শিশুতোষ গল্প

রফিকুর রশীদের।। কল্পগল্প।। রাসেল হাঁটছে

একা একা। গ্রামের পথ ধরে হাঁটছে।
দু’ ধারে কলাগাছের সারি। কেমন গলা জড়াজড়ি ভাব। গায়ের উপর গড়াগড়ি। হাসাহাসি। ঝুলে পড়া একটা কলাপাতা রাসেলের মাথা ছুঁয়ে যায়। আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়। কপালে শিশিরবিন্দু পড়ে টুপ করে। ডান হাতের তেলোয় শিশির ফোঁটা মুছে ফেলে রাসেল। তাকায় উপরের দিকে। চোখ পড়ে গাছের ডালে। ঘুঘু পাখি ডাকছে– ঘুঘুর ঘু। হ্যাঁ, ঘুঘুই তো! গলার নিচে কী চমৎকার গয়না আঁকা। চোখ জোড়া কালো কুচকুচে। আবার ডাকে– ঘুঘুর ঘু! রাসেল অবাক হয়, কী বলছে পাখিটা! কলাপাতাও কিছু বলছে নাকি? বন্ধু বলছে? কে বন্ধু ওদের- আমি! আমি তো ঢাকায় থাকি। ধানমন্ডি। বত্রিশ নম্বর। লেকের উপর ব্রিজ পেরিয়ে ইশকুলে যাই। সেখানে আমার বন্ধু আছে। একজন দুজন নাকি! কত্তো বন্ধু! কত্তো!
রাসেল হাঁটছে।
পথের ধারে টিনের বাড়ি। রোদ পড়েছে টিনের চালে। ঝকমকে রোদ। যেন ঝলসে ওঠা তরবারি। রোদ ঝলমল। হাসছে কেন খিলখিলিয়ে? বাব্বা, চোখ ধাঁধানো হাসির ঝিলিক। বাড়ির বাইরে নারকেল গাছ। মাথায় উঁচু। অনেকগুলো। হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে। দিনরাত জেগে থাকা প্রহরী। মাথা দোলাচ্ছে, কিন্তু
শরীর অনড়। ভাঙবে, তবু মচকাবে না। চিরল চিরল পাতায় তাদের রোদের নাচন।
নাচতে নাচতে বলছে তারা– একা কেন! বন্ধু তুমি একা কেন? রাসেল ভাবে- তাই তো! আমি একা কেন! হাঁটতে হাঁটতে ভাবে রাসেল– সত্যি আমি একা কেন? ঢাকায় আমার সঙ্গী কতো! তারা সবাই গেল কোথায়! রাসেল ভাবে আর হাঁটে।
রাসেল হাঁটছে।
ছায়াঢাকা পথ। পাখপাখালির ডাকাডাকি। ক্লান্তি নেই রাসেলের। ভালোই লাগে হাঁটতে। পথের পাশে ভাটফুলের ঝাড়। তারই নিচে পুটুশবন। অমা, কী সুন্দর ফুল ফুটেছে থোকায় থোকায়! এমনিতে আকৃতিতে ছোট, ক্ষুদে ফুল। কিন্তু ফুটে আছে থোকা ধরে। ফলে সৌন্দর্য ফুটেছে অন্যরকম। ভারি মিষ্টি গন্ধও আছে ওদের। রাসেল হাত বাড়ায় ওইদিকে। কিন্তু এ কী! ফুলের থোকা ঘাড় দুলিয়ে হেসে ওঠে ফিক করে। তক্ষুনি এক ঝাঁক প্রজাপতি উড়ে যায়। রাসেলের চোখেমুখে বিস্ময়। প্রজাপতির পাখায় পাখায় এত রঙ! এত আল্পনা! রাসেলের মাথার উপরে ওরা মেলে ধরে রঙিন চাঁদোয়া। ভারি মজার নকশাকাটা। হাত বাড়ালেই ধরা যায়। কিন্ত ওরা যদি ধরা না দেয়! পাঁচ আঙুলের ফাঁক গলিয়ে ওরা যদি পালিয়ে যায়! হঠাৎ প্রজাপতিরা বলে
ওঠে,
আজ তোমার জন্মদিন, তাই না বন্ধু?
চমকে ওঠে রাসেল,
আমার জন্মদিন?
কেন, আমাদের দাওয়াত দেবে না বুঝি!
রাসেল ভেবেই পায় না– এরা এ সব কী বলছে! জন্মদিনে বন্ধুদের দাওয়াত না দিলে চলে! কী মুশকিল! আজ কত তারিখ! আমার জন্মদিন, আর আমিই জানব না? সেই খবর জানবে ফুল পাখি প্রজাপতি? বেশ মজার ব্যাপার তো! রাসেল ঘাড় তুলে তাকায় প্রজাপতিদের দিকে। কিন্তু ঠিক তক্ষুনি দুটো ঘাসফড়িং উড়ে আসে সামনে। হাত তুলে যেন তারা সালাম জানায়। দুজনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। তারপর অনুযোগের সুরে বলে,
আমাদের ফাঁকি দিতে চাও বন্ধু?
না না, ফাঁকি দেব কেন?
রাসেল যেন থতমত খেয়ে যায়। সহসা কথা খুঁজে পায় না। প্রজাপতিরা বলে,
তাহলে আমাদের ডাকছ না যে!
সে কী! বন্ধুরা না এলে কি জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়!
তবে যে তুমি কথাই বলছ না!
না না, তোমরা সবাই এসো অনুষ্ঠানে।
সব্বাই এসো কিন্তু।
হি হি করে হাসতে হাসতে উড়ে যায় ওরা। দূরে যায়। চলে যায়।
ভাবনায় পড়ে রাসেল– আজ সত্যিই তার জন্মদিন! তাহলে কিছুই মনে পড়ছে না কেন তার? নিজের জন্মদিনের কথা কেউ এরকম ভুলে যায়? প্রতিবছর তার জন্মদিন যে খুব ধুমধাম করে পালন করা হয়, এমন নয়। বাবার আপত্তি আছে। তাঁর মতে জন্মের চেয়ে কর্ম বড়। জন্মের উপরে কারো হাত নেই, এত ঘটা কিসের? এ সব কথা মনে পড়ছে, জন্মদিনের কথাটা মনে পড়ছে না কেন? হাসু আপু বললে আর কিছুতেই আপত্তি করে না বাবা, রাসেল সেটা ভালোই জানে। এবার কি তবে হাসু আপু আগে থেকেই সব ঠিক করে রেখেছে! কেবল তাকেই জানায়নি কিছু!
রাসেল হাঁটছে।
হাঁটতে হাঁটতে পথ ছেড়ে নেমে আসে মাঠে। চিকন আইল ধরে সে হাঁটে। দু’ পাশে সবুজ ধানখেত। দু’ চোখ মুদে আসে সবুজের ঢেউ লেগে। এ্যাত্তো সবুজ! এমন প্রগাঢ় সবুজ! আবার সেই ঘাসফড়িং দুটোর কথা মনে পড়ে যায়। সবুজ ধানের মতো গায়ের রঙ। ভাবে, ওরাও আমার বন্ধু! মেঠোপথ ধরে হাঁটার সময় কে যেন সুড়সুড়ি দেয় পায়ের তালুতে। পা টেনে টেনে হাঁটে রাসেল। হাঁটতে হাঁটতে নদীতীরে এসে তো অবাক! পালতোলা নৌকা দেখে তার বুকে ঢেউ জাগে আনন্দের। এতক্ষণে গ্রাম্যপথ, পুটুশবন, কলাগাছ, মাঠঘাট, নদী জনপদ– সব তার চেনা মনে হয়। তবু নিশ্চিত হবাতর জন্যে এক নৌকার মাঝিকে সে জিজ্ঞেস করে,
এটা কি মধুমতি নদী?
মাছধরা জাল নিয়ে মাঝি খুব ব্যস্ত। নৌকার গলুই থেকে তবু একবার ঘাড় তুলে সে জবাব দেয়, হ।
খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর। তবু ভালো লাগে রাসেলের। সে জানে গ্রামের মানুষের অনেক কৌতূহল। এরপর যদি ওই মাঝি প্রশ্ন করে, বাড়ি কোথায়? তাহলে তো বলতেই হবে- এখানে, এই গ্রামে। টুঙ্গিপাড়ায়। না, রাসেল আজ অচেনা হয়েই থাকতে চায়। এই টুঙ্গিপাড়া তার পিতৃভূমি। ঢাকায় থাকলেও এই মাটির সঙ্গে তার নাড়ির সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের সুতো কি ছিঁড়ে ফেলা যায়! কিন্তু একা একা এতদূর এলো কীভাবে? রাসেলের কেবল মনে পড়ে- সে গত রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার প্রিয় সাইকেলের চাকায় হাওয়া নেই। লিক হয়ে গেছে। এই দেখেই তার মাথা খারাপ। কান্নাকাটি। এখনই সাইকেল সারিয়ে দাও। কাজের ছেলে আব্দুল, রমা ভাই দুজনই ব্যস্ত। অনেক কাজ তাদের হাতে। সকালে সারিয়ে আনবে সাইকেল। রাসেল সে কথা শুনলে তো! শেষে মায়ের বকুনি। মন খারাপ। সে ঠিক করে- এই পচা সাইকেলে আর চড়বেই না। হাসু আপু জার্মানি থেকে নতুন সাইকেল এনে দেবে বলেছে। নতুন সাইকেল পেলে আদরের ভাগ্নে জয়কে সে সাইকেল চালানো শেখাবে। ছোট মামা হিসেবে তার দায়িত্ব আছে না! এ সব প্ল্যান
করাই আছে। জার্মানি থেকে আপু- দুলাভাই দেশে এলেই হয়। নতুন সাইকেলের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন আনমনে ঘুমিয়ে পড়ে রাসেল। তবে মনে পড়ে- অনেক রাতে মা একবার জোর করেছিল ভাত খাওয়ার জন্য। সে খায়নি। ঘুমিয়ে থেকেছে। তাই বলে সে টুঙ্গিপাড়ায়
এলো কেমন করে!
নদীতীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে দিনের শেষে রাসেল দাদুবাড়ির সামনে এসে অবাক হয়। অতো বড় বাড়িটা একেবারে
নিস্তব্ধ। আঙিনায় হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুই বোন– হাসিনা এবং রেহানা। কোথাও আর কেউ নেই। ফাঁকা। এতক্ষণে রাসেলের গায়ে কাঁটা দেয়, ভয় ভয় করে। ছুটে গিয়ে হাসু আপুর বুকের মধ্যে মুখ লুকায়। ফুঁপিয়ে ওঠে। হাসু আপু মাথায় হাত বুলায়, সান্ত্বনা দেয়,
কাঁদছিস কেন! জন্মদিনে কাঁদতে হয়!
রাসেল কান্নাভেজা চোখে তাকায় দু বোনের মুখের দিকে, আস্তে করে শুধায়,
সত্যি আমার জন্মদিন আপু?
আজ কত তারিখ তোর মনে নেই? এই দ্যাখ, রেহানা কত বড় কেক নিয়ে এসেছে।
হ্যাঁ, তারিখ ঠিক মনে পড়ে রাসেলের। কেক দেখেও খুব খুশি হয়। কিন্তু এখানে কেন জন্মদিনের অনুষ্ঠান, সেটাই বুঝতে
পারে না সে। জানতে চায়, ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে নয় কেন?
হাসু আপু জানায়– ওটা তো এখন বাঙালির জাতীয় সম্পদ। তাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত জাদুঘর। গোটা জাতির ঠিকানা। আমাদের পৈত্রিক ঠিকানা তো এই গ্রামেই, এই মাটিতে।
রাসেল শোনে। কিন্তু হাসু আপুর এ সব কথা বেশ ভারি ভারি মনে হয়। সবটুকু
বুঝে ওঠে না। মা-বাবা ছাড়া জন্মদিন হয়
কিছুতে! বড় ভাই, মেজো ভাই, দুই ভাবী-
কেউ নেই। শুধু শুধু কেক কাটলেই হলো!
ভেতরের এত সব ক্ষোভ বুকের মধ্যে জমা রেখে সে শুধু জানতে চায়,
আচ্ছা আপু, এটা আমার কততম জন্মদিন বলো তো! এমন প্রশ্ন যেন কেউ আশাই করেনি। দুই বোনেরই বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। হাসু আপু আবারও জড়িয়ে ধরে আদরের ছোট ভাইকে। তার চোখে তখন শ্রাবণ মেঘের আকাশ। আঁচলে চোখ মুছে সে বলে,
কেমন করে জন্মদিনের হিসেব করতে হয়, সে তো পঁচাত্তরেই ভুলে গেছি ভাই!
রেহানা এবার ডুকরে ওঠে সশব্দে।
রাসেল তখন কী করে! আজ সারাদিন আঠারোই অক্টোবর। তার জন্মদিন। কেক নিয়ে প্রস্তুত দুই বোন। তবু আর ভালো লাগে না। এত অশ্রুজলের মধ্যে কিসের জন্মদিন! হাসু আপুর হাতের মুঠো থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। উধাও।
হাসু আপু কান্নাভেজা কণ্ঠে ডেকে ওঠে,
রাসেল তুই ফিরে আয়।
ছোট আপু আর্তস্বরে ডাকে,
রাসেল তুই কোলে আয়।
দুই বোন পিছন থেকে হাত বাড়ায়,
রাসেল, তুই যাসনে ভাই!
রাসেল আর কোনোদিকে তাকায় না। কারো কথা শোনে না।

বাংলার নদী মাঠ প্রান্তর জুড়ে তার জন্মদিন। পুটুশ বনে, প্রজাপতির পাখায়, পাখপাখালির কণ্ঠে তার জন্মদিন। পতাকা সবুজ ঘাসফড়িং জানে তার জন্মদিন। এত উৎসব ফেলে ঘরে ফিরবে কী করে রাসেল!
রাসেল হাঁটছে।
রাসেল হাঁটছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *