শিল্প-সংস্কৃতি

লেখমালা : ছোটকাগজ ছোট নয়, বেশ বড় জোবায়ের মিলন

ইদানিং ভালো একটি গল্প বা ভালো একটি কবিতা বা ভালো একটি মুক্তগদ্য অথবা প্রবন্ধ হাতের কাছে পাওয়া সহজ কথা নয়। ভালো কাজ হচ্ছে না তাও আবার নয়। পুরো সপ্তাহান্তে যে কয়েকটি ‘সাহিত্য সাময়িকী’ দৈনিকের সঙ্গে প্রকাশ পায় তার সবকয়টি হাতড়িয়েও একটি মনঃপুত রচনা পাওয়া দুষ্কর। এখানেও যে হচ্ছে না তাও কিন্তু বলছিনা। মাঝে মাঝে মুগ্ধতাও থাকে। তবে নগন্যতাকে উঁচিয়ে বলার কিছু আছে বলে মনে হয় না। ‘লিটলম্যাগ’-এ সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্র এখানে সুবিশাল, বলিষ্ঠ, মজবুত, পরিশীলিত। লিটলম্যাগের অবস্থাই-বা বর্তমানে কতটুকু সুখপাঠ্যের তা একটি প্রশ্ন। কতটি লিটলম্যাগ পাঠ করলে কতটি মানমম্পন্ন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, আলোচনা মনানন্দে ধরা দেবে তা কে বলতে পারে নিশ্চিত করে? আমাদের এখানে লিটলম্যাগের আন্দোলন আজকের বা গতকালের বা গতপরশুর নয়, সুদীর্ঘ সময়ের। এই সুদীর্ঘ সময়ে কতটুকু সমৃদ্ধ হয়েছে চেষ্টাগুলো? হাতে হাত রেখে এখানে লিটলম্যাগ আন্দোলন দিনকে দিন এগিয়ে চলেছে বটে, তবে গুণগত মান আর যৌলুশ নিয়ে এগিয়ে চলার সংখ্যাটা একেবারেই ছোট। চাইলে হাতে গুণে গুনে বলে দেয়া যাবে সংখ্যাটা। বাকি অনেকগুলোকে হেয় করার জন্য নয়, সত্য বলতে গিয়ে বলতেই হয় তারা তেমন ভালো করতে পারছে কই! এক্ষেত্রে চেষ্টার বা সীমাবদ্ধতার সীমা উৎরে যাওয়ার যে শ্রম নেই তা অন্তত বলা যাবে না। প্রায় নিয়মিতভাবে লিটলম্যাগ (বাজারের সব না হোক অধিকাংশ) পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কিছু কিছু ছোটকাগজ কাজের মাধ্য দিয়ে তার স্বাতন্ত্রিকতা, নান্দনিকতা ও বৈচিত্র্যের মাধ্যমে পাঠক হিসেবে আমার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। শুধু রঙের চাকচিক্য বাড়িয়ে ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রয় করা গেলেও পাঠকের কাছে কিন্তু সাহিত্যকে গছিয়ে দেওয়া যায় না। সু-পাঠক বা নিয়মিত পাঠক মুখ রক্ষার্থে দু’একটি অনুরোধ রাখলেও দিনশেষে গোজামিলকে সে ছুঁড়ে ফেলে আস্তাকুঁড়ে। সত্যিকার পাঠক অর্জন করতে চায়। চিমটি চিমটি করে বোধের বালু জমিয়ে নিজেরক ঝিনুকসম বানাতে চায়। তারা সমৃদ্ধ হতে চায়। তই বোধের মাণিক্য যেখানে থাকে পাঠক সেখানে ফিরে ফিরে আসে বার বার। ঠিক এমনই যখন অবস্থা, তখন পাঠ করলাম মন ও মননের ছোট কাগজ ‘লেখমালা’র ১০ম সংখ্যা।
মার্চ ২০১৯-এ প্রকাশিত সাদামাটা মলাটে সাধারণ পোশাকের ভেতর সমকালীন পাঁচ গল্প, দশ কবির এই সময়ে কবিতা, সাত স্মৃতিকথার পরিপাটি আয়োজন। প্রথমেই সমকালীন পাঁচ গল্পকারের গল্প পাঠ করতে গিয়ে দেখি, শহীদ ইকবালের ‘একটি ছোট্ট মানুষের অনেক দাম আছিল’ গল্পটি আঞ্চলিকতার বুননে গাঁথতে গিয়ে একটু বেশিই যেন ঠাসা হয়ে গেছে কোথাও কোথাও। মান আর বাক্য চালে পাঠকের দুর্বল হয়ে ওঠার আগেই গল্পটির সমাপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় গল্প সজল বিশ্বাসের ‘আবু তালেবের তুলি’ গল্পটিতে গল্পকার যে তার মেধা, শ্রম আর নামের মতই বিশ্বাস মিশিয়েছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রত্যাশা, সময়ের বাস্তব রূপ, চলমান পৃথিবীর শাশ্বত ধর্ম গল্পটিতে ফুটে উঠোছে গল্পের চরিত্র আবু তালেবের জীবনকাহিনীর হাত ধরে। তৃতীয় ও চতুর্থ গল্পটি পথ হারায় না। সালেহ্ মাহমুদ রিয়াদ তার গল্প ‘আত্মা ও পরমাত্মা’ গল্পে মজার ছলে শুরু করে শেষ করেছেন চিরায়ত সত্য-ছবির চিত্রাংক এঁকে। ভাসায় হাস্যরসের উদ্রেগ হলেও গল্পস্থ সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আমাদের চারপাশের নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনাটিকে গল্পকার তার কলমে টুকতে চেয়েছেন তার মতো করে, যা পাঠককেও ছুঁয়ে গেছে আলতো করে। আর আনিফ রুবেদ তার ‘সাবান’ গল্পটি জাস্ট ছুঁড়ে দিয়েছেন; যার স্বর বাতাসে মিশে গিয়ে ভাবনাকে স্পর্শ করে আপনাতেই। পঞ্চম গল্প ‘জলাবৃত চাঁদ’-এর গল্পকার শ্রাবণী প্রামানিক তার গল্পে এদেশের গ্রামীণ প্রেক্ষাপট তথা সামাজিক বিকারগ্রস্থতার মখমলে অবলা এক নারীর চরিত্রায়নের মাধ্যমে অসহায় একটি পরিবারের চিত্র তুলে ধরেছেন। এ গল্পে একটি সমাজ ব্যবস্থার পর্যালোচনার ভেতর থেকে অনুধাবন করা যায় রাষ্ট্র বা একটি প্রতিষ্ঠানের অতীত বা বর্তমান করুণ পৃষ্ঠার।
দশ কবির এই সময়ের গুচ্ছ কবিতাগুলোও আমাকে ঠকায়নি এক আদলিও। মামুন মুস্তাফার ‘সুবর্ণচর’ কবিতাটি যেমন চলমান সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে তেমনি ওবায়েদ আকাশের ‘সমর্পিতা : অলঙ্ঘ স্তুতি যার’ কবিতাটি থেকে ঘোর কাটাতে সময় লেগে যায়। তুষার প্রসূন, বঙ্গ রাখালের কবিতায় ডুব দিলে দেখা যায়, সময় খেলছে নাটম-লে নেচে যাওয়া কিশোরীর মতো। ভাষা ও বক্তব্যে পাঠ-পূর্ণতা পাওয়া যায় অন্য কবিদেরও প্রায় সবগুলো কবিতাতেই। সলিল চট্টপাধ্যায়ের ‘শৈশব-স্মৃতি : টিনের বাক্স ও বিদায়ের মালা’, আহমদ রফিকের ‘ভাষা আন্দোলনের কথকতা’, আবুবকর সিদ্দিকের ‘মুক্তিযুদ্ধ : একটি ঘটনার সাক্ষী’, সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিনের ‘স্মৃতিতে নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন’, খান জিয়াউল হকের ‘দেশভাগ ও আমার সময়’সহ সাতটি স্মৃতিকথা রয়েছে এই সংকলনটিতে। প্রতিটি স্মৃতিকথা আবেগ ও চেনতাকে নিয়ে যায় কাহিনীর সময়ে। বর্ণনায়, তথ্যে, উপাদান-উপাত্তে কথাগুলো জীবন্ত মাছের মতো। সব মিলিয়ে ‘লেখমালা’ ছোটকাগজটি পড়ে নিরানন্দে ডুবতে হয়নি একটুও।
সব বই একটানে যেমন পড়া যায় না তেমনি কিছু বই পড়ার পর রেশ কাটে না। ‘লেখমালা’ ছোট কাগজটির কথা মনে থাকবে অনেক দিন। মনে থাকবে এর গুণগতমান ও নান্দনিকতার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যাবলীর কারণে। মামুন মুস্তাফা সম্পাদিত এই কাগজটি সাহিত্যানুরাগী যে-কোনো পাঠক সত্যিকারের সাহিত্যপাঠের আনন্দ পাবেন বলে আমার বিশ্বাস। মননশীল এই কাগজটির উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করে সবিশেষ বলতে চাই ছোটকাগজ ছোট নয়, কোন কোনটি বেশ বড়; ‘লেখমালা’ তাকেই ধারণ করে।

ছোটকাগজ : লেখমালা
সম্পাদক : মামুন মুস্তাফা
মূল্য: ৫০টাকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *