শামসুল আরেফীন-এর কবিতা
বন
একটি বন বিবর্ণ ছিল অসংখ্য প্রহর।
মহাপদ্ম মুখে পুরে সকল সবুজ
উগ্রে দিয়েছিল কর্ণফুলীর জলে।
তার বিষের ছোঁয়ায় ভয়ানক
কাতরাতে কাতরাতে মৃত অথবা অর্ধমৃতের
মতো ছিল মায়াহরিণ সব।
ভূমধ্য সাগরের উপকূলে,
ভারত-আফ্রিকার হাজার উপত্যকায়
লোনাজলে ভেসেছিল ফুল-পাখি-বৃক্ষের বিবেক।
দেবতারা বলেছিল: ‘এই বনে বড়ো বেমানান বটে
মায়াহরিণের বাস, ওদের ধ্বংস করো…’
আর তখনই শোনা গিয়েছিল দেবব্রত ভীষ্মের
ডাক: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
এতো ডাক নয়, যেন ব্রহ্মাস্ত্রের জ্বালা।
দেবতারা ভাবেনি এমন হবে;
তারা চুপ হলে মহাপদ্ম ভয়ে যুদ্ধ করতে করতে
পালিয়েছিল পাতাল-গুহায়।
আহা, দেবব্রত ভীষ্ম যেন প্রকৃতির অনন্য আশীর্বাদ।
সেই বন, সেখানের সবকিছু আবার আগের মতো হয়েছিল
আঙুলের ইশারায় তার।
সেই বন আজও আছে
লাল-সবুজের চিহ্ন উড়িয়ে অসীম আকাশে।
কঙ্কাবতী-১
গান্ধারীর বখে যাওয়া শত পুত্র আজ
শত অঞ্চলের নায়ক।
তাদের ভয়াল আগুনে পুড়ে যাচ্ছে
কোটি কোটি গোলাপের জগত।
কী করে শান্তিতে থাকি, কঙ্কাবতী?
প্রতি রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি: ডলুর ওপাড়ে
কেবলই কাঁদছে লেনিন, মাও, এঙ্গেলস,
হোচি মিন, চে, রাসেল, রবীন্দ্রনাথ।
আমাকে বারবার বলছে, হে উত্তর প্রজন্ম,
নিকুঞ্জে থেকো না আর…
কঙ্কাবতী, এবার পাঞ্চালী হয়ে উঠো,
আমাকে পঞ্চপা-ব করে নিয়ে চলো
কুরুক্ষেত্রের বুকে।
রচনা করবো আমি শত পুত্রের শ্মশান।
কঙ্কাবতী-২
বল্গার পাড় ঘেঁষা বেপারিপাড়ায়
এসময়ে এলে প্রিয় কঙ্কাবতী।
এখানে রয়েছে শঙ্খ, শতো শতো বাঘ,
যখন বেরুবে তুমি, হেঁটে যাবে ধিরে,
ভয়াবহ চোখে নেবে তোমার পিছু।
ওরা জানে: একালের দ্রৌপদী তুমি,
দারুণ বসন্ত নিয়ে তোমার আবির্ভাব।
তোমার বিনাশ তরে করবে ওরা সব;
জুটেছে ওদের সাথে মার্কিন, ফ্রান্স,
বিলেত, ভারত আর ইতালি, জাপান…
কুরুক্ষেত্রের বুকে বিশেষ প্রহরে
এবার রচিত হবে নতুন সমর।
ভয় নেই তবে প্রিয় বন্ধু আমার,
একালের কানু আমি তোমার ছায়া।
মানিক সদাগর
ভোর-বেয়ানে ওই এসেছে নলুয়া সুন্দরী,
বাস করে সে অনেক দূরের শ্যামলা বন্দর;
হঠাৎ তাকে দেখতে পেয়ে ফুলচেরাগির মোড়ে
আজ হয়ো না উল্লসিত মানিক সদাগর।
তোমার কাছে জমা আছে বঙ্গসাগর-কোরাল,
সুন্দরী তা জেনে গেছে রাতের ইতিহাসে;
পঙ্খিরাজের বেগে এলো কী ভয়ানক লোভে!
পদ্ম-কুলীর-শঙ্খ আছে তাহার পাশে পাশে।
সুন্দরী আজ সুন্দরী নয়, দুঃশাসনের ছায়া;
সকল কোরাল হরণ করে হবে পগারপর,
শূন্য হয়ে সহজ-সরল ও সদাগর তুমি
দেখতে পাবে দশদিকেতে সমর অন্ধকার।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শব্দের টীকা
ভোর-বেয়ানে: প্রাতে, কোরাল: প্রবাল।
চিড়িংঘাটা
এক কবুতর অনেক বছর শুনলো বকুল পরি,
নছর মালুম, কাফন চোরা, ভেলুয়া সুন্দরী।
একটু খুশির ছোঁয়া তবু পেলো না তার মন,
চিড়িংঘাটার লাগি সদা রইল উচাটন।
ছোটকালে শুনেছিল: চিড়িংঘাটার মাটি
সূর্যরাজা-স্বর্ণলতার ছোঁয়ায় হলো খাঁটি।
তারা ছিল মলকা-মনু এবং ছিল বীর,
চিড়িংঘাটার মান বাঁচাতে যুদ্ধে দিল শির।
শুনেছিল চিড়িংঘাটার বিরাজ-কথা আরো:
বিরাজমোহন শোভন ছিল, জাতে ছিল গারো।
চিড়িংঘাটার ডলুপাড়ায় করতো বসবাস,
লিখতো সদা গারো কবির পালার ইতিহাস।
তখন থেকে কবুতরে চিড়িংঘাটাই সব,
অন্য কথা, অন্য বাখান ফালতু অনুভব।
তা’ই কি শুধু? তখন থেকে ভাবনা তাহার এই:
চিড়িংঘাটার রূপ আছে ওই জ্বলনধারাতেই।
গল্প শুনে, না দেখে হায়, চিড়িংঘাটার দ্বার
তার এমনি ভালবাসা সত্যি চমৎকার!
ও মহুয়া, ও মলুয়া, ও নলুয়া আয়
চিড়িংঘাটা আনিয়া দে কবুতরের পায়।
টীকা:
বকুল পরি, নছর মালুম, কাফন চোরা, ভেলুয়া সুন্দরী: পালাগানের নাম, চিড়িংঘাটা: স্থানের নাম।