গদ্য

মহাদেব সাহার কবিতায় রোমান্টিজম ও প্রেমের বৈচিত্র্যময়তা।। আবু আফজাল সালেহ

‘হঠাৎ সেদিন হাতে পেয়ে চিরকুট/নিমিষে সময় হয়ে গেলো যেন লুট;/পার হয়ে বহু বছরের ব্যবধান/কানে ভেসে এলো হারানো দিনের গান।/…এই বয়সেও একখানি চিরকুট/তোলে শিহরন, কম্পিত করপুট।’(চিরকুট, অস্তমিত কালের গৌরব)। মহাদেব সাহার কবিতায় অনুসঙ্গ হিসাবে অনেকাংশে দখল করে আছে প্রেম। বৃষ্টির কথা আছে অনেক কবিতায়। বৃষ্টিকে ভালোবাসতেন তিনি। পাহাড়-নদী ইত্যাদি তাঁর কবিতায় ভরে উঠেছে। এসবের প্রাধান্য রয়েছে বিভিন্ন কবিতায়। বিভিন্ন ঋতুর কথা ফিরে এসেছে বারবার। বর্ষা-গ্রীষ্ম-বসন্ত বা অঘ্রান-শ্রাবণ-চৈত্র ইত্যাদি বিষয় উঠে এসেছে। এসবের মধ্যেই রোমান্টিজম এনেছেন কৌশলে। মানুষ ও মানবিকবোধ কবিতার উপাদান। তাঁর নব্বয়ের অধিক কাব্যগ্রন্থের বেশিরভাগ জুড়েই এসব শব্দাবলির হাটাহাটি, কবিতায় বসবাস। কবি খুব সহজেই এসব উপাদান কবিতায় ব্যবহার করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর মতো খুব কম কবিই এমন মুন্সিয়ানার প্রয়োগ করেছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাব চলে আসে তাঁর কোনও কোনও কবিতায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে তাঁর স্বর ভিন্ন।

মহাদেব সাহার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ : এই গৃহ এই সন্ন্যাস (১৯৭২), মানব এসেছি কাজে(১৯৭৩) চাই বিষ অমরতা(১৯৭৫) কী সুন্দর অন্ধ(১৯৭৮), তোমার পায়ের শব্দ(১৯৮২), ধুলোমাটির মানুষ(১৯৮২), ফুল কই শুধু অস্ত্রের উল্লাস (১৯৮৪), লাজুক লিরিক(১৯৮৪), আমি ছিন্নভিন্ন(১৯৮৬), মানুষ বড় ক্রন্দন জানে না (১৯৮৯), প্রথম পয়ার(১৯৯০), কোথা সে প্রেম, কোথা সে বিদ্রোহ(১৯৯০), প্রেমের কবিতা(১৯৯১), মহাদেব সাহার রাজনৈতিক কবিতা(১৯৯১),অস্তমিত কালের গৌরব(১৯৯২), আমূল বদলে দাও আমার জীবন(১৯৯৩), কোথায় যাই কার কাছে যাই(১৯৯৪)। শিশুসাহিত্যেও মহাদেব সাহার অবদান আছে। উল্লেখযোগ্য কিছু শিশুসাহিত্য হচ্ছে টাপুর টুপুর মেঘের দুপুর, ছবি আঁকা পাখির পাখা,আকাশে ওড়া মাটিরঘোড়া, সরষে ফুলের নদী, আকাশে সোনার থালা, মহাদেব সাহার কিশোর কবিতা(সংকলন)। বেশ কয়েকটি প্রবন্ধগ্রন্থও রয়েছে। উল্লেখযোগ্য কিছু বই: গরিমাহীন গদ্য (২০০৯),আনন্দের মৃত্যু নেই(২০১১), মহাদেব সাহার কলাম,কবির দেশ ও অন্যান্য ভাবনা(২০১১), ভাবনার ভিন্নতা(২০১১), মহাদেব সাহার নির্বাচিত কলাম।

