কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদার জন্মদিনে কাব্যশীলনের শুভেচ্ছা
বাঙালি জাতিসত্তার কবি হিসেবে পরিচিত একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার জন্মদিন আজ। তিনি ১৯৪৯ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের সদর উপজেলার পোকখালী ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন।
তার পিতা মরহুম হাজী মোহাম্মদ সেকান্দর সওদাগর, মাতা আঞ্জুমান আরা বেগম। তিনি ১৯৫৯ সালে পূর্ব পোকখালী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে মেধা-বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৫৯ সালে ঈদগাঁও হাইস্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে ঈদগাঁও হাইস্কুল থেকে এসএসসি (মাধ্যমিক) পরীক্ষায় (কলা বিভাগে) কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন তিনি।
তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে অনার্স ও পরের বছর মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন।
এরপর তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার তালশহর কলেজের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে থাকেন। দেশ স্বাধীন হলে তিনি রাজধানী ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। সোহরাওয়ার্দী কলেজে অধ্যাপনার সময়ে তার প্রথম কাব্য ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’ (১৯৭২) প্রকাশিত হয়।
১৯৭৩ সালে মুহম্মদ নূরুল হুদা বাংলা একাডেমিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৬ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত তিনি বাংলা একাডেমিতে একটানা বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালের আগস্টে নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক পদে যোগদান করেন এবং ২০০২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন শেষে আবার বাংলা একাডেমিতে ফিরে যান। পরে তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
বাংলা একাডেমিতে কর্মরত অবস্থায় ১৯৮৫ সালে আমেরিকার হাওয়াইস্থ ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারের সংস্কৃতি ও যোগাযোগ বিষয়ক ইনস্টিটিউটে গবেষক হিসেবে যোগ দেন এবং সেখান থেকে ১৯৮৬ সালে ফিরে আসেন।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন গদ্য, করেছেন অনুবাদ, লিখেছেন চিকিৎসা শাস্ত্র (হোমিওপ্যাথিক) নিয়ে। বাংলাভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতেও লিখেছেন তিনি। তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।
মুহম্মদ নূরুল হুদার প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য সম্মাননা ও পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে- আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), যশোর সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), আবুল হাসান কবিতা পুরস্কার (১৯৮৩), আওয়ামী শিল্পী গোষ্ঠী সংবর্ধনা (১৯৮৬), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), কক্সবাজার পদক (১৯৮৮), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৪), উপন্যাসের জন্য), যুক্তরাষ্ট্রের আইএসপি ঘোষিত পোয়েট অব ইন্টারন্যাশনাল মেরিট ও পোয়েট অব দ্য ইয়ার সম্মানে ভূষিত (১৯৯৫), কবি আহসান হাবিব কবিতা পুরস্কার (১৯৯৫), তুরস্কের রাষ্ট্রপতি সুলেমান ডেমিরিল কর্তৃক বিশেষ রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত (১৯৯৭), কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ কর্তৃক প্রদত্ত নজরুল জন্মশতবর্ষ সম্মাননা (১৯৯৯), কলকাতাস্থ ‘নজরুল ফাউন্ডেশন’ কর্তৃক সম্মাননা (২০০০), জীবনানন্দ পুরস্কার (২০০১), কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার (২০০১), সুকান্ত পুরস্কার (২০০৪), মহাদিগন্ত পুরস্কার (কলকাতা ২০০৭), চয়ন সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), দেশব্যাপী ষাটবর্ষপূর্তি সম্মাননা (২০০৯), নগরচাবি কক্সবাজার (২০০৯), ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতি পুরস্কার (২০১০), রূপসী বাংলা পুরস্কার- কলকাতা (২০১০), উতল হাওয়া পুরস্কার- কলকাতা (২০১০), একুশ-উনিশের ভাষাগৌরব সম্মাননা, ত্রিপুরা সরকার, ভারত (২০১২), নগরপ্রতীক কক্সবাজার (২০১২), সিটি-আনন্দ আলো কবিতা পুরস্কার (২০১৩), বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক-২০১৫, চর গড়গড়ি সাহিত্য পুরস্কার-২০১৭।
তিনি বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব ও বাংলাদেশ রাইটার্স কপিরাইট সোসাইটির সভাপতি। তিনি বাংলাদেশের শীর্ষ কপিরাইট বিশেষজ্ঞ হুদা জেনেভাস্থ আন্তর্জাতিক ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের (ওয়াইপো) কনসালট্যান্ট ও বাংলাদেশ কপিরাইট বোর্ডের সদস্য।
সাংবাদিক হিসাবেও নূরুল হুদার রয়েছে চার দশকের অভিজ্ঞতা। সত্তরের দশকে ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বঙ্গকণ্ঠ-এ তার সাংবাদিকতার শুরু। তারপর দীর্ঘদিন তিনি ‘অধোরেখ’, ‘বিশ্বাস, ‘বহুবচন’, ‘বাংলা একাডেমি পত্রিকা’, ‘বাংলা একাডেমি জার্নাল’, ‘নজরুল ইনস্টিটিউট পত্রিকা’, ‘নজরুল ইনস্টিটিউট জার্নাল (ইংরেজি), ইত্যাদি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন।
কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদার চারটি কবিতা
উড়ন্ত সাঁতারু
পা – দুটো গুঁজেছে বুকে,
দুই হাতে ডানা
পালকবিহীন তবু
উড়ে যেতে মানা
অগত্যা রেখেছো হাত
আকাশের গায়ে
সমুদ্র – ঘুঙুর করে।
বেঁধেছাে দুপায়ে
এভাবে উড়তে গিয়ে
কাটছে সাঁতার
সমুদ্র আকাশ যদি,
আকাশ পাথার
সাঁতরাতে সাঁতরাতে
যাও উড়ে যাও
বদলাতে বদলাতে
নিজেকে বাড়াও
যেহেতু মানুষ নয় মাছ কিংবা পাখি
মানুষ মানুষ হতে আজো ঢের বাকি ।
গড়াতে গড়াতে কোন বোঁটা থেকে
কোথায় তার শুরু, কোন আকাশের কোন বােঁটায়
কেউ জানে না; কেউ জানে না কোন দরিয়ায়
কোন ঘূর্ণিস্রোতের গােপনাঙ্গে শেষমেশ তার ঠাঁই।
তবু যখন অঙ্কুরিত হলাে তার বীর্য, শুধু যাই – যাই।
যাবে তাে যাবে, কিন্তু কোথায় যাবে, কোন পথে?
ঠিকানা অটুট আছে কোন বটমূলে, কোন অশ্বত্থ?
যেতে যেতে পাল শুটাবে কোন চিলমারির ঘাটে?
গাভির ওলান ছেড়ে কোন সুন্দরীতমার দুধের বাঁটে?
যেখানেই যাও, যেভাবেই, আমি কিন্তু পেছন ছাড়িনি;
এতাে দুষ্মন্ত এতাে অৰ্জুন আমি কারাে কাছেই হারিনি;
আমার হাতে গদা নেই, আমি নই রঁদার মতাে সুনিপুণ;
খুনােখুনিতেই মগ্ন, বারবার আমি নিজেও হয়ে যাই খুন।
বৃষ্টি বলাে শিশির বলাে আমি আজ যে কোনাে ফোটার জন্যে উদগ্রীব;
টগবগ ফুটছে আমার তৃষ্ণা, আমি মহাদেব, আমি নটরাজ, আমি শিব।
নির্লিঙ্গ
জোছনায় শঙ্খচূড় ফণা তােলে কাঞ্চনজঙ্ঘায়। চন্দ্রমুখী উর্ধারােহী, এ নিশীথে নয় মৌনযূনী;
তুষার পেরিয়ে যারা অনন্তের খাড়া – শীর্ষে যায়।
আদপে তারাও নয় কৃষ্ণ – বুদ্ধ, ঋষি, মহামুনি।
যদিও মাথায় জটা, স্বতঃশ্চল ঘূর্ণি পদ্মাসন,
ছায়াপথ ঘুরে এসে সারে তারা দ্রুত গঙ্গাস্নান,
ধারণ করে না তারা অঙ্গে অঙ্গে জন্মের কাফন,
মৃত্যুর মূরলী নৃত্যে জন্ম দেয় সহিংস জীবন।
পাল্টে যায় মত – পথ, পাল্টে যায় আদমসুরত,
পাল্টে যায় নরনারী, গঙ্গা – পদ্মা, যমুনা – ঝিলাম;
পাল্টে যায় মন্ত্র – তন্ত্র, গণতন্ত্র, জীবন – শপথ; বস্তুরা অবস্তু হয়, অবস্তুরা বস্তুর নীলাম।
এসেছে এমন কাল, যেইকালে অন্য কাল নেই;
অতীত, বর্তমান; না স্বপ্ন, না ভবিষ্যৎ;
স্মৃতিহীন কৃতিহীন, বিনষ্টেরা নাচে ধৈই ধেই;
বীর্যের বিলাসে মত্ত, নিঃশেষিত নির্বীর্যের রথ।
নর বলাে নারী বলাে, উভলিঙ্গ, হিজড়ে স্বভাব; ঈশ্বর কি সর্বলিঙ্গ? ধরে তবু নির্লিঙ্গের ভাব!
মানুষ আত্মার পাখি
কাকে তারা ছেড়ে ব্যর্থ তীর?
তারা বাঁচে কতকাল?
ঘৃণিত নিন্দিত চির,
ঘাতকেরা হারায় ত্রিকাল।
তারা ভাবে, অন্যরা অক্ষম;
তারা ভাবে, তারা সব মানুষের যম;
তবে কি জানে না তারা প্রকৃতি – নিয়ম:
একদিন প্রাণী মাত্রে ফুরাবেই দম?
ঘাতকের হাতে যারা হত হয়ে যায়,
চরাচরে তারা সব তারা হয়ে ভাসে,
তারা সব ফুটে থাকে আকাশডাঙায়,
তারা চাষ করে ধরণীর মাটি পরিপাটি,
জলেস্থল নভােতল ঘাটি, তার ঘাঁটি।
তারা সব ধরণীর দ্রোহী সক্রেটিস
তাদের শরীরে – মনে নরনারী অভিন্ন হদিস;
তারা সব তুচ্ছ করে ঘাতকের কূটিল কৌশল; মানুষ আত্মার পাখি, মানুষেরা অমল-ধবল।
আত্মার পাখিরা ওড়ে কাল মহাকাল:
ঘাতক ঘৃণিত চির, ঘাতকেরা হারায় ত্রিকাল।