাতব্বর, তার হাতোত কম করি হলেও এক শ খান ভোট। এখন আপনেই কন হামি কোনপক্ষ লিবার পারি? হামি তো এই চেয়ারোত রামরাজত্ব কায়েমের জন্যে বসিনি। হামাক ফের পাঁচ বছর পর পর ইলেকশন করা লাগবি। হামি তো তিনখান ভোটের জন্য এক শ খান ভোট নষ্ট করবার পরি না! আপনেই কন বাহে ঠিক কিনা?
সুলতান আহমেদ ততদিন ক্ষমতার রাজনীতি ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেনি। এর ভয়াবহতা, এর নৃশংসতা, এর অমানবিকতা দেখে সে শিউরে উঠেছিল। এখন অবশ্য তার গায়ের লোম দাঁড়ায় না। গ্রামের আগাপাশতলা দেখতে তার আর বাকি নেই।
সেপাই দু’জন ফিরে আসে তক্তা আর এক দঙ্গল গা খোলা বাচ্চা ছেলে নিয়ে। তারা এসেই জিপ ঠেলতে শুরু করে মহাউৎসাহে। তাদের সম্মিলিত ঠেলা, সেইসাথে চাকার তলায় তক্তার শক্ত জমিন পেয়ে জিপ নড়ে ওঠে। জিপ চলে কাদা ছিটিয়ে, জিপের পেছন পেছন ছেলের দঙ্গল ছোটে হৈ হৈ করে। নিজেকে সার্কাসের ক্লাউন মনে হতে থাকে সুলতান আহমেদের। গোঁজ হয়ে ঘাড় শক্ত করে বসে থাকে সে জিপের গদিতে। এইভাবে এক সময় তারা পৌঁছে যায় চকআমহাটি। তারপরে জিপ আর চলে না। কেননা যে রাস্তাটা গ্রামে ঢুকে গেছে সেটি দিয়ে শুকনোর দিনে বড়জোর একটা ভ্যানরিক্সা গলতে পারে। জিপের চওড়া গতর সেদিক দিয়ে সেঁধোতে পারবে না। অতএব সদলবলে হেঁটেই গ্রামে ঢুকতে হয় সুলতান আহমেদকে।
গাঁয়ে ঢুকতেই জটলা। সেই জটলা আরো বাড়ে খাকি পোশাক দেখে। লোকগুলোর একটু একটু শঙ্কা, একটু দ্বিধামাখা মুখ। গাঁয়ে খাকি উর্দি কোনোদিনই কোনো মঙ্গলের বার্তা বয়ে আনেনি, একথা তারা পুরুষানুক্রমে জানে। জানে যে পুলিশ ছুঁলে আঠারো ঘা। তারা জটলা করে কিন্তু কাছে আসে না। তখন তহসিলদার নবাব আলিকেই এগিয়ে যেতে হয়। সে প্রশ্ন করে– শওকত আলির বাড়ি কোনটা?
জটলায় একটু গুঞ্জন ওঠে। মাঝবয়সী একজন এগিয়ে আসে– কোন শওকত আলি?
কোন শওকত আলি মানে?
মানে শওকত আলি আছে এই গাঁয়ে দুইজন। তিনজন ছিল। একজন বছর দশেক আগে ভিনগাঁয়ে বিয়ে করে উঠে গেছে। অন্য দুজন এই গাঁয়ের স্থায়ী বাসিন্দা। একজন ছাগলাদাড়ি শওকত আলি, অর্থাৎ যার কিনা ছাগলের মতো কয়েকটা মাত্র দাড়ি মুখে, আরেকজন ল্যাংচা শওকত আলি। তা ছারেরা কোন শওকত আলিকে চান?
এবার দমে যায় সুলতান আহমেদের দল। এত খুঁটিনাটি জেনে তো আসা হয়নি! নিরুপায় হয়ে সুলতান আহমেদ পকেট হাতড়ায়। তার কাছে মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলির বংশপরিচয় লেখা আছে। সে কাগজটা দেখে বলে, নওশের আলির ছেলে শওকত আলি, যে মুক্তিযোদ্ধা ছিল।
ও ল্যাংচা শওকত! জটলা থেকে একসাথে অনেক গলায় উচ্চারিত হয়– তা তাঁই তো আজ সক্কালেই ইন্তিকাল করিছে!
এটাও মিলছে। কেননা গেজেট-ফাইল থেকে পাওয়া তথ্যে সুলতান আহমেদ জেনেছে যে যুদ্ধের সময় উরুতে গুলি খেয়েছিল শওকত আলি। ফলে বাকি জীবন তাকে খুঁড়িয়ে চলতে হয়েছে। সেই তথ্যের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে আজ সকালে মৃত্যুর তথ্য। সব মিলিয়ে বলা যায়, এটাই তাদের উদ্দিষ্ট শওকত আলি। তা সেই শওকত আলির বাড়ি কোনদিকে জিজ্ঞেস করায় একজন গ্রামবাসী উল্টে জিজ্ঞেস করে– কী অপরাধ করেছে ল্যাংচা শওকত?
অপরাধ? এই প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় সুলতান আহমেদ। পরক্ষণেই বুঝতে পারে, খাকি পোশাক দেখে এই প্রশ্ন। অর্থাৎ পুলিশ মানেই শুধু আসামি ধরা কিংবা হয়রানি। সুলতান আহমেদ মুখে হাসি টেনে বোঝায় যে শওকত আলি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করার জন্যই তাদের আগমন এবং আয়োজন।
এবার মুশকিল আসান। কয়েকজন ভলান্টিয়ার হয়ে তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে। গলি-সরু গলি-বাড়ির উঠোন-ভেন্নার ঝোপের তলা দিয়ে তাদের নিয়ে উপস্থিত হয় শওকত আলির বাড়িতে। মাথা ঝিমঝিম করছিল সুলতান আহমেদের। মনে হচ্ছিল ভুলভুলাইয়া দিয়ে হাঁটছে তারা এতক্ষণ। শওকত আলির উঠোনে পৌঁছে হাঁফ ছাড়তে গিয়েও বিস্মিত বোধটাই তাকে পেয়ে বসে– এত দুরবস্থা একজন মুক্তিযোদ্ধার! বাড়ি বলতে ঘর মাত্র একখানই। উত্তর-দক্ষিণে লম্বায় হাত বিশেক। খড়ের চালা, বাঁশের খুঁটি। চালা এত নিচু যে কোমর ঝুঁকিয়ে উঠতে হয় বারান্দায়। এবং সেখানে সোজা দঁড়ানোর কোনো উপায় নেই। বড় ঘরের উল্টোদিকে উঠোনের অন্যপাড়ে একটি মাটি খুড়ে বানানো উনুন, কিছু রান্নার সরঞ্জাম। মাথার ওপরে কোনো ঢাকনা নেই। বর্ষার দিনে নিশ্চয়ই তোলা উনুনে বারান্দাতেই রান্না হয়। এইসব দেখে সুলতান আহমেদের বড় অস্বস্তি হয়। তাহলে পেপার-পত্রিকায় যে লেখা হয় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষা করছে, খেতে পাচ্ছে না, মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না– এসব সত্যি! তার ধারণা ছিল পত্রিকায় লেখা মানেই অতিরঞ্জন, পাবলিকের সহানুভূতি আকর্ষণ করার জন্য বাড়িয়ে লেখা। তার চেম্বারে কিছু মুক্তিযোদ্ধার আনাগোনা আছে। তারা বিভিন্ন তয়-তদবির নিয়ে আসে। তাদের তো রীতিমতো ঘাড়ে-গর্দানে অবস্থা। কারো পরনে সাফারি, কারো টেট্রনের পায়জামা-পাঞ্জাবি, চকচকে গাল-মুখ, শরীর ছিটকে বেরোয় কাঁচা পয়সার জেল্লা। তাদের ঐরকম জেল্লা থাকলে শওকত আলিদের এই রকম দুরবস্থা কী করে হয়! সুলতান আহমেদের মনের দ্বিধা একজন সেপাইয়ের গলা চিরে সন্দেহ আকারে বেরিয়ে আসে– আমরা ঠিক জাগাত আইছি কি ছার? এইডা কি সত্যি একজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি?
সন্দেহ জাগাটাই স্বাভাবিক। যে কয়জন মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে এর আগে সে মৃত্যুর খবর পেয়ে গেছে, বাড়ি দেখেছে গম গম করছে মানুষে। বাড়িতে ঢোকার বেশ আগে থেকেই কানে এসেছে মাইকে “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে” গানের সুর, বাড়ির ভেতরে ক্যাসেটে বাজছে ক্বারী বেলালী কিংবা ক্বারী মনসুরের কোরানপাঠ, সারা বাড়ি লোবানের গন্ধে ভুর ভুর, বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই আত্মীয়-স্বজনের ছুটে আসা, বসার ব্যবস্থা করা, ঠান্ডা অথবা গরম পানীয় দিয়ে তাৎক্ষণিক আপ্যায়ন করা, শোকাতুর মুখের ওপর গর্বের ছাপ ফুটে থাকা আত্মীয়-পরিজনের গম্ভীর, নিচুস্বরে কথোপকথন– এইসব দেখতে অভ্যস্ত সে।
এখানে নিচু বারান্দায় খেজুর পাতার পাটিতে কাফনঢাকা লাশ। তিনজন যুবতী মেয়ে লাশ ঘিরে বসা। গাঁয়ের লোক জানায়, ঐ তিনজনই শওকত আলির মেয়ে। তার কোনো পুত্র নেই।
ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বিধবা। লম্বা, শুকনো, ক্ষয়রোগীর মতো চেহারা। শওকত আলির পরিবার। তাদের সামনে এসে ভাষাহীন চোখে দাঁড়িয়ে থাকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় মহিলা। সালাম-টালাম দেবারও কোনো উদ্যোগ করে না। তার পাশে এসে দাঁড়ায় আরো দুজন প্রৌঢ়। গ্রামবাসীরা জানায় এরা দুজন মৃত শওকত আলির ছোট ভাই। তারাও এসে বোবাচোখে পুলিশ দেখতে থাকে। গ্রামবাসীরাই তাদের আশ্বস্ত করে– পুলিশ এসেছে মৃত মুক্তিযোদ্ধার প্রতি সম্মান জানাতে। অন্য কোনো ভয় নেই।
তহসিলদার ব্যাপারটা বিশদ বুঝিয়ে দেয়– মুর্দা শওকত আলি একজন মুক্তিযোদ্ধা। সরকারি হুকুম হচ্ছে, কোনো মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন হবে। সেইজন্য পুলিশের সাথে এসিল্যান্ড স্যার মানে ম্যাজিস্ট্রেট স্যার নিজে এসেছেন।
একথায় একটু চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। প্রৌঢ় দুজন– বসেন ছার আপনেরা বসেন, বলে তাদের বসানোর ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আশপাশের বাড়ি থেকে জোগাড় হয় একটা কাঠের চেয়ার আর একটা জলচৌকি। সেগুলোর সাথে উঠোনে খেজুর-চাটাই বিছিয়ে সরকারি লোকদের বসার ব্যবস্থা হয়।
বসলেও উসখুস করে সুলতান আহমেদ। মন থেকে অস্বস্তি যায় না। ঠিক লোকের বাড়িতে এসেছে তো? নিশ্চিত হওয়া দরকার। উল্টোপাল্টা কিছু ঘটলে সর্বনাশ। প্রমোশনের বারোটা বেজে যাবে। শওকত আলির এক ভাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করে– আপনি কি জানেন কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছিল আপনার ভাই?
সেক্টর বোঝে না সে। ফ্যালফেলিয়ে তাকায়। তখন সুলতান আহমেদ আবার ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে– মানে কোন এলাকায় যুদ্ধ করেছে?
এবার ভাতৃগর্বে প্রৌঢ়ের মুখে খই ফোটে– সারা দ্যাশে ছার! সারা দ্যাশে যুদ্ধ করিছে আমার ভাই। খানসেনা মারিছে শয়ে শয়ে, রাজাকার মারিছে হাজার হাজার। খুব সাহস আছিল তো ভায়ের! খুব সাহস!
আপনার তখন বয়স কত ছিল? আপনি যুদ্ধে যাননি?
আমিও তখন জুয়ানই। আমরা সব ভাই-ই জুয়ান। কিন্তু আমরা যুদ্ধে যাইনি। বড় ভাই বলিছিল, তোরা বাপ-মায়ের দেখ-ভাল কর। খানের বাচ্চাগুলোক তাড়ানোর জন্য আমি একলাই যুদ্ধে যাব। তাছাড়া যদি মরি, তিন ভাই মরলে বংশ নিপাত। তারচেয়ে আমি একলাই যুদ্ধে যাই, তোরা ভিটা আগলা। তো বড়ভাই যুদ্ধে গেল। নয় মাস পরে শ্যাখ মজিবরের দলের সাথে ঘরে ফিরল জয়বাংলা করতে করতে। বড় ভাইয়ের কাছে যুদ্ধের কত গল্প শুনিছি।
সেইসব গল্প শুরু হয় এরপর। গল্পের দিকে কান নেই সুলতান আহমেদের। তার মনের খচখচানি যাচ্ছেই না। কী করা যায়! সার্টিফিকেটটা চেয়ে দেখবে নাকি? একটু দ্বিধা করে চেয়েই বসে– আপনার ভাই তো যুদ্ধের পরে সার্টিফিকেট পেয়েছিল।
সার্টিফিকেট! প্রৌঢ় যেন জানেই না সার্টিফিকেট বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে। সুলতান আহমেদ তাকে বোঝায়, মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট হচ্ছে একটা ছাপানো কাগজ, যার মাঝখানে অঙ্কিত আছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রামের জলছাপ।
প্রৌঢ় সার্টিফিকেট খুঁজতে ঘরে যায় আর সুলতান আহমেদ ভাবে ঐ কাগজটা পেলেই সব সমস্যার সমাধান। মনের চোখে দেখতে পায় সে সার্টিফিকেটে লেখা আছে–
“জয়বাংলা
দেশরক্ষা বিভাগ
স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র
শওকত আলি, পিতা: নওশের আলি, গ্রাম: চকআমহাটি
থানা: নাটোর, জেলা: রাজশাহী বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর/বীরাঙ্গনা সৈনিক। তিনি ৭ নং সেক্টরে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁর অবদান চির উজ্জ্বল হয়ে রইবে।”
সার্টিফিকেটটা দেখতে পেলেই তারা লাশের সঙ্গে গোরস্থানে যাবে, পতাকা দিয়ে মুড়ে দেবে লাশের কাফন, স্যালুট করবে মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলির মরদেহকে, বিউগলে দুই লাইন বাজবে জাতীয় সংগীত। তারপরেই তার ছুটি। কোয়ার্টারে বউটা বোধহয় ভাত-তরকারি বেড়ে রেখেছে টেবিলে, এতক্ষণে বোধহয় ঠান্ডা কড়কড়ে হয়ে গেছে। ফোঁশ করে নিশ্বাস ফেলল সুলতান আহমেদ।
প্রৌঢ় ফিরে এলো শূন্যহাতে। সার্টিফিকেট নেই!
নেই মানে?
বিধবা এসে দাঁড়াল তার সামনে। অনুচ্চ কণ্ঠে স্থানীয় ভাষায় যা বলল তার মর্মার্থ হলো– সার্টিফিকেটটা বছর দুই আগে নিজহাতে ছিঁড়ে পুড়িয়ে ফেলেছিল শওকত আলি। কেন? তার বড় মেয়ে হামিদার ইজ্জতের ওপর হামলা চালিয়েছিল শান্তি কমিটির মেম্বর ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে আক্কাস। গ্রাম্য সালিশ, থানা-পুলিশ সব জায়গায় টাকার জোরে পার পেয়ে গেল সেই ছেলে। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ধর্না দিয়েও সুবিচার পায়নি শওকত আলি। আর লোকটাও ছিল খুব বদরাগী, গোঁয়ার-গোবিন্দ গোছের। রাগের চোটে– শালার সার্টিফিকেট না বাল! এই কাগজ দিয়া শুয়োরের বাচ্চা রাজাকারের একখান বালও উপড়ান যায় না– বলে পুড়িয়ে ফেলল কাগজটাকে।
শওকত আলি তো পুড়িয়ে ফেলেছে, কিন্তু এখন সুলতান আহমেদ কী করে! সার্টিফিকেট ছাড়া কোনো প্রমাণ নেই যে মৃত শওকত আলি মুক্তিযোদ্ধা। এখন যদি লোকটা সত্যিই মুক্তিযোদ্ধা হয়ে থাকে, তবে তার শবদেহকে গার্ড অব অনার না দিয়ে ফিরে গেলে, আর সেই খবর জানাজানি হলে তার পাছার চামড়া আস্ত থাকবে না। আবার, সে গার্ড অব অনার দিল অথচ লোকটা যদি মুক্তিযোদ্ধা না হয়ে থাকে, তবে সে ঘটনা জানাজানি হলেও ঢি ঢি পড়ে যাবে সারাদেশে, পেপারে-পত্রিকায় লিখে সাংবাদিকরা তাকে জোকার বানিয়ে ছাড়বে। মেঘলা আকাশের নিচে পড়ন্ত দুপুরে সুলতান আহমেদ বুগবুগিয়ে ঘামতে থাকে।
তখন বুদ্ধি যোগায় তহসিলদার– স্যার গেজেটে তো আমরা দেখে এসেছি নাম, পরিচয়ের পাশাপাশি শওকত আলির উরুতে গুলির জখমের দাগ আছে। নাম, বাপের নাম, ঠিকানা তো মিলছে। এখন দাগটা মিলিয়ে নিলে মনে হয় সার্টিফিকেট ছাড়াও স্বীকৃতি দেওয়া যায়।
কিন্তু কাফনের কাপড় সরাতে নারাজ বাড়ির লোকজন। ময়-মুরুব্বীর মধ্যে চাপা ক্ষোভ– মুর্দাকে বেআব্রু করা যাবে না।
না বললেই তো আর হয় না। সুলতান আহমেদেও চাকরি-প্রমোশন-ক্যারিয়ারের ব্যাপার। অতএব পুলিশী হস্তক্ষেপ ঘটে। এক পুলিশ হ্যাঁচকা টানে শওকত আলির মৃতদেহের কোমরের নিচ থেকে কাফনের কাপড় ফাঁক করে ফেলে।
অমনি মেটেরঙা আকাশের নিচে শাদা ধবধবে কাফনের পটভূমিকায় খুব প্রকট হয়ে দেখা দেয় মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলির রাইগার মর্টিসে আক্রান্ত পুরুষাঙ্গ, নাভি, সিঁটিয়ে যাওয়া উরুতে উর্ধ্বমুখি বুলেটের জখমি গর্ত। সেই গর্তে যেন মুহূর্তে কবর হয়ে যায় আব্রুর সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলি, ৭ নম্বর সেক্টর, দেশজুড়ে বিস্তৃত রণাঙ্গনের বাদবাকি সম্ভ্রমটুকুর। কাফন সরিয়ে নিলে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের শরীরের ক্ষতচিহ্ন ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ে না।