ছোটগল্প “প্রক্ষেপণ” মোহিত কামাল
চা-শিঙাড়ার অর্ডার দিয়ে অফিস ক্যানটিনের কোণে একা বসে আছে শান্তা। ক্যানটিন এখন প্রায় খালি। দু-একজন বসে আছে এদিক-ওদিক। সাধারণত দুপুর বারোটার দিকে ক্যানটিন ফাঁকা হয়ে যায়। ফাঁকা সময়টা বেছে নেয় শান্তা। তুমুল আড্ডার সময়টা এড়িয়ে চলে সে। অফিস কলিগদের আড্ডা বসে এগারো থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। এ সময় গিজগিজ করে ক্যানটিন। তর্ক-বিতর্ক চলে। তর্ক-বিতর্কের সময় কত যে কথা উঠে আসে! আড্ডায় কেউ কেউ অন্যের গোপন কথাও ফাঁস করে দেয়। ঘনিষ্ঠতার সময় অনেকেই নানা গোপন কথা শেয়ার করে। সেই কথা প্রকাশ করা অন্যায়। অন্যায় কাজটি করে কেউ কেউ তুমুল আনন্দ পায়। অন্যদেরও আনন্দ দেয়। বোঝেন না যে, এটা একধরনের স্যাডিস্টিক আচরণ। অনুপস্থিত অন্যের ব্যাপারে মনগড়া গল্পও তৈরি করে তারা। পরচর্চা বা পরনিন্দার খই ফোটে- কথাগুলো সবসময় মাথায় থাকার কারণে এ ধরনের আড্ডা ভালো লাগে না শান্তার। তাই একা আসে ক্যানটিনে। ফাঁকা সময়ে চা-শিঙাড়া খেয়ে এনার্জি নিয়ে আবার ফিরে যায় কাজে। যতক্ষণ কাজে থাকে ততক্ষণই মন ভালো থাকে। আজকাল ভালো থাকাটা দুরূহ ব্যাপার।
হাই শান্তা! কেমন আছেন। বলতে বলতে সামনের খালি চেয়ারটা টেনে বসলেন ফয়সাল হাসান, অফিসের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ।
একা টিফিন করা হলো না দেখে হতাশ হয়ে ম্লান হেসে শান্তা জবাব দিল, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
চলছে ভালো। কাজের চাপে দিশেহারা থাকি। অনেক সময় মেজাজও ঠিক থাকে না, সব মিলিয়ে চলছে আর কি।
শান্তা বলল, কাজের চাপ তো থাকবেই। চাপের মধ্যে আনন্দও থাকে। আনন্দ কুড়িয়ে নিতে পারলে মেজাজ বিগড়ে যাবে না।
শুধু কি কাজের চাপে মেজাজ বিগড়ায়?
তো? আর কী কারণে মেজাজ খারাপ করেন?
জয়নাল সাহেব সেদিন বললেন, অফিস কলিগরা বলাবলি করছে, আমি আর আপনি নাকি বসের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠতা রাখছি। স্বার্থসিদ্ধির জন্যই নাকি বসকে তেল দিই আমরা! বলেন, কথাগুলো কি সহ্য করা যায়? হজম করা যায়?
আমি শুনিনি তো এমন কথা! কেউ আমাকে জানায়নি এমন সমালোচনার কথা!
আপনাকে জানানোর কি সাহস আছে ওসব চিংড়িপোনাদের!
উপমাটা ভালো লাগল না শান্তার। কলিগদের চিংড়িপোনা বলা মোটেই উচিত নয়। অন্যের সম্পর্কে কমেন্ট করার আগে নিজের কথা ভাবা উচিত। কাউকে নিয়ে এমন বিরূপ মন্তব্য করা ঠিক না। মন্তব্য করার যোগ্যতা আছে কি না ভেবে দেখা উচিত। অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন। অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা নিজেকেই মর্যাদাবান করে- এ বিশ্বাস ধারণ করে শান্তা বলল, ভালোভাবে বিষয়টা না জেনে তৃতীয় ব্যক্তির কথা শুনে এমন মন্তব্য করা কি ঠিক হলো, ফয়সাল সাহেব?
আমি কি নিজে মন্তব্য করেছি। জয়নাল সাহেবের মাধ্যমে জেনেছি। আমি তো পুরুষমানুষ। আমাকে নিয়ে মন্তব্য হলে তেমন কিছু যায়-আসে না। আপনি মহিলা, তার ওপর সুন্দরী। আপনাকে নিয়ে যদি বসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা কেউ বলে, খারাপ লাগবে না!
জয়নাল সাহেব তো সজ্জন লোক। কাউকে নিয়ে সমালোচনা করেন না। তা ছাড়া আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ আগেও দেখা হয়েছে, কিছুই বলেননি আমাকে। জবাব দিয়ে ফয়সাল খানের সমালোচনা মোকাবিলা করার চেষ্টা করল শান্তা।
আপনি কি মনে করছেন কথাগুলো বানিয়ে বলছি আমি?
প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে নরম স্বরে স্বাভাবিক ঢঙে পরোক্ষভাবে শান্তা জবাব দিল, প্রত্যেকের মধ্যে ভালো কিছু দিক আছে। সেই দিকগুলো খুঁজে বের করা গেলে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এমনভাবে চলা উচিত যেন মেজাজ, চিন্তা বা আচরণে পরনিন্দা কোনো প্রভাব ফেলতে না পারে।
শান্তার কথার দিকে নজর না দিয়ে ফয়সাল খান আবার প্রশ্ন করলেন, কী ভাবছেন আপনি? বিষয়টার কি একটা মোক্ষম জবাব দেওয়া উচিত না?
দেখুন, বস আপনাকে দক্ষ মনে করেন। মনে করেন আপনি গুণীজন, কাজের লোকও। আমাকেও বিশ্বস্ত মনে করেন। এ যোগ্যতা অর্জন করেছেন আপনি। আমিও। আমাদের নিয়ে অন্যদের ঈর্ষা হতেই পারে। ঈর্ষাবশে নানা কটু কথা রটাতে পারে যেকেউ। সেটা নিয়ে বিচলিত নই আমি। আপনারও উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। আপনার কথা অনুযায়ী আপনি একজন পুরুষমানুষ। আমি মেয়েমানুষ। দুটো শব্দই মানি না আমি। মনে করি, আমরা সবাই মানুষ; এ অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী। এজন্যই বলছিলাম, এমনভাবে চলা উচিত যেন পরনিন্দা আপনার কেশও স্পর্শ করতে না পারে।
জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হলেও বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে নিজের কথা প্রকাশ করতে পেরেছে শান্তা। এজন্য মনে মনে নিজেকে ধন্যবাদ দিল সে।
শান্তার জোরালো কথা শুনে মুষড়ে পড়েন ফয়সাল খান। পরাজিত হতে রাজি নন তিনি। পিছু না হটে, দমে না গিয়ে বললেন, আপনি যা-ই বলুন, এ অপবাদের ছাড় দেব না আমি। কে কী অপকর্ম করছে, জানি না আমি? সব জানি। জয়নাল সাহেবও প্রায় অফিসে ফোন এনগেজড রাখেন। সুযোগ পেলেই কথা বলেন এক কচি মেয়ের সঙ্গে। ছুটির আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা আগে বেরিয়ে যান অফিস থেকে। একসঙ্গে ঘুরে বেড়ান দুজনে। সব জানিয়ে দেব বসকে।
এবার সত্যিই বিব্রত বোধ করতে লাগল শান্তা। অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে নিন্দাসূচক কথা একদম ভালো লাগছে না তার। সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করতে গেলে বিশ্বস্ত জায়গা তৈরি করতে হয়, ঠিক রাখতে হয় পারস্পরিক মর্যাদাবোধ। কখনই কারও গোপন কথা অন্যের সামনে ফাঁস করে দেওয়া উচিত নয়। পরচর্চা অফিসের কাজের পরিবেশ নষ্ট করে। এর ক্ষতির প্রভাব পড়ে প্রতিষ্ঠানের ওপর। মনের পরিবেশও তেতো হয়ে ওঠে। এখনকার বিব্রত অবস্থা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে ইচ্ছা করছে শান্তার। পারছে না। এখনও চা-শিঙাড়া আসেনি টেবিলে। টেবিলে রাখা পানি ভরা গ্লাস ডান হাতে তুলে নিল শান্তা। ছোট করে চুমুক দিয়ে বলল, কারও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলাপ করা পছন্দ করি না আমি। রিকোয়েস্ট করছি, ভালো কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ করতে পারেন। সরি। সরাসরি কথাগুলো বলতে হলো আপনাকে। তবে এটুকু বলতে পারি, কেউ ভুল করলে, ভুল পথে চলতে থাকলে নিজে টের পায় না। অন্যরা টের পায়। সে-রকম কিছু দেখে থাকলে অন্যের সঙ্গে আলোচনা না করে সরাসরি তাকেই ভুল ধরিয়ে দেবেন। সেটাই হচ্ছে কনস্ট্রাকটিভ আলোচনা। আমারও কোনো ভুল হলে সরাসরি আমাকেও বলতে পারেন। সিনিয়র হিসেবে এ অধিকার আছে আপনার। স্বীকার করি।
শান্তার ধারালো কথার উল্টোপিঠে শেষ কথায় কিছুটা সম্মানের এলিমেন্ট পেলেন ফয়সাল খান। সূক্ষ্ম ট্রিটমেন্ট দিয়েছে শান্তা। এ কারণে কিছুটা সহজ হয়ে গেলেন তিনি।
লাই পেয়ে সহজ হয়ে বলে বসলেন, তাহলে একটা কথা বলি, শোনেন, যখন-তখন বসের রুমে যাবেন না। আপনার একা যাওয়াটা পছন্দ করে না কেউ।
ফয়সাল খানের কথা শুনে কান গরম হয়ে গেল শান্তার। নিজের অজান্তেই মন হয়ে গেল অশান্ত। বুঝতে অসুবিধে হলো না, ‘কেউ পছন্দ করে না’ বাক্যটা বানোয়াট; ফয়সাল খানেরই মনগড়া কথা। বরং ফয়সাল খান সুযোগ পেলে নিজের ঘরে ডাকেন তাকে। অথবা নানা অজুহাতে শান্তার ঘরে ঢোকেন। এটা-সেটা বলে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করেন। ইমপ্রেশন তৈরির চেষ্টা করে মূলত তিনি ইভ টিজিং করেন, বুঝতে চান না, বুঝতে পারেন না তার নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের কারণে। মোক্ষম সময়ে জবাবটা দিয়ে দিল শান্তা, কারও পছন্দ-অপছন্দ বিবেচনা করে কি অফিসে টিকে থাকা যাবে? বস কি কেবল আমাকে ডাকেন? সব কর্মকর্তা -কর্মচারীকে যার যার ফাইল নিয়ে যেতে হয় বসের রুমে। আমাকে একা টার্গেট করবেন কেন? আপনিও তো রুমে ডাকেন একাকী আমাকে। সুযোগ পেলে তো ঢুকে পড়েন আমার রুমেও। তখন কেউ কিছু বলে না? বলবে না?
শান্তার কথার জবাবে একদম বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন ফয়সাল খান। কিছু একটা বলতে গিয়ে বলতে পারলেন না। তোতলাতে থাকেন। সুযোগমতো মনের কথাগুলো সরাসরি উজাড় করে দিয়ে শান্তি পেল শান্তা। চা এসে গেছে সামনে। গরম ধোঁয়া বেরোচ্ছে কাপ থেকে। দুটো শিঙাড়ার একটা ফয়সাল খানের দিকে এগিয়ে বললেন, নিন। শিঙাড়া খান। আপনি তো এখনও অর্ডার দেননি।
শিঙাড়া খাওয়ার সুযোগ পেয়ে ফয়সাল খান যেন জান ফিরে পেলেন। দ্রুত হাতে শিঙাড়া তুলে নিয়ে কামড় বসাতেই উহ্ করে ওঠলেন। গরম শিঙাড়ার ভেতরের তাপ জিহ্বা প্রায় পুড়িয়ে দিয়েছে। দিশেহারা হয়ে শান্তার চুমুক দেওয়া গ্লাসটি তুলে নিয়ে ঢকঢক করে পানি চালান করে দিলেন মুখে। অস্বস্তি কাটার পর দেখলেন ভিজে গেছে শার্টের একাংশ, প্যান্টের সামনের অংশ। দেখে মনে হচ্ছে প্রকৃতির ছোট ডাক সেরে ফেলেছেন তিনি। কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে এবার শিঙাড়ার বাকি অংশে ফুঁ দিয়ে ঠাণ্ডা করে কামড় বসালেন আবার।
সুযোগ পেয়ে শান্তা আবার বলল, আমাদের নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে প্রথমে। ভালো ভালো চিন্তাভাবনা করতে হবে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বাড়াতে হবে সবার। তাহলেই অফিসটা হবে নিজেদের। তখনই উন্নতি হবে এ প্রতিষ্ঠানের।
এবার ফয়সাল খান একমত হলেন শান্তার সঙ্গে। শিঙাড়া শেষ করে বললেন, ঠিকই বলেছেন আপনি, নিজের প্রতিষ্ঠান ভাবতে হবে। বলেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ম্লান হাসি দিয়ে ক্যানটিন ত্যাগ করলেন।
শান্তা এবার আয়েশ করে চা খেতে পারছে। গ্রিন টি। প্রতিটি চুমুকে দেহে জাগছে উষ্ণ সজীবতা, মনটাও হয়ে উঠছে ঝরঝরে, উৎফুল্ল। চা শেষ করে আনন্দচিত্তে বেরিয়ে এল ক্যানটিন থেকে। নিজের রুমে ঢুকে মনোযোগ দিল কাজে।
দুই
মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিল শান্তা। ফাইনান্সিয়াল রিলিজের একটা ফাইল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। হঠাৎ পিপ্ পিপ্ শব্দে জ্বলতে শুরু করেছে টেবিলে সেট করা ইন্টারকমের লালবাতি। সে বুঝতে পারল, এটা বসের কল। রিসিভার তুলে দৈনন্দিন কাজের অংশ হিসেবে সম্বোধন করল, স্যার!
অপরপ্রান্ত থেকে স্বাভাবিক গলায় মোহসিনুজ্জামান চৌধুরী, চিফ এক্সিকিউটিভ, জানতে চাইলেন, ফাইনান্সিয়াল রিলিজের ফাইলটি কি দেখা হয়েছে, আপনার?
স্যার। দেখা প্রায় শেষ। আরও পাঁচ মিনিট সময় লাগবে।
ওকে। মনোযোগ দিয়ে দেখে নিন। পাঁচ মিনিট পর ফাইলসহ আমার রুমে চলে আসুন।
জি স্যার। আসছি।
বসের স্বরে কোনো পরিবর্তন নেই। দৈনন্দিন অফিস- কাজের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এটি। যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো কর্মকর্তাকে তার রুমে ডেকে পাঠান তিনি। কাজের অংশ হিসেবেই যেতে হয় সবাইকে।
অন্য রকম লাগছে আজ। বসের ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছে, দেহের মধ্যে দিয়ে ছুটে গেছে অদৃশ্য সোর্স থেকে ধেয়ে আসা বিদ্যুৎ-তরঙ্গ। পুরো শরীর নাড়িয়ে দিয়েছে তরঙ্গটি। মনের মধ্যেও ঢিল পড়েছে। উদ্বেগের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে দেহজুড়ে। মনেও জেগে উঠছে উৎকণ্ঠা, হীনম্মন্যতা। ফাইলের বাকি কাজে মন বসছে না। পাঁচ মিনিটের কাজ শেষ হতে লাগল প্রায় ১০ মিনিট। অন্য কোনো দিন এমন হয়নি। বস ডাক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেছে। আজ ছন্দপতন হয়েছে, অদৃশ্য বাধা আটকে রাখছে তাকে পেছন দিকে। এমন ঘটল কেন, বুঝতে পারছে না। কাঁপা হাতে ফাইলটি তুলে বুকের সঙ্গে সেঁটে নিজ কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল সে। বসের রুমে যাওয়ার পথের দুপাশে বসে আছে আরও কয়েকজন জুনিয়র কর্মকর্তা, আট-দশজন কর্মচারী। যাওয়ার পথে একবার মনে হলো সবাই তার দিকে তাকাচ্ছে। নার্ভাস লাগছে। কাঁপতে শুরু করল সে। সাহস করে একবার চোখ তুলে তাকাল একে একে সবার দিকে। না, কেউ দেখছে না তাকে। বসের রুমে ঢুকলেই কানুঘুষা করবে সবাই। ভাবনাটা আরও জড়োসড়ো করে ফেলেছিল। জড়তা কেটে গেছে এখন। সবার দিকে মাথা ঘুরিয়ে ভালো করে দেখে নিল শান্তা। সবাই যার যার কাজে মগ্ন। বসের কক্ষে তার যাওয়া নিয়ে কারও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হলো না। নুতন উপলব্ধি কিছুটা স্বাভাবিক করে দিয়েছে তাকে। নার্ভাসনেস কাটেনি, তবুও হেঁটে গেল দৃঢ় পায়ে। সরাসরি ঢুকে গেল বসের রুমে।
চিফ এক্সিকিউটিভ মোহসিনুজ্জামান মাথা তুলে তাকালেন শান্তার দিকে। তাকিয়েই চমকে উঠলেন। আচমকা বলে বসলেন, একি! আপনাকে এমন লাল লাগছে কেন? কোনো সমস্যা?
লাল শব্দটি তীরের মতো বিঁধে গেল বুকে। ছলকে মুখের পেশিতে বেড়ে গেল রক্তপ্রবাহ। আরও লালচে হয়ে ওঠল মুখ। বসের কথার জবাব খুঁজে পেল না শান্তা।
প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে উত্তরের অপেক্ষা করলেন না মোহসিনুজ্জামান। আবার প্রশ্ন করলেন, এত দেরি হলো যে? অসুস্থ বোধ করছেন?
উত্তর দেওয়া জরুরি। উত্তর দিতে পারছে না। বসের দিকে ফাইলটা বাড়িয়ে দিয়ে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে রইল শান্তা।
মোহসিনুজ্জামান আবার মুখ তুলে তাকালেন তার দিকে। নিজে থেকে বললেন, আজ অন্য রকম লাগছে আপনাকে। নিশ্চয় অসুস্থ বোধ করছেন। আগেভাগে বাসায় চলে যাবেন। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। ফাইলটা দেখে নিই। কোনো কোয়ারি থাকলে বুঝিয়ে দিতে হবে আমাকে। বসুন, চেয়ারে বসুন।
বসের সামনে কখনও চেয়ারে বসতে হয় না শান্তার। আজ বসতে বলেছেন তিনি। বসতে বাধ্য হয় সে। এসি রুমেও ঘেমে যাচ্ছে। ফয়সাল খানের কথাটি মনে পড়ে গেল, ‘আপনি মহিলা, তার ওপর সুন্দরী, আপনাকে নিয়ে যদি বসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা কেউ বলে, খারাপ লাগবে না?’ ‘যখন-তখন বসের রুমে একা যাবেন না আপনি। আপনার একা যাওয়াটা পছন্দ করে না কেউ।’ ঝোড়ো গতিতে মনে ঢুকছে এসব কথা। ঝোড়ো গতিতে বদলে যাচ্ছে মুড। অজানা সংকোচ ও নার্ভাসনেস বেড়ে গেছে কয়েক গুণ বেশি। কানও গরম হয়ে গেছে। দেহের ভেতরে তীব্র কম্পন হচ্ছে। সুবিধা এই যে এই কম্পন দেখা যাচ্ছে না বাইরে থেকে।
চুপচাপ বসে আছে শান্তা। মনের ঘরে ঝড় চললেও তাকিয়ে আছে বসের মুখের দিকে। মগ্ন হয়ে ফাইল দেখছেন তিনি। কাজ-পাগল লোকটার আচরণে ও কথায় কখনও কোনো ধরনের নোংরামি দেখেনি সে, আজও দেখছে না। অথচ ফয়সাল খানের কয়েকটি কথার কারণে এমন বিপ্লব ঘটে গেল কেন নিজের দেহ-মনে, বুঝতে পারল না শান্তা। বিজ্ঞানের কোন ঘুঁটির টানে ঘটছে এমনটি, বোঝার মতো জ্ঞান না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হলো না ফয়সাল খানের পরচর্চা ‘ঢিল’ হিসেবে আক্রান্ত করেছে মস্তিষ্ক। পরনিন্দাটা অযৌক্তিক এবং তা ফয়সাল খানের মনগড়া কাহিনি জেনেও সামলাতে পারছে না নিজেকে। এটা নিজের ব্যর্থতা, ব্যক্তিত্বের ত্রুটি; বুঝতে পারছে শান্তা।
চিন্তার জগতে বাধা পড়ে। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে মোহসিনুজ্জামান বললেন, থ্যাংকস শান্তা। ফাইলটা চমৎকার করে গুছিয়েছেন আপনি। সহজবোধ্য হয়েছে। কোথাও ত্রুটি ধরা পড়েনি আমার চোখে। আবারও ধন্যবাদ আপনাকে।
এত প্রশংসা শুনে লজ্জা পেল শান্তা। তারপরও দাঁড়িয়ে গেল নিজের ব্যক্তিত্বের ভিতের ওপর। নরম কণ্ঠে বলল, ওয়েলকাম স্যার।
শোনেন। আজ আপনার ছুটি। আগেভাগে বাসায় চলে যেতে পারেন। দেখে অসুস্থ লাগছে আপনাকে। অফিসে ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে হলে ফিটনেসের বিকল্প নেই।
শান্তা চট করে বলে বসল, আমাকে আনফিট মনে হচ্ছে আজ, স্যার?
