অণুগল্প

অণুগল্প।। কসাই ডাক্তার।। সুস্মিতা জাফর

তখন বাজে সকাল এগারটা। মেডিসিন ওয়ার্ডে নতুন একটা রোগী দেখছিলাম আমি। ঠিক সেই সময় ওয়ার্ডের একদম শেষ প্রান্ত থেকে ভেসে এলো সাইফুল্লাহর চিৎকার, ‘আপু, আপু। এই রোগীটা আমার গ্রামের, আত্মীয় আমার। আপু একটু ভালো করে দেখবেন রোগীটা, প্লিজ।’মনে মনে বললাম, ভাল করেই তো দেখি সব রোগী। কিন্তু সামনে মাথা নেড়ে বললাম, ‘দেখবো, ভাল করেই, চিন্তা করিস না।’ সাইফুল্লাহ যখন দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে, আমি তখন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্নি। দেড় বছর আগে ওদের ব্যাচ টা নিয়ে আমাদের ১৭ তম ব্যাচ ক্যাম্পাসে একটা প্রোগ্রাম আয়োজন করেছিল। আর তাতে সে অংশগ্রহণ করায়, সাইফুল্লাহকে বেশ ভালোভাবেই চিনতাম।তো দুইদিনের মাথাতেই সেই আত্মীয়ের রোগ নির্ণয় হয়ে গেল- লিভার এবসেস বা যকৃতে ফোঁড়া। এখন এই ফোঁড়া কোন প্রকারের তা নির্ণয়ের জন্য এখান থেকে পুঁজ টেনে পরীক্ষা করতে পাঠাতে হবে পরীক্ষাগারে। প্রকার জানা না হলে সঠিক ওষুধ নির্বাচন করা যাবে না।আমাদের ওয়ার্ডের সিএ বললেন, ‘তারান্নুম, তুমি নিজেই চাইলে এই পুঁজ টেনে নিতে পার এবং এটা হবে তোমার জন্য খুব ভাল একটা অভিজ্ঞতা।’ ইন্টার্নশিপের সময় কোন অভিজ্ঞতাই হাতছাড়া করতে বিন্দুমাত্র রাজী ছিলামনা। আর তাই রোগী যেহেতু আমারই দায়িত্বে, তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করার যাবতীয় দায়িত্ব আমি নিজের কাঁধেই তুলে নিলাম খুশি মনে।যেহেতু পুঁজ টা বের করা হবে ultrasonogram guiding এর মাধ্যমে সেহেতু হাসপাতালের রেডিওলজি বিল্ডিং এ স্যারের সাথে যোগাযোগ থেকে শুরু করে হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় ডেকে কাউন্সেলিং করে বিনামূল্যে স্ট্রেচার এর যোগান করা (হাসপাতালে ওয়ার্ডবয় রা স্ট্রেচারে রোগী বহনের কাজে ২০০ থেকে ৪০০ করে টাকা নেয়, সরকারি হাসপাতাল হলেও), রোগীর লোককে ডেকে পরীক্ষার জন্য বাড়তি যেসব সরঞ্জাম লাগবে, যেমনঃ জার, সিরিঞ্জ- যা হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয় না, সেসব সরঞ্জাম তালিকা করে কেনানো; সবই একদম একা হাতে আয়োজন করে ফেললাম একদিনের মাঝেই।মজার ব্যাপার হল, কোন এক অদ্ভুত কারণে হাসপাতালের আর একজন সহকর্মীও আমাকে এই কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। এমনকি এ ব্যাপারে সাইফুল্লাহর কাছেও কোন সহযোগিতা চাইলাম না, ওকে জানাইও নাই কী থেকে কী করতে হবে। কী দরকার নিজের কাজে অন্যকে বিরক্ত করার? আসলে তখন রোগী কার আত্মীয় এটাই মনে ছিল না। রোগী এখন আমার নিজের, এটাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল সেসময়। সত্যি বলতে কয়েক মুহূর্তের জন্য ভুলেই গিয়েছিলাম সাইফুল্লাহর কথা।সারাদিনের রোগীর ফলোআপ, স্যারদের রাউন্ড শেষে সব কাজ গুছিয়ে, বহু কসরত আর পরিশ্রমের পর দুপুর একটার দিকে রোগীকে পরমাণু বিল্ডিং এ নিতে পারলাম। আল্ট্রাসনোগ্রাম রুমের বাইরে বিশাল লাইনে দাঁড়াতেও হল। চিকিৎসক এসেছে বলেই যে সিরিয়াল ভেংগে ভেতরে ডেকে নেবে, তা সরকারী হাসপাতাল হলেও সম্ভব ছিল না।এদিকে ওয়ার্ডবয় হাউকাউ শুরু করে দিয়েছে। কথা বার্তায় বেশ ভাল করেই বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমার মোটিভেশনের পাল্লায় না পড়লে এতক্ষণে তার চার-চারটে ট্রিপ শেষ হয়ে পকেট খানা ভালোই ভারী হয়ে যেতো! অথচ আমার কথায় ফেঁসে গিয়ে এখন এখানে পড়ে আছে সে বিনামূল্যে!ওয়ার্ড বয় আর থাকতে না পেরে কাচুমাচু মুখ করে বলে উঠল, ‘ম্যাডাম, আর কতক্ষণ?”আরে দাঁড়াও না বাবা, এইতো হয়ে এলো বলে!’ আশ্বস্ত করলাম তাকে। যদিও আমি নিজেই জানিনা, কখন আমাদের ডাক আসবে? স্যার আমাদের না দেখেই আবার চলে যায় কিনা এত দেরী করে আসার জন্য।পাক্কা আধা ঘন্টা পর দেখি, আর মাত্র দুইটা রোগীর পরেই আমাদের সিরিয়াল। খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছিল। আহ, আজ একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে! এইতো সনোলজিস্ট স্যার ডাক দিলেন বলে!আনন্দে লাফাতে লাফাতে রোগীর লোকের কাছে গিয়ে বললাম, ‘ভাইয়া, বয়ামগুলো দেখি দেন তো আমার কাছে। এখনি ভিতরে যাব আমরা, বুঝলেন?’কিন্তু রোগীর লোক জার বাড়িয়ে ধরতেই আঁতকে উঠলাম সাথে সাথে।’আরে, আপনাকে পই পই করে বলে দিলাম, ছবি দেখিয়ে দিলাম, কীরকম জার আনবেন! এত বুঝিয়ে বলার পরেও আপনি এই আজব বয়াম কেন এনেছেন, হ্যাঁ?’ এখন তো সময়ও নেই, আশ্চর্য!! দেড়টার বেশি বাজে! আজ এখন স্যার চলে গেলে পরশুর আগে আর পরীক্ষা করা হবে না! আগামীকাল সরকারী ছুটি! আরো দুই দিন বেশি হাসপাতালে থাকবেন? হাসপাতালে থাকতে খুব ভাল লাগবে? আর আবার বিনামূল্যে এই স্ট্রেচার, ওয়ার্ডবয় কী করে ম্যানেজ করব আমি?পাগল পাগল লাগছিল নিজেকে। এক নাগাড়ে এতগুলো কথা বলার পর পরই দেখতে পেলাম, রোগীর লোক ছুটে বেরিয়ে গেল। কয়েক মিনিট পর অতি কষ্টে মাথা ঠান্ডা হতেই বুঝলাম, অনেক বেশি প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলেছি। কী ভাবলো লোকটা কে জানে। স্যারকেই বা এখন কী বলব? কষ্টে কান্না পেল খুব। অসহায় চোখে তাকালাম এদিক ওদিক। এত কষ্ট করে সবকিছু ব্যবস্থা করে এখন তীরে এসে তরী ডুবতে বসেছে! দুই হাত কপালে চেপে বসে পড়লাম করিডরে রাখা বেঞ্চে। শুনতে পেলাম, ওয়ার্ড বয় খ্যান খ্যানে গলায় বলছে, ‘চিন্তা নিয়েন না ম্যাডাম, আমি আছি আপনার লগে, যতক্ষণ না কাজ শেষ হয়, আমি যামু না!’সেদিন ৫ মিনিটের মাঝে জার কীভাবে, কোথা থেকে সেই লোক যোগাড় করে এনেছিল, আমি জানিনা। এত কিছুর পরেও কীভাবে কীভাবে যেন সেদিন স্যারের সহযোগিতায় আলট্রাসনোগ্রাম নির্দেশনার মাধ্যমে সেই রোগীর যকৃতের পুঁজ টেনে বের করতে সফল হলাম এবং পরীক্ষাতেও পাঠিয়ে দিতে পেরেছিলাম! এর দিন দুয়েক পরে পরীক্ষার ফলাফল চলে আসায় রোগীর ছুটির কাগজে প্রয়োজনীয় ওষুধ-পত্র নিজ হাতেই লিখে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম।রোগী চলে যাওয়ার দুইদিন পর দেখি, মেডিসিন ওয়ার্ডে সাইফুল্লাহর আনাগোনা। দেখেই লজ্জায় মারা যাচ্ছিলাম। নিশ্চয়ই রোগীর লোক ওর কাছে বিচার দিয়েছে, কী খারাপ ব্যবহার টাই না করেছি সেদিন দুপুরে ওদের সাথে! ওয়ার্ডের কাজে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, আমি দুঃখ প্রকাশ করতে গিয়েছি যতক্ষণে; ততক্ষণে নার্স ওদের ছুটির কাগজ বুঝিয়ে ছুটিও দিয়ে দিয়েছে! আর তাই সাইফুল্লাহকে দেখে এ যাত্রায় ভয়ে আর লজ্জায় পালিয়ে যেতে পারলেই বাঁচি আর কী!আমার অস্থিরতা আরো বাড়িয়ে দিতেই কিনা কে জানে, পেছন থেকে ডাক শুনতে পেলাম, ‘আপু, আপু।’শুনেও পাত্তা দিলাম না, কোনমতে ঘাড় ঘুরিয়ে ছুটতে ছুটতে বললাম, ‘ভূপেন স্যারের রাউন্ড আছে রে, পরে কথা বলি।’ সেদিন যদি পেছনে তাকাতাম তাহলে অত্যন্ত বিস্মিত এবং সেই সাথে পরিপূর্ণ আশাহত এক জোড়া চোখ দেখতে পেতাম নির্ঘাত!সেইদিন সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত আমি মাত্র কম্পিউটার অন করেছি, নোটিফিকেশনে দেখতে পেলাম, ফেসবুকে আমাকে ট্যাগ করে স্ট্যাটাস দিয়েছে একজন। কে আর দিয়েছে? দিয়েছে তো সাইফুল্লাহই! আল্লাহ রে! কী লিখেছে?দেখব না, দেখব না করেও, বন্ধ চোখ খুলে স্ট্যাটাস টা পড়েই ফেললাম অবশেষে। কতক্ষণ আর এরকম অস্বস্তিতে থাকা যায় জেনে শুনে? অবাক হলাম যখন দেখলাম, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে সাইফুল্লাহ! সেই সাথে লিখেছে রোগী এবং রোগীর লোক বলেছে, ‘এই ডাক্তার আপা, তাদের রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য অনেক কষ্ট করেছে! তারা অসম্ভব কৃতজ্ঞ।’চট করে মোবাইলে ডায়াল করে কানে চেপে ধরলাম শক্ত করে। ‘সাইফুল্লাহ, আমি তো রোগীর লোককে ভীষণ বকা দিয়েছি রে।’সাইফুল্লাহ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে উঠল, ‘দিয়েছেন,বেশ করেছেন আপু। রোগীর ভালোর জন্যই তো বকা দিয়েছেন।’আমিতো পুরাই হতবাক! ভাল ব্যবহার করেও ইন্টার্নশিপ এর এই সময়টাতে কত রোগীর লোকের কাছে যে অপমান, অপদস্থ হতে হচ্ছে বা হয়েছে! সবাই শুধু চিকিৎসকদের অন্যায় ভাবে ‘কসাই’ উপাধিতে ডাকে। অথচ কখনো শুকরিয়া আদায় করে না কেউ! কিন্তু সাইফুল্লাহ এবং তার আত্মীয়ের কাছে থেকে আজ আমি এগুলো কী শুনছি উলটা পালটা? নাকি এটাই স্বাভাবিক আসলে?ভাবতে ভালই লাগছে, কসাই ডাক্তারের জন্য মন ভাল করা একটা সন্ধ্যা আমার স্মৃতির ব্যাংকে জমা হয়ে রইলো আজ! সত্যিই নিজেকে সার্থক মনে হচ্ছে এতদিনে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *