ফারুক আফিনদীর দীর্ঘ কবিতা
বৃষ্টি, বৃষ্টি বৃষ্টি
০.
বৃষ্টি, কুহক
কানাওলি : ভাঙো মেঘ, বঁধু! যেভাবে ভাঙতেছ ইট। ছড়াক কিছু- রাবিশ রাবিশ, সলিড লাল গুড়া-। আর লাল কি বোঝ?
লালের স্বভাব ছড়িয়ে পড়া। আগুন দেখনি? পাকা গমখেতে দুপুরের তৃষ্ণার্ত রোদের জিহ্বা দেখেছ? বিপ্লব?
প্রেম? ছড়িয়ে পড়া বোঝো? দেখে নিও এই মনচিত্র কুরবানিতে এবার- কীভাবে মাটির ওপর ছড়িয়ে পড়ে পবিত্র
রক্তগুলো। এর আগে তুমি গরুটির চোখের কোণায় তাকিও। দেইখো সুন্দর, শিক্খো মায়া, কান্না-। তোমার
গরু কি লাল? তুমি তাকে ভালোবাস খুব? হোক, তাকে তুমি দেখিও না লাল মেঘ। শুধু ভাঙো। কিছু
সোনারুপার পানি ছড়াক পৃথিবীতে, কিছু প্রবল বাতাস-। শুচি হোক স্নিগ্ধ হোক, ‘হও হও, একা- জমাট, ধূসর-’।
রাত হয়েছে। সূর্যাগুন গিয়েছে খুব।
কুহকী : বিলাপ শেষে
চুল ছেড়ে বেড়ায় ঠেস দিয়ে বসে আছে
শাওনের রাত
মরা পেয়ারার ডালে বৃষ্টির ফোঁটার মতো
-ঝুলে আছে আলো
-অকস্যাত জ্বলে উঠলো এ চোখ কিবা ও চোখ- অনন্ত আলোর মতো ঝুলে আছে এক ফোঁটা বৃষ্টি
এই নীল চোখ ওই লাল চোখ, ওই নীল চোখ এই লাল চোখ
সাদা চোখ- একটি সাদা চোখ জানে, এই কুহক মনের লাবণ্যের ভেতর ঠাঁই নিয়েছিল বলে বৃষ্টি শশি আর অন্ধকারকে একে একে
ভালোবেসেছিল সমূলে, শরীরে। মেখে নিয়েছিল জল জোছনা আর এক কালো নরম শরীরের মিক্সার।
তখন বাইরে এক ফোঁটা বৃষ্টির টলমল বুক ছুঁয়ে ছিল এক টুকরো বৈদ্যুতিক আলো। কাছে যেতেই পালাল।
১.
নগরে নঞর্থক বৃষ্টি
ধুয়ে নেবে? কী নেবে? কী?
সূর্য! শশি!
সূর্যকেই নিয়ে নেবে পুরো
জোছনাকে চেটে খাবে
বর্শা ফলকের মতো মুখ নিয়ে বুনোশেয়ালেরা যেভাবে আসে সন্ধ্যায় ঝাঁক নিয়ে
আকাশের একঝাঁক বৃষ্টি, চোখা চোখা-
সেভাবে এসে খেয়ে নেবে জোছনার ক্ষির
মাতাল মাগির ছাওয়াল যেমনে চোষে,- যোনি ভরা উষ্ণ তাড়িমদ-
বলছ, জোছনা কি সাদা ফর্সা নারীর শরীর থেকে উপচে পড়া পথিবীর লাবণ্যজল? কেন নয়? কেন নয়? জোছনা তো কয় রূপ
সঞ্চারের কালে একসাথে ছিল তারা নরম হাওয়া ঘিরে। জোছনা গলে যায়- জমে জমে ঠাণ্ডা হয়- নারী-। থকথকে। জোছনা গিলে খাবে
কেউ আষাঢ়ে আজ। আষাঢ় থেকে শ্রাবণে, এবং ভাদ্রে- নারীকেই খাবে। শস্যবীজ নেবে ভাসিয়ে।
আকাশের একঝাঁক বৃষ্টি, দীর্ঘ দীর্ঘ হাতে-
নামাবে অন্ধকারের পর্দা!
কিছুই দেবে না! নেবে না কিছু ক্লেদ!
নরম গানের কলি ফুটবে না এই জলে যে
পৃথিবী হঠাৎ একটু অবসর নিয়ে নিজ নিজ লাবণ্যে লুকাবে
একা হবে কিছুক্ষণ কেউ
নীল জলের এ নদীর পাড়ে, বিলে, বিলে ফিঙেটির মতো-
ঠাণ্ডা হয়ে যাবে খুব-
শুনবে পৃথিবীর নরম সব গান, ভুল বলেছি- গাইবে,
শুনবে না কেউ যা কোনোদিন, হয়তো-
পাখিদের চেয়ে নরম- নরম এই গান এইসব গান
কেউ, কেউ বেলি হাসনাহেনার মতো গন্ধময় ভোরের আলো ফোটার মতো সাদা,
করুণ শিহরণ কিংবা গন্ধময় গোলাপি রঙের কলিতে কোনো ঘষবে মুখ
নীরবে একা হবে কিছুক্ষণ-
মানুষ এসে মানুষীর সাথে মিশবে।
হৃদয়ের চেয়ে বিশুদ্ধ পানীয়ে মুখ ডোবাবে কেউ- অপার অপার হয়ে
ফুটবে না এই রাঙা পারিজাত। নেবে না কিছু কালি।
শুধু- দেখা দেবে চাপা চাপা ‘আহা’, ঘৃণা ও মায়ার আগুন। দেখা যাবে- দেখা যাবে- ভেঙে বলি, মেঘ যেভাবে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে-
বর্ষার একটু নির্জনতা
ঘন আন্ধারে
এক কোমলাঙ্গীর সাথে
জোট লেগে আছে
এক কালো জোঁক।
নীরব- শুধু ঝিঁঝি ঝিঁঝি, গুঞ্জন- পোকামাকড়ের হৈচৈ-
আর শুধু চাপা ‘আহা’।
লুট। সর্বস্ব লুট- সর্বস্ব হারানোর নগর-
ভারী ভারী টেঁটার মতো বৃষ্টিতে ধীরে ভেসে যায় পিচ, বাগান বিলাসের ফুল। বাড়ে লোডশেডিং, সড়কবাতি নিভে যায় কোথাও।
ভেঙে যায় কোথাও দাঁড়ানোর একটুকু ইট, বিবর্ণ-। আরো ঘন ঘনিষ্ট হয় আঁধার।
অন্ধকার আসে নীরবতা নিয়ে স্তব্ধ ও স্থবিরতা নিয়ে। থেমে যায় পথ, সব-।
অন্ধকারে আসে অর্থ, রাস্তায় রাস্তায়। ইটের রঙের মতো লাল হয় কিছু মুখ বিকৃত সুখ। আপেলের মতো গোল। বারেবারে-, বারবার
ভেসে যায়-। লুট লুট, সর্বস্ব লুট সর্বস্ব হারানোর নগর।
আপনারা শুনছেন ‘বৃষ্টি মানে কী’। বৃষ্টি মানে কী? মানে তো স্থবির হওয়া সকাল- উষ্ণ ঘুম, একই সাথে কাদাজল নিয়ে দেরি করে-,
সময়! সময়কে হারিয়ে, নাকি আশা ও অপেক্ষায়-, কারখানায় যাওয়া করুণ নারীর মুখ। তীর্র্যক অপমান, মধ্যস্বত্বভোগীর মতো
তাপকাতর কোনো বানচোতের মুচকি হাসা- ‘এই তো, বৃষ্টি বৃষ্টি কী ভাপ উত্তাপ এই তো একবার সুযোগ’।
আর মাস শেষে করুণ শিশুর সামনে মাইনে কাটা মায়ের বিষণ্ণ ভেজা মুখ।
এই তো।
২.
বৃষ্টি এবং এক লোক
বৃষ্টি নয় লেবুপাতায় ঝুলে থাকা টসটসে… টসটসে.. টসটসে…টসটস-, সাদা নয়নতারা-
উদাস দুয়ার দিয়ে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেল উদ্দেশহীন গান, গ্রামের পথের মতো, সোজা- আঁকাবাঁকা-। সব পথ বাড়ি যায়, মাঠে যায়।
একটি পথ গেছে সোজা নিস্তরঙ্গ গোরস্থানে। সব পথে ফুল থাকে হাওয়া থাকে, ফুল ও হাওয়া খেলে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা, এইসব খেলার স্বাদ
আর শান্তি নিয়ে সব পথ যায় বাড়ি, যেভাবে ঢেউ তুলে তুলে যায় এই একটি লোকের নিরুদ্দেশ গান। এই যে সাদা বিড়ির ধোঁয়াগুলো
মিশে গেল বৃষ্টির ভেতর, লাল লাল চোখ অথবা কোণে কালো কালো ছোপ-, শ্বাসগুলো তেমনি ধানের দুগ্ধগন্ধ খোঁজে- বিগত ঋতুর
ধূসর খড় কিছু- ভিজে আসে, মেঘে বৃষ্টিতে-। একবার গাভীটিরে দেখে, তাকিয়ে তাকিয়ে দরজায় বৃষ্টির ছাটে ভেজে লোক, আর এক
শালিক বেড়ার ফাঁক গলে ঢুকে পড়ে- করুণ হৃদয়ে- হৃদয়ের ভেতর। এক এক লোকের ভেতর এক এক শালিক, নরম গরম। এই ক্ষণে
নীরব, সুরেলা বৃষ্টি উৎসব। ঘরোয়া এবং ঘরো ছায়া ও বৃষ্টি এসে গায়ে জড়িয়ে দিয়ে যায় পাতলা ধূসর চাদর।
বসে বসে বুড়ো হয় এক লোক- আর এক বুড়ি-।
৩.
নিজস্ব যৌনতান্ত্রিক বৃষ্টি
কান্না নয়, শাপলা চত্তরের বোবা ফোয়ারা-
ভাবা যাক এভাবেই
নিজের দুটো হাত আছে, দুটো চোখ, জুড়ানোর মতো কিছু দৃশ্য- বর্ষায় বাদা ঘাসের ওপর বৃষ্টিতে…
ওই একটা নারী, ওই সাদা শাড়ি, শুয়ে আছে চোখ বুঁজে, ওই ওই
হ্যা, এই তো দুধে আলতা…আর আর জলের মুক্তা খানে খানে, নাকে, ঠোঁটে। কোন মোহনায়-
এভাবেই তো…ভাবা যাক…নিজের মতো
নিজের দুটো হাত আছে, একটা দেশ- নিসর্গের লাবণ্যে ভরা
সরস মাটি, আরো কিছু মানুষ মানুষ
এই হাত দিয়ে তুলে আনি স্বর্ণলতা
ধঞ্চের হলুদ দুল।
কান্না শুনিনি কোনো, সঙ্গমের মতো সঙ্গীত-
শিয়রের পাশে পড়ে থাকে নিটোল তানপুরা
বদ্ধ ঘরে সরস নারীর উষ্ণতার হাওয়া
উঠোনে প্রমত্ত জল ঝরছে