সিদ্ধার্থ সিংহ এর দুটি অণুগল্প
লকডাউনের বাজারে অনেকেরই খাবার জুটছে না। তাই বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এগিয়ে এসেছে।
বেলা বারোটা নাগাদ পি জি হাসপাতালের সামনে বড় গাড়িটা এসে দাঁড়াতেই শুনশান রাস্তায় কোথা থেকে যে ঝটপট করে এত লোক লাইন দিয়ে ফেলল!
দেখলাম, গাড়ি থেকে বড় বড় গামলা বের করে খাবার বিতরণ করার তোড়জোড় শুরু হচ্ছে। ভাত, ডাল, আলুর তরকারি, এক পিস করে মাছ আর একটি করে রসগোল্লা।
খাবার দেওয়ার আগেই সবার হাতে দেওয়া হচ্ছে দু’-চার ফোঁটা করে স্যানিটাইজার। খাবার নিয়ে তারা এদিকে ওদিকে বসে পড়লেন। কেউ কেউ দাঁড়িয়েই খেতে লাগলেন।
আধ ঘণ্টা পরে আর একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল গুরুদুয়ারা সন্ত কুশিয়ার সামনে। তারা পর সর অনেকগুলো গামলা নামিয়ে খাবার দেওয়া শুরু করল।
কী করে যেন মুহূর্তের মধ্যে মুখে মুখে রটে গেল ওরা শুধু ডাল, ভাত, তরকারি, মাছ, রসগোল্লাই দিচ্ছে না, দু’পিস করে ইয়া বড় বড় মাংসের টুকরো আর একটি করে কলাও দিচ্ছে।
যে লম্বা লাইনে এতক্ষণ ধরে সবাই অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেই লাইন থেকে ঝপঝপ করে বেরিয়ে নতুন লাইনে গিয়ে দাঁড়ালেন অনেকেই।
কোনও সামাজিক দূরত্ব না মেনেই ধাক্কাধাক্কি করে শুরু হল সুগন্ধি সেনিটাইজার নেওয়া এবং যথারীতি ভাত, ডাল, তরকারি, মাংস, রসগোল্লা এবং কলা।
আগের বিতরণকারীদের লাইনটি ফাঁকা হয়ে যেতেই, তারা তো আর এই ঘাটা খাবার নিয়ে ফেরত যেতে পারবে না। তাই শুধুমাত্র মাছ আর ভাতগুলো কোনও রকমে মেখে রাস্তার আশপাশে যত কুকুর ছিল, তাদেরকে খাওয়াতে শুরু করল। ওদিকে খাচ্ছে মানুষ। এদিকে কুকুর।
খানিকক্ষণ পর দেখা গেল যারা মাংস দিয়ে খাবার পরিবেশন করছিল, তাদের সব খাবারই ফুরিয়ে গেল।
ফলে যাঁরা আগের লাইন থেকে বেরিয়ে ওই লাইনে গিয়েছিলেন, তাঁরা একদম মুখের সামনে গিয়ে খাবার না পেয়ে অনেকেই ফিরে গেলেন পুরনো লাইনে।
ততক্ষণে তাদের ভাত-মাছ যা ছিল, সবই কুকুরদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বোঝা গেল, দল বেঁধে বেঁধে যত লোকই এই ভাবে খাবার বিতরণ করুক না কেন, যাঁদের খালি পেটে, অনাহারে থাকার কথা, তাঁদের কোনও না কোনও ভাবে অনাহারেই থাকতে হবে।
পরিযায়ী
বউ আর ছোট্ট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দলছুট এক পরিযায়ী শ্রমিক হাঁটতে হাঁটতে রাজ্যের সীমানার কাছে আসতেই, হইহই করে তেড়ে এল জনাকতক পুলিশ— এই, দাঁড়া দাঁড়া দাঁড়া, যাচ্ছিস কোথায়?
শ্রমিকটি বলল, গ্রামে বাবু।
‘কত দূরে?’
‘এই তো সামনেই, আর সত্তর-বাহাত্তর মাইল হবে…’
‘স… ত্ত… র… বা… হা… ত্ত… র… মা… ই… ল!’
‘হ্যাঁ, একশো তিরিশ মাইলের মতো তো হেঁটে এলাম…’
‘জানিস না, এখন লকডাউন চলছে?’
পাশ থেকে অন্য এক পুলিশ বলে উঠল, ছেড়ে দে, ছেড়ে দে, দেখছিস না কোলে বাচ্চা আছে! হয়তো খিদে পেয়েছে…
শ্রমিকটি বলল, না বাবু, না। ওর খিদে পায়নি। ও তো খিদের জ্বালায় অনেকক্ষণ আগেই মরে গেছে।
খুব সুন্দর গল্প । মুগ্ধতা রেখে গেলাম ।