ছোটগল্প।। দবির মিয়ার পেনশন ।। জাহাঙ্গীর বাবু
সরকারী চাকুরী থেকে অবসর নেয়ার পর দবির মিয়া আরো বেশি ধর্ম পরায়ন হয়েছেন। আগে নাটক ,খবর দেখলেও এখন ওয়াজ ,মাহফিল,ডক্টর জাকির নায়েকের অনুষ্ঠান বেশি দেখেন। ইবাদতেই বেশি থাকেন। তবে একটা বিষয়ে অহংকার করেন বেশ। ছেলে বউ মেয়ে ,মেয়ের জামাই নাতি কাউকে ছাড় দেন না। কারণ একটাই তার পেনশন।মাস শেষ হাজী দবির মিয়ার বাড়িতে পৌঁছে যায় পোষ্ট ম্যান। অবশ্য বছরে একবার বিভাগীয় শহরের বড় বাবুকে কিছু কচ কচে নোট সুন্দর একটি খামে ভরে দিয়ে আসেন। মন খুশি থাকলে ইয়ার দোস্তকে বলেন, ,বুজলা মিয়া ঘুষের টাকা কচ কচে নোট হওয়া ভালো। এতে কর্তা বাবুদের মন খুশি থাকে!
দবির মিয়া জওয়ান বয়সে নাটক পালা গান ,যাত্রায় বেশ অংশ নিতেন। ব্রিস্টল ব্রান্ডের সিগারেট ফুকতেন ,হাতাকাটা টি শার্ট ,মোটা বেল্টের প্যান্ট ,বড় ফ্রেমের সানগ্লাস কিছু বাদ যায়নি। সরকারী চাকরির সুবাদে ঘুরেবেড়িয়েছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল শহর বন্দরে। যা কিছু করেছেন ,চাকুরিতে ছিলেন ভিশন সৎ। ছেলে মেয়েদের আর বিয়ে করা বউটারে বেশ ভালো বাসতেন। তাই পরিবার নিয়ে দেশের মাঝেই প্রবাসী ছিলেন।জীবনে এক ওয়াক্ত নামাজ বাদ পড়েছে কিনা নিজেই মনে করতে পারেন না। তার স্ত্রী কুলসুম বানু ধার্মিক একজন গৃহিনী। সকাল হলেই ছেলে মেয়েদের রান্না ঘরের মেঝেতে পাটি পেতে কায়দা,আমপারা,কোরান শরিফ নিয়ে পড়াতেন। আর রুটি বানাতেন ,একেক জনের পড়া শেষ ,তাকে নাস্তা দিতেন।তার পর স্কুলে পাঠাতেন একেক করে। আর স্বামী সেবা,সংসার নিয়ে পার করেছেন ,জীবন যৌবন, সময় পেরিয়ে আজ দবির মিয়া আর কুলসুমের সংসার বড় হয়েছে।তিন ছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে এনেছেন তিন বউ। এক মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। ঢাকা শহরে থাকে। মেয়ে ঘরে এক নাতিন আর এক নাতি।বড় ছেলে প্রবাসে থাকে। বছরে দুই বছরে দেশে আসে। বড় ছেলের দুই মেয়ে। মেঝ ছেলের এক মেয়ে। ছোট ছেলের একটি ছেলে। দবির মিয়া চান সব ছেলে এক সাথে থাকুক।বড় আর মেঝ ছেলে দীর্ঘ দিনের প্রবাসী।বড় ছেলে আর তার সন্তান দবির মিয়ার কাছেই থাকে। মেঝ জন গত কয়েক বছর বউ শশুর বাড়িতে রাখে। ছোট জন জীবন যুদ্ধে লড়াই করছে দেশের মাটিতে।বিশ্ব বিদ্যালয়ের বড় ডিগ্রী নিয়েও কোথাও পাকা পোক্ত হতে পারছে না। বউ নিয়ে একবার চলে যায় কর্ম স্থলে আবার ফিরে আসে কয়েক মাস পর। আসা যাওয়ার মধ্যেই আছে।
দবির মিয়ার ছেলে ফাহিম এর বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। চাকুরীর অবসরে কাব্য কবিতা ,নাটক নিয়ে ব্যস্ত থাকে।দবির মিয়ার টিনের ঘর আজ একতলা ইটের দেয়ালের।বেশ অসুস্থ।ডায়াবেটিক গত ত্রিশ বছরের। কুলসুম বানু আগের মত কাজে শক্তি পান না। ছেলে মেয়েদের বড় করতে আর সংসারের ঘানি টানতে টানতে শরীর ক্ষীন কায় ,দুর্বল হয়ে গেছে।ডাক্তার ,ঔষধ পত্তর দবির মিয়ার সংসারের বড় খরচের একটি।দবির মিয়ার বড় ছেলে ফাহিম যখন ঢাকায় হোস্টেলে থেকে কলেজে পড়ত প্রায় দেখতে যেতেন।ফাহিম প্রায় বেইলি রোডে নাটকে বা রিহার্সেলে থাকতো। হোস্টেলের দারোয়ানের কাছে চিঠি লিখে ভবিষ্যত বাণী দিয়ে আসতেন।আর ফাহিমকে পেলে সাথে নিয়ে ঘুরতে যেতেন। ফাহিমের বন্ধু থেকে বান্ধবী সবার কাছে একজন আদর্শ পিতা বা বন্ধু হিসাবে ছিলো দারুন খ্যাতি।
ফাহিম ছিল বরাবর উদার মনের মানুষ। দবির মিয়া যেমন নিজের স্ত্রী সন্তান নিয়ে কর্ম ক্ষেত্রে বাসা নিয়ে থাকতেন চাকুরী জীবনের শেষ দিকে বড় ছেলের বউ বড় নাতিনকে নিয়ে চাকুরী করেছেন। গ্রামে আসার পর দবির মিয়ার সব আধুনিকতা চলে গেছে। এখন মসজিদ,মাদ্রসায় দান খয়রাত করেন। হজ করেছেন ,স্ত্রীকে হজ্ব করিয়েছেন।মেঝ ছেলেকে দারুন ভালবাসেন।অথচ দবির মিয়াকে কষ্ট দিয়েছে বেশি মেঝ ছেলে। টাকা পয়সার জন্য নয় সংসারের হাড়ির টুন্ টুনা টুন্ ,আর এক গুয়েমি। ঘরে অন্য ছেলেদের সন্তান থাকলেও দবির মিয়ার মন কাঁদে মেঝ ছেলে ,ছেলের বউ আর ওদের সন্তানের জন্য।দবির মিয়ার যত অভিমান করুক ,মাফ চাইলে ক্ষমা করে দেন ,তার কথায় সায় দিলে খুশি হন। তিনি চান সব ছেলেদের আয় তার কাছে দিক.তিনি সবাইকে সম বন্টন ,ঘর বাড়ি সব করে দিয়ে যেতে চান, দবির মিয়ার স্কিম বেশির ভাগ ফ্লপ।
সরকারী চাকুরীর মাঝে তিনি নিদারুন সংগ্রাম করেছে। ছেলে মেয়ের জন্য যা করার প্রয়োজন সব করেছে। এখন একটু অন্যরকম হয়েগেছে,যেই ছেলে যে মাসে ,যে সময়ে টাকা বেশি দেন তার জন্য মায়া বেড়ে যায়,কোন ছেলে দিতে অপারগ হলে বা নিজে কিছু করতে চাইলে তার বড়াই করা সেই কথা, আমি কারো খাই না পরি, আমার পেনশনের টাকায় আমি চলি। অথচ ছেলেরা যে যার মতো চেষ্টা করছে দবির মিয়ার সংসারে। তিনি মনে করিয়ে দেন আমি বেঁচে থাকতে কেউ এই সংসারে আলাদা হতে পারবে না ,আলাদা হলে ঘরের বাইরে,এখানে নয় !
অথচ এই সংসার ,এই ঘর বাড়ি সংসার দাঁড় করাতে বড় ছেলে তার জীবনের কত গুলি বছর দিয়েছে,ফাহিমের বউ আজো সেই সংসারে ,মেঝ ছেলে দিয়েছে বছর সাতেক , এখন ধরি মাছ না চুই পানি ,মাঝে মাঝে টাকা দিয়ে খুশি করেন দবির মিয়াকে। ছোট ছেলে তার ছাত্র জীবনে কায়িক শ্রম,চলমান জীবন যুদ্ধে যা পারছে তাই দিচ্ছে দবির মিয়ার হাতে। দবির মিয়ার কোন সন্তান যদি মনে করিয়ে দেয় কখন কি দিয়েছে ,সাথে সাথেই উত্তর আমি অস্বিকার করেছি নাকি? তোমাদের ছেলে পুলে আছে ,তাদের জন্য করছ,আমরাতো পেনশনের টাকায় চলি ।দবির মিয়া শরীর আর কত দিন চলবে বলা মুশকিল, কাউকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। কিসের এক চাপা অভিমান ,ক্ষোভ কাজ করে। বড় ছেলে ফাহিম দবির মিয়ার মনের অশান্তি দূর করতে আর এক্কান্নবর্তী সংসারটাকে ধরে রাখতে গিয়ে নিজের জীবনের অনেক কিছু হারিয়েছে। যার নাম সুখ,শান্তি। ফাহিম নিজের অজান্তেই বলে উঠে, আলহামদুলিল্লাহ ,আসলেইতো ভাগ্যিস বাবার পেনশন ছিলো। তার ছেলেদের পেনশন নেই ,তারা কি বলবে জীবন সায়াহ্নে তাদের সন্তানদের ?