শিশুতোষ গল্প

শিশুতোষ গল্প তুতুল পুতুলের চিঠি – আসাদ জোবায়ের

পাহাড়ের কোলঘেষে বয়ে চলেছে এক ছোট্ট নদী। নদীর স্বচ্ছ পানিতে ঘুরে বেড়ায় রঙিন মাছ। আর নদীর পাড়ে বসে বসে কাগজের নৌকা বানায় তুতুল ও পুতুল। এরপর তা ছেড়ে দেয় নদীর পানিতে। তবে নৌকা বানানোর আগে তারা কাগজে একটা চিঠি লেখে। একেক দিন একেক জনের কাছে চিঠি লেখে তারা। সেই চিঠিই নৌকা হয়ে ভাসতে ভাসতে চলে যায় অজানার উদ্দেশে। তাদের বিশ্বাস একদিন না এক দিন চিঠির জবাব আসবে।
একদিন তারা চিঠি লিখল চাঁদের কাছে-
‘নীল আকাশের চাঁদ। ঐ দূর আকাশে একা একা তুমি কেমন আছো? আমাদের দেখতে পাওনা বলে কি রাগ করেছো? আমাদের বস্তির চালায় একটা ফুটো ছিল। ওটা এখন বন্ধ করে দিয়েছি। তোমাকে দেখবো না বলে। তোমাকে দেখলেই যে আমাদের বাবার কথা মনে পড়ে যায়। বাবার দুই হাঁটুতে আমরা দুইজন মাথা রেখেই তো তোমাকে দেখতাম। বাবা চাঁদের বুড়ির গল্প বলতেন। আচ্ছা সত্যিই কি তোমার দেশে ওরকম বুড়ি আছে, যে সারাক্ষণ বসে বসে চরকায় সুতো বানায়?
চাঁদ মামা, তোমাকে আমরা চাঁদমামা বলে ডাকি। বাবাও বলতেন মামা, আমরাও বলি মামা। কী আজব, তাই না? বাবার কথা মনে হয়ে চোখে পানি এসে যাচ্ছে। আর কিছু লিখতে পারছি না। শুধু এইটুকু বলি, বাবা এক সন্ধ্যায় রিকশা চালিয়ে বাসায় আসছিলেন। পথে গাড়িচাপায় মারা গেছেন তিনি। মা বলতেন, ঐ নীল আকাশে হারিয়ে গেছেন। আচ্ছা চাঁদ মামা, নীল আকাশে তো তুমিও থাকো। বাবার একটু খোঁজ এনে দিতে পারবে?’
চিঠির নিচে ওরা নিজেদের নাম-ঠিকানা লেখে। এরপর নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দেয় কুলুকুলু নদীর জলে। নৌকা যতক্ষণ দেখা যায় ওরা দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওপরের দিকে হাঁটতে থাকে। পায়ের ব্যাথায় ছোটবোন পুতুলের খুব কষ্ট হয়। তুতুল এক হাতে কুড়ানো কাগজের বস্তা, আরেক হাতে তুতুলকে ধরে পাহাড়ের উপরে উঠে যায়। পাহাড়ের ওপারেই তাদের বস্তি।
ঘরে ফিরে সকাল সকাল ঘুমিয়েছিল ওরা। মধ্যরাতে ঘুম ভাঙে পুতুলের। খেয়াল করে জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। ধাক্কা দিয়ে তুতুলকে ডেকে তোলে পুতুল। ওরা জানালা খুলে দেখে চাঁদ একদিকে হেলে জানালার বরাবর চলে এসেছে। মনে হচ্ছে আকাশ থেকে ঝুলে পড়েছে তাদের দেখার জন্য। ঝলমল করে হাসছে চাঁদ। হেসে ওঠে তুতুল ও পুতুল। তিন জনের হাসিতে জোসনায় ধুয়ে যায় পৃথিবী। পুতুল ও তুতুল জেনে যায়, তাদের বাবা আকাশেই আছেন, ভালো আছেন। চাঁদের হাসিতেই সে কথা পড়া যায়।
পরদিন বিকেলে আবারো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তারা নদীর কাছে নেমে আসে। ওদের খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। একটু বেশি কাজ করতে হয়েছে বলে। নদীর পাড়ে এসেই পুরাতন ময়লা কাগজ ঘেটে ঘেটে একটা ভালো কাগজ বের করে। পকেট থেকে কলম বের করে লিখেতে থাকে-
‘প্রিয় নদী, কেমন আছো তুমি? কুলকুল করে একা একা বয়ে চলেছো, তোমার কোনো বন্ধু নেই? স্বজন নেই? তুমি কি জানো, আমরা তোমাকে মায়ের মতো মনে করি? আমাদের মা নাই তো, তাই। কোনো কারণে দঃখ পেলেই তো তোমার কাছে ছুটে আসি। এসেই তোমার আঁচলে মুখ লুকাই। আমাদের মা এক বছর হলো কোথায় যে গেছে আমরা জানি না। বাবা মারা যাওয়ার পর মা হারিয়ে গেলেন। আমরা এখন কোথায় যাই বলো তো? তাই সুযোগ পেলেই ছুটে আসি তোমার কাছে। অবশ্য সুযোগ তেমন পাই না। সারাদিন শহরে কাগজ কুড়াই। সেই কাগজ বস্তির মালিকের কাছে জমা দেই। তবেই না রাতের খাবার জোটে।
আচ্ছা নদী ভাই, তুমি তো মাইলের পর মাইল বয়ে চলেছো। আমাদের মায়ের দেখা কি তুমি পাওয়া না? তুমি তো আমাদের মাকে চেন। এই এখানে এসেই তো মা গোছল করতেন। আমরা মায়ের আঁচল ধরে সাঁতার কাটা শিখেছি এখানে। তুমি সব জানো। অন্য কোনো ঘাটে যদি মাকে গোছল করতে দেখো, আমাদের কথা বলো কিন্তু। পারলে এই চিঠিটাও দিও তাকে। আর মাকে বলে দিও, বেতন দিতে পারিনি বলে ইশকুল থেকে আমাদের বের করে দিয়েছে। মায়ের স্বপ্ন ছিল আমি ডাক্তার হবো। পুতুল হবে ইঞ্জিনিয়ার। মায়ের সেই স্বপ্ন আর পুরণ হচ্ছে না।’
এভাবে দিনের পর দিন চিঠি লিখতে থাকে পুতুল ও তুতুল।
একদিন তারা পাখির কাছে চিঠি লিখল। সেখানে তারা তাদের ইচ্ছের কথা লিখল। তাদের ইচ্ছে, দুই পাখায় ভর করে তারা সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াবে। মেঘের সাথে গল্প করবে। চাঁদের সাথে লুকোচুরি খেলবে। উড়তে উড়তে পরির দেশে যাবে। আরো কত ইচ্ছে ওদের। সেসব লিখে দিল চিঠিতে যতন করে।
একদিন তারা সাগরের কাছে চিঠি লিখল। সেখানে তাদের স্বপ্নের কথা লিখে দিল। তাদের স্বপ্ন সাগরের মতোই বিশাল। তারা একটা ইচ্ছেশহর গড়ে তুলবে। মা-বাবা নাই যাদের তারাই শুধু থাকবে সেখানে। আর থাকবে অনেক পাখি, ফুলের বাগান। বাগানে পাখিদের সাথে খেলাধুলায় মেতে উঠবে শিশুরা। ফুলেরা হাসি ছড়িয়ে দেবে। গাছেরা তাদের ফল এনে গুজে দেবে শিশুদের হাতে। সেখানে একটা মজার ইশকুল থাকবে। ইশকুলে শিশুদের সাথে পাখিরাও পড়ালেখা করবে। গান গাইবে। কত্ত মজা হবে সেখানে।
একদিন তারা মেঘের কাছে চিঠি লিখল। সেখানে তারা তাদের কষ্টের কথা লিখল।
‘প্রিয় মেঘ, তুমি কোথায় হারিয়ে গেছ? আমরা সকালে না খেয়েই কাগজ কুড়াতে বের বই। কাগজ কুড়াতে কুড়াতে বেলা হয়ে যায়। কারো কাছ থেকে রুটি চেয়ে নিয়ে খেয়ে ফেলি আমরা। কিন্তু পানি পাওয়া যায় না। তুমি নেই বলে রোদে পুড়ে যাই আমরা। তুমি কি আমাদের কষ্ট বুঝবে না? মাঝে মাঝে একটু বৃষ্টি হয়ে ঝরতে পারো তো। অবশ্য বেশি বৃষ্টি হলে আমাদের বস্তির ভেতরে পানি ঢোকে। পাহাড় ধসে বস্তির ওপর এসে পড়তে পারে। সেটাও খেয়াল রেখ, কেমন? একটু একটু বৃষ্টি হয়ে আমাদের শুধু একটু শীতল পরশ দিও।’
মেঘের কাছে চিঠি লেখার পরের রাতেই অনেক বৃষ্টি হলো। তুমুল বৃষ্টিতে ভেসে যেতে লাগল চারপাশ। তুতুল-পুতুল বস্তি থেকে বের হয়ে আচ্ছা করে ভিজল। ভিজতে ভিজতে তারা হারিয়ে গেল সেই ইচ্ছেশহরে। ফুলের লুটোপুটি, পাখির ছুটোছুটি- কত আনন্দ। আনন্দে নাচতে নাচতে তারা আবার ফিরে আসে তাদের ভাঙাচোরা বস্তিতে।
নিজেদের ঘরে ঢুকে দেখে চালা ফুটো হয়ে তাদের বিছানা ভিজে দিয়েছে। সেগুলো জড়ো করে এক পাশে রাখে তারা। গায়ের ভেজা কাপড় পরিবর্তন করে। এরপর টিনের বাকস থেকে মায়ের একটা পুরনো শাড়ি বের করে। কাঠের চৌকিতে বিছিয়ে দেয়। সেখানেই গুটিসুটি মেরে তারা শুয়ে থাকে।
সকালে পুতুলের গায়ে জ্বর আসে। তুতুল পুতুলের গায়ে হাত দিয়ে অস্থির হয়ে ওঠে। দৌড়ে বস্তির মালিকের কাছে যায়।

  • চাচা চাচা, পুতুলের গায়ে তো অনেক জ্বর। আজ তো কাজে যেতে পারবো না। কয়েকটা টাকা দিন, ডাক্তারের কাছে যাবো।
    মুখে মেসওয়াক নিয়ে, বড়সড় পেট সামনে বাড়িয়ে দিয়ে, ঘর থেকে বের হয়ে আসেন মালিক চাচা।
  • কার জ্বর বললি, পুতুলের? এসব ন্যাকামো বাদ দিয়ে কাজে যা তো। হুহ.. জ্বর! মিথ্যে কথা। এসব কাজ ফাঁকি দেওয়ার মতলব। যা যা..।
    তুতুল মাথা নিচু করে ঘরে ফিরে আসে। পুতুলের কপালে হাত রাখে। জ্বর আরো বেড়েছে। উল্টা-পাল্টা কথা বলতে শুরু করেছে সে।
  • মা এখানে একটু বসো তো। তোমাকে না খুব সুন্দর লাগছে মা। তোমার কি আবার বিয়ে হয়েছে? নাকফুলটা খুব মানিয়েছে তোমাকে।
    পুতুলের ঠোটে হাসি। কিন্তু সেই হাসিতে খুশি হতে পারে না তুতুল। ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে কয়েকটা খুচরা টাকা পায় তুতুল। সেগুলো নিয়েই দৌড়ে বাইরে যায়। ওষুধের দোকানে। ওষুধ এনে খাইয়ে দেয় পুতুলকে। তারপর পানি এনে ঢালতে থাকে পুতুলের মাথায়।
    পুতুল চোখ বন্ধ করে ছড়া কাটতে থাকে-
    তুতুল তুতুল তুতুলরে
    দোদুল দোদুল হাওয়ার গাড়ি
    তুতুল গেল শশুরবাড়ি
    সঙ্গে গেল ভূতুলরে।

ছড়া কেটেই হিহি করে হেসে ওঠে পুতুল।

  • তোমার শশুরবাড়ি কোন দিকে তুতুল ভাইয়া? আমাকে একটু নিয়ে যাবে? আমার না মুরগির গোস্ত দিয়ে পোলাও খেতে মন চায়। খুব চায়। পাই না তো…।
    তুতুল কিছুই বলে না। মাথায় পানি দেওয়া শেষ হলে গামছা দিয়ে মুছে দেয়। তারপর পুতুলের কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে, ভালো হয়ে ওঠ, আমি তোকে মুরগির গোস্ত দিয়ে পোলাও কিনে খাওয়াবো। তুই তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওঠে বোন।
    হঠাৎ চমকে ওঠে তুতুল। কে যেন বাইরে থেকে ডাকাডাকি করছে।
    -এখানে কি তুতুল-পুতুল নামের কেউ থাকে?
    তুতুল দৌড়ে বাইরে যায়। পাঞ্জাবি-পাজামা পরা একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন।
  • আমার নাম তুতুল। আর আমার ছোটবোনের নাম পুতুল।
  • ও আচ্ছা, আমি এসেছি আনন্দপাঠ ইশকুল থেকে। আমি ইশকুলের একজন শিক্ষক। তোমাদের নিতে এসেছি।
  • আমাদের কোথায় নিয়ে যাবেন স্যার?
  • তোমরা এখন থেকে আনন্দপাঠ ইশকুলে পড়বে। আজই তোমাদের ভর্তি করানো হবে।
    ইশকুলের কথা শুনে চোখ চকচক করে ওঠে তুতুলের। কিন্তু একটু পরেই চিন্তায় পড়ে যায়।
  • কিন্তু আমাদের তো টাকা নেই স্যার। আগে একটা ইশকুলে পড়তাম। বেতন দিতে পারিনি বলে বের করে দিয়েছে আমাদের।
    স্যার তুতুলের মাথায় হাত রেখে বললেন, বাবারে দুনিয়াতে সবাই খারাপ নয়। এখনো কিছু ভালো মানুষ আছে। সেরকমই একজন ভালো মানুষ তোমাদের পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়েছেন।
  • কে সেই ভালো মানুষ স্যার?
  • সে অনেক কথা। তোমরা এখন চল আমার সাথে।
  • কিন্তু আমার বোনের খুব জ্বর। কিভাবে যাবো আমরা এখন?
    পুতুলের অসুখের কথা শুনে স্যার সাথে সাথে ভেতরে ঢুকে পড়েন।
  • সে কি জ্বরে তো মেয়েটার শরীর পুড়ে যাচ্ছে। চলো চলো এখনই হসপিটালে নিতে হবে।
    স্যারে নিজের কাঁধে তুলে নিলেন পুতুলকে। তারপর বাইরে বের হলেন। পিছে পিছে তুতুল। কাছেই একটা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো পুতুলকে। সেখানে দুই দিন রেখে চিকিৎসা চললো। সব ব্যবস্থা আনন্দপাঠ ইশকুল থেকেই করা হলো। পুতুলের অসুখ সেরে উঠলে নিয়ে যাওয়া হয় ইশকুলে।
    ইশকুলের হেডস্যারের সামনের চেয়ারে বসা তুতুল ও পুতুল।
    হেডস্যার বললেন, তোমাদের পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়েছেন একজন মহৎ মানুষ। তিনি আমাদের একাউন্টে তোমাদের এক বছরের সব খরচ জমা দিয়েছেন। এমনকি তোমাদের হোস্টেলে থাকা-খাওয়ার খচর, কাপড়-চোপড় ও বই-খাতা কেনার খরচও তিনি দিয়েছেন। তবে তিনি তার পরিচয় এখনই জানাতে চান না। আমরাও চিনি না তাকে। টেলিফোনে আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর দেওয়া ঠিকানা ধরেই তোমাদের খুঁজে বের করেছি আমরা।
    অতি আনন্দে তুতুলের গলা শুকিয়ে গেছে। কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। হেডস্যার বুঝতে পেরে তাকে পানি খেতে দেন।
    ঢকঢক করে পানি খেয়ে তুতুল বলে, স্যার, কখনোই কি সেই ভালো মানুষের দেখা আমরা পাবো না? পা ছুঁয়ে যে একটু সালাম করতে চাই তাকে।
  • পাবে। এক বছর পরে। তবে একটা শর্ত দিয়েছেন তিনি। ভালো করে পড়ালেখা করতে হবে। একবছর পরে আমরা তোমাদের ফলাফল পাঠিয়ে দেবো তাঁর কাছে। ফলাফল পছন্দ হলে তিনি নিজে এসে তোমাদের সঙ্গে কথা বলবেন।
    এরপর তুতুলকে ভর্তি করানো হলো ক্লাস সিক্সে। আর পুতুলকে ক্লাস থ্রিতে। ভর্তি শেষে তুতুলকে ছেলেদের হোস্টেলে আর পুতুলকে মেয়েদের হোস্টেলে উঠিয়ে দেয়া হলো।
    একবছর খুব ভালো করে পড়ালেখা করলো তারা। ফলাফলও খুব ভালো করলো। সেই ফলাফল জানিয়ে দেয়া হলো সেই মহৎ মানুষকে।
    তারপর একদিন দুপুরের ঘটনা। কালো কাঁচে ঢাকা একটি গাড়ি এসে দাঁড়ালো ইশকুলের গেটে। রোদচশমা পরে, মাথায় লম্বা ঘোমটা দিয়ে একজন ভদ্রমহিলা ঢুকে পড়লেন ইশকুলে। সোজা চলে গেলেন হেডস্যারের রুমে। সেখানে ডেকে পাঠানো হলো তুতুল ও পুতুলকে। ওরা ভয়ে ভয়ে হেডস্যারের রুমে ঢুকল। স্যারের ইশারায় ওরা বসল দুটো চেয়ারে।
    ভদ্রমহিলা রোদচশমা খুলে চেয়ে থাকলেন তুতুল-পুতুলের দিকে। তুতুল-পুতুল লজ্জায় মাটির দিকে চেয়ে রইল।
    ভদ্রমহিলা রুমাল দিয়ে চোখের কোনায় জমে থাকা পানি মুছলেন।
    তারপর বললেন, আমার বেঁচে থাকার জন্য তোমাদের খোঁজ দিয়েছেন আল্লাহ। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি।
    হেডস্যার ও তুতুল-পুতুল কিছুই বুঝতে পারল না।
    ভদ্রমহিলা বললেন, আমার অনেক সম্পদ। বাবার কাছ থেকে পেয়েছি, স্বামীর কাছ থেকে পেয়েছি। কিন্তু আমার সুখ ছিল না। কারণ আমার কোলে কোনো সন্তান নেই। মনের দুঃখে কতবার নদীর জলে ঝাপ দিতে চেয়েছি, কিন্তু পারিনি। একদিন নদীর পাড়ে বসেছিলাম, হঠাৎ একটা কাগজের নৌকা ভেসে যেতে দেখলাম। কী মনে করে একটা কঞ্চি দিয়ে নৌকাটা তুলে আনলাম। নৌকাটা খুলে অবাক বিষ্ময়ে একটা চিঠি পড়লাম। চাঁদের কাছে লেখা চিঠি। পরদিন আরেকটা চিঠি। নদীর কাছে লেখা।
    এভাবে একের পর এক চিঠি পেয়ে আমি বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পেলাম। দুটো বাচ্চার কত স্বপ্ন, ইচ্ছে, দুঃখমালা। অথচ ওদের মা কোথায় চলে গেছে। বাবাও মারা গেছে। আর আমার অঢেল সম্পদ। কিন্তু আমার সন্তান নেই। সুখ নেই। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাদের বুকে জড়িয়ে ধরেই বাকিটা জীবন পার করতে চাই।
    তুতুল-পুতুলের চোখে পানি। হেডস্যারের চোখে পানি।
    ভব্রমহিলা উঠে এসে তুতুল-পুতুলের সামনে মেঝেতেই বসে পড়লেন। বললেন- আমার বুকে কি তোমরা আসবে? একটু ‘মা’ বলে ডাকবে?
    নতুন মাকে জড়িয়ে ধরলো পুতুল। কিন্তু তুতুল অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। তার খুব লজ্জা হতে থাকলো। একটা অপরিচিত মহিলাকে কীভাবে সে মা বলবে?
    নতুন মা উঠে দাঁড়ালেন। তুতুলের মাথায় হাত রেখে বললেন, চলো আজ তোমরা নতুন মায়ের ঠিকানায় যাবে। হেডস্যারের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, দুইদিন কি ওরা ছুটি পাবে স্যার?
    হেডস্যার ওদের দুইদিনের ছুটি দিলেন। ওরা নতুন মায়ের ঠিকানায় চলে গেল। ওদের আর কোনো দুঃখ রইল না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *