ঈদ সংখ্যা ২০২১-এর ছোটগল্প।।বৃত্তচ্যুত।। শাশ্বত নিপ্পন
সামছুল মেম্বার পাকিস্তানি সৈন্যের প্রথম সাক্ষাৎ পায় জবেদ আলী মাস্টারের সুবাদে। মাস্টার সাহেব এ অঞ্চলের গণ্যমান্য লোক। মূলত তার দাওয়াতেই এই সৈন্যরা এখানে এসেছে। আমাদের মেহমান। জবেদ আলী মাস্টার ক্যাপ্টেন স্যারের সঙ্গে নিজে পরিচয় করে দিলেন।
আসসালামু ওয়াইকুম স্যার, পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
ওয়ালাইকুম মাস্টার সাহেব;
এর নাম সামছুল মেম্বার, সব কাজ কর দে গা…
হোয়াট মেম্বার!
না না ইলেকটেড মেম্বার নেহি হ্যায় জনাব। হি ইজ পপুলার বাই দিস নেইম- ‘ও আই সি’। কী তার চেহারা! কী কণ্ঠস্বর, গায়ের রং। সাক্ষাৎ ফেরেস্তা! যদিও সামছুল মেম্বার কোনো জ্যান্ত ফেরেস্তা এখন অবধি দেখেনি- তবু আজ এই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন ইয়াকুব হায়দার খাঁনকে তেমনটিই লাগল। বড়লোকের ব্যবহারই আলাদা! ‘ক্যাপ্টেন ছার’ চা বিস্কুট খাওয়ালেন। আর নিজে খেলেন সিগারেট আর লম্বা বোতলে রঙিন কি যেন। সরবত বা ঔষধ হবে হয়তো। সামছুল মেম্বারের মনে হলো, ‘ব্যবহারই বংশের পরিচয়।’ সবই আল্লাহতায়ালার রহমত। তা নাহলে আধাপেট খাওয়া সামছুল আজ ক্যাপ্টেন সাহেব কাছাকাছি। ভাবা যায়! সে মনে মনে আল্লাহ’র কাছে শুকরানা আদায় করে। রহমত তো বটেই। এখন সামছুলের কোনো অভাব নেই। খাওয়া-পরা, বিড়ি, সিগারেট ক্ষমতা, রাইফেল, বন্দুক এমনকি যা চায় সে। দিব্বি কেটে যাচ্ছে দিন তার আর তার বাঁজা বউ তহমিনার একচিলতে সংসার।
যেদিন ওরা এই গ্রামে এল তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। বিশাল বড় গাড়ি বন্দুক আর ভারি ভারি বাক্স; ওরা লাফিয়ে লাফিয়ে নামছিল বড় গাড়ি থেকে। জবেদ মাস্টার ছাতি মাথায় চাঁদতারা পতাকা হাতে নিয়ে হাসিমুখে তাদের বরণ করে নিলেন। সেদিনই বৈকণ্ঠপুর গ্রামে প্রথম কাক ডেকেছিল- কা-কা-কা… হাটফিরতি মানুষেরা ওদের দেখছিল দূর থেকে। ভয় পাচ্ছিল। সামছুল তখন হাটে পিঁয়াজু বড়া ভাজছিল। সেদিন হয়তো একটু তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমেছিল এই গ্রামসহ পাশের গ্রামগুলোতে। এককড়াই পিঁয়াজু নষ্ট হয়েছিল।
তখনো এই গ্রাম থেকে হিন্দুদের চলে যাওয়ার হিড়িক লাগেনি। ঘোষপাড়া কৈবর্তপাড়া থেকে এখনো সন্ধ্যা হলে তুলসীতলার মৃদ আলো পথচলতি মানুষের গোচর হয়। তবে মানুষ পালাচ্ছে দেশ ছেড়ে। পালাতে বাধ্য হচ্ছে। কোনো এক অজানা আশঙ্কাকে মাথায় নিয়ে তারা গভীর রাতে অথবা ভোরের আলো ছায়ায়। এইতো ক’দিন আগে দুলাল দত্ত বাবু বাড়ি, বাগান, খাস-জমি, পুকুর সবকিছু মাস্টার সাহেবের জিম্মায় দিয়ে পাড়ি জমালেন ভারতে। তখন শেষ রাত। দত্ত বাবু জবেদ মাস্টারের হাতে ঘরের চাবি আর বাগান পুকুরে মৌখিক বন্দোবস্ত দিয়ে ধরা গলায় বললেন, ‘মাস্টার সাহেব আমার সাত পুরুষের ভিটে, আমাদের স্বর্গাদপি গরীয়সীকে আপনার হাতে তুলে দিলাম; যাচ্ছি অজানায়, আপনি আশীর্বাদ করবেন।’
সেই স্বর্গাদপি গরীয়সীতেই সৈন্যদের জায়গা করে দিয়েছেন জবেদ আলী মাস্টার। বাড়ির সামনে তাঁবু পড়েছে, সেন্ট্রি বসছে, সন্ধ্যায় ব্যাটারি চালিত বিজলী বাতি জ্বলছে। এই প্রথম গ্রামের মানুষ আর জঙ্গলের পোকাগুলো দেখল বিজলী বাতির রোশনায়। সামছুল মেম্বারের ডাক পরে তার দু’দিন পর। জবেদ আলী মাস্টারই সবকিছু ব্যবস্থা করে দিলেন আর কি। সামছুলের কাজ আপাতত কষাইয়ের গ্রাম থেকে কালো খাসি নিয়ে আসা, জবাই দাও সহি তরিকায়, মাথা, ভুঁড়ি ফেলে দাও, চামড়া ফেল হাড়-হাড্ডি বাদে গোশ সাইজ করে ভিতরে পাঠাও ব্যস, কাজ শেষ সকাল নয়টার মধ্যে। মাথা-ভুঁড়ি নিজের কাছেই রেখে দেয় সামছুল। দুপুরে পেঁয়াজ রসুনের খুশবু ছুটিয়ে রান্না করে তহমিনা। সামছুল ঘরের দাওয়ায় আলস্যে মোড়মুড়ি করে কখানা বিড়ি খাওয়া আর জ্বলজ্বল চোখে বউটাকে দেখে।
রান্নার সময় উনুনের পাশে বসে থাকে মেম্বার। এটা ওটা এগিয়ে দ্যায় সে আর বিড়ি টানে ফুকফুক করে। নিঃশব্দে দেখে যায় বউকে। তার সুটোড বাহু, দু’বুকের গভীর গিরি খাদে জমে ওঠা ঘামের বিন্দু, কোমড়ের খাঁজ, কপালের ঘামে লেপটে থাকা কোঁকড়া চুল সবই সে দেখে জ্বলজ্বল চোখে। নিঃশব্দে হাত নাড়িয়ে যায় তহমিনা। মনে তার শান্তি নেই; এত রান্না কে খাবে! ঘরে আর কেউ নেই। ছেলেপুলে না থাকলে কিসের রান্না-খাওয়া আর কিসের সংসার! রান্না করতে করতেই তার মনে ক্ষোভ দানা বাঁধে, ‘বাঁজা মাগির আবার সংসার!’ প্রথম প্রথম খাসির মাথা ছিলে কুচি করে, মগজটা আলাদা করে বাড়ি আনত সামছুল। ভুঁড়িও আনত। মাথা বানাতে পরিশ্রম করতে হতো তাকে আর ভুঁড়ি বানাতে তহমিনাকে। তারপর আস্তে ধীরে আর মাথা বানান! চকচকে গসা দিয়ে এককোপে দু’ভাগ করে, শুধু মগজটা নিয়ে নেয় সামছুল; সঙ্গে গোশতো থাকলেই। আর ভুঁড়িটা ফেলে দেয় দূর জঙ্গলায়। পাখ-পাখালি কুকুর শেয়ালের জন্যে।
ছাগলের ভুঁড়ি কুকুর-শেয়ালে খেত প্রথম প্রথম। কিন্তু এখন তাদের খাদ্যের অভাব নেই। প্রতিদিন জঙ্গলায় পাওয়া যাচ্ছে লাশ! ভৈরব নদের জলে ভেসে আসা যুবতীর লাশ কচুরিপানার সঙ্গে শোলার মতো ভাসতে থাকে। দুর্গন্ধ ছড়ায় দুপুরের বাতাসে মিশে। শুরুর দিকে এই লাশকে ঘিরে মানুষ দাঁড়াত; শনাক্ত করার চেষ্টা করত। অন্যকে প্রশ্ন করত, ‘পাশের গাঁয়েরও না।’ ‘পোশাকে তো ভদ্র ঘরের মেয়েছেলেই মনে হয়।’ ‘আহা!’ লোকেরা লাশের জাত নিয়ে প্রশ্ন করে না কখনোই।
রান্না শেষ হতেই তহমিনা একবাটি তরকারি সযত্নে তুলে রাখে আলাদা করে। ‘এ-তরকারি কার জন্যি রে?’ লালচে ঝোলে ভাত মাখতে মাখতে প্রশ্ন করে সামছুল। তহমিনা গা করে না। সামছুলের ব্যক্তিত্বে ঘা লাগে তৎক্ষণাৎ। মাগি মানুষের অবজ্ঞা সে কোনোকালেই সহ্য করেনি। ভাত মাখা বন্ধ করে গলাটা আরও কিছুটা উপরে তুলে, প্রশ্নটা আবার করে সে।
ও তরকারি যাবে কুসুম দিদির ঘরে : ঝাঁঝের সঙ্গে উত্তর দেয় তহমিনা। সে আবার কে?
‘বড় দুঃখী মানুষ গো; এ গাঁয়ের না। ওর সুয়ামিকে নাকি রাজাকার বাহিনী কেটিচে; দিদিকেও খানদের হাতে তুলে দেচ্ছিল; বারো বাজার লোক হোলি তো ঠাপ খেতিই হবে।’
আমাদের গ্রাম দিয়ি ভারত যাচ্ছিল। আমার সঙ্গে দেখা। সেই ফজরের সমে। কেবল ওজুটা সেরিচি… আমার বুকে মাথা দিয়ে জ্ঞান হারালু। আমি বুললাম বুউন গো, আমার কাছে থাক, কোনো অসুবিধা নেই; ত্যাবে আমরা মোছলমান। মেইডা আমাকে বুল্লু; ‘দিদি রে, আমাকে ওদের হাতথে বাঁচায়ছে কতগুলো মুসলমান ‘ভাই গো-হিন্দু মুসলমান নাই গো দিদি; আমরা সবাই বিপদে এখন।’ ছোট একটা ধমক দিয়ে সামছুল বলে ওঠে, ‘এ্যায় মাগি এখন বিপদ মানে? এ্যাঁ? এখনই তো সুদিন। প্যাট ভরে খেতি পাইচি। আর এই হেঁন্দু মাগি কি গোশ খাবে?’ সে আমি দেখবু; কতা-বাত্তা ভালো করি বুলবেন কেন্তু; এই খবরডা তো আমাকে আগে বুলিসনি?
আপনাকে বুলার কি আছে- আপনের প্যাট যা পাতলা! কোনো কতাই তো রাখতে পারেন না; এসব কতা গুপন কতা বলেই সামছুলের চোখের দিকে তহমিনা দৃষ্টি রাখে। তার চোখে কি ছিল, কে জানে মুহূর্তে হকচকিয়ে যায় সামছুল মেম্বার। তহমিনা কিছু বলার আগেই সে বলে-
‘কিরে ওমন করে তাকাচির ক্যানে?’
আচ্ছা আপনে কি রাজাকার?
নিমিষেই চোয়াল শক্ত হয়ে যায় সামছুল মেম্বারের। দ্রুত ভাবতে থাকে- মাগির আস্পর্দ্ধা কত! রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। গাঁ গ্রামে বেড়িয়ে আর পেটভরে ভাত খেয়ে বউতো অনেক খবর রাখতে শুরু করেছে। কিন্তু কিছু করার নেই। বাড়ির মেয়েছেলে সাংঘাতিক জিনিস। সামছুল চোখ লাল করে উঠে পড়ে। তবে মনের মধ্যে খচখচানি থেকেই গেল। হেন্দু মাগিটাও আর মরার জায়গা পেল না। বাড়িওয়ালী না থাকলে এখনই ক্যাম্পে খবর দিত সে। কিন্তু তহমিনার মুখটা মনে হতেই মনে মনেই দমে গেল সামছুল মেম্বার।
ক্যাম্পের চেহারা পালটেছে। প্রতি সন্ধ্যায় আসে বড় ট্রাক। সে ট্রাকে থাকে চোখ বাঁধা যুবক। আর অর্ধনগ্ন নারী। ক্যাম্পের একটা চৌকো ঘরকে করা হয়েছে টরচার রুম। যেখানে চোখ বাঁধা যুবকদের পেটানো হয় আদিম পদ্ধতিতে। আঙ্গুলের নখ তোলা, তালুতে পেরেগ পোঁতা, দাঁত উপড়ান ইত্যাদি। ছেলেগুলো ‘জয়বাংলা’ ‘জয়বাংলা’ করতে করতে ওখানেই মরে যায়। যারা বেঁচে থাকে তারা মরে সকালে বা দুপুরে গুলি খেয়ে। জঙ্গলায় মেয়েগুলোকে নিয়ে সারারাত ধরে চলে ফুর্তি। সকালে মিলে ভোগ করে জীর্ণ শীর্ণ মেয়েগুলোকে। তারপর ওদের নিয়ে যায় অন্য ক্যাম্পের সৈন্যদের জন্য। ওরা হলো গনিমাতের মাল- সকলের সমান অধিকার।
কবর্ত্য পাড়া আর ঘোষপাড়া হয়ছে হিন্দুশূন্য। দিনেরাতে দাউ দাউ করে জ্বলছে মনোহরপুর, রামকৃষ্ণপুর, ধলাসহ অন্য গ্রামগুলো, জ্যৈষ্ঠ মাসের বৈকুণ্ঠপুরের বাগানে ম-ম কাঁঠাল পাকা গন্ধ; লোক নেই। বাগানের উঠান এখন শিশুশূন্য। ফলন্ত ল্যাংড়া গাছের ডালে এক শকুন অন্য শকুনের গা ঠুকরে দ্যায়। গাছের নিচে ছিন্নভিন্ন লাশ। ভরদুপুরে শেয়াল কুকুরে ঝগড়া করে সেই লাশ নিয়ে। শনাক্ত করার লোক নেই। কোথাও। বৈকুণ্ঠপুরে শান্ত আকাশে কালো ধোঁওয়া কু-লী পাকিয়ে উড়ে যায়।
জবেদ আলী মাস্টার পাল্টেছে আমূল। দু’জন খাকি পোশাকের বন্দুকধারী লোক তাকে ঘিরে রাখে সর্বক্ষণ। একটা বাহিনী গড়েছেন তিনি। সে বাহিনী এই পাঁচ গ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায়ের কাজে নিয়োজিত আছে সর্বদাই। এসব কিছুই সামছুল মেম্বার দেখে নির্লিপ্ততার সঙ্গে। মাথায় নেন না কিছুই। তার মাথায় খালি খাসি ছাগল, গোশ, আর মগজ। সে এতটুকু বুঝেছে- সময়টা ভালো না। এ সময়ে সাবধানে থাকতে হবে। পিঁয়াজু ভাজা আর আধপেট খাওয়া জীবনে ফিরে যাওয়া যাবে না কিছুতেই। তাই রাতেও সামছলকে ক্যাম্পেই থাকতে হয়। রাতেও জবাই করতে হয় খাসি। জবাই দেওয়া ছুরিতে কখনো লেগে থাকে মানুষের রক্ত। গায়ে মাখে না সামছুল। কষাইদের অত মানবিক হলে চলে না। ঘোড়া যদি ঘাসের সঙ্গে দোস্তী করে তাতে ঘোড়াই বিপদ হয়।
কোথায় যেন একটা গ-গোল হচ্ছে, হিসেবটা মিলছে না কিছুতেই। সামছুলের সবটা মেলাতে চেষ্টাও নেই খুব একটা। কিন্তু গোশ আগের মতো যাচ্ছে না। শালা আমাকে দেখতেই ছাগলের পাল ভ্যা ভ্যা করতে থাকে। বিড় বিড় করে বলে ওঠে সামছুল। প্রায় প্রতিদিনই নতুন খানরা আসছে ক্যাম্পে। সেন্ট্রির সংখ্যা বেড়েছে। দুপুরে বা সন্ধ্যায় ওরা যখন ক্যাম্পে ফিরে আসে তখন ওদের চোখে মুখে থাকে ক্লান্তি আর আতঙ্ক। তাড়া করে ফেরা আতঙ্ক নৃশংসতাকে বাড়িয়েছে তিনগুণ। ব্যস্ততা বেড়েছে জবেদ মাস্টারের। রাতদিন ক্যাপ্টেন ছারের সঙ্গে আছেই। রাত ঘন হলেই আশপাশে বোম ফোটে ভীষণ আওয়াজ করে। বৈকুণ্ঠপুরের মাটি কেঁপে ওঠে। কাছেপিঠের কোনো মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প থেকে ছোঁড়া শেল আকাশ খসা তারার মতো উড়ে এসে এসে পড়ে কোথাও কোথাও। কীভাবে ছোড়ে? লক্ষ্য কী? এসব বুঝতে চায় না সামছুল। এই অসময়ে বেশি বুঝা ঠিক না। ওসব বুঝার সময় হয় নাই এখনো তার। বুঝতে গেলেই মাথা হেদিয়ে যায়। আর তখনই উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্ত এসে যাবে। তারপর আবার হাটে পিঁয়াজু ভাজেন, আর একবেলা খাও তার চেয়ে না বুঝাই ভালো।
আজ হুকুম হয়েছে কচি পাঁঠা খাওয়ানো। জবেদ আলী মাস্টার এই কচি পাঁঠা অভিযানে। এই দেশগ্রামে পাঁঠার সংখ্যা কম নয়। তবে যুদ্ধের বছরে ধারী-পাঁঠার চেয়ে মানুষ গর্ভবতী বেশি। শুধু আল্লাহতালা কেন যে তহমিনার মুখে হাসি ফুটাচ্ছে না সেটি ভেবেই সামছুলের মনটা তিক্ততায় ভরে গেল।
আজ সন্ধ্যার পর থেকেই ক্যাম্প থমথমে। জবেদ আলী মাস্টার দীর্ঘক্ষণ ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে কথা বললেন। রাত ঘন না হতেই সৈন্যরা বড় গাড়িতে চড়ে গেল কোথায় যেন। সামছুলের মন বলছে বড়কিছু একটা ঘটতে চলেছে; কাজে মন বসাতে পারছে না সে। গোশভাত, খাসির মগজ আর তার মুখে স্বাদ আনে না আগের মতো। চোখবাঁধা মানুষগুলো দেশ দেশ করে মরছে; মায়ের সঙ্গে মেয়ে ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরছে ‘গনিমত’ হয়ে- আর সে খানেদের খাসি অথবা কচি পাঁঠা খাওয়াচ্ছে ভাবতেই তার সারা গায়ে এক ঘিন ঘিন বোধ খেলে যায়। সেই অসহ্য বোধ নিয়েই সামছুল কচি পাঁঠাটাকে এক হাত পায়ে ধরে চিৎ করে ফেলে। প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও মুহূর্তে সর্বশক্তি এক করে সে বাঁচার চেষ্টা করে সঙ্গে চিৎকার- ভ্যা ভ্যা… মানুষের শক্তি আর নিষ্ঠুরতার সঙ্গে পেরে উঠে না নির্বোধ পাঁঠা; ওর পশুজন্মে সার্থক করতে সামছুল ‘বিসমিল্লাহ আল্লাহ আকবর’বলে তার গলায় ধারাল চকচকে ছোরাটা ছোঁয়াতেই বৈকুণ্ঠপুরের ক্যাম্পের চারপাশ কাঁপিয়ে বোমা পড়ল। থর থর কেঁপে উঠল সামছুলের পায়ের মাটি। সামছুলের উচ্চরিত পবিত্র শব্দ বিকট শব্দের নিচে ঢাকা পড়ে যায়। হাত ও গেল কেঁপে; ধারাল ছোরার পোঁচে সামছুলের হাত বেশ কিছুটা হা হয়ে গেল। ‘উফ! শব্দ করে এক দৃষ্টিতে কাঁটা হাতর দিকে তাকিয়ে থাকে সামছুল। তখন পাঁঠাটা স্থির হয় চার পা টান দিয়েছে। গলগল করে রক্ত ঝরছে। খাসির গোশমগজ আর পেটপুরে ভাত খাওয়া রক্ত। সে রক্ত মিশে যাচ্ছে নির্বোধ কুৎসিত চরিত্রের পশু পাঁঠার রক্তের সঙ্গে। সামছুল বুঝতেই পারছে না কোনটা কার রক্ত সামছুল অপলক তাকিয়ে থাকে। আর তখনই ভিতর থেকে ক্যাপ্টেন স্যার ডাক দেন, ‘মেম্বার, ইয়ে মেম্বার, ইদার আও। সম্বিত ফিরে পায় সামছুল। তারপর কাটা হাত আর রক্তাক্ত ছোরা নিয়েই দৌড় দেয় সে। ‘জ্বি ছার, যা… য়…য়।’
ক্যাম্পে অন্যদিনের চেয়ে লোকজন কিছুটা কম। আলোআঁধারি টরচার রুমে খালি গায়ে ক্যাপ্টেন বসে আছে একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে। খাঁকি প্যান্টের বোতাম খোলা। সামনের টেবিলে রাখা একটা পিস্তল, লম্বা মুখে পাটুমোটা বোতল, একটা দামি গ্লাস আর সিগারেট। সামছুল দরজায় দাঁড়িয়ে ফ্যাস ফেসে গলায় বলে, ‘বান্দা হাজির হ্যায়। পাকিস্তান জিন্দাবাদ। আমি পাকিস্তানের গুলাম হ্যায় ছার;’ ‘আও আও মেম্বার কাম ইন।’ আলো আঁধারের ঘরে শুধু রক্তের গন্ধ। পুরনো ঘরের দেয়ালে যেন বাড়ি খাচ্ছে যন্ত্রণা মাখা শত শত চিৎকার। একটা আতঙ্ক তাকে গ্রাস করল মুহূর্তেই। ক্যাপ্টেন বলে মেম্বার আর পেহেচোনো দুনো শালী কো… ওয়াচ দেম কোয়ারফালি অ্যান্ড সে কৌডন আওরাত মালউয়ান কা বাচ্চা, বা হা হা…’ সামছুলের কাটা হাতে ব্যথা শুরু হয়েছে। তার শরীরের রক্ত পশুর রক্তের সঙ্গে মিশে কালো হয়ে জমে গেছে। ‘আমি দেখতি পাইচিনি ছার, ঘরমে আন্ধার হ্যায়’─আতঙ্ক মেশানো গলায় উত্তর দ্যায় সামছুল। ‘নো প্রবলেম, কই রাত নেহি, এলো বাত্তি।’ মুহূর্তে ঘর আলোকিত হয়। ঘরের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়ে আলো। উজ্জ্বল আলো পড়েছ সামনে ঝোলানো উলঙ্গ দু’টি নারীর শরীরেও। ক্ষত-বিক্ষত দুটো শরীর!
থরথর কাঁপছে সামছুল মেম্বার। এ কি দেখছে সে। এই শরীরটাতো তার চেনা। তার কোঁকড়া চুল ঝুলে পড়েছে মুখের সামনে; ঐতো সেদিন বুকের মাঝে গরম তেল ছিটকে পড়ার দাগ খুব হেসেছিল সামছুল সেদিন দুপুরে আর ঐ যে তার মসৃণ তলপেটের কালো জরুল; সামছুল তার পরিচিত শরীরের গন্ধটাও পায় এ মুহূর্তে।
কালো চেয়ারে বসা ক্যাপ্টেন ইয়াকুব আলী খানের মাথাটা একপাশে ঢলে পড়েছে। গায়ে তার ধর্ষণের গন্ধ। বেসামাল হাতে সে পিস্তলটা হাতরায়। সামছুলের পা কাঁপছে। হাত তার মুষ্ঠিবদ্ধ হয়েছে রক্তাক্ত ছোরার বাঁটে। কাটা আঙ্গুলে আবার শক্তি ফিরে এসেছে হঠাৎ করেই। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় সে; ফিরে তাকায় চেয়ারের দিকে। তীব্র আলোয় ক্যাপ্টেন ছারের ফর্সা গলাটা খাসির ছিনার গোশের মতো ঝলক দিয়ে ওঠে। সামছুল আর দেরি করে না…
বাইরে তখন ভীষণ শব্দ। কান ফাটান শব্দ। শেল আর বোমের শব্দে কেঁপে উঠছে বৈকুণ্ঠপুরের নিরীহ মাটি- শুধু বৈকুণ্ঠপুর কেন, মনে হয় সারাপৃথিবীই কেঁপে উঠছে এই শব্দে। বাতাসে তখন ভয় আর আতঙ্ক।
সামছুল মেম্বার ভয় পাচ্ছে না মোটেও; তার মনে কেবল একটাই প্রশ্ন- মুক্তিদের ক্যাম্পটা ঠিক কোন দিকে?