ছোটগল্প// বিবির বিভ্রম কিংবা ভালোবাসা// আহমেদ আববাস
কীভাবে যে আমার বিয়েটা হয়ে যায়, বুঝতে পারি না। বুঝতে পারি ক’মাস পরে। যখন প্রাত্যহিক স্ত্রীর মুখ
ঝামটা, খোটা দেয়া আর অনায়াসে অগ্নিশর্মা এবং রূদ্রমুর্তি ধারণ দৃশ্য দেখি। ইন্টার পাশের পরই ধুম করে ধুমধামের
সঙ্গে ধুম্রজালে আটকা পড়ি। মধুপুস্পে আটকেই মধু-চন্দ্রিমার ঘুর্ণি হাওয়ার যত্রতত্র ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে থাকি।
একইসুত্রে গ্রথিত থেকেও উড়তে উড়তে হরবখত সে ডানা ঝাপটায়। উড়–ক্কুর মতো অস্থির হয়। বরের জীবন বরবাদ
করার জন্যে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বুঝতে পারে, লাগাম দেওয়া ঘোড়াকে চাবুক মারা সহজতর। প্রাকবিবাহ যত
প্রেমালাপই হোক, বিবাহ পরবর্তীতে অধিকাংশক্ষেত্রেই তা কর্পূরের মতো উবে যায়।
মধুকালেই ময়মনসিংহে মলিনা খালার বাসায় যাই। খালার চার মেয়ে। সবাই আমার চাইতে বড়। বিবাহিতা
তিন জনের কর্তাই সরকারি কর্মকর্তা। সবার ছোটো রোজি’পা আমার চাইতে একক্লাস ওপরে পড়ত। সেসময় মেঝআপা
ও রোজি আপা বাসায় উপস্থিত ছিল।
‘ও শিলা, আমরা বিয়ে করেছি, ভীতকন্ঠে রোজি আপাকে বলি।’
’এই ছোঁড়া, তুই বলিস কী? বিয়ে করেছিস!,’ রোজি আপা যেন আকাশ থেকে পড়ে এবং শিলার সামনেই বলতে থাকে,
‘তোর নাক চিপলে এখনো দুধ বার হয়, নাভির ঘা শুকায়নি, গালেমুখে একটা পশম গজায়নি।’
‘কী করব আপা। একটু পরিচয় ছিল মানে আগে থেকেই একটু খাতির তারপর———-।’
‘শিলা তুমি কিছু মনে ক’রো না বোন। ছোঁড়ার কান্ডজ্ঞান দেখে ভাবছি। বুঝতে পারছি শিলার ছাদ দেখে মাত হয়ে
গেছে। রূপ দেখে ডুব দিছে। কিছু দিতে না পারলে শিলার পিষানি খেয়ে মাথায় চাঁদ উঠে যাবে।’
আমি ইতোমধ্যে একটা চাকরিতে যোগদান করেছি। সীমিত বেতন। কিন্তু কর্মস্থলের ওপরওয়ালাদের
যোগাসাজসে অনেকেই ‘উপরি’ পেয়ে যায়। অপছন্দনীয় জিনিস আমার ধাতে সয় না জেনে হাতে শেকল দিয়ে রাখি।
সংসারের হাল শিকেয় উঠতে থাকে। অঙ্কলক্ষীর অঙ্ক না মেলায় পঙ্কে পা দিতে বলে। মান হানির ভয়ে মণিদীপ হয়েই
থাকি।
এ কারণে টু-লেটে ব্যর্থ হয়ে সাবলেট নিই। শিলা আর আমি থাকি। পাশে তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকে
পিডিবি’র ইলেকট্রিশিয়ান বশির ভাই। ছুটির দিনে বিছানা ছাড়তে আমাদের দেরি হলেও পাশের বাসায় ওদের ফেরির
জন্য দেরি সয় না। সকালের তাজা শাক-সবজি কেনা চাই। আমাদের দুজনের নাস্তা ব্রেডের ক্রাইস, পরোটা কিংবা
ডালপুরি কিন্তু বশিরের পরিবারে পান্তা কিংবা গরম খিঁচুরি।
এক ছুটির দিনে শিলা ব্রেকফাস্টের জন্যে বাজারমুখো বশির ভায়ের হাতে বিশটা টাকা দিয়ে বলে, ‘ভাল দেখে
একটা ফ্রেশ ব্রেড (ইৎবধফ) নিয়ে আসবেন।’
সন্নিকটে বাজার হওয়ায় দশ মিনিটের মাথায় বশির ভাই ফিরে আসে এবং শিলাকে জানান দেয়, ‘সুপার-ম্যাক্সই এখন
বাজারের সেরা ব্রেড (ইষধফব)’, বলে হাতে এক প্যাকেট ব্রেড ধরিয়ে দেয়, ‘আর বলে এখানে ফ্রেশ বেøড পাওয়া যায়
না।’
‘কী বলছেন আপনি! আমি বুঝতে পারছি না।’ শিলা যেন বিস্ময়ে হতবাক।
‘আমি বুঝতে পারছি, বলে বিছানা ছেড়ে আসি।’ শিলা বশিরকে বলতেই থাকে, ‘আমি তো আপনাকে ব্রেড আনতে
বলেছি মানে পাউরুটি, ব্রেড নয়।’
বিতর্ক থেকে বিরত রাখার জন্যে আমি শিলাকে ডেকে বলি, ‘ব্রেড আর ব্রেড তো একই কথা। দুটোই তো মুখে
ব্যবহারের জন্য। একটি গেলার জন্য আর অন্যটি (দাঁড়ি কেটে) ফেলার জন্য।’ যেখানে সেখানে ইংরেজি শব্দের আড়ম্বর’
হয়ে গেলে এমন বিড়ম্বনা হতেই পারে।
একদিন সন্ধ্যেবেলা মেঘের আনাগোনা দেখে হাতেগোনা বাজার সেরে দ্রুত বাড়ি ফিরছি। বড়বাজার থেকে ছুটে
রাস্তা মেপে যখনি ওয়াপদা মোড়ে তখনি ঝড়বৃষ্টি টুঁটি চেপে ধরে। আর বেরোবার উপায় থাকে না। চারদিক অন্ধকার হয়ে
যায়। একটা খোলা টিনসেডের নিচে আশ্রয় নিই। বিষ্টি বেড়ে যাওয়ায় বেলা বয়ে যায়। ঘরে ফেরায় দেরি হলে স্ত্রীর জেরা
করতে দেরি সয় না। ভেবে প্রবৃত্তি চঞ্চলমতি হয়।
২
ওয়াদপা মোড়। মেহেরপুর শহর সংলগ্ন এলাকার একটি তেমাথা। বড়বাজার থেকে সরাসরি এসে একটি রাস্তা
এখানে মিশেছে। আরেকটি এখান থেকে সোজা কুষ্টিয়ার দিকে চলে গেছে এবং অপরটি কলেজ রোড, যা ক্রমশ
চুয়াডাঙ্গার দিকে অগ্রসরমান। বড়বাজার রোড এবং কলেজ রোডের সঙ্গমস্থলে অর্থাৎ ওয়াপদা মোড়ের অতি সন্নিকটেই
জেনারেল হাসপাতাল। ওয়াপদা মোড় থেকে কলেজ রোডের দিকে দুশ গজ এগোলেই প্রধান সড়ক থেকে পঞ্চাশ গজ
নাগালের ভেতরে বর্ণিত হাসপাতালের লাশকাটা ঘর। মেহেরপুরে এটাকে বলে কাটাইখানা। এ ঘরটি হাসপাতালের
সীমানার ভেতর থেকেও সেসময় উন্মুক্ত ছিল।
এক মদ্যপ সেদিনই সন্ধ্যেবেলায় ঝড়-বৃষ্টির আলোআধাঁরি দেখে বিদিশা হয়ে দৌড়ে গিয়ে লাশকাটা ঘরের
ডেডবডি কাটিং বেঞ্চে অবস্থান গ্রহণ করে। হয়তো তার কিছুক্ষণ পরই কোনো রিকশাঅলা ঝড়বৃষ্টির মুখে লাশকাটা ঘর
বরাবর গাছের নিচে আশ্রয় গ্রহণ করে। নিকটে লাশকাটা ঘর জানা থাকায় ভয়ে রিকশাঅলার গা ছমছম করতে থাকে।
ক্রমশ ঝড়বৃষ্টি থেমে যায়। পাশেই একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। মদ্যপের নেশা কেটে যায়। সে লাশকাটা
বেঞ্চ থেকে নিচে নামতে উদ্যত হয়। এ সময়েই রিকশাওয়ালার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় লাশকাটা ঘরের দিকে। আর যাবে
কোথায়! ভূত! ভূত! বলে উচ্চস্বরে গলাবাজি করতে থাকে।
তিন চারটে দোকান ছাড়া আশপাশে তেমন বাড়িঘর নেই। হাতে গোনা ক’জন লোক ভূতের ভয়ে দোকানপাট
বন্ধ করার জন্য উৎকন্ঠিত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে ভুতটি এসে আমার উপর আছর করে। আমি দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ
দেবার উপক্রম করতেই লোকটি আমাকে বলে, ‘ভাই আমি যে ভূত নই, ব্যাপারটা কাউকে বুঝাতে পারছি না। আমাকে
দেখে সবাই দৌড়ে পালাচ্ছে।’ আমার সাহস দেখে ভীত লোকদের মাঝ থেকে দু-একজন বলতে থাকে, ‘ওটা ভূত,
মানুষের রূপ ধরে এসেছে। ওটাকে বিশ্বাস করবেন না।’
আতঙ্কে জোটবদ্ধ জনতার মাঝ থেকে আরও একজন বলে, ‘আমরা দেখেছি লাশকাটা ঘর থেকে বের হয়ে
এসেছে, ইত্যাদি, ইত্যাদি।’ তারপরও ওসব কেয়ার না করে মদ্যপের সব ঘটনা শুনে আমি তাকে যথারীতি মানুষ বলে
সনাক্ত করতে সমর্থ হই। এমন সক্রিয় অংশগ্রহণের ঘটনাটি বাসায় এসে বলতেই স্ত্রী রত্নটি “ঝুঁটিবাধা উড়ে সপ্তম সুরে
পাড়িতে লাগিল গালি”- ‘লোফার, মিথ্যাবাদি, নিশ্চয়ই বাইরে গিয়ে বিষ্টির ভেতর কোনো মিষ্টি মেয়ের খপ্পরে পড়ে সময়
পার করেছো। না-হলে এতো দেরি হবে কেন?’