ফারুক আফিনদীর কবিতা
কবিতা তা-ই
কবিতা তা-ই, যা আমি বলবো তুমি শুনবে। এই যে আমি তোমাকে বলছি ভালোবাসি। আবার বলছি, ‘ভালোবাসি’। এটা একটা কবিতা। এক শব্দের। তুমি ফুলের মতো চুপে বিস্ময়ে, শুনে যাচ্ছ প্রতিধ্বনি তার। আর, এই মাত্র একটা ভোরের শব্দের সাথে সাথে জেগে উঠলে, নৈঃসঙ্গের লাবণ্য নিয়ে, গোলাপ! গোলাপ! গোলাপ! শিশিরে সেজেছো তবু। সাদা- গোলাপি- এই যে লাল আর ধ্বনির সাথে সাথে পাঁপড়িগুলো মেলছে। ছড়িয়ে পড়ছে দশদিকে। দক্ষিণে, এর পর উত্তর দিকে, এভাবে অধঃপানে। গন্ধ ছড়াচ্ছে। গন্ধ ছড়াচ্ছে। গন্ধ ছড়িয়ে ছড়িয়ে খুঁজছে, খুঁজছে-। তুমি খুঁজছো সেই আওয়াজ যা শূন্যতা ভেদ করে এখনো আসেনি জমিনে। যা মাটির সাথে মিশে আছে আজও। এবং অপেক্ষা করছো- ঠোঁটে বয়ে রাঙা কামরাঙার এক বীজ এনে সবুজ গুল্মলতা আর মরা মরা ডালের আড়ায় ফেলে যাবে বুলবুলি। সাদা মটমটিয়ার পাতা থেকে কুড়াবে কি? কী কুড়াবে? জানো কি তুমি? বলো তো তোমরা, তোমাদের মধ্যে ‘রাঙা ঠোঁটের টিয়া’ একজন বলো।
এই যে আমি বলছি, ‘ভালোবাসিবাসি’, এই যে আমি তোমাকে-।
এবং রাস্তায় ধীর পায়ে হেঁটে যাওয়া তামাটে বর্ণের একজন লোককে দেখিয়ে বললাম- ‘দেখো দেখো তীর- পদক্ষেপে দৌড়াচ্ছে বুড়ো লোকটি শেষ সূর্য্যরে মতো দ্রুত’। এটা একটা কবিতা। এক পঙক্তির। তুমি একবার দেখে থমকে গেলে- লোকটি কত ধীরে কাচা রাস্তায় হাঁটছে, অথচ ঘামছে কী রকম। বসে বসে তা-ই ভাবছো। তোমার ভেতরে এই লোক, সকালের দীর্ঘ ছায়া-, টেনে নিয়ে যাচ্ছে তোমাকে কোনো বিরতি ছাড়াই, পশ্চিমে সূর্য্যের দিকে, দীর্ঘ ছায়ায়।
কবিতা তাই, যা আমি বলবো, প্রথমত তুমি গিলবে শুধু সুধার মতো।
কবি
একটা কবিতা লিখে একজন কৃষককে শোনাতে গেলাম। সে আমারে শুনিয়ে দিলো তার মেঠোপথে কুড়ানো কবিতা। অন্ন হৃদয় আর রূপে পেয়েছিল সে এক জীবনসুন্দর। ভরা মুঠো খুলে দেখালো ধুলিধূসর সারল্যের রেখা। স্বভাবছন্দে বললো-
সোনালি ধানের ছড়া বাঁকা
পিয়ার গলার হাড়ছড়া-
আর বাঁকা হৃদয়ের ধনুক।
ধানের বোঝা নিয়ে ঝনঝন ছন্দে পা মেলাতে মেলাতে দূরে মিলিয়ে যাওয়া এক যুবককে দেখিয়ে আরো বললো সে-
সে তার যৌবনবতী কাচের চুড়ি পরা নারীকেই নিয়ে যাচ্ছে ধানের হৃদয় আর ম ম গন্ধের তাবিজে।
আমার তো ধানের মতো অমন সোনালি হৃদয় কোনোকালে ছিল না যে চার কোণে হ্যাজাক জ্বালিয়ে তার পর ভালোবেসে মঞ্চে তুলে আনি তোমাকে, সন্ধ্যা ও সকালের রানি, ছিল না।
এর পর একজন জেলের কাছে গেলাম। বললো সে-শোনো, কি মিষ্টি আওয়াজ! এদিক ওদিক তাকালাম। কিন্তু জলরঙের এ ছবির পল্লিতে না কোনো শব্দ শুনতে পেলাম, না কাউকে দেখলাম কাছে-ভেতরে। যে তুমি জলের কলরোল শোন না, সে তুমি কী করে চিনবে জলেশ্বরী- আমার সিনায় তর্জনীর ঠনঠনে টোকা দিয়ে বুঝি বললো সে। ব্যথা পেয়ে গেলাম।
এর পর গেলাম এক কামারের কাছে। সে কপালের একটু ঘাম মুছে আঙুলে তুলে ঝাড়া দিয়ে বললো, পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাদের খানা খেয়ে সব চেয়ে সুন্দর জীবনময় গান গেয়ে চলে যাচ্ছে…, জীবন- স্বপ্নায়িত ঘুমে। আরো বললো- লোহা পেটানোর মতো তীব্র ভালোবাসার শব্দগুলো লুকিয়ে থাকে শব্দরোধী বুকের ভেতর।
সেখানেও নিজেকে খুব নিঃস্ব দরিদ্র মনে হলো।
বাজার-হাট, নদীপাড়, নতুন বউয়ের কাচের চুড়ির মতো ধানের ঝনঝনানিতে মুখর গাঁ ঘুরে ঘুরে এর পর একবার এক ধূসর রঙের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম- পোড়া মাটির মতো শরীর, মুখে মানুষের শিল্পিত ছাপ নিয়ে যত্নে বানাচ্ছেন অন্ন আর দইয়ের হাড়িগুলো, আর হাতি ঘোড়া- চোখ পিটপিটে পুতুল। সেই কুমার এসে কাছে, বললো শুনে- মাটিতে থাকি, মাটির গান গাই, কবিতা বুঝি না ভাই। হাড়িপাতিল, গরিবের সানকির ঢপ দেখে এই যে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছি, দেখেন আঁধারভরা গাবের গাছে কি করে চেয়ে আছে কাকপাখি।
আমি দেখিনি, দেখিনি কিছু- জীবন, কাকপক্ষি।
বাঁচবার ভেদ
একদিন কবিতাও তোমাকে বাঁচাবে না আর। শুনে রাখো আফিনদী। লিখে রাখো। যখন মৌমাছি উড়ে যেতে দেখবে, পড়ে থাকবে চাক, তুমি বসে থাকতে চাইবে একটা ঠান্ডা খেজুর পাতার বিছানায়। আজ তো মধুঘন রাত নিজেরই কেবল নিঃশ্বাসে ভরে যেতে দেখে কবিতা এসে কাঁটাযুক্ত ফলের বাগান থেকে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছে। তুমি লোকদিগকে দিয়ে যাচ্ছ সেইসব মৃতসঞ্জীবনী এবং অবশ্যই তুমি নিজেও সেইসব লোকের অন্তর্গত। একদিন এইসব সুরাঘন পানিও পান করতে চাইবে না। দীর্ঘদিনের নদীটির জলস্পর্শ আর তোমার শরীরকে জুড়িয়ে দেবে না, যেরকম স্পর্শ পেয়ে যাচ্ছ এই চৈত্রের দুপুরে। শুধু একটা চষা খেতের মতো ঢিলা চামড়ার মুখ, হাত এসে ক্ষণে ক্ষণে একটু পানির গেলাস নিয়ে দাড়াবে। তুমি বাড়িয়ে দেবে হাত।