গুচ্ছ কবিতা।। ফরিদা ইয়াসমিন সুমি
বেহালা
ওই যে পড়ে থাকে নিরহংকারী শ্বেতকরবী প্রণতি-পবিত্রতা নিয়ে
নিরক্ত বেদনার রঙে
বিদায়ের মতো
বিষাদের মতো
বেহালার মতো
নিশ্চেষ্ট কুঁড়ে হয়ে…
কর্মচঞ্চল যুগে এ তো
রীতিমতো বিদ্রোহ!
চেনা ভালোবাসার চেয়ে
কল্পনার প্রেমিক বেশি নিরাপদ,
যে দেখতে পায় না –
তার জন্য রাত জাগি
কবিতা লিখি,
সুর করি
গান বাঁধি,
তাকে ভালোবাসার জন্য
একা বাঁচি!
ওই যে পড়ে থাকে নির্বাক কুয়া
সত্যের তিক্ততা নিয়ে
ঝরাপাতার ধূসর রঙে
একাকিতার মতো
বিস্মৃতির মতো
তানপুরার মতো
নির্বিকার ধূলো হয়ে…
প্রণয়াত্মক যুগে এ তো
রীতিমতো নিষ্কাম প্রেম!
চেনা ভালোবাসার চেয়ে
কল্পনার প্রেমিক বেশি নিরাপদ,
সান্নিধ্যহীন থেকে থেকে
তাই বাড়িয়ে তুলি
সান্নিধ্যের তাপমাত্রা!
তাকে ভালোবাসার জন্য
একাই বাঁচি!
মৃতমুখ
আমাদের তবু দেখা হয়ে যায় –
জন্ম, মৃত্যু, বিয়ের মতো চিরন্তন পরিণামে, পরিণতিতে।
স্তবকে সাজাই ফুল, ছবিতে ধরি শিশুমুখ, কনেমুখ, নিষ্প্রাণ মৃতমুখটিও! শিশু কাঁদে, কনে কাঁদে, মৃতমুখ দেখে লোকে কাঁদে। আমরা ধরে রাখি কান্নাপর্বের স্মৃতিগুলো। প্রমাণে সচেষ্ট থাকি ডালি ধরেছিলাম আমিও। পরিণামের অন্তর্গত গূঢ়বার্তা সাময়িক অনুরণন তোলে নিউরনে! নিজেকে নিয়ে ভাবিত হই। চিন্তাক্লিষ্ট হই। বিয়ে-মজলিশের আড়ম্বরতায় ভাবি, কী এমন সুখ এনে দেয়, ভারসাম্যে ভরা জীবন ছাড়া? শিশুমুখটিও একদিন আর থাকে না, চলে যায় নিতান্তই একা করে দিয়ে! মৃতমুখটি কাতর করে তোলে সবচে’ বেশি। দাঁড় করিয়ে দেয় নির্মম সত্যের মুখে – জীবন আর মৃত্যুর ফারাক যে রেশমসুতোর প্রস্থের চেয়েও কম! আমরা তবু সংসারে ফিরি, জীবনে ফিরি, কাঁদি, হাসি, ভালোবাসি জাগতিক ভারসাম্য, ভালোবাসি শিশুমুখ, মৃতের জন্য শোকজ্ঞাপনের আড়ম্বর!
দিব্যি
জীবনে বঞ্চনা যত,
প্রবঞ্চনা তারও কিছু বেশি
আদায় করে নেয় অজস্র দিব্যি।
কবিতার ফুল ছিটিয়ে
দিব্যিগুলো সব ভাঙব,
ছলকে পড়তে দেব না
একবিন্দু টলটলে মদিরা,
দলবন্দি করে নেব সমস্ত মাতাল-রাত্রি
সমুদ্র হাসুক লম্পট মাস্তানের মতো
ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকুক চাঁদটা,
তবু দিব্যিগুলো সব ভাঙব।
ভেঙে যাক স্বপ্ন কঠিন আঘাতে
হৃদয়হীন প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে
দেয়ালে পড়ুক হিমাদ্রি-নীরব ছায়া,
কবিতার সুরভিতে উত্তরমালা হবে
ভূমধ্যসাগরের জলের মতো নীল।
বিদ্যুৎ দেখে বজ্র এড়ানো কঠিন
তবু দিব্যিগুলো সব ভাঙব,
কবিতার নদী অবগাহনে
প্রেমের পাঠ হবে চুম্বনে!