লেখকের মৃত্যু ও একটি পান্ডুলিপি- সৈয়দ নূরুল আলম
মৃত্যুর আগে অনেকে পছন্দের কিছু খেতে চায়। সেটা ভেবে কামাল আব্দুল্লাহ রানাকে বলে, স্যার কিছু খাবেন, কিছু খেতে ইচ্ছে করে?
‘কলার মোচা পাবা? মায়ের হাতের কলার মোচা কাঁচা মরিচ পেঁয়াজ দিয়ে ভাজা খেতে ইচ্ছে করছে।’
‘স্যার খুঁজে দেখব। পারলে বিকেলের মধ্যেই জোগাড় করে ফেলব।’
‘কিন্তু মোচা যোগার করতে পারলেও মায়ের হাতের রান্না পাবে কোথায়?’
এ প্রশ্নের উত্তর কামাল দিতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাসিস্টেন্ড ডিরেক্টরে চাকরির জন্য ভায়বা বোর্ডে চাঁদপুরের কাছে মেঘনা আর যমুনা নদীর কালো আর ঘোলা পানি মিশে যায় না কেন, এ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে যেভাবে বোর্ডের মেম্বারদের দিকে হাঁ করে চেয়েছিল, এখনো কামাল মৃত্যুশয্যাশায়ী আব্দুল্লাহ রানার দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে।
কামালের ভালো নাম মো. গিয়াস কামাল। নয়কে ছয় করার মতো সাহিত্যিক নাম কামাল গিয়াস। ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স, এম এ। চাকরির প্রচলিত বয়সসীমা শেষ। স্কুলজীবন থেকে লেখালেখির অভ্যাস ছিল। কিন্তু এ অর্ধেক জীবনে একটা উপন্যাস ছাড়া আর কিছু লেখেনি। ইচ্ছে প্রথম লেখা দিয়েই বিখ্যাত হওয়া। কিন্তু বিভিন্ন প্রকাশকের কাছে ঘুরে ঘুরে সেন্ডেলের তলা ক্ষয় ছাড়া আর কিছু হয়নি। ছাপানো তো দূরের কথা কেউ পড়ে দেখতেও রাজি হয়নি। সময় নষ্ট।
কামাল শেষমেষ ভেবেছিল, ভালো বড় কোনো লেখকের কাছ থেকে একটা ভূমিকা লেখাতে পারলে, অন্তত প্রকাশক উপন্যাসটা পড়ে দেখতেন। কিন্তু সেটাও সম্ভব হয়নি।
কামালের সংসারে মা ছাড়া কেউ নেই। মা সম্প্রতি খাট থেকে পড়ে মাজা ভেঙে বিছানায় শোয়া। এই বয়সে অপারেসন করা যাবে কিনা, আর করা গেলেও অনেক টাকার ধাক্কা। সে টাকা পাবে কোথায়?
তাই কামাল রাস্তার পাশে ওষুধের দোকান থেকে পাঁচটা পেন কিলার আর একপাতা গ্যাষ্ট্রিকের ওষুধ মায়ের হাতে দিয়ে নিজের মনের কষ্ট, নিজের মধ্যে চেপে রেখেছে।
কলার মোচা সাধারণত রাস্তার পাশে যেসব বাজার বসে, সেখানে পাওয়া যায়, এটা ভেবে কামাল বিকেলে কমলাপুর রেলস্টেশনের উত্তর পাশে যে বাজার বসে সেখানে যায় এবং ঠিকই কলার মোচা পেয়ে যায়। মৃত্যুশয্যাশাহী একজন লেখকের শেষ ইচ্ছে বলে কথা।
মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি করতেন। এত ভালো চাকরি ছেড়ে দিলেন শুধু লেখালেখি করবেন বলে। এ নিয়ে বাড়িতে ঝগড়াঝাটি। এক পর্যায়ে মামুন সাহেব বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। ছাড়া হাত পা। শান্তিনগর একটা ছোট ফ্লাট খুঁজে নেন। মামুন সাহেব বিয়ে করেননি। এই বিয়ে না করার কারণ আজ পর্যন্ত কেউ জানে না।
লেখার হাত ভালো ছিল। পিড়িতে আসন গেড়ে বসতে বেশি সময় নেননি। চুরাশি থেকে পঁচানব্বই ছিয়ানব্বই পর্যন্ত দুহাতে লিখলেন। মামুন সাহেব কারও সাথে নেই, পাছে নেই, দলে নেই। নীরবে লিখে যান। প্রথম বই বের হওয়ার পর আলেয়া প্রকাশনীর মালিক নিলয় দাস বলেন, স্যার এত বড় নাম আজকাল আর চলে না। আপনি ছোট করে আব্দুল্লাহ রানা রাখেন। ওই সময় কবিলেখকদের নাম পাল্টানোর হিড়িক চলছে। নিলয় দাসের কথা লেখকের মনে ধরে। পালটে ফেলান নাম। সেই থেকে আব্দুল্লাহ রানা।
‘কলার মোচা কে রান্না করে দিল? মায়ের হাতের রান্নার মতোই মনে হচ্ছে।’
লেখকের কণ্ঠে অস্পষ্ট কথা। কিন্তু কামালের বুঝতে অসুবিধা হয় না।
‘আমাদের বাড়িওয়ালার মেয়ে রিনা।’
‘বয়স কত?’
‘স্যার, বিধবা।’
‘বয়স জানতে চেয়েছি।’
কামাল কোনো উত্তর দেয় না।
‘ওকে বলো রান্না খুব ভালো হয়েছে। মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ পাইছি। ভাজিতে জিড়ার গুঁড়া দেয়াতে বেশ স্বাদ হয়েছে।’
‘স্যার বলব। ও খুব খুশি হবে।’
আব্দুল্লাহ রানাকে স্যার বললেও, কামালের সাথে যেন বাবা ছেলের সম্পর্ক। কামাল লেখককে বাবার মতো সম্মান করে। নিজের বাবা অসুস্থ হয়ে ঘরে পড়ে থাকলে কামাল যতটুকু সেবা যত্ন করত, লেখককে ঠিক ততটুকু সেবাযত্ন করে।
বেলা হেলে পড়ার আগেই হঠাৎ লেখকের লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে। অবস্থা বেশ বাড়াবাড়ি। এ সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে লেখক, প্রকাশক, গুণগ্রাহী, শুভাকাক্সক্ষী, ফ্যান সবাই ছুটে আসে। আব্দুল্লাহ রানার মূল প্রকাশক আলেয়া প্রকাশনী। মালিক নিলয় দাস। কথিত আছে নিলয় দাস আব্দুল্লাহ রানার বই বের করে ঢাকা শহরে দু-দুটো ফ্লাটের মালিক হয়েছে, অথচ আব্দুল্লাহ রানার কোনো মাথা গুজবার ঠাঁই নাই। লিখে টাকা যে পাননি তা নয়, আর নিলয় দাস যে এডভান্স সম্মানী বা লেখক রয়ালিটি দেয়নি তাও নয়। লেখক টাকা রাখতে পারেনি। বন্ধুদের পেছনে অকৃপণভাবে ভেঙেছে।
খবর পেয়ে নিলয় দাসই সবার আগে ছুটে এসেছে। ডাক্টার দেখানোর ব্যবস্থা করেছে। কামাল তো আগের থেকেই আছে। লেখককে এটাওটা এগিয়ে দেয়া। কাছাকাছি থাকা । সকাল থেকে সন্ধ্যা। শুধু রাতটুকু মায়ের কাছে যেয়ে থাকে। ওদিকে দিনের পুরো সময় রিনা মাকে দেখে। এটা একটা টান। কার টানে, কে কোথায়, কামাল তা বোঝে না। বুঝতে চায় না।
বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সাংবাদিক আসে, আব্দুল্লাহ রানার ইন্টারভিউ নিতে। কিন্তু কামাল বিনয়ের সাথে না করে। বলে, স্যারের শরীর ভীষণ খারাপ, স্যার ইন্টারভিউ দিতে চান না। নতুন-পুরান অনেক প্রকাশক আসে স্যারের শেষ লেখাটা নিতে, কিন্তু সবাইকে খালি হাতে ফিরে যেতে হয়।
অন্য কেউ না জানলেও কামাল জানে, স্যার অসুস্থ হওয়ার বেশ আগে থেকেই লেখা একেবারে ছেড়ে দিয়েছেন।
বিকাল থেকে লেখকের অবস্থার অবনতি হয়। কামাল হাসপাতালে নিতে চায়, কিন্তু লেখক যেতে চান না। শারীরিক অবস্থার অবনতির কথা জানিয়ে কামাল ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়। আরেক দফায় মানুষ ছুটে আসে। লেখক, প্রকাশক, সাংবাদিক, ছাত্র, শিক্ষক, সাধারণ মানুষ।
সন্ধ্যার আগে লেখক একটু চোখ মেলে তাকান। কথা বলেন। মনে হয় সুস্থ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এ লক্ষণ ভালো না, সেটা কামাল জানে। যাবার আগে একটু জ্বলে ওঠা।
কামালের আব্বা যখন চলে যায়, তখন এই একই অবস্থা হয়েছিল। সারা রাত ধরে কামালের সাথে কত কথা। ছোটবেলার কথা, যুদ্ধের কথা, নদী ভাঙনের কথা। সেই মানুষ সূর্য ওঠার আগেই চোখ বুজল। সব শেষ।
আব্দুল্লাহ রানা কামালকে ডেকে বলে, কাল রাতে দাস এসেছিল, ওকে একটা পান্ডুলিপি দিলাম।
পান্ডলিপিটা অনেক দিন বিছানায় তোষকের নিচে পড়েছিল। কবে লিখেছিলাম, তাও ভুলে গিয়েছি। শিরোনামের পাতাটা খসেগেছে।
একটু থেমে, দমনিয়ে লেখক আবার বলেন, পান্ডুলিপির জন্য দাস তিন লাখ টাকা অ্যাডভান্স আর সতেরো পার্সেন্ট রয়ালিটি দিতে চেয়েছে। দুই পার্সেন্ট বেশি। চেক রয়ালিটি সব তোমাকে দিতে বলেছি।
এ কথা শুনে কামাল না না বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। বলে, আমার কিছু চাই না। আপনি শুধু ভালো হয়ে উঠুন। কিন্তু লেখক মুখে আঙুল দিয়ে, কামালকে কোনো কথা বলতে না করে ।
কামালও আর কোনো কথা বলে না । ও বোবা হয়ে যায়।
ও রাতেই সন্ধ্যার পর থেকে লেখকের শ্বাসটান ওঠে। ফজরের আজানের আগেই সব শেষ।
নিলয় দাস আর দেরি করে না। বাতাস গরম থাকতেই, এক সপ্তাহের মধ্যে বই বের করে, এক কপি বই, তিন লাখ টাকার একটি চেক এবং একটা ডিট নিয়ে কামালের সাথে দেখা করে।
কামাল বইটা দেখে আর স্থির থাকতে পারে না। পরম মমতায় সন্তানের গায়ে হাত বোলায়। এক সময় ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। মায়ের কথা মনে পড়ে। রিনার কথা মনে পড়ে।
কেন এত কান্না, নিলয় দাস সেটা বুঝতে পারে না।