ছোটগল্প

গল্প।। সৎকার।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী

ছোটগল্প

আষাঢ়ের প্রথম দিনগুলিতে আম-কাঁঠালের মৌ মৌ গন্ধ সজীব বাতাসের পাটে পাটে যেন মসলিনের বুনন বিস্তৃত আঙিনায় অদৃশ্য ঢেউয়ের নকশী। জোনাকির মত বৃষ্টি নামে আর থামে। বৃষ্টির নতুন পানিতে প্রজনন উল্লাসী ব্যাঙের ব্যাকুল ডাক নিশ্ছিদ্র অন্ধকার নিস্তব্ধ রাতের শরীরে ঝিনুকের বুকের মতো চির ধরায়। দিনের বেলায় কাঁঠালের গন্ধে বেপরোয়া নীল মাছিগুলোর ভনভনানি নেই। ঝড়োবাতাস আর বৃষ্টির ঝাপটা ক’দিন ধরেই বিরামহীন। ডিমওয়ালা গোলসা মাছের পেটের মত থোর ধরা লতানো আউশের লমলমা ডগা নিচু জমিতে সারা শরীর ডুবিয়ে শুধু শিষ ভাসিয়ে কোনক্রমে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের কৃষকের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। এভাবে বৃষ্টি আর বাতাস থাকলে ধান ডুবে যাবে, ধানে চিটা হবে, শ্রাবণে ধানি জমিতে কাঁচি পড়বে কি পড়বে না; আহার জুটবে কি জুটবে না এমন দুশ্চিন্তা আর চাপা হাহাকারে কৃষকের বুকের ভেতর হু হু করছে। এমন লমলমা থোর ধরা ধানের ডগা দেখে যে কৃষকের বুক ভরে গিয়েছিল ক’দিন আগেও তাদেরই বুক এখন শুকিয়ে যাচ্ছে, ফইল্যা মাছের চোখের মতো চোখ বড় হয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি দেখে। রাতে ঝড়োবাতাস আর বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেল। কানিবুড়ির বেড়া ভাঙা খড়ের ঘরের ভেতরে বৃষ্টির ছাঁট স্বচ্ছন্দে ঢুকে। বাঁশ বেতের পাটি বিছিয়ে কানিবুড়ি ঘরের মাঝখানে শুয়েছিল, বৃষ্টির ছাঁট দেখে এখন ঘরের উত্তর পাশে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে শু’লো। বৃষ্টিভেজা ঠান্ডা বাতাস ঝুলে পড়া চামড়ায় কাঁপন তুলছে কিঞ্চিৎ। ছেঁড়া শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে কোনোমতে ঘুমানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ। মেঘের ফাঁক-ফোকরে লুকিয়ে থাকা বিদ্যুতের ঝিলিক মাঝে মধ্যে সাপের জিহার মত বেরিয়ে এসে লাঠিমের মত ঝিম ধরা জঙলি অন্ধকারের শরীর ছেনে আবার লুকিয়ে পড়ে। এ রকম বিজলির আলোয় পথ দেখে দেখে সন্তোষ কানিবুড়ির ভাঙা ঘরের বারান্দায় এসে বসল। কানিবুড়ির চোখে একটু ঘুমের ভাব আসতেই ঘরের বারান্দায় কাশির শব্দ শুনতে পেয়ে খরগোশের মত কান খাড়া করে একটু স্থির হয়ে কি যেন ভাবল, দ্বিতীয় কাশির শব্দে একটু নাড়াচাড়া দিয়ে কানিবুড়ি জিগ্যেস করল, কেলা গো তুমি? লোকটি উত্তর দিল, আমারে চিনবা না। সন্তোষের সঙ্গে একটা বাড়তি ছেঁড়া লুঙ্গি আর একটা ছালার চট। আকাশে লিকলিকিয়ে ঝরেপড়া বিজলির আলোতে যতটুকু দেখতে পেল তাতেই তার ছালার চটের বিছানাটা পেতে নিল। বৃষ্টির ছাঁট আছে বটে তবু সে শুয়ে পড়ে। শরীর ক্লান্ত, একটু ঘুমই তার শরীরের জন্য জরুরি প্রয়োজন। একবার কোনো মতে চোখ বন্ধ করতে পারলেই রাত কাবার সন্তোষ জানে। কাশিটা থামার নয়, যখন তখন মাতাল ষাঁড়ের মত লাফিয়ে উঠে বুক থেকে গলা বেয়ে মুখ দিয়ে নেমে আসে। শুকনো কাশি বলেই ফাটা ঢোলের শব্দ। বাইরের শব্দে বুড়ি বিরক্তি নিয়ে আবার জিগ্যেস করল, নাম নাই তোমার? সন্তোষ উত্তর দিল, আমার নাম নাই। একেক জায়গায় একেক নাম। লোকটির কথা শুনে বুড়ির মনে বিস্ময় দেখা দিল। এমন রহস্যময় কথা জীবনে শুনে নিÑতার ভাবনায় ছেদ পড়ে। মনে মনে বলল, জ্বীন, ভুত, সক্স, পেরতনি নাহি অন্য কিছু কে জানে। খরগোশের মত কান খাড়া করেই আছে। বুড়ির মনে অনেক প্রশ্ন বর্ষার নতুন পানির মাছের মত এলোপাথারি ছোটাছুটি করছে। ভয়ানুভূতিতে বুকের ভেতরটা একটু নড়ে উঠলেও মনে মনে বলল, এ্যা কেমুন মানুষ। এবার সরব বুড়ি জিগ্যেস করল, তোমার বাড়ি কই? লোকটি বলল, যেহানে রাইত সেহানেই কাইত। আমার কুনো বাড়ি নাই, কুনো ঘর নাই। কাটা কাটা উত্তর শুনে বুড়ির কথা বাড়ানোর ইচ্ছে হল না। কোথাকার কে না কে, কে জানে? বুড়ি অন্ধকারে চোখের দু’পাতা মিলিয়ে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। সে আবার ঘুমানোর চেষ্টায় নিমগ্ন হয়। পাথুরে বুনো অন্ধকার আর বৃষ্টির শব্দ বারান্দায় সন্তোষের খচখচানি গ্রাস করে নেয়। বুড়ির ঘুমানোর চেষ্টা নিরন্তর কিন্তু ঘুম আসছে না। ভাবলেই তো আর ঘুম আসে না। চন্দ্র-সূর্যের মত ঘুমেরও নিজস্ব আহ্নিকগতি বার্ষিকগতি আছে। নিজের মতোই চলে। একটু পরে আবার লোকটির কাশির শব্দ শুনে বুড়ি জিগ্যেস করল, তোমার জার করে?


শীত তো লাগারই কথা। বৃষ্টিভেজা বাতাস যেন শরীর ধুয়ে নিচ্ছে। গায়ে বাড়তি কোনো কাপড় নেই। একটা লুঙ্গি পরনে আর একটা লুঙ্গি গায়ে জড়ানো। চটের বিছানা। এখন সবকিছুই ভেজা। ভেজা বাতাস আর ভেজা কাপড় মিলে সন্তোষের শরীরের উষ্ণতার পারদ নিচের দিকে নেমে আসছে। বুড়ির কথায় কিছুটা স্বস্তিবোধ করে একটু আশা নিয়ে সন্তোষ গভীর আগ্রহ নিয়ে উত্তর দিল, জার তো করেই। একটা কেথা অইলে ভালা অইতো। মেঘের ফানিতে শইল ভিজা। একটা কেথা থাকলে দেও দেহি। সন্তোষের কথায় বোঝা যাচ্ছে শরীর কাঁপছে শীতে। বুড়ি বলল, কেথা নাই। ঘরে আইয়্যা বইয়্যা থাহো। বাইরে বাতাস। রাইত ফইয়ালে বাড়ি যাইবানে। কথাগুলো শেষ করে কানিবুড়ি শাড়ির কোচর থেকে দিয়েশলাই বের করে হাতের তালুতে ঘষতে শুরু করে। বৃষ্টির আর্দ্রতায় দেশলাইয়ের বারুদ নেতিয়ে আছে। কিছুক্ষণ হাতের তালুতে ঘষে একটা কাঠি বের করে জ্বালানোর চেষ্টা করল কিন্তু অন্ধকার ঘর আলোর মুখ দেখতে পেল না। আকাশে মেঘের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা বিজলির আলোকে পুঁজি করে ঘরের ঝাপ খুলে দিয়ে বুড়ি ডাক দিল, ঘরে ভিতরে আইয়ো। ভাঙা ঘরের ভেতরে সন্তোষ এক কোণায় গিয়ে বসল। শীতে কাঁপছে। আষাঢ়ি বৃষ্টিতে এমন ঠান্ডা হয় তা কে ভাবে? অন্ধকারে কেউ কারো মুখ দেখছে না। বুড়ি তার বাঁশবেতের পাটিতে শুয়ে পড়ে। কানিবুড়ি আবার ঘুমানোর চেষ্টা করে। সন্তোষ ঘরের কোণে বসে ঝিমুচ্ছে। তার চোখে ভর করেছে রাজ্যের ঘুম। কঙ্কালসার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ক্লান্তির বিষ বয়ে বেড়াচ্ছে। একটু ঘুম বিশেষ প্রয়োজন। শীত কিংবা বাতাসের ঝাপটা তার ঘুমের গতিকে ফেরাতে পারছে না। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে খুব দ্রুত। সকালে ঘুম থেকে উঠে বুড়ি ঝাপসা চোখে দেখে সন্তোষ ঘরের কোনে মাটিতে পড়ে আছে। জরাজীর্ণ শরীর। গায়ের চামড়া ঝুলে পড়েছে। মুখে সামান্য কিছু ব্যাংক অ্যান্ড হোয়াইট দাড়ি। দাঁত আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না। বুড়ির মতই রুগ্ণ দশা। লোকটিকে দেখে বুড়ির হাড্ডিসার দেহের ভেতরে লুকোনো হৃদয় মায়ার আর্দ্রতায় ভরে যায়। মনে মনে বলল, আহারে মানুষটা কেমুন দুব্বল অইয়্যা গেছে। ভিক্ষার চালে রান্না করা কিছু ভাত ছিল সকালে খেয়ে ভিক্ষায় যাওয়ার জন্য। সে ভাত দিয়ে দুই জনের হবে কি না বুড়ি একটু চিন্তা করল। পরক্ষণেই ভাবল, ঘরে অতিত আইলো, রাইতে তারে না খাওয়ায় রাখলাম! এ যে বড় পাপের কাজ। ভাবতে ভাবতে তার মনে হলো ঘরের একটা হাড়িতে কিছু চাল আছে। বুড়ি চাল বের করে ভাত চড়িয়ে দিল। বৃষ্টির ছাঁট আর বাতাসের আর্দ্রতায় লাকড়ি ভিজে শিথিয়ে আছে। চুলোয় লাকড়ি ঢুকিয়ে দিলে, আগুনের চেয়ে ধোঁয়া বেশি, অনেকক্ষণ পরে কোনোমতে বুড়ি ভাত রান্না শেষ করে। অতিথিকে কী দিয়ে খাবার দেবে সে ভাবনায় কিছুটা অস্থির হয়ে ওঠে বুড়ি। মনে পাপবোধ মেঘলা আকাশের বিজলির মতই ঝিলিক মারছে, রাতে তাকে খাওয়া দিতে পারে নি, এরচে’ পাপ আর নেই। চুলোর পাড় থেকে উঠে অন্য একটা হাঁড়ি থেকে একটা পুঁটি মাছের শুঁটকি (সিদল শুঁটকি) বের করে সেটি আর কয়েকটা লঙ্কা খোলায় সেঁকে একটু লবণ ছিটিয়ে চটকিয়ে নিল খুব দ্রুত। ভাত আর শুঁটকি ভর্তা হয়ে গেলে বুড়ি সন্তোষের শিয়রের কাছে বসে তাকে কয়েকবার দেখল। মানুষটা কেডা, নাম নাই, বাড়ি নাই, ঘর নাই, কইত্থে আইল? বুড়ি পুনরায় ভাবনায় পড়ে যায়। কিছুক্ষণ ভেবে বেঘোরে ঘুমিয়ে থাকা সন্তোষকে ডাক দিল, ভাত খাইবা, ওডো দেহি। মাতার উফরে বেইল উঠছে। সন্তোষ উঠে বসে। চোখেও ভালো দেখতে পায় না। সন্তোষ বলল, ভাতের ব্যবস্থা আছে? রাতে বেঘোরে বৃষ্টি খসিয়ে আকাশে এখন আর কোনো মেঘ নেই। নিরাবরণ আকাশ ঝলমল করছে, ক’দিন ধরে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রোদ গাছের সজীব পাতায় ফড়িংয়ের মতো নাচানাচি করছে। সদ্য ফোটা ফুলের মত প্রকৃতি মেলে ধরেছে উজ্জ্বল হাসির ডালা। বুড়ি বলল, আমি ফকির মানুষ। তোমারে খাওয়ানির ক্ষেমতা আছে? দুইডা চাইল হিজাইলাম। মুখ ধুইয়্যা আইয়্যা খাও। সন্তোষ পুকুর থেকে মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসে। বুড়িও তার সঙ্গে বসেছে খেতে। বুড়ি আবার জিগ্যেস করল, তোমার বাড়ি কই? যাদের বাড়ি ঘর নেই তাদেরকে নিয়ে মানুষের একই প্রশ্ন। এটা না হলেই যেন নয়। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সন্তোষের আর ভালো লাগে না। বুড়ির দিকে না তাকিয়েই সে বিরক্তি নিয়ে বলল, রাইতে কইলাম না, বাড়ি ঘর নাই। যেহানে জায়গা ফাই সেহানেই থাহি। রাইতে হুনো নাই? বুড়ি দ্বিধা-দ্বেদ্ব পড়ে যায়। কিছুক্ষণ কোনো কথা বলেনি। কিন্তু কথা না বলেই কি থাকা যায়? কানিবুড়ি আবার জিগ্যেস করল, রাইত কোন হানতে আইলা? খাওয়ার সময় সন্তোষ কোনো কথা বলতে চায় না। আবার বুড়ির কথায় উত্তর না দিলেও চলে না। বিরক্তিতে সন্তোষের কুচকে গেল। সে বলল, কীর্তনে গেছলাম। মেঘের লাইগ্যা কীর্তন অইল না। খাওয়াও জুটল না। আঁটতে আঁটতে এইহানে আইলাম। বুড়ি জিগ্যেস করল, তুমি কীর্তনে গেছলা, তুমি কি হিন্দু? হাড়জিরজিরে সন্তোষের তেজের ঘাটতি নেই। তার মাথায় মাঝে মাঝে রক্ত উঠে যায়। তখন কপালের দু’পাশের শিরা ফুলে উঠে। এখনও তাই হলো। থার্মোমিটারের পারদের মত তার বিরক্তির মাত্রা আরও দুই দাগ উপরে উঠে গেল যেন। জীবনের এত পথ পেরিয়ে এসে এই কথা বারবার শুনতে তার আর ভালো লাগে না। মানুষের ধর্মই বড় অইলো? সন্তোষ বলল, আমার কোনো ধর্ম নাই। যেহানে খাওন ফাই সেহানেই যাই। মুছলমানের মজলিসে যাইয়া কইলমা ফরি, হিন্দুর কীর্তনে যাইয়া কীর্তন গাই, খ্রিষ্টানের গীর্জায় যাইয়া যীশুর নাম লই।


কানিবুড়ির জীবনে প্রথম শুনল একজন মানুষের কোনো ধর্ম নেই, কোনো জাত নেই। বুড়ি এই বেমিল বিষয়টি মিলাতে পারছে না। ধর্ম ছাড়া মানুষ হয় কীভাবে? কিছুক্ষণ ভেবে আবার জিগ্যেস করল, ধর্ম ছাড়া মাইনসের কোনো দাম আছে? সন্তোষের মেজাজের তিরিক্ষির ভাবটা উপচে পড়ে। গলার আওয়াজ ক্ষীণ বলে তার রাগ বোঝা গেল না। সন্তোষ বলল, তোমার তো ধর্ম আছে, তাইলে তোমার কি দাম অইলো কও দেহি? ভিক্ষা কইর‌্যা খাও। কী দাম অইলো কও দেহি? খায়, কোনো দিন খায় না। এভাবেই যদি পড়ে থাকে তাহলে তার দাম কী? যোগ-বিয়োগ করে মিলাতে চেষ্টা করল, ধর্মের কাজ সে কতটুকু করে। তা নিয়ে তার আক্ষেপ আছে, ক্ষোভ আছে, যন্ত্রণা আছে। ধর্মের চেয়ে বেশি ক্ষোভ জীবনের প্রতি। কেন এত বছর বেঁচে আছে এটিই বড় ক্ষোভ। কিছু বলতে হয় তাই বলল, ধর্মের কাম করি না তাই দাম নাই। সন্তোষের চোখ নিরুত্তাপ, নিস্তেজ। চোখের পাতা ঝুলে গেছে। সে এখন মুখ তুলে বলল, বুঝলা বুড়ি, আমার ভগবান অইলো ভাত। সন্তোষ ভাতের থালার দিকে তী² দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে ভাতের চেয়ে প্রিয় তার কাছে আর কিছু নয়। গত দুইদিন ধরে সে ভাত খায় নি। একটা রুটি খেয়েছিল বানাইলের বাজারে। তাও একজন দিয়েছিল একটা কলেমা পড়ার বিনিময়ে। মুসলমানদের বাড়িতে গেলে কলেমা পড়লে খাওয়া দেয়। অনেকেই হাসি তামাশা করে। কেউ কেউ খাওয়া না দিয়েই তাড়িয়ে দেয়। সন্তোষ ভিক্ষা করে ঠিকই কিন্তু কিছু কোথাও থেকে নিয়ে যায় না। যা পায় তাই সে খায়। খাওয়া হলে বাকি সময়টা বসে বসে কাটায়। আপন মনে কী যেন ভাবে। নিজের তো কোনো কিছু করার মুরোদ নেই তা সে ভালোভাবেই জানে। তাই খাওয়ার জন্য মানুষের কাছে যেতেই হবে। তা সে যে ধর্মের মানুষই হোক। সন্তোষের কথা শুনে বুড়ি তাকিয়ে দেখে বুভুক্ষু মানুষটা গোগ্রাসে ভাতের লোকমা মুখের ভেতরে ঠেলে দিচ্ছে। বুড়ির মনে হলো মানুষটার আরও ভাত দরকার। বুড়ি মায়ার্দ্র চোখে লোকটির দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবল। তার গলা দিয়ে আর ভাত নামছে না। একটা অজানা কষ্টে তার বুক ভারি হয়ে গেল। সে পাতিলের বাকি সবগুলি ভাত সন্তোষের পাতে ঢেলে দিয়ে বলল, খাওনের তো যোগাল কিছু নাই। হিদলের ভর্তা দিয়া কি আর খাইবা? সন্তোষ বুড়ির দিকে তাকায় নি। সে আপন মনে পাতে লবণ ছিটিয়ে দিয়ে মরিচের ঝাল দিয়ে ভাত চালান দিল দু’দিনের দানাহীন পেটে। ছালার চটটি এখন বারান্দায় নিয়ে পাতল সন্তোষ। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল রোদ ঝলমল করছে। সন্তোষ বুড়ির দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, আইজ ফইরে বার অইবা না? বুড়ি বলল, যদি মেঘ আইয়ে তাইলে ভিখে গেয়া কী অইবো? পিছলা খাইয়্যা ফইর‌্যা কোমর ভাঙলে…। তিন ভুবনে বুড়ির কে আছে? কেউ নেই। যৌবনে বিয়ে হয়েছিল। দুই বছর পর স্বামী মারা গেল। আর বিয়ে হলো না। কখন যে বার্ধক্যের পিঁড়িতে বসেছে সে ভেবেও পায় না। জীবন তো আর থেমে থাকে না। ঘরের সিঁড়িতে রোদের আবছা ছায়া পড়েছে। সিঁড়ির গোড়ায় রোদের ছায়া দেখে বুড়ি দিনের কতটুকু হলো না হলো সে হিসাব করে। ঘরের দরজা গলিয়ে গলা বের করে আকাশের অবস্থা দেখে নিল। বৃষ্টি নেই। আকাশে সোনা রোদের ঝলমলানি। সন্তোষ শুয়ে আছে ছালার চটের ওপর। খাওয়া-দাওয়া হলে মানুষটার আর কোনো চিন্তা থাকে না। বুড়ি জিগ্যেস করল, আইজ কোনোহানে যাইবা না? সন্তোষ খানদানি ভিক্ষুক। সে মাঝে মাঝে ভিক্ষা করতে যায় ঠিকই কিন্তু খাওয়া হয়ে গেলে সে আর ভিক্ষা করে না। চাল নিয়ে এসে রান্না করা ঝামেলা। এই কাজটি সে পারে না। আজকের খাওয়া হয়ে গেছে। শরীরের অবস্থাও আষাঢ়ের আকাশের মত নড়বড়ে। সে বলল, আইজ আর কই যাইবাম? শইলের তাগত ঠিক নাই। তুমি যাও। বুড়ির মনে সন্দেহ দেখা দিল। তাহলে সে কি এখানে থাকার চিন্তা করছে কি না কে জানে। বুড়ি মনে মনে বলল, যদি থাহে তো থাহুক মানুষটা। কই যাইব? এমুন দুব্বল মানুষের কিছু করার ক্ষেমতা কি আছে? আর কোনো কথা না বলে বুড়ি ঝোলাটা নিয়ে তৈরি হয় বাইরে যাওয়ার জন্য। মুন্তা পাগলা গান গাইতে গাইতে এসে বুড়ির দাওয়ায় বসে পড়ল বাজ পাখির মত। হাতে হুঁকো। বুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ছইরে বাইর অইতাছো নি? বুড়ি উত্তর দিল, হ। আমি আর কই যাইয়াম? সন্তোষের কাশি শোনা গেল। সে এমনভাবে শুয়েছিল তাকে বোঝাই যাচ্ছিল না। মুন্তা পাগলা ঘাড় উঁচিয়ে দেখল সন্তোষ শুয়ে আছে। বুড়ির সঙ্গে মশকারি করে বলল, তোমার জামাই নি বুড়ি? এইডা কেলা গো নানি? বুড়ি উত্তর দিল, দুর যা। বুড়াকালে হিরেবার জামাই। জোয়ান থাকতেই জামাইয়ের মুখ দেইক্যাও দেহি নাই অহন জামাই। বুড়ির দাঁতহীন মাড়িতে হাসির লুটোপুটি। এই হাসি অকৃত্রিম, সুন্দর আর স্বর্গীয়। মুন্তা পাগলা বুড়ির দিকে চেয়ে কি যেন বলতে গিয়ে থেমে যায়। সে হুঁকো টানতে টানতে চলে যায়। সন্তোষের একটা দম দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও মুন্তার গতির কাছে ওর ইচ্ছেটা সেখান পর্যন্ত পৌঁছতে পারে নি। বুড়ি বের হয়ে যায় ভিক্ষের উদ্দেশ্যে। বুড়ির ঘরের রাখঢাকের কোনো প্রয়োজন নেই। তাই সে এদিকে লক্ষ্য করে নি। ঝাপটা খোলা রেখেই চলে যায়। সন্ধ্যায় ফিরে আসে বুড়ি। সন্তোষ ঘুমে বিভোর। বুড়ি আসার পর সে একবার চেয়ে দেখে। তারপর আবার চোখ বন্ধ করে। বুড়ি জিগ্যেস করল, অহনও ঘুমাইতাছো? সন্তোষ কোনো কথা না বলে মাছের চোখে চেয়ে রইল। বুড়ির সন্দেহ দানা বাঁধে। সে সন্তোষের কপালে হাত দিয়ে চমকে ওঠে, অত জ্বর তোমার, কও নাই তো? অহন কী করি? বুড়ির আকুতি বুক বেয়ে পড়ে। সেই ছোট কালে শুনেছিল সিবাজল বড়ির কথা। সে বড়ির নাম তার এখনও মনে আছে। এখন যুগ পাল্টেছে। সিবাজলের বড়ির নাম পাল্টে কত নাম ধরেছে সে হিসাব কি বুড়ির কাছে আছে? সে আফসোস করে বলল, একটা সিবাজলের বড়ি অইলে তো অইতো। জরটা কমত। অহন কী করি কও দেহি? সন্তোষ বুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, গরিবের জ্বরের অসুধ লাগে না। তুমি চুপ মারো। কাইল জ্বর থাকব না। দেইখো। সন্তোষের কথা শুনে মনে হলো সে অনেককালের পুরনো আত্মীয়তার সম্পর্কের নিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে আছে। বুড়ি আর কথা বলল না। কুপির আগুনে সে একটা হলুদের গোড়া পুড়িয়ে সন্তোষের হাতে দিয়ে বলল, এইডা চাবাও। কাশ ভালা অইবো। সন্তোষ সেটাই ভাঙা দাঁত দিয়ে চিবুতে না পেরে চুষতে লাগল। মুখের ভাব দেখে মনে হলো এটিও বুড়ির কাছে তার পাওনা ছিল। মুন্তা পাগলা সন্ধ্যার পরপরই এসেছে বুড়ির বাড়িতে। ঘরের সামনে এসে সে বলল, নানী আইছো নি? আইজ একটা কাডল আনছি তোমার জামাইর লাইগ্যা। হে হে হে …। মুন্তার কথা শুনে বুড়ির মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে বলল, দাও দেয়া একটা কুপ দেয়া কাল্লা ফালাইয়্যা দিমু হারামজাদা। বুড়ির অন্তরাত্মায় কাঁপন ওঠে। শরীরের বেয়ে নেমে গেল ক্রোধের ঝরনা। মুন্তা পাগলার মুখে হাসি। গ্রামের অন্য কোনো মানুষকে মুন্তা ক্ষ্যাপাতে পারে না। বরং মানুষ তাকে ক্ষ্যাপায়। সেই ঝাল ঝাড়তে হয়ত সে বুড়িকে মাঝে মাঝে ক্ষ্যাপায়। সে দাঁত বের করে বলল, আদর কইর‌্যা কাডল আনলাম আর তুমি মিজাজ দেহাও। মুন্তা ঘরের ভেতরে ঢুকে কাঁঠালটা বুড়ির মেঝেতে রেখে চাপ দিয়ে ফাটিয়ে দেয়। নেও নানী খাও, মুন্তা বলল, বলা আর কাঁঠালের কোয়া মুখে দেওয়া এক সঙ্গে চলল। কাঁঠালের কথা শুনে সন্তোষ ওঠে বসে সে মুন্তার দিকে তাকায়। একটা ছোট কেরোসিনের কুপির আলোতে ঘরময় ধুমসি অন্ধকারে ভরে আছে। মুন্তার পেছন দিকটা দেখতে পেল সন্তোষ। সে বুঝতে চেষ্টা করছে সত্যি সত্যি কাঁঠাল কি না এবং সত্যি সত্যি তার জন্য এনেছে কি না। তবে কাঁঠাল ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে ভুরভুর করে মিষ্টিগন্ধ বাতাসে ভেসে উঠলো। এই মিষ্টি গন্ধে সন্তোষের জিভে জল এসে গেল। সন্তোষ আস্তে আস্তে উঠে মুন্তার কাছে আসবে ভাবছে। সন্তোষ বুঝতে পারছে মুন্তা ঘপঘপ করে মুখে দিতে শুরু করেছে কাঁঠালের কোয়া। মুহূর্তের মধ্যে কাঁঠাল শেষ। তলায় কয়েকটা কোয়া আছে কি নেই বলা মুশকিল। এ অবস্থায় মুন্তা বলল, নেও খাও। মুন্তা লুঙ্গিতে হাত মুছতে মুছতে ঘর থেকে নেমে চোখের পলকে অন্ধকারে মিশে যায়।
সারা গাঁয়ে মুন্তাকে পাগল বলেই চিনে। তার বাড়ি কোনটি সে ভালভাবে জানে না। অন্যের বাড়িতেই খায়। কাঁঠালটা আজকের সারাদিনের কাজের বিনিময়ে রাতের খোরাকি হিসেবে পেয়েছিল। রাতের খাবার কাঁঠাল দিয়েই চালিয়ে দেয়।
মুন্তা অদৃশ্য হলে সন্তোষ বুড়ির কাছে এসে বসে। শান্ত ও ম্লান হাসি হেসে বুড়িকে জিগ্যেস করল, আছে নি কিছু? বুড়ি কাঁঠালের অবশিষ্টাংশে হাত চালিয়ে যাচ্ছে। চোখে কম দেখে বলে কাঁঠালের কোয়া খুঁজে পায় না। সন্তোষ বলল, মনে অয় পলো দিয়া মাছ বিছরাউ। দেও দেহি একটা কোষ, বলেই সে হাত বাড়ায়। বুড়ি হতাশ হয়ে বলল, মনে অয় বেবাক শেষ কইর‌্যা গেছে। ফাগলার কম অমনই। খালি লালুস দেহায়। এইহানে বইয়্যা খায়া যায়। কিছুই রাহে না। সন্তোষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। বিলম্ব সহ্য হচ্ছিল না। সে এগিয়ে এসে দ্রুত হাত চালালো। কাঁঠালের কোনো কোয়া পায় নি। হতাশ হয়ে হাত চালিয়ে কয়েকটা বড় বড় শাস খায়। শুষ্ক গলায় বলল, এমন লালুস দেহান ঠিক অইলো? এইডা কুনো মাইনসের কাম? বুড়ি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, মুন্তা কি মানুষ? ফাগল। একটু পরে সন্তোষেরও দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। সন্তোষের জ্বর কমল দুই দিন পর। বুড়িই তার সেবা-যত্ন করল যতটুকু পারে। আজ সকাল সকাল সন্তোষের বের হওয়ার মতলব বোঝা যায়। সে বলল, আইজ বাইর অই। গীর্জায় যাইবাম। যীশুর প্রার্থনা আছে আইজ রবিবার। তুমি যাইবা নি? বুড়ি বললো, না, খিরিস্টানের ধারো যাইতাম না। তুমি যাও। সন্তোষের মনে কোনো আফসোস নেই। সে একা যেতে পারলে বেশি ভালো। এত ফকির অইছে দেশে যে, ফাদারও সামাল দিতে পারে না। সন্তোষ বলল, তাইলে তুমি অন্য কোনোহানে যাও। ফাদারের কাছে একটা খাওন ফাওনা আছে। যদি খাওনের দেয় তাইলে তোমার লাইগ্যা লইয়্যা আইমু নে। যীশুর নাম কইলেই ফাদার খাওন দেয়। বুঝলা বুড়ি, একেক বাড়িতে একেক কায়দা। মুছলমানের বাড়িত গিয়া কইল্মা ফড়ি, আমার নাম কই রহিম। হিন্দুর বাড়িত গিয়া কই হরে কৃষ্ণ, হরে রাম আর আর আমার নাম কই সন্তোষ। গীর্জায় গিয়া কই যীশু তুমি সবার ত্রাণকর্তা। তোমার মধ্য দিয়েই স্বর্গে যেতে হবে। গীর্জায় নাম বদলানো লাগে না। হিন্দু আর খ্রিষ্টানের নাম একই। তবে জোশেফ টোশেফ কইলে সুবিধা অইতো। আসলে আমার ধর্ম যে কী তা-ই জানি না। আমার ধর্ম অইল ভাত। যে ভাত দেয় তার ধর্মই আমার ধর্ম। বুঝলা। বুড়ি কি বুঝলো না বুঝলো বোঝা গেল না। সে বলল, হ বুঝলাম। ভালা খাওন দিলে আইননো। খাইয়া দেহামনে। ফছন্দ অইলে অন্য সোমায় যাইয়ামনে। সন্তোষ তার বিছানাপত্র সব নিয়েই বের যায়।
অনেক দূরের পথ। ফাদার প্রার্থনা করে গির্জার সামনে এসে দাঁড়ায়। কেউ কেউ এখনও গির্জার আঙিনায় হাঁটাহাঁটি করছে। এদের মধ্যে বয়স্ক আর যুবক-যুবতী। বয়স্করা জীবনের হিসাব-নিকাশ করছে কখন জীবনের শেষ হবে। এই সুন্দর সযন্তের শরীর মাটির সঙ্গে মিশে ধুলো-বালি-কাদা হয়ে পৃথিবীর জড়পদার্থের সঙ্গে একাকার হয়ে যাবে। আর যুবক-যুবতীরা প্রেম ভালোবাসার গল্প করছে। কখন তাদের ঘর বাঁধার কিংবা যৌবনের হোলিখেলায় মেতে উঠবে তার হিসাব করে যাচ্ছে গহিন অলিন্দে। গির্জার আঙিনায় ফাদার অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবছিলেন। সন্তোষকে দেখে ফাদার হাসলেন। এই মানুষটাকে নিয়ে মানুষেরা হাসি-তামশা করে। ফাদার প্রকাশ্যে এমন তামশা না করলেও মনে মনে হাসেন এই বিচিত্র মানুষটাকে দেখে। মাঝে মাঝে একটু খাবার দিয়ে তার কাছ থেকে যীশুর কথা শুনেন। এতেই তার মজা। ফাদার কি অন্য পাঁচ জনের বাইরে? ফাদারের কাছে দাঁড়িয়ে সন্তোষ বলল, যীশুর দয়ায় কিছু খাবার দেন ফাদার। ফাদার জানেন কী খাবার দিতে হবে। সে খাবার ছাড়া টাকা-পয়সা নেয় না। তিনি গীর্জার একজনকে ডেকে সন্তোষের খাবারের ব্যবস্থা করেন। সন্তোষ খেয়ে দেয়ে অদৃশ্য হয়। ডিসেম্বর মাস। বড় দিনে গীর্জায় গীর্জায় প্রার্থনা বিপুল আয়োজন। বাড়িতে বাড়িতে নানান জাতের খাবার উপচে পড়চে, ঝলমলে পোশাক-পরা মানুষেরা আনন্দে নাচানাচি করছে। সন্তোষ কয়েক বছর ধরে বড়দিনে ফাদারের কাছে আসে ভাল খাবারের প্রত্যাশায়। আজও এসেছে দুপুরের দিকে। ফাদার বেশ আদর-যত্ন করলেন, পূর্ণ তৃপ্তিতে সন্তোষের খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। খাওয়ার সময় ফাদারকে বলল, সামান্য খাবার কি এক বুড়ির জন্য নিতে পারি? সেই বুড়ি গত বর্ষায় আমার অসুখের সময় আদর-যত্ন করেছিল। ফাদার হেসে বললেন, তুমি যতটুকু পারো নিয়ে যাও। সন্তোষ কিছু খাবার, বিশেষ করে কয়েক টুকরো কেক নিয়ে রওনা হয় বুড়ির বাড়ির দিকে। তীব্র শীতে জান নাকাল। সারাদিনেও সূর্য ওঠেনি। কুয়াশার শীতলপাটি বিছিয়ে দিয়েছে গাছগাছালির উপরে। বিকেলেই যেন সন্ধ্যার আয়োজন। একটু একটু বাতাস শীতের হিংস্রতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সন্তোষ শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে পা চালিয়ে বুড়ির বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। সন্ধ্যায়-ই রাতের আয়োজন। কোনো দিকে সাড়াশব্দ নেই। গ্রামের মানুষেরা ঘরে ঢুকে কাঁথা-কম্বল মুড়ি দিয়েছে। চারদিক ধোঁয়াশায় নাকি সাদা অন্ধকারে আচ্ছন্ন বোঝা যাচ্ছে না। সামনের পথটুকু ভালভাবেও দেখা যায় না। এই পথ ধরেই সে দ্রুত পা চালায়। শীত-কাঁপা শরীরে মাঝে মাঝে হোঁচট খায়। তবুও সে আর থামে না কোথাও। এগিয়ে যায় কুয়াশাচ্ছন্ন কনকনে শীতে শীতার্ত সন্তোষ গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠো পথ বেয়ে। কানিবুড়ির ঘরে এসে দেখে বুড়ি শুয়ে আছে। অন্ধকারে ডুবে আছে ঘর। তার গায়ে মোটা একটা কাঁথা। সন্তোষ ঝাপ খুলে ঘরের তেরে ঢুকে বলল, কেইক আনছি তোমার লাইগ্যা। নেও খাও। বুড়ি কাঁথার বালিশের নিচ থেকে দেশলাই বের কুপি বাতিটা জ্বালিয়ে হাত বাড়ায়। মুখে বলল, যে জার উডনের যোগাল নাই। দেও দেহি কেমুন মেওয়া আনছো। সন্তোষ বুড়ির হাতে দিল এক স্লাইস কেক। শীতের কাঁপুনি তো আছেই। রক্ত জমে যাচ্ছে মনে হয়। বুড়ি কেকের অর্ধেকটা মুখে পুরে দিল। কেক তো তরল খাবার নয়। গলায় আটকে গেল। শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখে তাড়াতাড়ি ওঠে সে মাটির ঘড়া থেকে এক মগ পানি নিয়ে গলা ভিজিয়ে গলা পার করে। সন্তোষের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতাভরে বলল, বড় মজার জিনিস গো বুড়া। আমারে একবার লইয়্যা যাইয়ো সেইহানে। কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে যায়। বুড়ি তাড়াতাড়ি কাঁথার নিচে গিয়ে শুঁয়োপোকার মত গুটি মেরে শুয়ে পড়ে। শীতে কোঁকাচ্ছে। সে সন্তোষের দিকে না তাকিয়েই বলল, ফাইতলাত ভাত আছে লইয়্যা খাও। আমার খুব জার। সন্তোষ বুড়ির দিকে চেয়ে থাকে নির্বাক। গরিবের কত যন্ত্রণা! শীতের, গরমের, ধরমের, শরমের এই সব যন্ত্রণার মধ্যে বেঁচে থাকতে থাকতে কোন দিন জীবন শেষ হয়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না। ধান গাছের মত দেখতে দেখতেই শেষ। সন্তোষ বারান্দায় চটের বিছানাটা বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। মুন্তা পাগলা বুড়িকে একটা পাতলা কাঁথা দিয়েছিল গতকাল। সে কোথায় পেয়েছিল কে জানে। শীতের রাতে সে খড়ের গাদায় শেয়ালের গর্তের মত গর্ত করে সেখানে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে, কোনো শীতবস্ত্রের প্রয়োজন হয় না। বুড়ি মুন্তা পাগলার কাঁথাটিও গায়ে জড়ায়। আকাশ ভেঙে কুয়াশা নেমে আসছে নিচে। নাকি আকাশই নিচে নেমে এসেছে তা-ই বা কে জানে? হিমালয়ের বরফ ধোয়া উত্তরা বাতাস কুশায়ার ভাঁজে ভাঁজে ঢুকে ঘন হচ্ছে। ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢুকে শরীরে করাত চালাচ্ছে। শিশির ঝরার শব্দ পাতায় পাতায়। টপ টপ। টপ টপ। দূরের বনে রাত জাগা দু’একটা পাখির ডাক শোনা যায়। দূর থেকে দূরে ওদের আর্ত চিৎকার ভেসে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ। রাতের গভীর স্তব্ধতা ভেঙে দেয় শীতার্ত শেয়ালের কান্নায়। হঠাৎ সন্তোষ শুনতে পায় বুড়ির ক্ষীণ স্বর। শীতে কুঁকড়ে গিয়ে কোঁকাচ্ছে। শীতে সে মরে যাবে কি না কে জানে? এমন শীত ওরা জীবনে দেখে নি। সন্তোষ ভাবল, এই মানুষটা গত আষাঢ়ে তার জ্বরের সময় এত কিছু করেছে আজ তার শীতে একটু সাহায্য না করলে আল্লা-ভগবানের গায়ে সইবে না। সে আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে ওঠে। নিচের ছালার চট ও একটা কাঁথা (গত দু’দিন আগে একজন দিয়েছিল) হাতে নেয়। ঘরের ঝাপ খুলে। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে বুড়ির যেখানে ঘুমায় সে জায়গাটা খুঁজে পায়। সন্তোষ বুড়ির গায়ে জড়িয়ে দেয় নিজের ছালার চটটি আর কাঁথাটি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে অন্ধকার আর বুড়ির শরীর ও মুখ একাকার। তার চেতন আছে কি নেই সে জানে না। তবুও সে প্রার্থনা করে বুড়ি যেন না মরে। সে আবার ঝাপ বন্ধ করে বারান্দায় এসে অতিরিক্ত পুরনো ছেঁড়া লুঙ্গিটা গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় বসে থাকে। বুড়ি অনেক বেলায় ঘুম থেকে ওঠে দেখে তার গায়ে ছালার চট। একটু বেদিশা। সে জানে না কোথা থেকে এসেছে এই চট। বিছানা ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে গত আষাঢ়ের দিনগুলির মতো দুইটি সানকিতে নুড়ির মত ঠান্ডা ভাত বেড়ে সন্তোষকে ডাক দিল বুড়ি। সন্তোষ কোনো সাড়া দেয়নি। সে সন্তোষের কাছে গিয়ে ডাক দিল, ও বুড়া ওডো। ভাত খাও। না, সাড়া নেই। সন্তোষ নিথর পড়ে আছে বুড়ির বারান্দায়। গাঁয়ের লোকজনের কাছে মৃত সন্তোষ একটি কঠিন বোঝায় পরিণত হলো। মৃতরা চিরকালই জীবিতদের বোঝা। তার সৎকার কীভাবে হবে তা-ই গ্রামবাসীর কাছে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের মৌওলানার কাছে কয়েকজন সন্তোষের মৃত্যুর খবর বললে তিনি বললেন, আবুল মোড়ল দেহো কী কয়? তারপর আমার কাছে আইসো। সে তো মুসলমান ছেল না। গায়ে কাশ্মিরী শাল, পায়ে পাম্প সু, হাতে গ্লাভস, মাথা আর গলায় মাফলার বেঁধে আবুল মোড়ল বাড়ির দাওয়ায় চেয়ার পেতে বসে আছে। তাঁর সামনে ফরসি হুক্কা। কয়েক জন লোক তার সামনে মাটিতে বসে আছে। তীর্থের কাকের মত সবাই আবুল মোড়লের দিকে তাকিয়ে আছে সন্তোষের সৎকারের ব্যাপারে কিছু শোনার জন্য। অনেকক্ষণ পরে মুখ তুলে আবুল মোড়ল এক রাশ ধোঁয়া ওপরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে গুরুগম্ভীর উচ্চারণে বললেন, সে কোন ধর্মের কইলি? একজন বলল, মনে অয় হিন্দু আছিন। মাইনসে তারে সন্তোষ ডাকতো। আবুল মোড়ল হুকোয় টান দিয়ে দম নিয়ে অনেকক্ষণ পরে মুখ তুলে আস্তে আস্তে বলল, তাইলে বাম্মনের কাছে লাশ লইয়্যা যা। শ্মশানে লইয়্যা যা। হিন্দু মরা লইয়া তো আমরার কোনো দায়িত্ব নাই। হাড় জিরজিরে লোকগুলি দৌড়ে গেল ব্রাহ্মণের কাছে। খেয়া পারাপারের যাত্রীর মত অনেকক্ষণ ব্রাহ্মণের বাড়ির সামনে বসে রইল ঘাসের উপর। মন্দির থেকে ব্রাহ্মণ আসার পর ওদের একজন বলল, সন্তোষ মারা গেছে শীতে। তার সৎকার করা লাগবে। কী করা যায় কন দেহি ঠাকুর? ব্রাহ্মণ সন্তোষের কার্যকলাপ জানতেন। তার কপালে ভাঁজ পড়ে। কপাল কুঁচকিয়ে বললেন, সে হিন্দু থাকলেও তার কোনো জাত নাই। সে জাত খোয়াইছে। মুসলমানদের বাড়িতেই থাকতো। সে মাঝে মাঝে গির্জায়ও যাইত। তোমরা বরং গির্জায় গিয়া খোঁজ নিয়া দেখো সে খ্রিষ্টান হইছিল কি না। তবে আমার কাছে আর আসবা না। আমার কিছু করার নাই। তোমাদের গাঁয়ের মরা তোমরাই দেখ কী করবা? হাড় জিরজিরে মানুষগুলি ফাদারের কাছে রওনা হয়। ফাদার দয়ার সাগর। তিনি গির্জা থেকে বের হয়ে সন্তোষের কথা শুনে বললেন, সে খ্রিষ্টান হওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু পুরোপুরি হয় নি। সে ঈদের নামাজ পড়তো, মুসলমানের বাড়িতে থাকতো, আমার এখানেও আসত। হিন্দুদের পূজা-অর্চনাতেও যেত। আপনারাই এর দায়িত্ব নেন। আমি পারব না এই মরার দায়িত্ব নিতে। এ গ্রামে কোনো ডোম নেই। ডোম থাকলে হয়ত একটা বিহিত হতো। লোকগুলি কি করবে বুঝতে পারছে না। তাদের শরীর যেমন কঙ্কালসার তাতে মগজ আছে কি না তাও বোঝা শক্ত। একজন বলল, সদরে ডোম আছে তারে নিয়া আই চল। অন্যরা বলল, এইডাই মনে হয় ভালা। চল। ওরা হাঁটতে হাঁটতে সদরের দিকে এগিয়ে যায়। সন্তোষ পড়ে আছে বুড়ির বাড়ির আঙিনায়। দুপুর গড়িয়ে বিকেলে ছোঁয় ছোঁয়। সকাল পর্যন্ত অনেকেই ছিল তাদের মতবাদ দেওয়ার জন্য অনেক কথা বলেছে। বুড়িকে বাঁচাল যে সে তো বীর। সন্তোষ মহামানব। তাজা মৃতদের কদর কিছুটা থাকে। মৃত পুরনো হলে তার স্মৃতি আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে অন্ধকারে তলিয়ে যায়। সকালের দিকে সন্তোষকে দেখতে অনেকেই এসেছিল সন্ধ্যায় আর কোনো কেউ নেই। এখন সব শান্ত হয়ে গেছে। পাখিদের গান নেই। শুধু শীতের বাতাস আর কুয়াশা আবারও বেপরোয়া ধাবমানের মতো হয়ে উঠছে। বাতাসের গতি বেড়েছ। একটু পরেই সব মানুষ ঘরে গিয়ে ইঁদুরের মত মাথা লুকোবে। কিন্তু সন্তোষের এখনও কিছু হলো না। কে নেবে তার স্বর্গে যাওয়ার দায়িত্ব? মুন্তা পাগলা এসে দেখে সন্তোষ পড়ে আছে মাটিতে। অন্ধকার নেমে আসছে নিঃশব্দে। মুন্তা পাগলা বুড়ির বাড়ির আঙ্গিনায় একটা কবর খুঁড়লো আপন মনে। মাথায় একটা লুঙ্গি বাঁধল টুপির মত। মুন্তার কোনো জামা নেই। কোনো টুপি নেই। বেশি শীত পড়লে সে একটা লুঙ্গি গায় দেয়, একটা পরে। সন্তোষকে আস্তে আস্তে কবরে রাখে মুন্তা। জরাজীর্ণ শরীরটাকে কবরে নামাতে অন্য কোনো লোকের প্রয়োজন হয়নি। বুড়ি তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও কোনো কিছু করার সামর্থ্য নেই। সন্তোষকে কবর দিয়ে মুন্তা পাগলা মোনাজাত ধরে। সে শুধু আল্লা বলতে পারে, আর কিছুই জানে না। বুড়ি একটু বেশি পারে, লা-ইলাহা ইল্লা লাহু এ পর্যন্ত। এর বেশি বুড়ি কিছু জানে না। মুন্তা জানে না ভগবানের নাম। সে জানে না ঈশ্বরের নাম। মুন্তা হাত তুলে মোনাজাত করছে আর আল্লা আল্লা করছে। এক সময় মুন্তা হো হো করে কেঁদে উঠে। একটু পরে যারা ডোম আনতে আনতে গিয়েছিল তারাও এসে মুন্তার পাশে দাঁড়ায়। তারাও মুন্তার সঙ্গে হাত ওপরে তুলে। ওরাও কোনো প্রার্থনা জানে না। একজন মুন্তার মত আল্লা আল্লা করল, একজন একবার বলল, রাম রাম, অন্য একজন বলল, যীশু তাকে স্বর্গে নিয়ো। মুন্তার কান্না দেখে বুড়িও

কেঁদে ওঠে। তবে বুড়ির কান্নায় কোনো শব্দ নেই। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে আগেই। অশ্রু গ্রন্থিও শুকনো বলে চোখ বেয়ে নামে নি লোর। মুন্তার কান্না শোনা যাচ্ছিল দূর থেকে। ফেনিল কুয়াশার বুকে ভেসে ভেসে তার কান্না চলে গিয়েছিল অনেক দূর। অনেক দূর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *