অণুগল্প।। মনমন্দিরে।। ফখরুল হাসান
বাসের হেলপারের হাউকাউ আর হাঁকডাকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় আনিসের। হেলপার জোর গলায় ডাকতে থাকে সাইন্সল্যাব, সাইন্সল্যাব, নামেন, নামেন। আবারও মিরপুর, মিরপুর বলে চিল্লাতে থাকে। একে তো জ্যাম, তারপর লোকাল বাস। ঠেলাঠেলি, গাদাগাদি করে যাত্রী উঠিয়েছে। মানুষের কথোপকথনে ঘুম বা অলসতা দূর হয়ে গেছে আনিসের। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাসের একদম সামনের একটা মেয়েকে নিয়ে। বেশকিছু যুবকের মাঝে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রীরা এতোটাই চাপাচাপি করে দাঁড়িয়েছে যে, ওকে তার সিটে বসতে দেবে? আনিসের পক্ষে সেও সম্ভব না। কারণ, দুইতিন হাত দূরে থাকা মেয়েটির পক্ষে আসা সম্ভব না। ওকে ঘিরে থাকা ছেলেগুলোর আলোচনা শুনে বোঝা যাচ্ছে, তাদের রাজনৈতিক দলের নেতার সাথে ভালো সম্পর্ক। হঠাৎ করে মেয়েটি দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের একজনকে থাপ্পড় মারলো। এতোক্ষণে আনিসের অনুমান সঠিক হলো। ছেলেগুলো হয়তো মেয়েটিকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করছিলো। আনিস মনেমনে ভাবলো যথার্থ প্রতিবাদ। পরক্ষণেই আতঙ্কে চিৎকার আর চেচামেচি শুরু হলো বাসে। ছেলেগুলোর কেউ একজন মেয়েটাকে চাকু মেরে বাস থামিয়ে চলে যাচ্ছে! বাসের সবাই নীরব দর্শক! এমন কি আশেপাশের মানুষগুলোও! মুহূর্তে পুরো বাস ফাঁকা। যেনো কোনো যাত্রীই ছিলো না বাসে। আনিস দ্রুত এগিয়ে এলো। মেয়েটার শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণ রক্ত বেরিয়ে গেছে। তাকে কাছাকাছি একটা ক্লিনিকে নিয়ে গেলো আনিস। বিরক্তির ভাব নিয়ে আশেপাশে তাকায়। ভাবে, হায় রে মানুষ! এই ভয়কেই পুঁজি করে আমাদের জিম্মি করে রেখেছে একশ্রেণির কুলাঙ্গার। এদেশের সাধারণ মানুষগুলো যদি এই মেয়েটার মতো একসাথে প্রতিটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতো, তাহলে গুটিকয়েক কুলাঙ্গার এতোটা দাপট দেখাতে পারতো না। ক্লিনিকের করিডোরে পায়চারি করছে আনিস। এমন সময় ডাক্তার এসে জানালেন, ‘কয়েক ব্যাগ রক্ত লাগবে। দ্রুত রক্ত না পেলে মেয়েটিকে বাঁচানো সম্ভব না।’ ডাক্তারের সাথে কথা বলার পর আনিস নিজেই রক্ত দিলো। কিন্তু এই মুহূর্তে মেয়েটির পরিচয় জানা জরুরি। তার সাথে থাকা ব্যাগে কিছু পাওয়া যায় কি না ভেবে ব্যাগটা হাতে নিলো। ওটার ভেতরে থাকা মোবাইলটা হাতে নিতেই যেনো কাঠকাটা কুড়ালের মতো একটা হিংস্র ঘা পড়ে আনিসের কলিজায়। অন্তরভেদী প্রচণ্ড আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে চাইলো, নিটোল গৌরবর্ণের সেই প্রিয় রমণীকে দেখে! তার সাথে ছবিতে সম্ভবত বাংলা সিনেমার ভিলেন জাম্বুর মতো দেখতে পুরুষটাই হয়তো স্বর্ণালির স্বামী। আর বাসে চাকু খাওয়া মেয়েটা তাদেরই সন্তান। ছবিটা দেখে বেশ খানিকটা সময় অপলকনেত্রে চেয়ে থাকলো আনিস। বিশ বছর পর আনিসের মাথায় কতগুলো স্মৃতি এসে হঠাৎ ভীড় জমালো। স্বর্ণালির মনমন্দিরে একমাত্র বসবাস ছিলো আনিসের। আনিসের হৃদয়টা স্বর্ণালির মায়াবী স্নিগ্ধতায় আর প্রেমরসে কেমন যেনো সুখময় হয়ে যেতো! অথচ আজ সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো হাঙ্গামা দানা বেঁধেছে! অতীতে বিনষ্ট প্রেম, আর পরাজিত প্রেমিকের নিজের থেকে পালিয়ে বাঁচার খবর। যার জন্য গত বিশবছর আনিস গ্রামের বাড়িতে যায়নি। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস! তার মেয়েকেই আজকে নিজের শরীর থেকে রক্ত দিতে হলো! রক্তের জাত-পাত কি? অথচ মানুষ, ধর্ম খোঁজে, বংশ খোঁজে! খানিকপর নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করে আনিস। বারবার তার চোখের সামনে একটা চিত্রই ভেসে ওঠে। দৃশ্যটা যে বর্শার তীক্ষ্ণ ফলার মতো! যেনো আনিসের চক্ষু ছিদ্র করে মনের গহীনে প্রবেশ করছে! সেখানে সৃষ্টি করছে এক গভীর আবর্ত। বিশ বছর আগের অতীত নিয়ে ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যার দূরদিগন্তে অর্থহীন দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয় আনিস।
খুব ভালো লাগলো। অসাধারণ একটি অণুগল্প।