চূড়ান্ত ফিটনেস দেখিয়েছেন কাজে। তবে শারীরিকভাবে অন্য রকম লাগছে। এটা ঠিক আনফিটনেস না, আবার স্বাভাবিকও না। বলে হেসে ওঠলেন মোহসিনুজ্জামান।
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল শান্তা।
মোহসিনুজ্জামান আবার বললেন, ফয়সাল খান সাহেবের টেলিফোন এনগেজড, ইন্টারকমও রেসপন্স করছে না। ফাইলটা ওনার কাছে দিয়ে বলুন সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে দিতে।
ফাইলটা ফেরত নিয়ে শান্তা বলল, থ্যাংক ইউ, স্যার।
ওয়েলকাম বলে মোহসিনুজ্জামান অন্য কাজে মন দিলেন। ওই কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল শান্তা। দরজার দুদিকে তাকাল; কেউ তাকিয়ে নেই তার দিকে। সবাই কাজে মগ্ন। ফয়সাল খানের কথার সত্যতা খুঁজে পেল না সে। কনফার্ম হলো, অনেক মনগড়া কথা বলেন ফয়সাল খান। অন্যের রেফারেন্স দিয়ে পরনিন্দা করা ওনার বৈশিষ্ট্য। এ রকম লোকের কথার খোঁচায় আহত হওয়া ঠিক নয়। এ ধরনের কথা উপেক্ষা করতে হবে, রিঅ্যাক্ট করা চলবে না। রিঅ্যাকশন হলে পারফরম্যান্স কমে যাবে। বসের চোখে ধরা পড়বে। ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ তৈরি করা উচিত হবে না- ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেল সামনে।
ফয়সাল খানের কক্ষের দরজা খোলা। দরজায় ঝুলছে ভারী পর্দা। পর্দা সরিয়ে রুমের ভেতর তাকিয়ে শান্তা দেখল, ফোনে কথা বলছেন তিনি। রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে কথা বলছেন। মুখে ছড়িয়ে আছে বিগলিত হাসি। পুরুষের মুখের এমন হাসির অর্থ বোঝে সুন্দরী শান্তা। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে এমন গলানো হাসি লেগে থাকে পুরুষের মুখে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সে দেখল দৃশ্যটা। ফয়সাল খান এ জগতে নেই। তিনি ডুবে গেছেন বায়োলজিক্যাল রিঅ্যাকশনের ঘোরে। এ প্রতিক্রিয়ায় টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে নিশ্চিত কথা বলছে এক তরুণী। কিছুটা সময় নিয়ে শান্তা উচ্চ স্বরে বলল, এক্সকিউজ মি। আসতে পারি?
শান্তার গলার স্বর শুনে চমকে ওঠলেন ফয়সাল খান। চমকানোর সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে প্রায় ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল রিসিভার। রিসিভারটি সেটের ওপর রাখতে রাখতে বললেন, ইয়েস। কাম ইন প্লিজ।
একদম নির্মোহ শান্ত স্বরে শান্তা বলল, বেশ কিছুক্ষণ স্যার চেষ্টা করছিলেন আপনাকে কানেক্ট করতে। আপনার ইন্টারকম রেসপন্স করছে না। টেলিফোন দীর্ঘক্ষণ এনগেজড পেয়েছেন স্যার। এজন্য ফাইলটি নিয়ে আপনার রুমে পাঠিয়েছেন আমাকে।
দীর্ঘক্ষণ আমাকে কানেক্ট করার চেষ্টা করেছেন, স্যার?
হ্যাঁ। তাই তো বললেন।
সর্বনাশ!
সর্বনাশের কিছু হয়নি। ফাইলটা নিন। এটার নীতিমালা বাস্তবায়নের ব্যাপারে জরুরি অ্যাকশন নিতে বলেছেন।
আর কিছু বলেছেন?
না। আর কী বলবেন? ফোনে পেলে হয়তো ওনার কক্ষে ডাকতেন আপনাকে। কানেক্ট করতে পারেননি। তাই আসতে হলো আমাকে।
আপনি গিয়েছিলেন স্যারের রুমে?
হ্যাঁ।
ফাইলটা রেখে ফিরে যাচ্ছিল শান্তা।
ফয়সাল খান বললেন, থ্যাংক ইউ।
জবাবে ওয়েলকাম না বলে শান্তা বলল, স্যারের রুমে ঢোকার সময় কিংবা বেরোনোর সময় স্টাফদের দিকে ঘুরেফিরে দেখেছি। কেউ আমার দিকে তাকায়নি। কেউ কানুঘুষা করেনি। আমাদের কোনো স্টাফের মনে কোনো ধরনের নোংরা চিন্তা আছে বলে মনে হয়নি।
কথা শেষ করে বেরিয়ে আসে শান্তা। নিজের কক্ষে ফিরে কল করল ইকবালকে।
কী ব্যাপার, অফিসের সিনসিয়ার কর্মকর্তা কি ফাঁকি দিচ্ছে অফিস আওয়ার! ইকবালের কণ্ঠে বিস্ময়।
না। ফাঁকি দিচ্ছি না। ভালো কাজের উপহার হিসেবে আগেই ছুটি পেলাম আজ। কোথায় তুমি? সময় দেবে? বিকেলটা কাটাতে চাই তোমার সঙ্গে।
খুশি হয়ে ইকবাল বলে, এনগেজমেন্টের পর এটা আমার কাছে তোমার প্রথম দাবি। এটা কি উপেক্ষা করা যায়?
থ্যাংক ইউ। কোথায় দেখা করব?
তুমি কোথায় দেখা করতে চাও? উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জানতে চায় ইকবাল।
তুমিই তো একবার নিতে চেয়েছিলে অ্যাট্রিয়াম রেস্তোরাঁয়। নেবে সেখানে?
ওয়াও! সোল্লাসে লাফিয়ে উঠল ইকবাল। অ্যাট্রিয়ামকে মনে হয় সমুদ্রসৈকতের কোলঘেঁষা একটি ছোট প্রাসাদ। বাংলোও মনে হয়। চলো, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই। সমুদ্রসৈকতের পরিবর্তে শহুরে প্রকৃতির ভেতর থেকে ডুব দিয়ে আসি। এখনই আসছি তোমার অফিসের সামনে। আমিই ড্রাইভ করব, রাইট?
আসো। অপেক্ষা করছি।
তিন
অ্যাট্রিয়ামে ঢোকার মুখে রয়েছে সুন্দর বাগান- নানা রকম গাছগাছালিতে ভরা বাগানে ঢুকে চমকে গেল শান্তা। বাগানের মধ্যে রয়েছে আস্ত এক বাঁশঝাড়। আছে বৈচিত্র্যময় ফার্নও। সৌন্দর্য ছুঁয়ে গেল শান্তাকে, মুগ্ধতায় ডুবে গেল সে। ইট-পাথরের শহুরে সভ্যতার ভেতর সজীব এক ওয়েসিনে যেন ঢুকে পড়েছে তারা। জলাধারে খেলা করছে নানা প্রজাতির মাছ। জলের ভেতর রয়েছে বসার ব্যবস্থাও। অ্যাট্রিয়ামের সবচেয়ে আকর্ষণীয় রং হচ্ছে কালো। গার্ডেনের চেয়ার-টেবিল থেকে শুরু করে কাঠের সিঁড়িটাও কালো রঙের। অ্যান্টিক ধরনের পেনড্যান্ট লাইটগুলো সিঁড়ি থেকে ঘর পর্যন্ত থরে থরে সাজানো। ছোট ছোট ছয়টি কালো রঙের টুলের সেন্টারে রয়েছে একটি গোলাকার কালো টেবিল। ঝোঁপের আড়ালে এই জায়গাটি বেছে নিল দুজনে। বসে খাবারের অর্ডার দিল ইকবাল। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে এল চিকেন উইংস ও থাই স্যুপ। মেইন কোর্সে অর্ডার দিয়েছে তন্দুরি পম্ফ্রিট (সামুদ্রিক মৎস্যবিশেষ)। চিকেন উইংয়ে কামড় বসানোর সঙ্গে সঙ্গে শান্তার চোখ গেল সামনের ঝোঁপের আড়ালে অন্য একটি বসার স্থানে। সেখানে দক্ষিণ মুখে বসে আছেন তার কলিগ, বিবাহিত ফয়সাল খান। তারই সামনে উত্তরমুখী হয়ে বসে আছে অচেনা এক তরুণী। ধোঁয়া-ওঠা মাছের ম-ম করা সৌরভ ভেসে আসছে তাদের টেবিল থেকে। কে এ মেয়ে? প্রশ্ন ঢুকল শান্তার মাথায়। নিশ্চয় ফয়সাল খানের স্ত্রী নয়। স্ত্রীকে চেনে সে। সঙ্গে সঙ্গে জয়নাল সাহেবকে নিয়ে ফয়সাল খানের বলা সেই কথাটি মনে পড়ে গেল, ‘কে কী অপকর্ম করছে, জানি না আমি? সব জানি। জয়নাল সাহেব প্রায় অফিসের ফোন এনগেজড রাখেন। সুযোগ পেলেই কথা বলেন এক কচি মেয়ের সঙ্গে, অফিস ছুটির আধ ঘণ্টা এক ঘণ্টা আগে বেরিয়ে যান। একসঙ্গে ঘুরে বেড়ান।’ শান্তা বুঝতে পারল, নিজের গোপন কথা জয়নাল সাহেবের ওপর প্রজেক্ট করেছেন ফয়সাল খান। অন্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে দিয়েছেন নিজের অপকর্মের নমুনা। নিজের অপরাধবোধ, হীনম্মন্যতা, অপ্রীতিকর অনুভূতি অন্যের ওপর আরোপ করে নিজেকে অবচেতনভাবে দায়মুক্ত রাখতে চেয়েছেন ফয়সাল খান। শান্তা বুঝতে পারল মনোজগতের ইগো-ডিফেন্সের প্রক্ষেপণ কৌশলটি সাময়িক যাতনা থেকে মুক্তি দিলেও ভুল পথে টেনে নিয়ে যেতে পারে মানুষের মূল্যবোধ। তার জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছেন ফয়সাল খান। ফয়সাল খানের এই বৈশিষ্ট্য বোকা বানিয়ে দিল শান্তাকে। বোকার মতো তাকিয়ে রইল সেই তরুণীটির দিকে।
ইকবাল বলল, কী দেখছ এমন করে?
শান্তা বলল, দেখছি, রূপের আড়ালে বহুরূপী মানুষ।
মানুষ যদি বুঝত নিজেকে, সে হয়ে যেত বড় মানুষ, উত্তম মানুষ। মানুষ তো বহুরূপী হবেই। না বুঝে জবাব দিল ইকবাল।
শান্তা বলল, ঠিকই বলেছ। তবে উত্তম মানুষ হতে না পারলেও আগে মানুষ তো হতে হবে আমাদের, তাই না?
ইকবাল বলল, মানুষ হওয়ার সাধনা বাদ দাও। এসো এখন স্বাদ নিই তন্দুরি পম্ফ্রিটের। এই দেখো এসে গেছে সুস্বাদু পম্ফ্রিট।
তন্দুরি পম্ফ্রিটের দিকে তাকাচ্ছে না শান্তা। ইকবালের কথায়ও মনোযোগ দিচ্ছে না, তাকিয়ে আছে সামনের ঝোপের দিকে। শান্তার মনে হলো, ফয়সাল খান সামনে নিয়ে বসে আছেন অষ্টাদশী এক জীবন্ত পম্ফ্রিট। সুযোগ বুঝে মজা কুড়িয়ে নেবেন তিনি তাজা পম্ফ্রিটের।
গল্পটি বেশ ভালো লাগলো।সরল ভাবে বলে গেছেন লেখক।এক ধরনের পাঠককে ধরে রাখবে সন্দেহ নেই।ধন্যবাদ সম্পাদক মহোদয়কে।
বেশ ভালো লাগলো গল্পটি। শিক্ষণীয়।
গল্পটি মনোযোগসহকারে পড়লাম। কারণ, মোহিত ভাইয়ের লেখা অনেক আগে থেকেই পড়ি এবং গল্পের ভেতরে মনস্তাত্ত্বিক জটিল বিষয়গুলো খুঁজতে চেষ্টা করি। এই গল্পটিতে প্রক্ষেপিত হয়েছে একজন দুশ্চরিত্র লোকের মনোজগতের কামপ্রবৃত্তিও কুৎসিৎ রূপ। মেয়েটিকে নিজের ভোগের সামগ্রী বানানোর জন্য বসের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিল। এ-ধরনের চরিত্র বলতে গেলে আমাদের প্রায় অফিসেই পাওয়া যাবে যার কদাকার রূপ দেখা যায়।