মানুষ সুন্দরের পুজারি। কিন্তু সুন্দরের চারিদিকে অসুন্দরের বসবাস। সুন্দরকে সবাই প্রবলভাবেই চায় কিন্তু অন্যের সুন্দরে ঈর্ষা করে। এটাই চিরন্তন। কবি মহাদেব সাহার এমন চিন্তার বাস্তবায়ন হয়েছে বেশ কিছু কবিতায়। এমন কিছু কবিতায় ভান্ডার ভরিয়েছেন কাছে আসো,সম্মুখে দাঁড়াও, আমূল বদলে দাও আমার জীবন, কোথা সেই প্রেম, কোথা সে বিদ্রোহ নামীয় কবিতাগ্রন্থগুলোতে। ‘আমার প্রেমিকা- নাম তার খুব ছোটো দুইটি অক্ষরে /নদী বা ফুলের নামে হতে পারে/…আমার চোখের ঠিক মাঝখানে তোলা আছে /তার একটিমাত্র পাসর্পোট সাইজের শাদাকালো ছবি;/আমার প্রেমিকা তার নাম সুদূর নীলিমা,/রক্তিম গোধূলি,/ নক্ষত্রখচিত রাত্রি, উচ্ছল ঝর্ণার জলধারা/উদ্যানের সবচেয়ে র্নিজন ফুল, মন হুহু করা বিষন্নতা/সে আমার সীমাহীন স্বপ্নের জগৎ;…’(সংক্ষেপিত, আমার প্রেমিকা,আমূল বদলে দাও আমার জীবন)। আরও বলেন চমৎকারভাবে:-‘কাছে আসো, সম্মুখে দাঁড়াও/খুব কাছে, যতোখানি কাছে আসা যায়,/আমি আপাদমস্তক দেখি তোমার শরীর/যেখাবে মানুষ দেখে, প্রথম মানুষ।/দেখি এই কান্ড আর ডালপালাখানি, ভিতর-বাহির/কতোটা পেয়েছে মাটি, কতোটা বা এই জলবায়ু/পায়নি শিকড়খানি, পেয়েছে কি তোমার প্রকৃতি?/কাছে আসো আরো কাছে, … যেন দেখি তোমার সজল চোখ, তোমার মদির সলজ্জতা’। (সংক্ষেপিত/কাছে আসো,সম্মুখে দাঁড়াও)

প্রেম অন্ধ। এ কথা সর্বজনবিদিত। যদিও প্রেম পবিত্র একটা জিনিস। প্রেমে পড়লে নিজের স্বাভাবিকতা থাকে না। তারপরেও আমরা প্রেমে আবদ্ধ হই। বরং এটাই স্বাভাবিক। প্রেমে সময় নষ্ট করি। আবার প্রেমের মধ্যেই সুখ খুঁজি। প্রেম থেকেই বেঁচে থাকার ঘ্রাণ পাই, শক্তি পাই। ‘কিছুদিন শোকে ছিলাম, মোহে ছিলাম, কিছুদিন নারীতে/শোকাচ্ছন্ন ছিলাম/…কিছুদিন শিশুর গন্ধ, কিছুদিন দীর্ঘ দাহ, কিছুদিন/অধীনতা/কিছুদিন এই কিছুদিন/চলতে চলতে চলতে চলতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছ/লোকে বলে এইখানে এই মায়াদিঘি, বসন্তকাল,/আমি কোনো মূর্তি চাই না/আরো কিছুদিন চন্দ্রাসক্ত, আরো কিছুদিন ঘুমিয়ে পড়বো,/আরো কিছুদিন।’(কিছুদিন শোকে ছিলাম, মোহে ছিলাম, চাই বিষ অমরতা)। প্রেমের কাঙাল কবি কী অসাধারণ আকুতি করলেন প্রেমিকার কাছে-‘করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও/আঙুলের মিহিন সেলাই/ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,/এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো/অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।/চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও/বর্ণনা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দিও…’ (চিঠি দিও )

প্রেম ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনায় একাকার করে দিলেন। সাম্প্রদায়িক নষ্ট করে সম্প্রীতি,শান্তির পরিবেশ। এ অপশক্তি দেশ-সমাজকে কিভাবেই না ধ্বংশ করছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কবিরা এসব একেবারেই পছন্দ করেন না। কবি মহাদেব সাহাও ব্যতিক্রম নয়। বরং সবুজের মধ্যে টকটুকে রক্তজবার মতো উচ্চারণ তাঁর। তাঁর ঝাঁঝালো উচ্চারণ কবিতায়-‘তারা আমাদের কেউ নয় যারা মসজিদ ভাঙে/আর মন্দির পোড়ায়,/তাদের মুখের দিকে চেয়ে সমস্ত আবেগরাশি/হয়ে যাও বরফের নদী-/অনুভ‚তির সবুজ প্রান্তর তুমি হয়ে যাও উত্তপ্ত সাহারা।/তাদের পায়ের শব্দ শুনে রুদ্ধ হয়ে যাও তুমি/চঞ্চল উদ্দাম ঝর্ণাধারা,/মেঘ হও জলশূন্য, নীলিমা বিদীর্ণ/ধ্বংসস্তূপ।/তারা আমাদের কেউ নয়, কখনো ছিলো না,/…প্রেমিকার পবিত্র আবেগ,/মাদার তেরেসার অপারাহ্নের হাতখানি;/তাদের উদ্দেশ্যে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যাও তুমি পাখিদের গান,/মোনাজাত, মীরার ভজন।’(সংক্ষেপিত,তারা আমাদের কেউ নয়, একা হয়ে যাও)

নারীর পর্শ পুনর্জীবন দিতে পারে। কবি-লেখকদের জীবনকর্ম বদলে দিতে পারে। বিখ্যাত ওপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে চারজন ভিন্ন নারীর ¯পর্শে এসে চারটি উপন্যাস লেখেন। যা বিশ্বসাহিত্যে কালজয়ী উপন্যাস হিসাবে মর্যাদা পাচ্ছে। মহাদেব সাহাও নারীর সান্নিধ্যে এসে নতুন নতুন সাহিত্যকর্ম লিখতে চান।‘এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না/একবার তোমাকে দেখতে পাবো/এই নিশ্চয়তাটুকু পেলে-/বিদ্যাসাগরের মতো আমিও সাঁতরে পার হবো ভরা দামোদর/কয়েক হাজার বার পাড়ি দেবো ইংলিশ চ্যানেল;/…একবার দেখা পাবো শুধু এই আশ্বাস পেলে/এক পৃথিবীর এটুকু দূরত্ব আমি অবলীলাক্রমে পাড়ি দেবো।/তোমাকে দেখেছি কবে, সেই কবে, কোন বৃহ¯পতিবার/আর এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না।’(এক কোটি বছর তোমাকে দেখি না, আমূল বদলে দাও আমার জীবন)। অথবা আর একটি কবিতার অংশবিশেষ যদি বলি, ‘তোমার হাতের জল পেলে শুধু এই তৃষ্ণা যাবে/না হলে যাবার নয় এই তৃষ্ণা, এই গ্রীষ্মকাল।/তোমার হাতের জল ছাড়া ভিজবে না পোড়া জমি/এই পোড়ামাটির মানুষ; তোমার হাতের জল/পেলে তাই ফিরে পাবো এ জীবনে ফের সুসময়/…তোমার হাতের জল একফোঁটা শুধু যদি পাই,/কাঁটার বিরুদ্ধে আমি অনায়াসে বুনে যাবো ফুল।’(তোমার হাতের জল, আমি ছিন্নভিন্ন)

নারীই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রূপ। নারীকে নিয়েই রচিত হয়েছে অনেক ইতিহাস। নারীর রূপে দ্বিধাবিভক্ত করেছে অনেক সভ্যতা। অনেকেই বলেন, প্রতি ঘটনার পেছনেই একজন নারী জড়িত। ফলে তাজমহলের মতো অনেক স্থাপনা তৈরি হয়েছে। আবার হেলেনের জন্য ট্রয় নগরী ধংসপ্রাপ্ত হয়েছে বলে শ্রæতি রয়েছে। নারীর রূপই যে শ্রেষ্ট তা মহাদেব সাহা বারংবার বিভিন্ন কবিতায় বলার চেষ্টা করেছেন। ‘বলো না তোমাকে পেলে কোন মূর্খ অর্থ-পদ চায়/বলো কে চায় তোমাকে ফেলে স্বর্ণসিংহাসন/জয়ের শিরোপা আর খ্যাতির সম্মান,/কে চায় সোনার খনি তোমার বুকের এই স্বর্ণচাঁপা পেলে?/তোমার স্বীকৃতি পেলে কে চায় মঞ্চের মালা/…বলো কে চায় তোমাকে ফেলে স্বর্ণমুদ্রা কিংবা রাজ্যপাট?/বলো না তোমাকে পেলে কোন মূর্খ অন্য কিছু চায়,/কে আর তোমার বুকে স্থান পেলে অন্যখানে যায়!’ (কে চায় তোমাকে পেলে, কোথা সেই প্রেম, কোথা সে বিদ্রোহ)

প্রেমিকার জন্য আমরা অনেক কিছুই করি বা করতে পারি। সম্রাট শাহজাহান যেমন প্রিয়তমা মমতাজস্মরণে তাজমহলের মতো সৌধ নির্মাণ করেছেন তেমনি, কবি মহাদেব সাহাও প্রেমের শক্তি নিয়ে অনেককিছুই অর্জন করতে চান। জয় করতে চান সবকিছু। এমন একটি শক্ত উচ্চারণের কবিতাংশ-‘তোমার শরীরে হাত আকাশ নীলিমা ¯পর্শ করে/ভূমন্ডল ছেয়ে যায় মধ্যরাতে বৃষ্টির মতন/মুহূর্তে মিলায় দুঃখ, দুঃখ আমাকে মিলায়/জলের অতল থেকে জেগে ওঠে মগ্ন চরাচর/দেশ হয় দেশ, নদী হয় পূনর্বার নদী/নৈঃশব্দ্য নিরুণ হাতে করতালি দেয়/… তোমার শরীরে হাত সূর্যোদয়, মেঘে রৌদ্র/জন্মান্তর আমার আবার;/তোমার শরীরে হাত একদিন,/ এই জন্মে শুধু একবার!’ (¯পর্শ, মানব এসেছি কাছে)

ছন্দরীতিকে ভাঙতে চান কবি মহাদেব সাহা। বিশেষ করে প্রেমের ক্ষেত্রে। তাঁর ভাবনা প্রেম বা পৃথিবীর যত ভালো কিছু আছে সেখানে ধরাবাঁধা ছন্দ নেই। ছন্দের ফ্রেমে বাঁধতে গিয়ে কবিতার সৌন্দর্যহানি করতে চান না তিনি। প্রেমের কবিতার ক্ষেত্রে মহাদেব সাহা যেসব নতুন নতুন চিত্রকল্প আর উপাদান (শব্দাবলি) তা এককথায় অতুলনীয়। ‘তোমাদের কথায় কথায় এতো ব্যকরণ/তোমাদের উঠতে বসতে এতো অভিধান,/কিন্তু চঞ্চল ঝর্ণার কোনো ব্যাকরণ নেই/আকাশের কোনো অভিধান নেই, সমুদ্রের নেই।/ভালোবাসা ব্যাকরণ মানে না কখনো/হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো সংবিধান নেই/হৃদয় যা পারে তা জাতিসঙ্ঘ পারে না/গোলাপ ফোটে না কোনো ব্যাকরণ বুঝে।/…কেউ কি কখনো সঠিক বানান খোঁজে প্রেমের চিঠিতে/কেউ কি জানতে চায় প্রেমালাপ স্বরে না মাত্রায়?/নীরব চুম্বনই জানি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছন্দরীতি।’(ছন্দরীতি, কোথা সেই প্রেম, কোথা সে বিদ্রোহ)

প্রেম-বিরহ পাশাপাশিই চলে। যুদ্ধ-দামামার মধ্যেও প্রেয়সীর ¯পর্শ চায় মানুষ। কবির ক্ষেত্রে আরও বেশি। প্রথম প্রেমের কথা সবাই মনে করতে চায়। জানতে চায়। তেমনি মহাদেবের মানসপটেও এমন দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে। এমনিতেই তিনি প্রেমের কবি, নান্দনিকতার কবি। ‘আমার কাছে কেউ কেউ জানতে চায়/পৃথিবীর কোন নারীকে আমি প্রথম ভালোবাসি,/…প্রথম অশ্রুবিন্দুর কথা কার মনে থাকে,/তারপর এতো বৃষ্টি এতো বর্ষা/মাটির শ্লেটে প্রথম যে অক্ষর/ …কবে কে আমার হাতে লুকিয়ে/একটি গোলাপ ফুল দিয়েছিল/বইয়ের ভাঁজে রেখে দিয়েছিল/একখানা লাজুক চিঠি,/কে বলেছিল কানের কাছে কোকিলের/মতো মাতাল করা একটি শব্দ!’(সেসব কিছুই আর মনে নেই)

মহামারি হোক বা যুদ্ধ-দাঙ্গা হোক, কবি প্রেমের ডুবেই থাকতে চান। প্রেমিকার ¯পর্শ ও সান্নিধ্য আরাধ্য করেন তিনি। বিশেষত সুন্দরমনের সব মানুষের চাওয়া এমনই। কবি মহাদেব সাহাও অকপটে বললেই ফেললেন,‘…তোমরা সবাই ভয় পাও এই দাঙ্গা দেখে/মড়ক লাগলে মহামারী এমনি কিছুর/ভয় পাও ঠিক রাত-বিরেতে অন্ধকারে/যাকে তাকে দেখলে হঠাৎ/হয় পাও এই সাপের বাঘের/চোর-ডাকাতের দৈত্যদানা জলপুলিশের/অনেক কিছুর ভয় তোমাদের/ভয় তোমাদের বাইরে কেবল চেখের ওপার,/…আমার এ-ভয়/আমার এ-ভয় শত্রুকে নয় প্রিয়ার চোখে/নরম ঠোঁটে/নিজের দুটি করে মাঝে নখের ভিতর/আমার এ-ভয় অন্যরকম অন্যরকম।’(আমার এ-ভয় অন্যরকম, এই গৃহ এই সন্ন্যাস)

কবিতায় প্রেম ও প্রেমিকাকে শিল্পরূপ দিতে পেরেছেন তিনি। যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন প্রেমিকাকে টেনে জুড়ে দিয়েছেন। রূপক হিসাবে প্রেমিকাকেও ব্যবহার করেছেন। আমি মনে করি কোনও কোনও কবিতায় রোমান্টিজমে বা প্রকৃতির রূপ আবহ সৃষ্টিতে জন কীটস, ওয়ার্ডসওয়ার্থ বা হেরিককে ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। ‘বৃষ্টির কথা থাক, বিরহের কথা বলি।/শুনাই দুজনে বিদ্যাপতির বিষণ্ন পদাবলী,/বর্ষার কথা থাক, বকুলের কথা বলি।/ঝরা বকুলেই ভরে রাখি এই প্রশস্ত অঞ্জলি।/আকাশের কথা থাক, হৃদয়ের কথা শুনি।/…বিদ্যার কথা থাক, প্রেমের কবিতা পড়ি।/চারদিকে এই জলধারা তবু সৃষ্টির দ্বীপ গড়ি।(বর্ষার কবিতা, প্রেমের কবিতা, কোথা সেই প্রেম, কোথা সে বিদ্রোহ)

প্রেম-ভালোবাসা-প্রকৃতি বিষয়ক কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষার আরও কিছু উদাহরণ-(১) ‘মনটা ভীষণ উড়– উড়, আমি যেন/উড়ো পাতা,/ঝাউবনের কান্না শুনি বুকের মধ্যে/সারা দুপুর-/উড়তে উড়তে কোথায় যাবো, ঠিকানা ঠিক/কোথায় পাবো/নাকি শেষে হারিয়ে যাবো,/এই আমি এই উড়ো পাতা, উড়ো পাতা!/…লোকাল ট্রেনে যাচ্ছি কোথায়! আমার এখন মনে পড়ে তোমার চোখেবৃষ্টি নামা,তবু উড়– উড়– এই দুপুরে মধুপুরে হয় না নামা।’(মধুপুরে, সুন্দরের হাতে আজ হাতকড়া, গোলাপের বিরুদ্ধে হুলিয়া)

(২) মানুষ সুন্দরের পুজারি। কিন্তু সুন্দরের চারিদিকে অসুন্দরের বসবাস। সুন্দরকে সবাই প্রবলভাবেই চায় কিন্তু অন্যের সুন্দরে ঈর্ষা করে। এটাই চিরন্তন। কবি মহাদেব সাহার এমন চিন্তার বাস্তবায়ন হয়েছে বেশ কিছু কবিতায়। ‘তোমার সাথে প্রতিটি কথাই কবিতা, প্রতিটি/মুহুর্তেই উৎসব-/তুমি যখন চলে যাও সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর/সব আলো নিবে যায়,/বইমেলা জনশূন্য হয়ে পড়ে,/কবিতা লেখা ভুলে যাই।/তোমার সান্নিধ্যের প্রতিটি মুহূর্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতো/মনোরম/…যেন কারো অবিরল গাঢ় অশ্রুপাত;/তোমার সাথে প্রতিটি বাক্য একেকটি কবিতা/প্রতিটি শব্দ শুভ্র শিশির।’(তুমি ও কবিতা, সুন্দরের হাতে আজ হাতকড়া, গোলাপের বিরুদ্ধে হুলিয়া)

(৩)‘…মেঘ দেখতে দেখতে আমি যে কখন মেঘদূতের ভেতর ডুবে যাই,/বিরহকাতর যক্ষের জন্য ভারী হয়ে ওঠে এই বুক/কিংবা গোলাপের দিকে তাকাতেই চোখে ভেসৈ ওঠে/রিলকের মুখটি,/এই মেঘ দেখার দুঃখ, এই গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা/কাউকে বলাই হবে না;/আমি যখন এই প্রকৃতির দিকে তাকাই দেখি রবীন্দ্রনাথ/দেখছেন প্রকৃতির নীলাম্বরী/সেই ব্যকুল বসন্তে আমারও দুচোখ জলে ভরে যায়-/এই মেঘ, এই গোলাপ আমারও অলিখিত কবিতা।’(মেঘ দেখার দুঃখ, গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা, ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস)

(৪)‘তোমার দুহাত মেলে দেখিনি কখনো/এখানে যে ফুটে আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গোলাপ,/তোমার দুহাত মেলে দেখিনি কখনো/এখানে যে লেখা আছে হৃদয়ের গঢ় পঙক্তিগুলি।/…তোমার দুইটি হতে/ফুটে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিশুদ্ধ গোলাপ,/তোমার দুইটি হতে/পৃথিবীর একমাত্র মৌলিক কবিতা।’(তোমার দুইটি হাতে পৃথিবীর মৌলিক কবিতা, আমি ছিন্নভিন্ন )

(৫) ‘শরীর জুড়ে আমার শুধু/ভালোবাসার গন্ধ/কেউ বা তাকে ভালো বলে/কেউ বা বলে মন্দ;/আকাশে মেঘ হৃদয়ে ঝড়/যতোই চলে দ্ব›দ্ব/তুমি ঠিকই জানো/আমি ভালোবাসায় অন্ধ!’ (লিরিকগুচ্ছ-২২)

(৬) ‘চৈত্রে হয়তো ফোটেনি কৃষ্ণচুড়া/তাতে ক্ষতি নেই; তোমার ঠোঁটেই দেখি/এসেছে আবার কৃষ্ণচুড়ার ঋতু/তুমি আছ তাই অভাব বুঝিনি তার; …’(কবি ও কৃষ্ণচুড়া,আমি ছিন্নভিন্ন)।

(৭) বাংলা সাহিত্যের রোমান্টিক কাব্যে এনেছেন নতুনত্ব। যোগ করেছেন নতুন নতুন উপাদান। সহজ-সরল ভাষায় প্রেমিক-প্রেমিকার সরলোক্তি তুলে ধরেছেন তাঁর কবিতায়। তাঁর আগে বাংলা সাহিত্যে এরকম উপাদান খুব কমসংখ্যকই ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন ধরা যায়-‘মেসেজ কেন?/আমি তোমার হাতের লিখা চিঠিখানা চাই/ভুল বানান, বাঁকা অক্ষর,/কিছু ক্ষতি নাই…’। চমৎকার অভিব্যক্তি।

(৮) ‘বলো না তোমাকে পেলে কোন মূর্খ অর্থ-পদ চায়/বলো কে চায় তোমাকে ফেলে স্বর্ণসিংহাসন/জয়ের শিরোপা আর খ্যাতির সম্মান,/কে চায় সোনার খনি তোমার বুকের এই স্বর্ণচাঁপা পেলে?/তোমার স্বীকৃতি পেলে কে চায় মঞ্চের মালা/…বলো কে চায় তোমাকে ফেলে স্বর্ণমুদ্রা কিংবা রাজ্যপাট?/বলো না তোমাকে পেলে কোন মূর্খ অন্য কিছু চায়,/কে আর তোমার বুকে স্থান পেলে অন্যখানে যায়!’ (কে চায় তোমাকে পেলে, কোথা সেই প্রেম, কোথা সে বিদ্রোহ)

(৯) ‘তোমার হাতের জল পেলে শুধু এই তৃষ্ণা যাবে/না হলে যাবার নয় এই তৃষ্ণা, এই গ্রীষ্মকাল।/তোমার হাতের জল ছাড়া ভিজবে না পোড়া জমি/এই পোড়ামাটির মানুষ; তোমার হাতের জল/পেলে তাই ফিরে পাবো এ জীবনে ফের সুসময়/…তোমার হাতের জল একফোঁটা শুধু যদি পাই,/কাঁটার বিরুদ্ধে আমি অনায়াসে বুনে যাবো ফুল।’(তোমার হাতের জল, আমি ছিন্নভিন্ন)

প্রেমের কবি মহাদেব সাহা ১৯৪৪ সালের ৫ আগস্ট পাবনা জেলার ধানঘরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান এ কবি ২০১৬ সালে কানাডা প্রবাসী হন। তিনি মূলত প্রেমের কবি। রোমান্টিক গীতিকবিতার জন্য তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়। তিনি সাংবাদিক হিসাবেও বেশ দক্ষ ছিলেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৯৩টি। যার বেশিরভাগই কাব্যগ্রন্থ। ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ২০০১ সালে একুশে পদক পান রোমান্টিক এ কবি। এছাড়া আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৫), জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার(২০০৮সালে) পান তিনি। কবিতায় প্রেম ও প্রেমিকাকে শিল্পরূপ দিতে পেরেছেন তিনি। যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন প্রেমিকাকে টেনে জুড়ে দিয়েছেন। রূপক হিসাবে প্রেমিকাকেও ব্যবহার করেছেন। আমি মনে করি কোনও কোনও কবিতায় রোমান্টিজমে বা প্রকৃতির রূপ আবহ সৃষ্টিতে জন কীটস, ওয়ার্ডসওয়ার্থ বা হেরিককে ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। ‘বৃষ্টির কথা থাক, বিরহের কথা বলি।/শুনাই দুজনে বিদ্যাপতির বিষণ্ন পদাবলী,/বর্ষার কথা থাক, বকুলের কথা বলি।/ঝরা বকুলেই ভরে রাখি এই প্রশস্ত অঞ্জলি।/আকাশের কথা থাক, হৃদয়ের কথা শুনি।/…বিদ্যার কথা থাক, প্রেমের কবিতা পড়ি।/চারদিকে এই জলধারা তবু সৃষ্টির দ্বীপ গড়ি।(বর্ষার কবিতা, প্রেমের কবিতা, কোথা সেই প্রেম, কোথা সে বিদ্রোহ)

আমরা প্রেমের কবি হিসাবেই জানি। রোমান্টিজমে ভরপুর তাঁর কবিতা। রূপকের মাধ্যমে স্বাধীনতাও চলে এসেছে। আজীবন প্রেমিক মহাদেব সাহার প্রেমিকার অবয়বে দেখেছেন স্বাধীনতা। ভাষা আন্দোলন বা স্বাধীনতাকেন্দ্রিক অনুসঙ্গগুলোও চলে এসেছে। সাধারণ শাব্দাবলির পাশাপাশি এসব অনুসঙ্গ বেশি এসেছে – কাব্যগ্রন্থে।‘কী করে বলো না করি অস্বীকার এখনো আমার কাছে/একটি নারীর মুখই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দর্শনীয়,/তার চেয়ে অধিক সুন্দর কিছু অদ্যাবধি দেখিনি কোথাও;/…এখনো নারীর মুখের দিকে চেয়ে হতে পারি প্রকৃত তন্ময়/সময়ের গতিবিধি, প্রয়োজন একমাত্র নারীর মুখের দিকে চেয়ে/ভুলে যেতে পারি;/…মনে হয় এই যেন পৃথিবীতে প্রথম দেখেছি আমি একটি নারীর মুখ;/নয়ন জুড়ানো এতো শোভা আর কোনো পত্রপুস্পে নেই-/সেসব সুন্দর শুধু পৃথিবীতে নারী আছে বলে।/তাই নারীর মুখের দৃশ্য ছাড়া মনোরম বিপণিও কেমন/বেখাপ্পা লাগে যেন/…আমি শুধু দেখি এই সৌন্দর্যের শুদ্ধ শিল্পকলা, নারীর সুন্দর মুখ।/এর চেয়ে স্মপূর্ণ গোলাপ কিংবা অনবদ্য গাঢ় স্বর্ণচাঁপা /আমার মানুষ জন্মে আমি আর কোথাও দেখিনি,/এর চেয়ে শুদ্ধ শিল্প, সম্যক ভাস্কর্য কিংবা অটুট নির্মাণ/মিউজিয়াম, চিত্রশালা আর ইতিহাস-প্রসিদ্ধ কোথাও/আমি তো পাইনি খুঁজে;/কী করে বলবো বলো নারীর মুখের চেয়ে দর্শনীয় ক্রিসানথিমান/কী করে বলবো আমি নারীর মুখের চেয়ে স্মরণীয়/অন্য কোনো নাম!’ (নারীর মুখের যোগ্য শোভা নেই, ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস)

জল, নদী, বৃষ্টি, সমুদ্র, পাহাড়, বৃষ্টিধারাসহ শ্যামল বাংলার রূপের বিভিন্ন উপাদান নিয়েই কবিতার ডালি সাজিয়েছেন। নির্মাণ করছেন কবিতায় শক্ত ভিত। কবি বৃষ্টি-মেঘ-নদীকে বেশি ভালোবাসতেন। কবিতায় এসব শব্দাবলি বারংবার ব্যবহার সে কথাই প্রমাণ করে তাই তো কবির কবিতায় বৃষ্টি ধরা দেয় সহজেই। মেঘেরা জড়ো হয় কবিতাবুননে। নদী-সমুদ্র হাজির হয়। বৃষ্টির বিভিন্নরূপে ঝংকৃত হয় তাঁর মন। প্রয়োগ ঘটে কবিতার পরতে পরতে। চাঁপাফুল, কদম অতিসহজেই চলে আসে কবিতার ভেতরে। আনাচে-কানাচের বিভিন্ন উপাদান নিয়ে সাজিয়ে তোলেন কবিতার অবায়ব। কবিতায় নিয়ে আসেন বৃষ্টিসুরের আবহ। পাঠককেও আলোড়িত করেন; মুর্ছিত করেন বৃষ্টিসুরে। এসবই বিরাটধরণের কবি-কৃতিত্ব। সাহিত্যে নন্দনতত্ত¡ বা নান্দনিকতার বিষয় থাকে। মহাদেব সাহার কবিতাগুলো নান্দনিকতায় মোড়া। জন কীটস-র (সত্যই সুন্দর,সুন্দরই সত্য) সত্যই প্রতিফলিত হয়ে তাঁর বেশিরভাগ কবিতায়। তাঁর কবিতা কথা বলে প্রেমিকের, কথা বলে প্রেমিকার। ইথারে কথা হয় দুই আত্মার। ‘বৃষ্টির কথা থাক, বিরহের কথা বলি।/শুনাই দুজনে বিদ্যাপতির বিষণ্ন পদাবলী,/বর্ষার কথা থাক, বকুলের কথা বলি।/ঝরা বকুলেই ভরে রাখি এই প্রশস্ত অঞ্জলি।/আকাশের কথা থাক, হৃদয়ের কথা শুনি।/…বিদ্যার কথা থাক, প্রেমের কবিতা পড়ি।/চারদিকে এই জলধারা তবু সৃষ্টির দ্বীপ গড়ি।(বর্ষার কবিতা, প্রেমের কবিতা, কোথা সেই প্রেম, কোথা সে বিদ্রোহ)

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

One thought on “মহাদেব সাহার কবিতায় রোমান্টিজম ও প্রেমের বৈচিত্র্যময়তা।। আবু আফজাল সালেহ

  • রেজাউল করিম

    লেখাটি দীর্ঘ। তবে দীর্ঘ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে লেখক আমার প্রিয় কবি মহাদেব সাহার কবিতায় রোমান্টিজম ও প্রেমের বৈচিত্র্যময়তা স্বার্থকভাবে প্রস্ফুটিত করেছেন। ধন্যবাদ।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *