শিশুতোষ গল্প

ছোটগল্প।। শায়লার লাল ফ্রক।। রহমান রনি

আরিফের কবুতরগুলো আজ খুব অস্থিরভাবে ডানা ঝাপটাচ্ছে। গাছেও ঠিকমতো বসছে না। একবার বাসায় ঢুকছে আবার গাছে উড়ে যাচ্ছে। আরিফ বুঝতে পারছে না কবুতরগুলোর কী হয়েছে? রফিক মাছের ছিপি নিয়ে বসে আছে। সে আরিফের দিকে খেয়াল রাখছে কেন সে কবুতরগুলো নিয়ে চিন্তিত। আমজাদ চাচা বাজার থেকে খালি হাতে ফিরে এসেছে। তার চোখে-মুখে উৎকন্ঠা। গ্রামের সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে।
আমজাদ চাচা সবার দিকে তাকিয়ে বললো, অবস্থা ভালো না। হালদা’র ওপারের গ্রামে মিলিটারি নেমেছে। সবার ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। অনেক মানুষকে মেরে ফেলেছে। গরু-ছাগল, গোলার ধান সব লুট করে নিয়ে গেছে। আমজাদ চাচার কথাশুনে পুরো গ্রামে মুহূর্তে আতংক ছড়িয়ে পড়ে।
জব্বার মিয়া বলে, এসব কি সত্য কথা? তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না গ্রামে মিলিটারি নেমেছে। তিনি শুনেছেন যুদ্ধ হবে শহরে। গ্রামে কেন, কার সাথে যুদ্ধ হবে এটা ভেবে তিনি কূল পাচ্ছেন না। নিরীহ মানুষেরা মিলিটারির সাথে কীভাবে যুদ্ধ করবে?
আব্দুল মোতালেব বলে, তাহলে কি আমাদের গ্রাম ছেড়ে পালাতে হবে? আরিফের কবুতর উড়ে এসে কাঁধে বসে। এখন আগের থেকে বেশ শান্ত। আরিফ হাত বুলিয়ে আদর করে দেয়।
জব্বার মিয়া বলে, পরিস্থিতি সুবিধার মনে হচ্ছে না। সবাই গাট্টি-গোট্টা নিয়ে তৈরি থেকো। কাল সকালে আমরা গ্রাম ছেড়ে চলে যাবো। রফিক মাছের ছিপির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আমজাদ চাচা সবার উদ্দেশ্যে বলে, তোমাদের বিশ্বাস না হলে ঐ দেখো এখনো ধোঁয়ার কু-লী দেখা যাচ্ছে। সবাই হালদা’র ওপারে দেখে, সত্যি সত্যি আকাশ কালো ধোঁয়ায় ছেঁয়ে গেছে।
সন্ধ্যার পর অদ্ভুত নীরবতায় ছেঁয়ে যায় পুরো গ্রামে। ঝিঁ ঝিঁ পোকা ছাড়া আর কোন শব্দ শোনা যায় না। পুরো গ্রামের মানুষ সব যেন মরে গেছে। রাতে সবাই তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ে। শেষ রাতের দিকে রফিকের ঘুম ভেঙে যায়। রফিকের বোন শায়লা কাঁদছে। টিনের চালে প্রচ- শব্দ হচ্ছে। রফিক প্রথমে ভাবলো বৃষ্টি, কিন্তু বৃষ্টির শব্দ তো এমন নয়। একটু পর আব্দুল মোতালেব আগুন…মিলিটারি…আগুন বলে চিৎকার শুরু করলো। রফিক বুঝতে পেরেছে এতক্ষণ সে টিনের চালে বৃষ্টির নয়, গুলির শব্দ শুনেছে। রফিক শায়লার হাত ধরে বাইরে এলো। দেখে, উঠোনে জব্বার মিয়া এবং নারিকেল গাছের নিচে আব্দুল মোতালেব মরে পড়ে আছে। রফিকের কবুতরের ঘর ও কবুতরগুলো পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। অন্যদের সাথে রফিক ও শায়লা দৌড়ে পালাচ্ছে। দৌড়ে তারা বাজার পার হয়ে নৌকার ঘাটে আসে। রফিক দেখে শায়লা নেই। তার মন অজানা শঙ্কায় কেঁদে ওঠে। তার আদরের ছোট বোনকে এমন বিপদে হারিয়ে ফেললো! রফিকের দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
কিছুদিনের মধ্যে গ্রামের সবকিছু পাল্টে গেলো। চারপাশে এখন শুধু লাশের ও ঘর-বাড়ি পোড়ার খবর। বঙ্গবন্ধুর ডাকে চারিদিকে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কেউ যুদ্ধে যাচ্ছে। কেউ পালিয়ে যাচ্ছে। আর রফিক শায়লাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে যাচ্ছে। কিন্তু কোথাও শায়লাকে খুঁজে পেলো না। রফিক নদীর ধারে বসে কাঁদছে। রফিককে কাঁদতে দেখে স্কুলের প্রধান শিক্ষক রতন দাশ বললো, কেঁদে লাভ নেই। তুই যুদ্ধে যা, ঐসব নরপিশাচদের মেরে তোর বোনকে নিয়ে আয়। রফিক রতন স্যারের দিকে তাকিয়ে বলে, শায়লা কি ওদের কাছে?
রতন স্যার মুখ কালো করে বলে, শুনেছি শায়লাকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে। রফিক এ কথাটা বিশ্বাস করতে চাই না। নিশ্চয় তার বোন কোন গ্রামে লুকিয়ে আছে। কিন্তু সে শায়লাকে কোন গ্রামে খুঁজে পায় না। রফিক যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রফিক যুদ্ধে চলে যায়। সে পণ করেছে বাংলার মাটি থেকে সব হানাদার মিলিটারিকে মেরে তাড়িয়ে দেবে এবং শায়লাকে উদ্ধার করে আনবে। আরিফ বলেছে, যুদ্ধ শেষ হলে শায়লা হয়তো গ্রামে ফিরে আসবে। রফিক প্রার্থনা করে আরিফের কথাটা যেন সত্যি হয়।
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই গ্রামে ফিরতে শুরু করেছে। রফিক যুদ্ধে অনেক বীরত্ব দেখিয়েছে। কিশোর গেরিলা যোদ্ধা হিসাবে তার নাম পুরো দেশে ছড়িয়ে গেছে। সবার মতো রফিকও অপেক্ষা করে প্রিয়জন ফিরে আসার। কারো বাবা, কারো চাচা, কারো ভাই, কারো সন্তান ফিরে এসেছে। কিন্তু শায়লা ফিরে আসেনি। আরিফও যুদ্ধে গিয়েছিলো। আজ সে ফিরে এসেছে। সে গ্রামে না গিয়ে সোজা রফিকের কাছে এসে বললো, তুই তো অনেক বড় যোদ্ধা হয়েছিস!
রফিক বললো, তুই বেঁচে আছিস! কখন আসলি? শায়লা কোথায় জানিস?
আরিফ কোন কথা না বলে রফিকের হাতে শায়লার রক্ত মাখা ফ্রক তুলে দেয়। রফিক চিনতে পারে ফ্রকটি। তার মানে শায়লা আর বেঁচে নেই। রক্তের দাগ ফ্রকে শুকিয়ে গেছে। আরিফ কাঁধ থেকে বন্দুক নিয়ে আকাশে গুলি ছুঁড়ে বললো, এই দেশের মাটিতে শায়লার আত্মত্যাগ কখনো বৃথা যাবে না। এ স্বাধীনতা আমাদের। এ দেশের মাটিতে আর কোন হানাদার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।
রফিক শায়লার রক্তমাখা লাল ফ্রকটি বুকে আগলে ধরে অঝরে কাঁদতে থাকে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *