ওমর শামস- এর বিজয়ের কবিতা
আগন্তুক
হাঁসের পায়ে-পায়ে সন্ধ্যা এলো।
চৌধুরীরা কখন আসবে মা?
কারা সব মেহমান আসছেন আজ,
আমরা অপেক্ষমাণ।
এ-বাড়িতে হামেশাই কুটুমেরা আসে,
এই তো সেদিন
শেফালিকে দেখে গ্যালো শরৎ বিকেলে
তার থরোথরো মুখ।
অথচ এখন কেন নিবোনো উনুন?
ছাই, চেপে আছে কার মুখ?
টিয়েটাও হতবাক,
যেন চৈত্রের খরাজাত বিদ্যুদ্দাম
জিভে তার কষায় চাবুক।
সবাই উধাও মরুৎ, অনিল, হাওয়া।
বাকলের পিঠে গিঁট
গাছের পাতাও ভয়ে ফ্যালে না চরণ।
তবে কি বাঁশের ডাকে ভয়?
কুয়োর ব্যাদানে
খাটে?
চৌকির তলায়
পিতলের বদনায় নলে
তোরঙ্গে
মখমল জায়নামাজের মিহরাবে?
আলনায় শার্টের আস্তিনে
ছিকে?
ছাতার অতলে?
শঙ্কা!
কেবলি শঙ্কা বাড়ে বৈদেহী আয়তনে,
জলহীন প্লাবনে,
পত্রালিহীন বৃক্ষের বিস্তারে বিস্তারে।
দেশলাই জ্বালাই বরং, কাজে যাই
আনোয়ার, পড়তে বসো
হারিকেন দিয়েছি তোমার।
রোকেয়া, অংক হলো?
মাথার ভিতরে জমে অবোধ্য অব্যয়,
দ্বিধা-দ্বদ্ব-যুক্তি-ভয় জড়ো হয় জটিল সমাসে।
চৌবাচ্চায় অবিরল জল পড়ে,
অসাধু নায়ক কেবলি মেশায় জল দুধে;
তৈলাক্ত বাঁশে শত চেষ্টা তবু তুঙ্গে চড়ে না বাঁদর।
খাদ্য অসমাপ্ত, তাই
দুর্গে শুধু সৈন্য আসে
সৈন্য আসে
সৈন্য আসে।
কারা এই স্বজনেরা, মা?
হাট ফিরে আবু চাচা এখনো আসে না কেন?
সন্ধ্যা হলো,
অন্ধকার।
অন্ধকার থেকে কারা আসে?
শফি ভাই, হেনাতলা থেকে?
ব্যাপারী কাসেম মিয়া,
মামলার সাক্ষী: চারু দত্ত,
ন্যাপকর্মী নেয়ামুল্লা,
ছদ্মবেশী ছাত্রনেতা,
নাকি মারাত্মক অস্ত্রধারী বামপন্থী কমরেড সফদার!
অন্ধকার!
অন্ধকার থেকে কারা আসে?
পাতার ভিতরে চাঁদ,
সে-কি কুচক্রী সহচর?
পাতার ভিতরে হাওয়া,
সে-কি সঙ্গোপনের কান?
গুল্মোর, কলাপাতা, কামিনীর ঝোপ,
সে কার ক্যামোফ্লাজ?
অন্ধকার,
অন্ধকার থেকে কারা আসে?
স্তব্ধতা,
স্তব্ধতা থেকে কারা আসে?
নৈঃশব্দ্য,
নৈঃশব্দ থেকে কার শব্দ আসে?
স্থূল পা
ভারী বুট
চীৎকার!
বোয়োনেট
চীৎকার!
আনোয়ার!
আলো, আলো কই?
আবু চাচা, রোকেয়া, মা,
তোমরা কোথায়?
তোমরা কোথায়?
বৃষ্টি
একদিন আমি স্বাধীনতার মিছিলে গিয়েছিলাম। বৃষ্টি থাকুক আর না থাকুক সেদিন আষাঢ়। সেগুন বাগিচার থেকে পায়ের পাতায় দাঁড়ালে মুষল বৃষ্টির ঢল টিকাটুলির গলি, হাটখোলা রোড, আর্মানিটোলার ময়দান, ধোলাই খাল থেকে নারিন্দার পুল, স্টেডিয়ামের গোল বারান্দা, তোপখানা, টিপু সুলতান রোড গলি, উপগলি, বারান্দা, টালি, রেলিং, ছাদ উপচে-উপচে মানুষের ঢল। নবাবপুর রোডে আর কূল ধরে না; হাওয়া, হাওয়া, ঝাপটা বাঙলার বাঘের চোখ থেকে চম্কে ওঠে বিদ্দ্যুদ্দাম :
বাঙলার সংগ্রাম! মুক্তির সংগ্রাম!
এবারের সংগ্রাম! স্বাধীনতার সংগ্রাম!
রেল-লাইনের পাশের ছাউনী ফুঁসে অজস্র অঙ্কুরিত বিছনের মতো
খেটে-খাওয়া-না-খাওয়া মানুষ,
কামার, কুলি, কুমোর, ওস্তাগার,
পেশকার, ওভারশিয়ার, সেকশন অফিসার,
সরকারী এজিবি-র কেরানী,
ঠেলাঅলা, রিকশাঅলা, ফেরিঅলা কে নেই?
বুড়িগঙ্গার পাড় ঘেঁষে
তাম্রলিপ্তি, সোনার গাঁ-র সিংহল পাড়ি দেয়া বাঙলার মাঝি,
স্যাঁত-স্যাঁতে ভূতলের থেকে শাঁখারী, আঙুলহীন তবু হিম্মতি
বাঙলার মসলিন তাঁতী।
ঐ যে বাহাদুর শাহ পার্কের পাম গাছ থেকে
গলার ফাঁস ছিঁড়ে আসা বিক্রমপুরের সেপাই
ভবানীর সন্ন্যাসী, মজনুর সেপাই
পাঁচবিবি থেকে খনিজের মতো চকচকে সাঁওতাল,
সড়কির মতো ছুটে আসছে
তেস্তরি বাজারের গলি ভেদ ক’রে
অবলুপ্ত চরজাগা বর্গা আধিয়ার :
এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম!
সংগ্রাম! সংগ্রাম! স্বাধীনতার সংগ্রাম!