শিশুতোষ গল্প

শিশুতোষ গল্প- ভয় আসলাম সানী

পূর্বার মনে ভূতের একটা ভয় ছিলো। খুব ছোট্টবেলায় দাদুর মুখে ভূতের গল্প শুনে ভয়ে খুব জড়োসড়ো হয়ে যেতো পূর্বা। কালো কুচকুচে এয়া বড় বড় দুটো চোখ, তেল চিটচিটে শরীর। বেশ লম্বা লম্বা দুটো কান। ধারালো শান দেয়া দাঁত। আর মুখ দিয়ে নাকি লালার মতো অনবরত আগুন ঝরে। এ সবই দাদুর কাছে শোনা গল্পের বর্ণনা।
আর তখন সন্ধ্যে হলেই হলো, ভূতের ভয়ে ঘর থেকে বেরুতে চাই তো না সে। কখনোবা বিদ্যুৎ চলে গেলে ভয়ে চিৎকার করে উঠতো পূর্বা। রাতে কোনো গাছের ছায়া, কালো কুকুর বা বেড়াল দেখেও শিউরে উঠতো সে।
তখন পূর্বার বয়স চার কি পাঁচ হবে।
পূর্বার বয়স এখন পনেরো। সে এখন বেশ বড় হয়েছে, সব বোঝে। ভূতটুতের কোনো অস্তিত্বই নেই এই পৃথিবীতে, তাও সে বিশ্বাস করে। অথচ সমস্যাটা হয়েছে অন্যখানে। শৈশবে মনে গেঁথে-যাওয়া সেই ভূতের ভয় আজো ওর মনের ভেতর থেকে মুছে যায়নি।
ভূত নেই, একথা পূর্বা খুব ভালো করেই জানে, বিশ্বাসও করে। তবু যেন একধরণের ভয় ওর ভেতর আজো কাজ করে।
পূর্বা ব্যাপারটা মাকে বলেছে– আম্মু তুমি কি ভূত বিশ্বাস করো?
আম্মু প্রথমতো অবাক হয়ে প্রশ্ন করে– কেন, এ কথা কেনরে, তুই কি বিশ্বাস করিস?
পূর্বা: না, কিন্তু…
আম্মু: কিন্তু আবার কিরে? ওসব মনের ভয় মাত্র।
পূর্বা: আম্মু, ভূত যদি নাই থাকতো তবে ভূতের গল্প হলো কী করে, কিংবা ভূতের গঠনগাঠন মানুষ জানলো কী করে?
আম্মু: দূর, সব মিথ্যে অর কল্পনা।
পূর্বা: আমিও ওসব বিশ্বাস করি না। কিন্তু ইদানীং…
আম্মু: ওসব না-ভাবলেই হয়, ওসব ভাবাটা একটা বোকামি, আর ভূত-টুতের কোনো অস্তিত্ব বাস্তবে নেই, তবে…।
পূর্বা: তবে কী আম্মু?
আম্মু: এসব মানুষের মূর্খতা।
মানুষের একধরণের মানসিক ভয়ভীতি থেকে এসবের সৃষ্টি। যত্তো সব কুসংস্কার।
পূর্বা অনেক আগে কিছু কিছু ভূতের গল্প কাহিনী পড়েছে। তখন তেমন কোনো অনুভূতি জন্মেনি বলা যায়, শুধু একটু গা শিরশিরে করেছে।
এযাবৎ পূর্বারা শহরেই থাকছে। ছোটবেলায় কখনো-সখনো গ্রামে গিয়েছে। এখন ততোটা মনে নেই। বড় হয়ে আর যাওয়া হয়নি। পূর্বার ধারণা–শহরে কি আর ভূত থাকে না কি? তবে…।
পূর্বা যেদিকটায় পড়তে বসে সেই টেবিলের দক্ষিণ দিকে জানালার মুখোমুখি বাহিরে পাশের টুলু ভাইদের বাড়ির বিরাট দেবদারুগাছটায় সন্ধ্যা হলেই প্রায় একটা আবছা ভূতের ছায়া লক্ষ্য করে সে।
হঠাৎ সেদিন সন্ধ্যারাতে পূর্বা দেখলো, দেবদারুগাছের উঁচু ডালের অন্ধকার ঝোঁপ থেকে আগুনের মতো চিকচিক করা কী যেন একটা দেখা যাচ্ছে। প্রথমত পূর্বা হোঁচট খেয়েছিলো। পরে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো– হ্যাঁ সত্যিই তো, সেই আগুনের আলোটা স্পষ্ট ওদের ঘরের জানালা ভেদ করে ওর পড়ার টেবিলে বইগুলোর উপর এসে পড়ছে। পূর্বা কিছুটা ভয় ও অবাক হয়ে মাকে ডাকলো: আম্মু আম্মু। দ্যাখো, দেখে যাও।
পূর্বার ডাক শুনে আম্মু দৌড়ে এলো: কিরে পূর্বা, কী হয়েছে মা?
পূর্বা মাকে দেবদারুগাছটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো: ওই দ্যাখো আম্মু, ওই গাছের ডালটায়।
আম্মু: কী পূর্বা?
পূর্বা বললো : দেখছো না, কী যেন জ্বলে আছে। ভূতের আগুন বোধহয়।
আম্মু একটু ঘাবড়ে গেলেন বলা যায়। কিন্তু এই পূর্ণিমার রাত, চারিদিকে জোছনার উজ্জ্বল ঝলকানি। আর গাছের ডালে কিছু দেখাও যাচ্ছে না। অথচ একটা চিকচিক করে জ্বলে উঠছে, যার স্পষ্ট প্রতিবিম্ব এসে পড়ছে টেবিলের বইয়ের উপর। জানালা বন্ধ করলে আবার তা নিভে যাচ্ছে। আর এ দক্ষিণের জানালাটা বন্ধ করলে বাতাস ঢোকে না ঘরটায়। গরমের দিন দমবন্ধ হয়ে আসে।
আম্মু বাবাকেও ডাকলেন। বাবাও হতবাক!!
অথচ বাবা বা মা ভূতটুত বিশ্বাস করেন না। তাছাড়া এতোদিন যাবৎ এ বাসায় আছে এ–ধরণের কিছু কখনো চোখেও পড়েনি।
শেষে বাবা বললেন–জানালাটা বন্ধ করে দাও। কাল সকালে দেখা যাবে।
পরদিন সকালে কিছু দেখা গেলো না। আর এদিকে পাড়ায় এ নিয়ে বেশ কানাঘুষা। কেউ এটাকে ভোগাস ব্যাপার বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ ভূত বিশ্বাস করে ভয়ও পাচ্ছে। সবার উৎসুক-চোখ ওই দেবদারুগাছটার দিকে। সবার মনে একটা কৌতূহল–আজ রাতেই ওরা দেখবে আসল ব্যাপারটা কী।
পাড়ার মুরুব্বি রবিউল্লা ফকির তার কেরামতি দেখাবে। ভূতকে ধরে হাতের মুঠোয় আনবে, তারপর ছুড়ে ফেলবে জ্বলন্ত আগুনে।
কলমা কালাম পড়ে সবাই রেডি।
এ নিয়ে পাড়ায় যুবকদের মধ্যে বেশ মুখরোচক আলাপ-সালাপ চলছে। যুবকদের কাছে এ যেন এক হাসিঠাট্টার ব্যাপার।
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা। ভয়ে গা ছমছম করছে কারো-কারো। সন্ধ্যা হতেই চাঁদের জোছনায় আবার সেই দৃশ্যের অবতারণা। দেখা গেলো দেবদারুগাছের ডাল থেকে আবার সেই আগুনের ঝিলিক এসে পড়ছে পূর্বাদের ঘরে। সব মিলিয়ে হুলুস্থুল কান্ড।
বুড়োবুড়িরা আল্লাবিল্লাহ করছে। ছেলেপুলেদের বাহিরে যেতে বারণ করছে।
এমনি সময়। হঠাৎ পাড়ার লালু কোত্থেকে এসে বাঁধালো কান্ড। টুলুদের উঁচু দেবদারুগাছটায় গিয়ে হড়হড় করে উঠতে লাগলো যেন ডোন্ট-কেয়ার ভাব তার।
এ দেখে কেউ তাকে বাধা দিলো: লাউলা গাছে উঠিস না, ভূতে ধাক্কা মাইরা ফালায়া দিলে মরবি।
টুলুর বাবা চেঁচিয়ে উঠলো: করছিস কী, মারা পড়বি তো হাবা।
লালু কি আর কারো কথা শোনে, সে বীরের মতো বললো: আরে সামনে ভূতের বাপেও আইতে পারবো না।
সবার চোখ লালুর দিকে। কী জানি কী হয়। লালুর এ কান্ড দেখে আরো লোকজন জড়ো হতে লাগলো টুলুদের বাসায়।
সবার ধারণাই যে, ভূত ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে। হয়তো বা ওর উপর ভূতের আছর করবে।
পূর্বা স্তব্ধ হয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে।
সবার মুখে কলমা কালাম। লালু হাইফাই করে উঠে গেলো সেই ডালে– যেখান থেকে আগুনের মতো ঝিলিক মেরে উঠছে।
হঠাৎ একটা কাকের কা কা চিৎকার।
লালুও চিৎকার দিয়ে উঠলেন: পাইছি। পাইছি ভূতের বাচ্চা– বলেই কী যনে একটা হাতে নিয়ে নেমে আসছে সে।
সবাই হতবাক! উৎসুক কেউ কেউ এগিয়ে গেলো। কী পেয়েছে লালু? দেখলো একটা ভাঙা আয়নার টুকরো লালুর হাতে।
না, লালুকে ভূতে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়নি। কিংবা ভূত বলতেও কিছুই ছিলো না দেবদারুগাছটায়।
আসল রহস্য হচ্ছে, দেবদারুগাছের ডালে একটা কাকের বাসা। সেখানে কাকের কুড়িয়ে আনা একটা টুকরো কাচের আয়না ছিলো যাতে চাঁদের জোছনায় একটা প্রতিবিম্ব গিয়ে পড়ে পূর্বাদের ঘরে। আর তাই নিয়ে এতসব ভূতুড়ে কান্ড।
কথায় বলে : বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *