প্রবন্ধ।। প্রযুক্তি কালের লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি।। শাহিদ হাসান
ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতা কেন্দ্রিক কতিপয় লেখক ও চিন্তকদের জ্ঞানের আলোকে বাংলা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে রেনেসাঁসের ব্যানারে আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এ ধারার প্রবাদ পুরুষরা হলেন বঙ্কিচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও রাজা রামমোহন রায় প্রমুখ। তাদের দৈশিক ও বৈশ্বিক পাঠের সমন্বয়ে উদ্ভাবিত নতুন ধারা স্থবির বাংলাসাহিত্য ও সংস্কৃতিতে প্রাণের সঞ্চার করে। এ ধারার বিপরীতে অবস্থান মীর মশাররফ হোসেন, ইসমাইল হোসেন সিরাজীসহ আরো অনেকে। বৈশ্বিক পাঠের অভাবে তারা সর্বদা জীর্ণ-পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। যেখানে নেই নতুন রূপরেখা। আলোক বর্তিকহীন এ ধারার লেখকরা লেখালেখি করেছেন তার ঐতিহাসিক মূল্য আছে কিন্তু কালের বিচারে সাহিত্যিক মূল্য নেই।
রেনেসাঁর কাল পেরিয়ে গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে আধুনিকতার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে আরেকবার পরিবর্তন ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্নের প্রাক্কালে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে নানা জটিলতার উদ্ভব এবং নতুন জিজ্ঞাসা মানুষের চিত্ত চঞ্চল করে তুলেছে। সচেতন মানুষের অন্তহীন প্রশ্নের পেছনে ছিলো বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান। অন্ধজনের মিথ্যা অহঙ্কবোধ ও মূঢ়তার দর্পচূর্ণ করে বিজ্ঞান-মনস্ক চেতনা।
বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা, যন্ত্রের বিকাশ, যুক্তিবাদ ও অধিকার সংরক্ষণ পাশ্চাত্য সমাজে যে তুমুল আলোড়ন তুলেছিলো, সে আলোড়নের ঢেউ তিরিশের দশকের মুষ্টিমেয় লেখকদের অনুসন্ধান মনস্ক চিত্তে তীব্র ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ধর্মের ব্যাপারে সংশয়, পুরাতন মূল্যবোধের পরিবর্তন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘটা, দারিদ্রের নিপীড়ন ও বৈপ্লবিক সাম্যবাদ। এ বিষয়গুলো কেন্দ্র করে সাহিত্যের নব-রূপায়ণে অংশ গ্রহণ করে ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জগদীশ গুপ্ত, সুবোধ ঘোষ প্রমুখ। তাদের বিপরীতে সীমিত পাঠ ও প্রথাগত চিন্তায় মগ্ন ছিলেন জসীম উদ্দীন, বন্দে আলী মিয়া প্রমুখ। তাদের কাব্যে তারই প্রতিফলন ঘটে।
১৯৫২ সালে রক্তপাতময় ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়- ১. ধর্মভিত্তিক সেমেটিক ধারা। এ ধারার অনুসারীরা হলেন, ফররুখ আহমেদ, সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল কাদির ও গোলাম মোস্তাফা প্রমুখ ও ২. অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার অনুসারীরা হলেন, আবুল হোসেন, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ, শওকত ওসমান, জহির রায়হান, শহীদুল্লাহ কায়সার, আবু ইসহাক, শওকত আলী, কায়েস আহমেদ ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রমুখ।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালের নব্বই দশকে থেকে বিশ্বে বিভিন্ন অঞ্চলের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক পরিবর্তন প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজে জানা যায়। নতুন শতকে প্রযুক্তির বিবিধ আবিষ্কার জীবন আরো গতিশীল ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে যুক্ত কতিপয় কর্মীদের ওপর এর প্রভাব পড়ে। তারা সর্তক ও সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। অন্যদিকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত অধিকাংশের নিকট এ পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারা প্রাচীন ধারায় চলতে অভ্যস্ত। যুক্তি ও বিজ্ঞানের বদলে বিশ্বাস তাদের প্রধান অবলম্বন। যেখানে অন্ধত্ব প্রবল। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদীদের সঙ্গে বিশ্বাসবাদীদের সংঘাত অনিবার্য। এ ক্ষেত্রে বলতে হয় যে-সব লেখক বা চিন্তক অগ্রগামী নতুন ধারার সঙ্গে খাপ খেতে পারে না তাদের লেখক সত্তা আপনা আপনি মরে যায়, জীবন থাকলেও মৃত।
গল্প-উপন্যাসে সমকালের মেজাজ অত্যন্ত জরুরি। তা না থাকলে শিল্প-মনস্ক ও সমাজ সচেতন পাঠকের আগ্রহ থাকবে না। এ প্রসঙ্গে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আলোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) যখন ‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯) নিয়ে সাহিত্য আসরে প্রবেশ করেন তখন ভারত সংকটের মধ্যে দিয়ে চলছে। তিরিশের বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সমাজ, উভয় পক্ষের সংকট কাল। উক্ত কালে যেসব সংকট দেখা দিলো-
১. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ-ভারতে চাকুরি-নির্ভর মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের উত্থান ২. জমি-নির্ভর শ্রেণি ক্রমশ বিলুপ্তের দিকে, ৩. দেশভাগের আন্দোলন তার উত্তাল-তরঙ্গ জনমানসে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার, ৪. সোভিয়েত-বিপ্লব সাফল্যে পাশ্চাত্য জগতে বিপ্লবের দ্বার উন্মোচন, ৫. এঙ্গেলস-মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রয়োগ, ৬. ফ্রয়েডের অবচেতন-লোকের আবিষ্কার মানুষের বর্হিজগৎ ও অর্ন্তজগতের নানাবিধ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং ৭. কল্লোল-কালিকলম-পরিচয়-ভারতী-প্রবাসী-বিচিত্রার মাধ্যমে নানা বার্তা মনোভূমির তটদেশে বারবার আলোড়িত করেছে। যুগের এসব লক্ষণ বিভূতিভূষণের কথাসাহিত্যে দেখা যায়নি। বিভূতিভূষণ তাঁর যুগের সংশয়-বিক্ষোভ-বিতর্কে যুক্ত না হয়ে এবং কোলাহল মুখর নগরকেন্দ্রিক সমস্যা ও জটিলতা এড়িয়ে প্রচলিত ঐতিহ্য, চিরাচরিত বিশ্বাস ও পুরাতন সমাজ-নীতির প্রতি অন্ধের মতো আস্থা রেখে এবং গ্রামের প্রকৃতি ও মানুষের আচার-আচরণকে সম্বল করে গল্প-উপন্যাস রচনা করেছেন। পল্লীর প্রতি বিস্মিত চোখে বিভূতিভূষণ তাঁর গল্প-উপন্যাসে যে ধরনের বর্ণনা দিয়েছেন, গ্রামকেন্দ্রিক প্রথাগত বাঙালি পাঠকের মনে রেখাপাত করেছে। এক্ষেত্রে তাঁর দৃশ্য বর্ণনার ধরন উল্লেখ করা যায়-
“এই বন তার শ্যামলতার নবীন স্পর্শটুকু তার আর তার দিদির মনে বুলাইয়ে দিয়াছিল। জন্মিয়া অবধি এই বন তপহাদের সুপরিচিত, প্রতি পলের, প্রতি মুহূর্তের নীরব আনন্দে তাহাদের পিপাসুহৃদয় কত বিচিত্র, কত অপূর্ব রসে ভরিয়া তোলে।”
লেখক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভূতিভূষণ কতগুলো প্রচলিত বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেছেন। এ বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে বিনির্মাণের মাধ্যমে সময়ের নতুন কোন ভাবনা যুক্ত হয়নি। এতে তাঁর গল্প-উপন্যাস একই সুরে বাঁধা। আবেগ তাড়িত হয়ে বৈচিত্র্যহীন অহেতুক দৃশ্যের বর্ণনা সচেতন পাঠকের মনে ক্লান্তির উদ্রেক ঘটায়। সমকাল থেকে পালিয়ে বেড়ানো জন্যে নিস্তঙ্গ গ্রামকে গল্প-উপন্যাসে স্থান দিয়েছেন। যা পলায়নবাদিতার নামান্তর। এ দিক থেকে পর্যবেক্ষণ করলে এ সত্য স্পষ্ট হয়-
১. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যতটা সমকালিন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ততটা অতীতচারিতায় মগ্ন, ২. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দৃশ্য ইংগিতধর্মী, অন্য দিকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় অতিমাত্রায় বর্ণনাধর্মী, ৩. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প-উপন্যাসে গ্রামীণ পরিবেশ বিদ্যমান। সেখানে সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রের দিকে যাত্রা দেখা যায়। যেমন- ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসে হোসেন মিয়ার সুযোগ সন্ধানী বাণিজ্যিক কার্যকলাপ ধনতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ। তৎকালে ব্রিটিশ-ভারতে উক্ত তন্ত্রের যাত্রা শুরু এবং ৪. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোধ্যায়ের গল্প-উপন্যাসে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্রের চিত্র পাওয়া যায়। মানিকের মতো সমাজ পর্যবেক্ষণের দৃষ্টি ছিলো না বলে সমাজের চরিত্র বদল তাঁর নজরে আসেনি। একজন কথাশিল্পীর সমকালে পরিবর্তনের বিষয়-আশয় জানা অবশ্যই জরুরি।
গল্প ও উপন্যাস ক্ষেত্রে আজকের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে অতীত ও সমকালিন দুটি ধারা বিদ্যমান। অতীত ধারার লেখকদের গল্প-উপন্যাসের পরিবেশ, চরিত্র ও সংলাপ আজ থেকে অনেক বছর আগের। রচয়িতাদের নাম মুছে দিলে যে-কোন সচেতন পাঠকের মনে হবে লেখাটি এ প্রজন্মের লেখকের নয়। যেমন, আজকের বস্তিবাসীর সঙ্গে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের বস্তিবাসীর পরিবেশ, প্রেক্ষাপট ও চরিত্র কখনো এক হতে পারে না। আজকে যারা বস্তিতে বাস করে তারাও প্রযুক্তির বদৌলতে সারা বিশ্ব দেখতে পায়। মোবাইল ব্যবহার, হিন্দি সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের মতো সাজগোজ, বিশ্বকাপের ফুটবলারের মতো ছেলেদের চুলের ছাঁট দেখা যায়। এ ধরনের পরিবেশ ও চরিত্র তাদের লেখায় উঠে আসে না। পাঠ, পর্যবেক্ষণ ও সচেতনতার অভাবে সময়ের ধারাকে ধরতে পারছে না। অনেককে বলতে শুনেছি বর্তমানে অসহিষ্ণু রাজনৈতিক অবস্থার কারণে সমকালের বিষয়াদি তুলে আনা সম্ভব নয়। এ পরিপ্রক্ষিতে ইতিহাসের আলোকে বলা যায় পাক-ভারত উপমহাদেশে লেখকের মত প্রকাশের তেমন স্বাধীনতা কখনো ছিলো না। সচেতন লেখকরা নানা কৌশলে নিজেদের কথাটা বলার চেষ্টা করেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প-উপন্যাসে বৈরী সময়ের অনেক চিত্র নিপুণভাবে উঠে এসেছে। যেমন-‘হারেনের নাত জামাই’ ও ‘ছোট বকুলপুর যাত্রা’। উল্লেখিত প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক কালের গল্প-উপন্যাস রচয়িতাদের উদ্দেশ্য বলা যায়-
১. নিজের কালকে পাশ কেটে নিজস্ব লেখক সত্তার কখনো প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। তাই সময়ের চরিত্র ও গতি-প্রকৃতি অনুধাবন করতে হবে।
২. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সমকালের উত্থান-পতন ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত সুকৌশলে এড়িয়ে গ্রাম-সমাজ নির্ভর গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর আগে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও উক্ত বিষয়বস্তু নিয়ে গল্প-উপন্যাস রচনা করেছেন। দুজনের গল্প-উপন্যাসে গ্রাম-সমাজের চিত্র ও চরিত্রের তেমন কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। বিভূতিভূষণের প্রথাগত মানসিকতার কারণে গ্রাম-সমাজকে নতুন চেতনার আলোকে দেখার তেমন সুযোগ ছিলো না।
৩. মানিক ও বিভূতিভূষণ একই সময়ের লেখক হয়ে দুজনের গল্প-উপন্যাসের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। মানিক যতটা আধুনিক ও বিজ্ঞান-মনস্ক, অপর দিকে বিভূতিভূষণ সমাজের প্রথাগত চিন্তার আবহে আবর্তিত।
৪. মানিকের আধুনিক, বস্তুবাদী ও বিজ্ঞান-মনস্ক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আজও তাঁর প্রাসঙ্গিকতা অব্যাহত। সমাজে জটিলতা যত বাড়ছে চিন্তাগত দিক থেকে মানিক আলোচ্য হয়ে উঠছেন। অন্য দিকে ভাববাদী, প্রথাগত বিশ্বাস ও বিষয়বস্তুর কারণে বিভূতিভূষণ ততটা আড়ালে চলে যাচ্ছেন। তাই তাঁর প্রতিটি গল্প ও উপন্যাস বৈচিত্র্যহীন এবং এক রৈখিক।
এ ক্ষেত্রে ইংরেজি সাহিত্যে ভিক্টোরিয়ান যুগের টমাস হার্ডির গল্প-উপন্যাস নিয়ে উদাহরণ স্বরূপ কথা বলা মনে হয় প্রাসঙ্গিক। তাঁর সময়ে বিজ্ঞানের নানাবিধ আবিষ্কারে যন্ত্র-সভ্যতার বিকাশ ঘটে। রেলগাড়ি ও বিদ্যুতের ব্যবহার এবং চিকিৎসা জগতের বিজ্ঞানীরা মানুষের ব্যাধি মুক্তির বাণী শোনালো। চার্লস ডারউইন, টমাস হেনরি ও হাক্সলির মতো বিজ্ঞানীরা প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস ভেঙে দিয়ে ক্রমবিবর্তনবাদ প্রচার করলেন এবং মানবের জন্ম-ইাতহাস এবং ধর্মের প্রাচীন ধারণাসমূহ পরিবর্তন হতো শুরু করলো। বিজ্ঞানীরা প্রদৃপ্ত প্রত্যয়ে ঘোষণা করলো যে, মানুষের আদি পিতা অ্যাডাম নয়, অ্যামিবা বা জেলি জাতীয় পদার্থে প্রথম প্রাণের স্পন্দন লক্ষ্য করা যায়। মধ্যযুগ থেকে যে ধারণা ও বিশ্বাস ইংল্যান্ডে সমাজে প্রচলিত ছিলো, উক্ত বিশ্বাসের ভিত্তি মূলে চরম আঘাত লাগলো, তৎকালে ইংল্যান্ডের ধর্ম-প্রবণ ও রক্ষণশীল সমাজ এ ধরনের নতুন কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলো।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ইংল্যান্ডের মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি, নীতিবোধ ও চিন্তন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন সাধিত হয়। মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় আগের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যে এ সময়ে রাজনৈতিক ও অধিকার সম্পর্কে সদাজাগ্রত। শিল্প-বিপ্লবের ফলে নতুন নতুন কারখানা প্রতিষ্ঠিত হলো। সমাজে নতুন জীবিকা সৃষ্টি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গতির সঞ্চার এবং জীবন-যাত্রায় নতুন মাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে। ইংল্যান্ডের নতুন পরিম-লে মানুষ হয়ে টমাস হার্ডি (১৮৪০-১৯২৮) কখনো এ পরিবর্তন মেনে নিতে পারেননি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির উদ্বেলতা, শিক্ষার প্রসার ও যুক্তি-নির্ভর মতবাদ ছিলো নগরকেন্দ্রিক সমাজের আকর্ষণ। এ অগ্রগামী চিন্তন প্রক্রিয়া থেকে টমাস হার্ডি নিজেকে সজ্ঞানে মুক্ত করে বিভূতিভূষণের মতো আশ্রয় নিলেন আপন বাল্যের লীলাভূমি ডরচেস্টারের পল্লীতে। যেখানে জীবন-ধারা চলছিলো সম্পূর্ণ প্রাচীন ধ্যান-ধারণায়। চিন্তা-চেতনা ক্ষেত্রে নিত্য-নতুন ধারণা সম্পর্কে হার্ডি নিজে অবগত ছিলেন, কিন্তু তাঁর রক্ষণশীল মন ও মনন নব-ধারার দিকে কখনো সায় দেয়নি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো টমাস হার্ডির যাবতীয় রচনা তাঁর সমকালের ছোঁয়া পায়নি। তিনি কালের পরিবর্তনকে এড়িয়ে নিস্তরঙ্গ গ্রাম জীবনের প্রথাগত চিন্তার ছবি গল্প-উপন্যাসে এঁকেছেন। বিষয়বস্তু ও চিন্তন প্রক্রিয়ার কারণে আলোচনার ক্ষেত্রে তাদের দু’জনের পরিণতি করুণ। এ ক্ষেত্রে টমাস হার্ডির উপন্যাস থেকে কয়টি উদাহরণ টানলে তাঁর চিন্তন প্রক্রিয়ার স্বরূপ ও ধরন জানতে অসুবিধা হবে না। যেমন-
2“Meanwhile, the trees were just as green as before; the birds sang and the sun shone as clearly now as ever. The familiar surroundings had not darkened because of her grief, nor sickened because of her pain.
She might have seen that what had bowed her head so profoundly -the thought of the world’s concern at her situation- was found on an illusion. She was not an existence, an experience, a passion, a structure of sensations, to anybody but herself.”
( Tess of the D'Urbervilles)
- “The next morning, when Thomasin withdrew the curtains of her bedroom window, there stood the Maypole in the middle of the greek, its top cutting into the sky. It had sprung up in the night. or rather early morning, like Jack’s bean-stalk. She opened the casement to get a better view of the garlands and posies that adored it. The sweet perfume of the flowers had already spread into the surrounding air, which being free from every taint, conducted to her lips a full measure of the fragrance received from the spire of blossom in its midst. At the top of the pole were crossed hoops decked with small flowers; beneath these came a milk-white zone of Maybloom;then a zone of bluebells, then of cowslips, then of lilacs, then of ragged-rosins, daffodils and so on, till the lowest stage was reached.Thomasin noticed all these, and was delighted that the May revel was to be so near.”
( The Return of the Native)
উপরোক্ত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, সময় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি প্রজন্মের লেখকরা নিজেদের কালকে বাদ দিয়ে গল্প-উপন্যাসে অতীতের ছবি আঁকলে শরৎ, বিভূতিভূষণ ও হার্ডিদের ভাগ্য বরণ করতে হবে। সমকালের অগ্রগামী ধারাকে অতীতের অগ্রগামী ও অনন্য ধারার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে লেখকের নিজস্ব উদ্ভাবন ক্ষমতায় নতুন পথের সন্ধান দিতে পারলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মনস্ক আগামীদের সময়ে মূল্যায়ন বা আলোচনার সম্ভাবনা থাকে। এ বিষয়গুলো নিয়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি যুগের গল্পকার ও ঔপন্যাসিকদের ভাবতে হবে। অন্যথা সময় যাবে, সিদ্ধি লাভ হবে না।
প্রবন্ধ টি বর্তমান সময়ে যারা লেখালেখি করতে আসছেন, এবং বিজ্ঞান ও সমাজ বাস্তবতা কে আড়াল করে আত্মকেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চা করছে তাদের জন্য অতিব জরুরি।
আমার প্রিয় কবি বন্ধু কে অসংখ্য ধন্যবাদ, এই কারণে তিনি তাঁর গদ্য গুলো আটকে না রেখে পাঠকের জন্য ছেড়ে দিচ্ছন।