ঈদ সংখ্যা ২০২১- এর ছোটগল্প।। একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি।। প্রিন্স আশরাফ
‘আনুমানিক পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছরের একজন বর্ষীয়ান মহিলা তালতলা থেকে হারিয়ে গেছে। মহিলাটির পরনে ছিল বেগুনী ছাপা শাড়ি। মহিলাটি তার ঢাকার ঠিকানা বলতে পারে না। গ্রামের ঠিকানা বলতে পারে। মহিলাটি সাতদিন আগে ঢাকার বাসা থেকে হারিয়ে গেছে। দুসপ্তাহ আগে ঢাকায় এসেছিল। যদি কোন হৃদয়বান ব্যক্তি মহিলাটি খুঁজে পান তাহলে এই ঠিকানায় যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে।’
লেখক সুপান্থ সুহাস কম্পিউটারের স্ক্রিণ থেকে মুখ তুলে জানালার বাইরে তাকাল। হাত কিবোর্ডে। ডিজিটাল লেখক। কাগজ কলমের পরিবর্তে কিবোর্ড-মাউস। পাঁচতলার ভাড়া বাসা থেকে পাশের ফ্লাটগুলোর বারান্দা আর আলো দেখতে পেল। স্ত্রী শান্তা এখনও অফিস থেকে ফেরেনি। বেসরকারী অফিসের কাউন্সেলর ও। সাতটায় অফিস শেষ হয়। রাস্তার জ্যাম ঠেলে বনানী থেকে মিরপুর আসতে আসতে সাড়ে আটটা বেজে যায়।
একটা ছোটগল্পের জন্য আকাশ পাতাল হাতড়েও কোন থিম মাথায় আসে না। আশেপাশের যাবতীয় শব্দ বিপুল বিক্রমে মাথায় ঢুকে মনোযোগ চারিদিক ছড়িয়ে দিচ্ছে। মনোযোগ কেন্দ্রীভুত না হলে গল্প বের হয়ে কম্পিউটারের স্ক্রিণে জমা হবে না। সে একটা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। আর সেই সুবাদে বিভিন্ন পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকদের সাথে ভালো খাতির। তার গল্প কেউ না ছাপিয়ে ফেলে রাখে না।
মাথার ট্রাফিক জ্যাম ছাড়াতে কফির বিকল্প নেই। শান্তা অদ্ভুত রকমের কফি বানায়। তিতকুটে। কিন্তু নেশা ধরে যায়। ক্লান্তি চলে যায়। কাজের মহিলাকে ডেকে কফি বানানোর কথা বলা কি যুক্তিযুক্ত হবে? হয়তো সারাদিনের পরিশ্রান্ত ক্লান্ত বেচারী ড্রয়িংরুমের ওপাশের ছোট্ট খোপে ঘুমাচ্ছে। আর কফি কেমন বানাবে কে জানে? শান্তার মত হবে না। মেজাজ আরো খারাপ হবে। থাক। গল্প আসলে এমনিতেই আসবে। কফি লাগবে না।
দরজায় মৃদু টুকটুক শব্দ। শান্তা এল নাকি? কিন্তু কলিংবেলের শব্দ তো হল না? ‘দরজা খোলা আছে।’ সে গলা চড়িয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। দরজার ও পর্দার ফাঁক দিয়ে প্রথমে একটা ট্রে-ট্রেতে গ্লাসের গায়ে বুদবুদ ওঠা ঠান্ডা পানি, একটা প্লেটে পাঁচ ছয়টা পাকোড়া জাতীয় কিছু এবং উপরে পিরিচ ঢাকা কাপ। নতুন বউয়ের মত বেশ লম্বা ঘোমটা টেনে কাজের মহিলা নিঃশব্দে পাশের ছোট টেবিলটাতে রাখল। সুপান্ত ভুরু কুঁচকে খাবারগুলোর দিকে তাকাল। তেলের ছেরাদ্দ! মাতব্বরি করে কে বানাতে বলেছে এসব? মহিলাটি চলে গেলে সে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে একটা পাকোড়া মুখে দিল। গরম গরম পাকোড়া অসাধারণ লাগছে। কাজের মহিলাটির রান্নার হাত আছে বলতে হবে। এ কদিনে বারবার তার প্রমাণ দিচ্ছে। এটি শান্তার আমদানী। দাবড়ে বেড়ানো স্বভাবের কারণে কি করে কি করে জানি ও সব ম্যানেজ করে ফেলে।
চা টাও ভালো হয়েছে। তার মাথার জ্যাম আস্তে আস্তে কাটতে শুরু করেছে। এখন গল্পের প্লট আসবে। আর আসবে শান্তা। এসেই রাজ্যের প্যাচাল। গল্পের বারোটা বাজবে।
বলতে বলতেই পাখির টুংটাং ডাক। শান্তা ঢুকে ব্যাগ বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে বলল ‘বাহ, তোমার কি আরাম। ঘরে বসে বসে গরম পাকোড়া সাঁটছ। রাস্তা ঘাটের খবর কিছু রাখ?
সে কম্পিউটার থেকে মুখ না তুলেই বলল, ‘কেন কি হয়েছে? আজ তো একটু আগেই ফিরছো মনে হচ্ছে?
‘আগে না ছাই। তাও তো অফিসের গিয়াস ভাই গাড়ি নিয়ে এইদিকে একটা কাজে এসেছিলেন বলে।’ সে হাত নাড়িয়ে বলল ‘রাস্তায় জ্যাম আগের চেয়ে আরো কয়েকগুন বেড়ে গেছে। ঢাকা শহর থেকে প্রাইভেট কার উঠিয়ে দিতে হবে।’
‘প্রাইভেট কারে চড়ে এসে এ কেমন কথা?’ গিয়াস ভাইয়ের গাড়িতে চড়া সুপান্থের পছন্দ নয়। ‘নিজের প্রাইভেট কার থাকলে ও কথা বলতে না?
শান্তা মুখ বাঁকাল। ‘নিজের প্রাইভেট কার? কুঁজোর চিৎ হয়ে শোয়া?’ সে শাড়ি ছাড়তে শুরু করে। ‘তোমার আমার ফকিরনীর বেতনে এক জনমেও হবে না। ক্যাডেট কলেজে ছেলেটার টাকা পাঠাতেই তোমার হিমসিম। কত করে বললাম তোমার বাড়ির জমিটুকু বেঁচে দাও। সাত আট লাখ টাকা তো ওখান থেকে বেরিয়ে আসত?’
‘বাড়িতে মা থাকে না?’ সুপান্থ বুঝল লেখা মাথায় উঠেছে। স্বামী-স্ত্রীর চিরন্তন প্যাঁচাল। স্ত্রীর চাকরি করা মানে রাজ্য জয় করে আসা। ‘বাড়ির জমি বেঁচব কিভাবে?’
‘মায়ের বাড়িতে থাকার দরকার কি? আমাদের সাথে এসে থাকলেই পারে?
‘থাকতে তো চায় না? দেখ না এলেই কেমন যাওয়ার জন্য ছটফট করে।
‘জমি না থাকলে আর ছটফট করবে না। মুখ বুজে পড়ে থাকবে। ছেলের সাথে না থেকে একা বাড়িতে একা একা থাকা। ভয়ডরও যেন নেই।’ শান্তা শাড়ি ছেড়ে ম্যাক্সি। অদ্ভুত পোশাক। পাশ বালিশের খোলের মত। দাড়িয়ে আছে। আরো কিছু বলতে চায় বোধ হয়। না হলে বাথরুমে ঢুকে যেত।
‘মা ওরকমই। স্বাধীনচেতা। ফ্লাটের দমবন্ধ পরিবেশ পছন্দ নয়।’
শান্তা ঝাঁঝিয়ে উঠল ‘তুমি প্রশ্্রয় দিয়ে দিয়েই ওরকম করেছো। মাতৃমুখী ছেলে! মা যাই বলে তাই। বুড়ো বাপ-মাকে ছেলেরা শাসন করে জানো না।’ শান্তা বাথরুমের সামনে। ‘গাদা খানিক টাকা বেতন দিয়ে কাজের লোক রাখি। তাও যদি থাকে। মা থাকলে তো টুকটাক সংসারের কাজ করতে পারে। গ্রামের বাড়িতে তো দেখি এক হাতে সব দাবড়ে বেড়ায়। এখানে একটু কাজ করলে কি হয়! তুমি আমি বাইরে থাকি। মা তো সংসারটা সামলাতে পারে। কিছু টাকা সেভিংস হয়।’ শান্তা বাথরুমে ঢুকে গেল। দরজা বন্ধ করল না। ওর এই স্বভাব। দরজা বন্ধ করলে নাকি ভয় করে। ছেলেমানুষ! কিন্তু সংসারের হিসাবে টনটন। সুপান্থ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
সুপান্থ কি মনে করে ট্রেটা হাতে নিল। হয়তো শান্তার বকুনি শোনার ভয়ে। বেডরুম থেকে বেরুতেই মনে হলো মহিলাটি দরজার কাছ থেকে সরে গেল। আড়ি পেতে কথা শুনছিল নাকি? না ট্রে নিতে এসে স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া শুনে আর ভেতরে ঢোকেনি? ট্রেটা ডাইনিং টেবিলে রাখতে যেয়ে রান্নাঘরের দিকে চোখ পড়ল। কাজের মহিলাটি রান্নাঘরের দরজার কাছে শুণ্য দৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে ঘোমটা টেনে দিল। সুপান্থ একটু অবাক হলো। মায়ের বয়সী একজন বৃদ্ধা মহিলার তাকে দেখে বারবার ঘোমটা টানাটা কেমন অস্বস্থিকর দেখায়। গ্রাম্যরীতি। সে মহিলার অস্বস্থি ভাবটা কাটানোর জন্য বলল ‘চাচী, কোন অসুবিধে হচ্ছে নাতো?’ মহিলাটি উঠে দাড়িয়ে দুদিকে মাথা নাড়ল। ‘আপনার পাকোড়া চা বেশ ভাল হয়েছে।’ কাজের মহিলা হলেও বয়স্কা। তারপরে কোথায় যেন আভিজাত্যের ছাপ আছে। কিছুটা শিক্ষিতাও বোধ হয়। সহজে তুমি বলা যায় না। এসেছেও অল্প কদিন। মহিলাটি কিছু না বলে ডাইনিং টেবিলের উপর থেকে ট্রেটা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। সুপান্থও ফিরে এল বেডরুমে।
শান্তা গোসল সেরে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে। সুপান্থ আবার কম্পিউটারে বসল। নতুন একটা গল্পের জন্য ফোল্ডারও খূলল। কি গল্প জানে না সে। নতুন ফোল্ডারে যদি নতুন গল্প আসে।
শান্তা ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল ‘ চা খেয়েছো? খালার পাকোড়া কেমন হয়েছে? খালা রাঁধে বেশ, তাই না?
সুপান্থ প্রশ্নগুলোর উত্তর না দিয়ে নিজেই একটা প্রশ্ন করল ‘চাচী মানে খালাকে তুমি কোত্থেকে জোগাড় করেছো?
‘মানে?’ শান্তা পিছন ফিরে সুপান্থের দিকে তাকাল।
‘আমার একটা সন্দেহ হয়।’ হারানো বিজ্ঞপ্তির মাইকিং ঘুরে আবার এদিকে এল। ‘মাইকিংটা শোনো।’
শান্তা না শুনেই বলল ‘কি? কাল বিদ্যুৎ থাকবে না? গ্যাসের লাইনে কাজ হবে? মহলার কেউ মরছে নাকি? ও না। এতো দেখি হারানো বিজ্ঞপ্তি। এত বড় শহরে কে হারাল আবার?’ কাউন্সেলররা বোধ হয় শিক্ষকদের মত। কথা বেশি না বলে থাকতে পারে না।
‘চাচীর ব্যাপারে আমার সন্দেহ হয়!’ সুপান্থ নিচু গলায় বলল, ‘চাচির চালচলন, পোশাক আশাক, রান্নাবান্না এবং সবসময় চুপচাপ কিছু নিয়ে ভাবা…একটু ভেবে দেখ তুমি?
‘কি আবোল তাবোল বকছ? নতুন গোয়েন্দা গল্প লেখা শূরু করেছো নাকি?
‘বিষয়টা তুমি হেসে উড়িয়ে দিচ্ছ? শোন, চাচি আমাদের এখানে আছে কতদিন? এক সপ্তাহ। ওই মহিলাও হারিয়েছে এক সপ্তাহ আগে। বয়সও একই।’
শান্তা চিন্তিত স্বরে বলল, ‘হু। কেমন যেন ঠেকছে। মাইকে বেগুনী রঙের শাড়ির কথা বলছে না! খালা প্রথম দিন বেগুনী রঙের শাড়ি পরেই এসেছিল। ছোট ব্যাগ ছিল হাতে।
‘চাচিকে তোমার কাছে এনে দিল কে?
‘আমাদের অফিসের রিসিপশনিষ্ট শায়লা। ওকে বলে রেখেছিলাম। ওই অফিসে নিয়ে আসে। তারপর তো বাসায় নিয়ে এলাম।
‘কারো সমন্ধে না জেনেশুনেই নিয়ে এলে! ঢাকা শহরে কত কিছিমের মানুষ কত ধান্দায় থাকে। সে যাকগে, রিসিপশনিস্টের বাসা কোথায়?
‘তালতলায়।
‘চল। তার সাথে যেয়ে দেখা করে আসি।
শান্তা বিরক্ত গলায় বলল, ‘এই রাতে?
‘রাত তেমন বেশি একটা হয়নি। সত্যি যদি চাচি হারানো মহিলা হয়ে থাকে তাহলে তার ছেলে নিশ্চয় খুবই দুশ্চিন্তা করছে।
‘মাইকিংটা আবার আসছে। তুমি ঠিকানাটা এই ফাঁকে লিখে নাও তো। আমি চেঞ্জ করে নিচ্ছি।’
বেরুনোর সময় শান্তা খালাকে বলল ‘খালা, আমরা এই পাশের একটা বাসায় যাচ্ছি। যাব আর আসব। তুমি ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে রাখ। আমরা ছাড়া অন্য কেউ এলে দরজা খুলবে না। নিচের গ্রীলে তালা দেয়া আছে। তারপরও সাবধানের মার নেই।
তালতলায় রিসিশনিষ্টের বাসায় যেতে যেতে শান্তা মোবাইল করল। ধরে না। বাসায় সামনে যেয়ে দেখে তালা দেয়া। সুপান্থ বলল ‘এক কাজ করি। ঠিকানা যখন আছে আর এদিকেই যখন চল হারানো বাসা থেকেই একটা ঢু দিয়ে আসি।
শান্তা বলল ‘বর্ণনা শুনে কি ওরা চিনতে পারবে? এক কপি ছবি তোলা থাকলে বেশ হতো।
সুপান্থ হেসে বলল. ‘আমারে অত বোকা পাওনি। চাচি আসার সাথে সাথেই আমি মোবাইলে ছবি তুলে রেখেছি।’ শান্তাও হাসল ‘ডিজিটাল যুগের কত সুবিধে দেখেছো!
হারানো বাসায় যেয়ে যেমনটি ভেবেছিল তেমন কোন পরিস্থিতি নেই। স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে মা হারানো ছেলেটি বেশ সংসার করছে। টিভিতে দেশের খবর দেখছিল বাশার সাহেব। তাদের আগমণের খবর ও কারণ শুনে ড্রয়িংরুমে বসাল। জানাল, ‘মাকে এখানে আনার জন্য রেখেছিল। পার্মানেন্ট ঢাকায় থাকবে।’ পাশ থেকে পাঁচবছর বয়সী মেয়ে তিন্নি বলল ‘বাসায় কোন কাজের বুয়া নেই তো তাই। দাদীকে কাজের বুয়া…’ মহিলাটি মেয়েকে ধমক দিলেন ‘তিন্নি বড়দের কথার মধ্যে কথা বলতে নেই। তারপর তাদের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘আম্মা এসেছিল সপ্তাহ দুয়েক আগে। হঠাৎ একদিন সকালে দেখি ব্যাগসহ উধাও। ও ভাবল হয়তো গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। সেখানে যায়নি। সব আত্মীয় স্বজনের কাছে খোঁজ নিলাম। তাদের ওখানেই নেই। আমার বুদ্ধিতে ও শেষে মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করে।’
শান্তা মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলল ‘আমরা ঠিক শিওর না আমাদের বাসায় যিনি আছেন উনি সেই আপনাদের আম্মা কিনা। ও মোবাইলে ছবি তুলে রেখেছিল। বোঝেনই তো যে যুগ….। এ্যাই, ছবিটা বের করে…’
সুপান্ত ছবি বের করতেই সবাই একসাথে মোবাইলের স্ক্রীণে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তিন্নি ‘দাদী, দাদী’ করে চেঁচাতে লাগল। সেই সবচেয়ে বেশি দাদীর ভক্ত। অন্য ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেছে। গেয়ো ভুত তাদের টানে না। তারা এখন কম্পিউটার-ইন্টারনেট-ফাস্টফুড চেনে। ভুতের গল্পের চেয়ে অশ্লীল গল্পে তারা বেশি মজা পায়।
দাদীভক্ত ছোটমেয়েটাকে নিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ে। নিচের গেটের তালা খোলা দেখে শান্তা বিরক্ত হয়। দারোয়ানকে বারকয়েক ডাক দিয়েও সাড়া না পেয়ে গ্রীল লাগিয়ে পাঁচতলায় ওঠে।
অন্তত দশবারোবার কলিংবেল ও গলা ফাটিয়ে ‘খালা খালা’ ডাকে সাড়া না পেয়ে অগত্যা শান্তা পার্টস থেকে বাইরের লকের চাবি দিয়ে দরজা খোলে। ভেতরে ড্রয়িং ডাইনিংয়ের সব আলো জ্বলছে। আবারও ‘খালা খালা’ ডেকেও কোন সাড়া মেলে না। অতিথিরা ড্রয়িংরুমের সোফায়। শান্তা ও সুপান্থ এঘর ওঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে মহিলার ট্রাভেল ব্যাগটি না পেয়ে বুঝতে পারে পাখি উড়ে গেছে। দুজনের মনেই সন্দেহ ‘বড় কোন দাও মেরে দিয়ে গেছে কিনা।’ তারা বিব্রত মুখে ওদেরকে ঘটনাটি জানায়। মহিলাটি বলে ‘আপনাদের লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। বরং লজ্জা আমাদের। আম্মা এরকম ভাবে না বলে চলে যাবে…দেখুন আপনাদের কিছু…’ সুপান্ত কাষ্ট হাসি হেসে বলে ‘না… সব বোধ হয় ঠিক আছে।’
ওরা বেরিয়ে পড়ে। নিচে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ার আওয়াজ ভেসে আসে। ‘তুমিই নষ্টের গোড়া। আসতেই আম্মাকে কাজের মহিলার মত খাটিয়েছে। ঘর পরিষ্কার, ধোয়া-মোছা, যাবতীয় ময়লা কাপড় পরিষ্কার। তিন্নি সব বলেছে আমাকে। আম্মা মানিয়ে নেয়ার কিছুদিন পর থেকে না হয় ওসব করতে দিতে..’। স্ত্রীর গলা ‘তুমিও যেমন তোমার মাও তেমন। একগুয়ের জাত। পেটে ভাত নেই, রাগটা আছে ষোলআনা। থাকতে খেতে গেলে অমন একটু করতে হয়। এইখানে কাজ করে খাচ্ছিল না।’ পুরুষ কন্ঠ ‘আমার মনে হয়, এরা কি কাজে যাচ্ছে আম্মা বুঝতে পেরেছিল। সেইজন্য পালিয়ে গেছে। আম্মাকে আর খুঁজে লাভ নেই। আম্মা আর কোনদিন ফিরবে না।’
দরজা লক করতে আসা সুপান্ত আর ওদের কথা শুনতে পায় না। শুনতে পায় শান্তা ও তার বিগত দিনের কথোপকথন। তার মা তখন এ বাসায়। হয়তো তাদের দরজার কাছেই ছিল। তারা বেডরুমে। শান্তা বলেছিল ‘মার ব্যাপারে তুমি কি কিছু ভেবেছো? মা কি এখানে পার্মানেন্ট থাকার জন্য এসেছে নাকি?
‘এসেছে, থাকুক কিছুদিন।
‘ঢাকা শহরে একজন মানুষ পোষা কি খরচ তুমি জানো? তুমি থাক বিখ্যাত সব সাহিত্যিকদের নিয়ে। আমি কিভাবে সংসার চালাই আমি জানি।
‘সমস্যাটা কি হয়েছে তাই বলো?
‘দুজন ফাও লোককে আমি টানতে পারব না বলে দিচ্ছি।
‘দুজন পেলে কোথাও?
‘চোখের মাথা খেয়েছো নাকি? কাজের বুয়া থাকে না একজন। তার উপরে তোমার মা এসে জুটেছে। যেকোন একজনকে রাখ। আমি কাল থেকে কাজের বুয়াকে না করে দিয়েছি।
‘মা কিছু বুঝতে পারেনি তো।
‘বুঝলে আমার বয়েই গেল। তার খাই না পরি?’ পরদিন সকালে মা অজুহাত শুরু করেন ‘বাড়িতে গাছগাছালিগুলো নষ্ট হচ্ছে। মুরগী আছে। ছাগল আছে। দেখার কেউ নেই। বাড়ি যেতে হবে।’ সেই যে গিয়েছেন আর আসেননি। থাকার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে এসে কেন ওভাবে চলে গিয়েছেন আর কেন আসছেন না এখন আর বুঝতে অসুবিধে হয় না সুপান্তর। সে ডাইনিংয়ের চেয়ারটা টেনে ধপ করে বসে পড়ে।
ওঘর থেকে শান্তার তীক্ষ্ম গলা ভেসে আসে। ‘এদিকে এসো। দেখো কি কান্ড!’ শান্তার গলা শুনেই চমকে যায় সে। তাহলে কি ভদ্রবেশি মহিলাটি শান্তার গয়নাগাটি নিয়ে কেটে পড়েছে?
শান্তা এক টুকরো কাগজ ধরিয়ে দেয় সুপান্থের হাতে। ‘তোমার কম্পিউটার টেবিলের উপর পড়ে ছিল। দেখ কি লেখা এতে?’
সুপান্থ দেখে। গোটা গোটা মেয়েলী হরফে লেখা ‘মায়েরা আর্বজনা। আর্বজনা কেউ ঘরে রাখে না। ফেলে দেয়। সব ছেলেদের কাছেই মায়েরা বোঝা। বোঝা কমাতে ছেলের কাঁধ থেকে চলে এসেছিলাম। এসে দেখলাম এখানেও আমার মত এক মা বোঝা কমাতে চলে গেছে। আমিও চলে গেলাম। মায়েদের জন্য পৃথিবীতে কোথাও কোন জায়গা নেই। আল্লা কেন পৃথিবীতে মায়েদের পাঠায়? কেন?’
বাইরের সেই মাইকিং এখনও ভেসে আসছে। একঘেয়ে কমাতে বোধ হয় ওরা ভাষাটাও চেঞ্জ করেছে।
‘একজন মা হারিয়ে গেছে। ছেলের উপর অভিমান করে একজন মা হারিয়ে গেছে…’