ছোটগল্প

ছোটগল্প।। সফ্টটয়।। প্রত্যূষা সরকার

শহর নির্মাণের পর সেখানেই শেষ যুদ্ধ, শেষ রক্ত, শেষ কারাবাস। তারপর সমস্তটাই সন্ন্যাসীর কবিতা। কবিতার অক্ষর ঘুমন্ত পৃথিবীর বিছানায় ছোটো ছোটো মেঘ পুঁতে যায়। ওরা বড়ো হয় কী না, নাগরিক খোঁজ রাখে না।

মিতালি আজ সন্ধেবেলা শ্মশান থেকে ফিরছে, এমন সময় শুকনো পাতার আনুষ্ঠানিক আয়োজনে সে খুঁজে পায় দুটো ছোটো ছোটো হাত। বুকটা ফাঁকা হয়ে আসে। স্তন ঘেঁষে গন্ধ নেয় বছর দশের সপ্তক। মিতালির আর একবার ভুল হয়ে যায়। ও-বাড়িতে ঢুকবে না ভেবেও গেট খুলে ফেলে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বারান্দা আর বারান্দায় ঝুলে থাকা ছোট্ট হাফপ্যান্ট। সপ্তক ক্লাস ফোরের স্টুডেন্ট। বাবা চিকিৎসক আর মা ওয়ার্ড কাউন্সিলর। পাড়া থেকে শহরে বেশ নামডাক এই মুখার্জী ফ্যামিলির। অবিনাশ মুখার্জী শুধু একজন নামকরা ডাক্তার নন, রাইটারও। শব্দ নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি তিনি ডাক্তারি চালান তিনটে নার্সিংহোমে। তাঁর স্ত্রী রুবি মুখার্জী বাড়ির পাশেই পার্টি অফিসে বসেন। তাঁর স্বপ্ন মুখ্যমন্ত্রীর পাশে গিয়ে গোটা দশেক সেলফি তুলবেন। সুন্দরী, চকচকে, ফিটফাট ও ঠিকঠাক বাংলাটা আসে না এরকম ব্যক্তিত্ব এ শহরে যদিও একটা নয় তবুও তিনি সবার থেকে আলাদাই। ফসকে গেল হাত থেকে মোবাইলটা, মিতালির বাবা তাকে এই ছোট্ট ফোনটা পাঠিয়েছিল সে এখানে আসার আগের দিন। মা ছিল না মিতালির। বাবাকে মিথ্যে চুরির দায়ে ওর কাকিমা জেলে পুরেছিল, মিতালি তখন চার বছরের। তারপর জেল থেকে বেরিয়ে আর একটা বিয়ে করে ওর বাবা। তখন থেকেই অত্যাচার। সৎ মা জোর করে প্রতি রাতে ওকে কাকার ঘরে পাঠাতো। কাকিমাও জানতো। আসলে সমস্তটাই সম্পর্ক বোঝার ভুল, শুধু শিক্ষার অভাব নয়। ভারতবর্ষের চল্লিশ শতাংশ রেপ হয় বাড়ির ভিতরেই।

নুন আনতে পান্তা ফুরানো একটা সংসারে এভাবে অস্থায়ী হয়ে স্থায়ীত্বের দায় আর নিতে পারছিল না মিতালি। পশ্চিম বর্ধমানের একটা গ্রাম বনকাটি, সেখান থেকে রাতের অন্ধকারে জামাইবাবুর হাত ধরে সোজা নদীয়ায় চলে এসেছিল মিতালি। তারপর তাকে কাজ দেওয়ার নাম করে বিক্রি করা হয়েছিল এক মুসলমান ফকিরের কাছে। সেখানে মিতালি সরকারের নাম হয় নাজরিন। সন্ধেবেলা মদের ঠেকে নাচ করে তার রোজের ইনকাম। এসব আর সহ্য হচ্ছিল না। এই অবস্থায় সেই ফকির তাকে তার দরবার থেকে বের করার ব্যবস্থা করে। পাঠিয়ে দেয় পলতায়। সুতোর কলে কাজ পায় মিতালি। সেখানেই তার পরিচয় স্বপন ব্যানার্জির সঙ্গে, সে তাকে নিয়ে এসেছিল এই মুখার্জী পরিবারে পরিচারিকার কাজে। হাতে একটা ছোট্ট ফোন, গায় চুড়িদার , আর মাথায় লাল ফিতে। আঠারো পেরিয়ে উনিশে তখন মিতালি।
সপ্তককে দেখেই হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়। কী অদ্ভুত ভাব সেই মুখটায়, মিতালির চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মনে হয় আবার কোনও রং-রুটে ঢুকে পড়েছে সে। মিতালিকে দেখেই সপ্তক নাম জিজ্ঞেস করে। খুব সুন্দর করে ভেঙে নামটা উচ্চারণ করে “তুমি আমার মিতু… আমার মিতু দিদি”। মিতালির চোখে জল আসে।

ভোর ছটা থেকে রাত দশটা মিতালির কাজ। তারপর সপ্তকের মা ফিরে এলে মিতালি সিঁড়ির নীচে শুতে চলে যায়। বাকি দিন ওকে খাওয়ানো, স্নান করানো, স্কুলের জন্য রেডি করা, স্কুলে দিয়ে আসা, ঘুম পাড়ানো এসব করেই তার সময় চলে যায়। দুজনের বন্ধুত্ব এক মাসের মধ্যেই বেশ মজবুত হয়। সপ্তকও খুঁজে পায় নতুন বন্ধু মিতু দিদিকে। প্রায় তিন মাস পর সপ্তকের ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোয়। স্কুল থেকে গার্ডিয়ান কল, এই প্রথমবার। মিসেস মুখার্জীকে আসলে ভয় কেউ ঘাঁটাতে চাইত না। তবে এ বিষয়টা বলতেই হবে। রেজাল্ট খারাপ নয়, ভালো থেকে একেবারে খারাপ হলে শিক্ষক মহলে ভয়ের ছাপটা আরও বেশি ছড়িয়ে পরে। বিকেল চারটেয়ে মিসেস মুখার্জী স্কুলে পৌঁছান, সেখান থেকে বেরোতে প্রায় পাঁচটা বাজে। এই এক ঘন্টার পর তাঁর জীবনে প্রথম ঝড় আসতে শুরু করে। তিনি খুঁজে পান না শিক্ষকদের কথার আলটিমেট অর্থ, অথবা তিনি খোঁজার বা বোঝার চেষ্টাই করেন না। ভুলের পর ঘটে যায় আর একটা ভুল। নালিশটা এড়িয়ে গিয়ে সপ্তককে স্কুলছাড়া করে ওর মা। তারপর ডোনেশন দিয়ে ভর্তি করে অন্য আর একটা স্কুলে, বলতে পারা যায় শহরের টপ গ্রেডেড স্কুল এটাই।

সপ্তকের খাওয়াতে গাফিলতি ইদানিং। মিতু ছাড়া আর কারও সাথেই জমে না তার। মা এসে দেখতে পায় সপ্তক ঘুমাচ্ছে দিব্যি। মা যেই চলে যায়, কোলবালিশের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে স্মার্টফোন। ওর বাবা এবার জন্মদিনে এটা গিফ্ট করেছে ওকে। মা জানে, মিতু এসে সপ্তককে পাহারা দেয় রোজ রাতে। তাই ওর ঘরে আর মাকে ঢুকতে হয় না। শহরে আলো জ্বলে থাকে। ঘরগুলো অন্ধকার। কখনও বা মিতুর কান্না ছাপিয়ে যায় আর্টিফিসিআল গাছপালা, দরজা, আসবাব। মাঝেমাঝে ইন্ভার্টারের চার্জিং সাউড আর কখনও বা আরামের গোঙানি। একটা দশ বছরের শিশু কখন পুরুষ হয়ে যায় সে কথা শুধু মিতু জানতো। দশ-উনিশের ভেজা কার্নিশে, গলতে থাকে থোকায় থোকায় বরফ। “মিতু দিদি, ওই গল্পটা একবার শোনাও না, তোমাকে কীভাবে নষ্ট করা হয়েছিল। আচ্ছা নষ্ট আর রেপ কি একই? তাহলে ব্লু-ফিল্মের মতন? সব দেখেছিলো তোমার? ওই উঁচু উঁচু বুকটা… একবার হাত দেব? কী নরম!” মাত্রা বাড়ছিল ক্রমশ। স্কুল থেকে ফিরে সপ্তককে জামা ছাড়ানোর পর ওর একটা একটা চুলে লম্বা লম্বা নখের আদর। ছোট্ট বুকে তীব্র ঠোঁট। খেলনা গাড়ি থেকে বেরোতো ছোটো ছোটো পুতুল। মিতু আস্তে আস্তে বলতো, “এই ছেলেটা এই মেয়েটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে আদর হয়, প্রেম হয়”। সপ্তক বারবার সেই গল্পটা শুনতে চাইতো। মিতু বলেই চলতো ওর আগের জীবনের কথা। সপ্তক যখন বলতো, “আমায় আর বোলো না, কেমন কষ্ট হয় শুনলে, মাকে না বলতে পারলে পড়াশোনা করতে পারবো না। সারাক্ষণ মনে পড়ে এসব।” মিতু ফিসফিস করে ওর কানের সামনে ঠোঁট লাগিয়ে বলতো, “মাকে বললে, তুই আমার সাথে কী কী করেছিস, সব কিন্তু বলে দেবো। একদম চুপ। তুই শুনতে চাস তাই বলি, নইলে বলবো না। কে খেলে তোর সাথে দেখবো।”

সত্যিই তো সপ্তকের ইন্টারেস্ট বেশি। মিতুর প্রথম দিন থেকে এই কথাগুলো ওর মনে আরও আগ্রহ বাড়ায়। গল্প মানে গোয়েন্দা নয়, ফেয়ারি নয়… এই টেইলস্ জীবনের টেইলস্। মিতুর না লেখা উপন্যাস। দিনের পর দিন একজন বন্ধু খুঁজেছে মিতু। এতদিন পর সপ্তককে পেয়েছে সে। বাৎসল্য জড়তা কাটিয়ে ওকে যৌবনের গন্ধ দিতে পারছে সে। উগলাতে পারছে সমস্ত মনখারাপ। সপ্তক রোজ রাতে তিন থেকে চারটে পর্ণ সাইট ঘাঁটে। স্কুলের এইট-নাইনের ছেলেদের সাথে স্কুল গেটের পিছনে বসে সিগারেট খায়। আগের স্কুলে, ফিজিকাল এডুকেশন ক্লাসে ওর সেকশনের একটা মেয়ের স্কার্ট তুলে দেখেছিল জোর করে। সি.সি.টি.ভি. ফুটেজকে উপেক্ষা করে, ‘সামান্য দুষ্টমি’ করে ফেলার ভাবনায় ওর মা বিষয়টাকে চেপে যায়। তবু অন্যমনস্ক হলেই ঘটনার হদিস সে খুঁজে পায় না।

রাত্রিবেলা ডিনার পার্টি ছিল সেদিন। বাড়ি ভর্তি লোকজন। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস মুখার্জীর চোদ্দ বছর অ্যানিভার্সারি চলছিল। মিতু সবাইকে সার্ভ করতে করতে চার পেগ ভদকা গলায় ঢেলেছে। আজ মিতু একটা লাল টুকটুকে ফ্রক পড়েছে। সপ্তক এবার পুজোতে নিজে পছন্দ করে মাকে দিয়ে কিনিয়েছে এই জামাটা। নেশা চড়ার পর সে সপ্তককে নিয়ে যায় সিঁড়ির নীচে। সেখানে অন্ধকার, কেউ নেই। বুক থেকে জামা নামিয়ে আনে সপ্তকের। সপ্তককে এগিয়ে দেয় ওর টলটলে খোলা বুক। সপ্তক এদিক ওদিক তাকায়। তারপর চুষতে থাকে, যেমনটা সে লজেন্স চোষে। প্যাণ্টের ভিতর হাত ঢোকায় মিতু। টানতে থাকে ক্রমশ। ঠোঁট কামড়ে নেয় সপ্তকের। সপ্তক বুঝতে পারে সবটাই। এমনটাই করে ওরা রোজ দুপুরে, রাতে। তবে এতটা ব্যথা তো লাগে না। সপ্তক চিৎকার করে। মিতুকে ঠাস ঠাস করে মারতে থাকে ছোট হাতগুলো দিয়ে। চিৎকার পৌঁছায় না গোটা বাড়িতে। ডাইনিঙে তখন ডিস্কো মেজাজ। মিতু ওর পিঠ এগিয়ে দেয়। নিতম্বের ওপর মারতে থাকে সপ্তক। মেঝেতে শুয়ে পড়ে সপ্তককে কোলে নিয়ে। জামার নীচে ঢুকিয়ে নেয় সপ্তকের মাংসপিণ্ড। এই মুহূর্ত এবার প্রথম। সপ্তক ভয় পেয়ে যায়। মিতু স্বস্তি পায়না কিছুতেই। অত বড় হাঁ, এইটুকু মাংসের টুকরো পৃথিবী ওল্টাতে পারে না কিছুতেই। সপ্তকের এবার ব্যথা শুরু হয়, কোনও সিক্রেশন এই বয়সে বেরোনো সম্ভব নয়। টয়েলেট করে দিয়ে কাঁদতে থাকে এক নাগাড়ে। হঠাৎ সিঁড়ির নীচে পড়ে থাকা ভাঙা ফুলদানির পেছন দিয়ে আঘাত করে মিতুর মাথায়। আর নিশ্বাস পড়ে না।

দশ বছর কেটে যায়। ক্যালিফোর্নিয়ার আলোর রাত। হোস্টেলের ঘরে বসে সপ্তক দেখছে বালিগঞ্জের বারান্দা… শ্মশান থেকে হেঁটে আসছে মিতালি সরকার, সে মুসলমান এটা বলা বারণ ছিল দশ বছরের ছেলেটার। রক্ত মাখা হাফ প্যান্টটা দড়িতে এখনও শুকাচ্ছে। সপ্তক মুখার্জী আসামি, অপ্রমাণিত। অথচ শেষ হয়নি এখনও কারাবাসের মেয়াদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *