অণুগল্প

অণুগল্প।। অতৃপ্ত আত্মা।। তোফায়েল হোসেন

ক্রিংক্রিং শব্দে টেলিফোন বেজে চলছে। অন্ধকারে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সোডিয়াম আলো জানান দিচ্ছে রাত ১.৩০ মিনিট। এত রাতে কে তাকে ফোন করবে? রিসিভার তুলবে কি তুলবে না ভাবতে ভাবতেই লাইনটা কেটে যায়। পাশ ফিরে ঘুমুতে যাবে এমন সময় আবারো ক্রিংক্রিং শব্দে টেলিফোনটা বেজে উঠলো, রিসিভার তুলে কানের কাছে রাখতেই মনে হলো পরিচিত একটা কন্ঠস্বর, কিন্তু কে সে তা মনে করতে পারছেনা। ওপাশ থেকে আস্তে করে বলে উঠলো
-হ্যালো
-আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?
-কেমন আছেন?
-ভাল আছি, কিন্তু আপনি কে?
-আমি? আমি বলেই হা হা হা হেসে উঠলো কিন্তু নাম না বলেই প্রশ্ন করলো এত রাতে ফোন দিলাম, খুব ডিস্টার্ব করে ফেললাম মনে হয়?
-আপনি কিন্তু আমার কথার জবাব দেননি
-আজ বাইরে খুব সুন্দর আবহাওয়া, সুন্দর পরিচ্ছন্ন আকাশ
-এসব বলার মানে কি?
-কোনও মানে নেই, আজকের আকাশ দেখেছেন?
প্রশ্ন শুনে আনিকা মনেমনে ভাবতে থাকে একোন পাগল? মধ্যরাতে এমন ভাবুকের মত প্রশ্ন করে? প্রথমে বিরক্ত হলেও এখন মন চাচ্ছে একটু দুষ্টুমি করে বাজিয়ে দেখতে, লোকটি কি বলতে চায় তা শুনতে।
-না আকাশ দেখিনা বহুদিন, আমার আকাশ মেঘে ঢাকা তাই এখন আর আকাশ দেখতে ইচ্ছে করে না।
-ইচ্ছে হলে জানালা খোলে আজকের চাঁদ দেখতে পারেন, ভালো লাগবে। আজ কিন্তু পূর্ণিমারাত
-হোক পূর্ণিমারাত তবুও চাঁদ দেখবো না
-একসময় তো চাঁদ রাতে মুগ্ধ হয়ে আকাশ দেখতেন তারা দেখতেন, বাড়ির সামনে হাস্না হেনা বাগান কি এখনো আছে?
-চাঁদে কলংক আছে তাই চাঁদ দেখিনা আর আমার জোনাকিরা এখন আর আলো দেয় না।
-ইশ্ এমন করে বলছেন যেন ওসব এখন পুরনো এনার্জি বাল্ব এর মতো আলো কম দেয়া শুরু করেছে। একথা শুনে আনিকার খুব হাসি পেলো, আনিকা বললো, হয়তো তাই হবে। আপনি বুঝি আকাশ, চাঁদ, ফুল, পাখি খুব ভালোবাসেন?
-হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। প্রচন্ড ভালোবাসি।
-কিন্তু আপনি কে? আমাকে কিভাবে চেনেন? আমাকে কতটুকু জানেন আর আমার টেলিফোন নম্বরই কোথায় পেলেন?
-সে অনেক লম্বা কথা। এখন বলুন কেমন আছেন?
-ভালো থাকা আর হলো কোথায়? এত রাতে ফোন দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিলেন
-ও ও ও সরি, অনেকদিন থেকে ভাবছি আপনার সাথে কথা বলবো কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি কিন্তু আজকে আর নিজেকে বারণ করতে পারিনি তাই ফোন দেয়া। আপনার ডাক্তারী পেশা কেমন চলছে?
-এই তো চলছে কিন্তু আপনি আমার সমন্ধে এত কিছু কি করে জানেন?
-এত কিছু আর কোথায় জানলাম? আপনার হাসবেন্ড কেমন আছে?
প্রশ্ন শুনে মনের অজান্তেই হিহিহি করে হেসে উঠলো, হাসি যেন আর থামতেই চাচ্ছে না। হাসতে হাসতে দুচোখ পানি এসে গেলো, কন্ঠস্বর যেন কেউ চেপে ধরেছে, এই হাসি শুনে টেলিফোনের অপর পাশে থাকা নিলয় অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। নিলয় বলে উঠলো-
এভাবে হাসছেন কেন? আমি কি হাসির কোন কথা বলেছি?
প্রশ্ন শুনে আনিকা নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দিলো, আসলে তা নয়, বিয়ে করলে তো হাসবেন্ড থাকবে আর তারপরই তো ভালোমন্দের হিসেব।
-ওওও! কেন? প্রখ্যাত ডাক্তার অরবিন্দকে তো আপনি পছন্দ করতেন এবং তার সাথেই আপনার বিয়ের কথা চলছিলো শুনেছিলাম।
-না, সে বিয়েটা আমি ইচ্ছে করেই ভেঙে দিয়েছি। আর তাকে আমি কখনো পছন্দ করতাম না।
-তাহলে আপনি কি কাউকে পছন্দ করতেন?
এবার যেন বুকে তীক্ষ্ণ ছুরি দিয়ে আস্তে আস্তে কেউ হৃদয়টা কেঁটে নিয়ে যাচ্ছে। সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, কে এই ভদ্রলোক যে আমার ব্যাপারে এত কিছু জানে কিন্তু নিজের পরিচয় দিচ্ছে না। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে, যেন বমি করে ভাসিয়ে দেবে কারাগার নামের অসহ্য পৃথিবী। কয়েক সেকেন্ড পর নিজেকে ধাতস্থ করে আনিকা বলে উঠে, হ্যাঁ ভালোবাসতাম বললে ভুল হবে, কাউকে আমি ভালোবাসি আর তাইতো এখনো সংসার সাজানো হয়নি।
-আপনি এখনো তার অপেক্ষায় আছেন? তাকে তো আপনি কটাক্ষ ফিরিয়ে দিয়েছেন, তাকে ঘৃণা করেন এবং ছোটলোক বলে অপমানও করেছেন। তাকে যদি এত ভালোবেসে থাকেন তাহলে সেইদিনের পর আর কোনদিন খোঁজ নিয়েছেন? সে কেমন আছে? কোথায় আছে?
-না তার কোন খোঁজ পাইনি, তাকে অনেক খোঁজেছি, তারই অপেক্ষায় আমার সময় কাঁটে। জানি একদিন সে ফিরে আসবে আমার কাছে, শুধু ভালোবাসার টানে।
একথা শুনে অপর পাশ থেকে হো হো হো হা হা হা অট্টহাসি ভেসে আসে। আর এই হাসিটার সাথে আনিকা বেশ পরিচিত। আনিকা প্রশ্ন করে-
-আপনি কে?
-আমি কেউ না, আমি এক অতৃপ্ত আত্মা। যে ভালোবাসাহীন মরে গেছে গতকাল। ইচ্ছে হলে আপনার সেই নির্লজ্জ ভালোবাসার মানুষের খোঁজ নিতে পারেন।
-কিন্তু কিভাবে নেবো? তার যে কোন ঠিকানাই আগের মতো নেই
-ও সত্যিই তো! তার তো এখন আর কোন ঠিকানা নেই! ইচ্ছে হলে তার পুরনো ঠিকানার টেলিফোনে খোঁজ নিতে পারেন এবং পেয়েও যেতে পারেন, একথা বলে অপর পাশে একদম চুপচাপ। আনিকা একথা শুনে বিস্ময়ে, খুশিতে বলে উঠল আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এখনি ফোন দিচ্ছি বলে রিসিভার রেখে দিলো। এরই মধ্যে দেয়াল ঘড়িতে রাত তিনটে বাজায় ঢংঢং করে শব্দ হলো। আনিকার ঘুম ভেঙে গেলো, তার শরীর কাঁপছে। বুঝতে পারলো এতোক্ষণ সে কারো সাথে কথা বলেনি, ও শুধু স্বপ্ন দেখেছে। টেলিফোনের রিসিভার কানে ধরে নম্বর ডায়াল করলো….
আর অপর পাশ থেকে যে রিসিভ করলো তার কথা শুনে এক মুহুর্তেই জ্ঞান হারালো আনিকা।

One thought on “অণুগল্প।। অতৃপ্ত আত্মা।। তোফায়েল হোসেন

  • সাহানা আক্তার বানু

    খুব সুন্দর।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *