ছোটগল্প

ছোটগল্প।। জাপানি পুতুল।। কাজী সাবরিনা তাবাস্সুম

আমাদের একটা জাপানি পুতুল ছিল। রক্ত মাংসে গড়া সেই পুতুল। বাবা, মা, আমি, আমরা সবাই সেই পুতুল নিয়ে দিনরাত খেলতাম। সে অনেক বছর আগের কথা। অথচ মনে হয় এইতো সেদিনের গল্প ! বাবা পিএইচডির বৃত্তি পায় জাপান সরকার থেকে। আমি তখন চার কি পাঁচ বছরের। বৃত্তিটা ছিল আমার প্রফেসর বাবার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। কিন্তু আমাকে আর মা কে ছেড়ে থাকা বাবার পক্ষে সম্ভব ছিলনা। অগত্যা বাবা মা আর আমি বাক্স পেটরা গুছিয়ে জাপান পাড়ি জমালাম। ওসাকা শহরের ছোট ছিমছাম একটা ডরমেটরির দুইতলার একেবারে কোণায় শুরু হলো আমাদের এক রুমের নতুন সংসার। আমার এখনো মনে আছে ঢাকার সাজানো গোছানো ফ্লাটবাড়ি ছেড়ে ওসাকার এক রুমে সংসার করতে আমার মা কি পরিমান ত্যাগ স্বীকার করেছিল! মা মুখ ফুটে কিছু বলতোনা পাছে বাবার পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। আমাকেও খুব নিয়ন্ত্রণে রাখতো, যেন আমি বাবাকে বিরক্ত করতে না পারি। ছোট হলেও কেন জানিনা আমার সব মনে আছে।
ভিনদেশে বাস করার পারমিট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট হাতে পাওয়া মাত্রই বাবা মা আমাকে কাছের একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। আমি স্কুলে শিখতে লাগলাম জাপানিজ, আর সমান তালে বাসায় আমাকে তালিম দেওয়া হতো ইংরেজীর জন্য। আমার ছোট মন তখন বুঝতোনা দুইটি ভাষা একসাথে কেন শিখতে হবে? সে অন্য কথা, আমি কিন্তু এখনও জাপানি কিছু শব্দ মনে রেখেছি। ওসাকা আমার অন্তরের বিশাল একটা জায়গা জুড়েই রয়েছে।
মনে আছে , মাও জাপানি কালচারে খুব আকৃষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে স্কুলে দিয়েই মা চলে যেতেন ইকেবানার ক্লাসে। ইকেবানা হলো বহুল জনপ্রিয় এবং প্রাচীন একটা রীতি, যাতে শেখানো হয় বিভিন্ন ফুল এবং পাতা নির্দিষ্ট পরিমাপে কেটে একসাথে সাজানোর প্রক্রিয়া। মা ইকেবানার এতই ভক্ত যে এখনো আমাদের বাসার প্রতিটি কোণে মায়ের তৈরী সুন্দর সুন্দর ইকেবানা সাজানো।
এইভাবে বছর দুয়েক কিভাবে কেটে গেল আমরা বুঝতেও পারিনি। ইকেবানার পাশাপাশি মা একটি সুশি রেস্টুরেন্টেও পার্টটাইম কাজে ঢুকে গেল। পিএইচডি কোর্সে বাবার কর্মদক্ষতা ব্যাচমেটদের হার মানাতো। আনন্দে কেটে যাচ্ছিল সময়। বাবা ডরমেটরী ছেড়ে দিয়ে ছোট একটা বাসা ভাড়া করলেন। সারা সপ্তাহ আমরা যার যার কাজ এবং দায়িত্ব নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত থাকতাম। সপ্তাহান্তে ঘুরতে বের হতাম। শনি আর রবিবার আমরা ওসাকার আনাচ কানাচ চষে বেড়াতাম।
এর ধারাবাহিকতায় একদিন বাবা প্লান করলেন সাকুরা দেখাতে নিয়ে যাবেন। জাপানি ভাষায় সাকুরা মানে চেরীফুল। জাপানে শীতের শেষে বসন্ত আসা মানেই চারিদিক ছোট ছোট সাদা গোলাপী ফুলে ভরে যাওয়া। বড় বড় গাছ, একটা পাতাও নেই, ফুলের ভারে নুয়ে পড়ছে যেন। সে এক অনিন্দ সুন্দর দৃশ্য। ওসাকায় এমন তো প্রতিবছর দেখি, তাহলে আবার কোন সাকুরা দেখাতে চাইছেন বাবা? মা মেয়ের কৌতুহলকে বাড়িয়ে দিলেন সারপ্রাইজ শব্দটা ব্যবহার করে।
নির্দিষ্ট দিন তৈরী হয়ে আমরা ট্রেনে চাপলাম সাকুরা দেখার উদ্দেশ্যে। এখনও চোখে ভাসে সে দৃশ্য। সেদিন জাপান আমার কাছে অন্যরকম সুন্দর হয়ে ধরা দেয়! একটা লেক চলে গেছে এঁকে বেঁকে, তার দুধারে ঘন সবুজ মাঠের উপর সাড়ি সাড়ি চেরি ফুলের গাছ! গাছ থেকে ফুল ঝরে পড়ে লেকের ওপর। দেখে মনে হয় লেক নয়, ফুলের গালিচা। লেকে আবার নৌকা চলে। নৌকা যাওয়ার সময় ঝরে পড়া ফুলগুলো সরে যায়। মনে হয় যেন গোলাপী রঙের পানির উপর নৌকা। সে দৃশ্য ভোলার নয়।
মূলত সেটি ছিল একটি বিখ্যাত পার্ক। আমরা সারাদিন খুব আনন্দ করলাম। প্রচুর ছবি তুললাম। মা রান্না করে খাবার নিয়েছিল সঙ্গে। দুপুরের একটু পর একটা গাছের নিচে বিছানার চাদর বিছিয়ে খেতে বসেছিলাম। ঠিক তখনই চোখ গেল গাছের পেছনে। ছোট ছোট দুটি চোখ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক যেন একটি পুতুল।আমি ইশারা করতেই টুকটুক পায়ে আমার কাছে আসলো। আড়াই কি তিন বছর হবে বয়স। দেখে কেন যেন মনে হলো খুব অসহায়। নাম জিজ্ঞেস করতেই বললো তার নাম “নিজুকো”। বলা বাহুল্য আমি তখন বেশ ভাল জাপানি পারতাম। নিজুকোকে বললাম, সে চাইলে আমাদের সাথে খেতে পারে। মেয়েটা অবাক করে দিয়ে রাজি হয়ে গেল! আম্মুর রান্না করা ঝাল ঝাল বিরিয়ানি বেশ আগ্রহ নিয়েই খাচ্ছিল। কিন্তু বাবা আমার মত অবাক হতে পারেনি। তার কারন আমরা নিজুকোর মা বাবা কিংবা কোন বড় মানুষকে দেখতে পাইনি ওর সাথে। হারিয়ে গেল কিনা! এই চিন্তায় বাবা মা কিছু খেতেও পারছিলনা। নিজুকোকে জিজ্ঞেস করাতে সে কিছুই বলতে পারেনি। শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল। তবে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে বেশ ক্ষুধার্ত। তা যাই হোক, বাবা আমাদের বসিয়ে রেখে আশেপাশে খোঁজা শুরু করলেন।
এখনও মনে আছে নিজুকোর ব্যপারে খোঁজ করতে করতে সেদিন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। আমরা শেষ ট্রেনটাও মিস করলাম। ততক্ষনে নিজুকো আমার খুব বন্ধু হয়ে গিয়েছে। অনেক দৌড়াদৈড়ির পর এক স্যুভেনিরের দোকানের মালিকের কাছ থেকে বাবা আসল ঘটনা জানলেন। নিজুকোর বাবা নেই। তার মা তাকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে স্যুভেনির বিক্রি করতো। দুইদিন আগে হঠাৎ করে মহিলা মারা যায়। সম্ভবত হার্টঅ্যাটাক। এরপর থেকে নিজুকো এই পার্কে হেঁটে বেড়াচ্ছে। লোকজনের জানামতে ওর আর কেউ নেই। ঘটনা শুনে বাবা এত কষ্ট পেলেন। হুট করে মাথায় একটা বুদ্ধি এল। স্যুভেনির দোকানের ঐ লোককে বললেন নিজুকোকে বাবা সঙ্গে নিয়ে যেতে চান। আমার ছোট বোন হিসেবে আমার সাথে থাকবে। দত্তক নেয়া বলতে যা বোঝায় আর কি। ঐ অল্প সময়ে নিজুকো আমাদের মনের ভিতরে বড় জায়গা করে নিয়েছিল। বাবার এই সিদ্ধান্তে আমি এবং মা প্রচন্ড খুশি হলাম। কিন্ত লোকটি আমাদের হতাশ করে বললো, দত্তক নেয়ার ব্যপারে সে কোন সাহায্য করতে পারবেনা কারন নিজুকোকে আমরা রাস্তায় পেয়েছি। সে এতিমখানায় থাকলে তাকে দত্তক নেয়া যেত। অতঃপর বাবা বললেন আপাতত নিজুকোকে আমরা নিয়ে যাই, যেহেতু ওর কেউ নেই। কিন্তু বিনিময়ে আমাদের ঠিকানা, ফোন নাম্বার এবং প্রয়োজনীয় তথ্য লোকটির কাছে জমা দেন নিজুকোর খোঁজে যদি কেউ আসে তার সুবিধার জন্য। দোকানের মালিকের ঠিকানা এবং ফোন নাম্বার বাবা নিজের নোটবুকে টুকে নেন।
আমরা বাড়ি ফিরি জাপানি পুতুলকে সঙ্গে নিয়ে। কোন এক অজানা কারনে নিজুকো সম্পূর্ণ অচেনা এই আমাদেরকে খুব আপন করে নেয়। আমরাও জাপানি পুতুলকে কচলে ভর্তা বানিয়ে ফেলতাম। ওকে আমরা নিজুকো কম, পুতুল বলেই ডাকতাম বেশি। ছোট্ট একটা জাপানি বাচ্চা বাঙালি কালচারে কি করে মিশে গেছে তা আমাদের কাছে আজও বিষ্ময়। বাবা প্রায়ই ঐ দোকানদারকে ফোন দিতেন নিজুকোর খোঁজ কেউ করেছে কিনা জানার জন্য। যদিও আমরা কেউ চাইতাম না নিজুকোর খোঁজ কেউ করুক।
জাপানি পুতুলকে আমরা বড় করতে লাগলাম বাঙালি নিয়মে। ওকে খাওয়ানো, গোসল করানো, পার্কে নিয়ে যাওয়া, সর্বপোরি বাঙলা শেখানো, আমরা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু তা ছিল আনন্দময় ব্যস্ততা। এভাবে কেটে গেল আরও তিনটি বছর। বাবা পিএইচডি শেষ করে ভাল একটা চাকরি করছেন। আমার বয়স তখন দশ। আর নিজুকোকে দেখে মনে হয় বয়স পাঁচ আর ছয়ের মাঝামাঝি। জাপানি পুতুল যখন বাঙলা বলে মনে হয় চাবিওয়ালা বারবিডল কথা বলছে।আশ্চর্যের বিষয় হলেও সত্য, এতদিনেও নিজুকোর জন্য কেউ কোন খোঁজ করেনি। নিজুকোও তিনটা বছরে একদিনের জন্যও কাঁদেনি। আমার বাবা মা কে সেও বাবা মা ডাকতো। আমাকে ডাকতো দিদি। মা শিখিয়েছিলেন। একটা দিনের জন্যও আমাদের মনে হয়নি নিজুকো আমাদের কেউ না। ওর দেশ পরিবার ধর্ম আলাদা।
আরও বছরখানেক পর ঢাকায় বাবা একটা বিশাল বড় সুযোগ পেলেন। যেমন সুযোগ চেয়েছিলেন ঠিক তেমন। বাবা ঠিক করলেন দেশে ফিরে যাবেন। আমি আর মা প্রচন্ড খুশি হলাম। দেশে আবার সেই পুরোনো ফ্লাট নতুন করে সাজাবে মা। জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। কিন্তু নিজুকোকে ছাড়া তো আমরা থাকতে পারবোনা। বাবা ঠিক করলেন নিজুকোকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন, বৈধভাবে। বিনিময়ে যা খরচ করার করবেন। আমরা বুঝতে পারছিলাম বাবার হয়তো বিশাল একটা বাজেট রাখতে হবে নিজুকোকে বাংলাদেশ নিয়ে যাওয়ার জন্য। চায়না ট্রিপের প্লান করেছিলাম আমরা। সেটাও বাদ দিলাম। বাবা খোঁজ করা শুরু করলেন। কথা বললেন উকিল এবং পুলিশদের সাথে কয়েক ধাপে। এক পর্যায়ে বাবাকে যেতে হলো বাংলাদেশ এম্বেসীতে, জাপানের স্বরাষ্ট্র, আইন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে। প্রচুর টাকা এখানে সেখানে দিতে হলো। নিজুকোর পাসপোর্ট রেডি করা হলো। শেষ মুহূর্তে বাবার নামে সরকারী চিঠি আসলো, জাপানি মেয়েকে বাঙালী মানুষের কাছে দত্তক দেয়া হবেনা। সুতরাং বাবা কোন অবস্থাকেই নিজুকোকে বাংলাদেশ নিয়ে যেতে পারবেনা। শুধু তাই নয়, বাবার উপর নির্দেশ জারি করা হয়েছে আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে নিজুকোকে নিকটস্থ অনাথআশ্রমে রেখে আসার জন্য। নতুবা বাবার উপর আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে! জাপানে সরকারি চিঠির ভাষা এত পরিষ্কার, আমাদের বলার মত একটি কথাও থাকলোনা। স্পষ্ট মনে আছে, ঐ আটচল্লিশ ঘন্টা আমাদের বাসায় মাতম চলছিলো। কেউ কারোও সাথে একটি কথাও বলিনি।
নির্দিষ্ট দিন জাপানি পুতুলকে জাপানি অনাথআশ্রমে দিতে গেলাম আমরা। ওকে রেখে চলে আসার সময় ওর কান্নাটা আমার এখনো চোখে ভাসে। চিৎকার করে কাঁদছিল তবু জাপানিদের মন গললোনা। কেউ পেছন থেকে আমাদের ডেকে বলেনি নিজুকোকে নিয়ে যান। আমরা বাড়ি ফিরলাম, দেশে ফিরলাম কিন্তু প্রায় বছরখানেক একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। পরিবারে একজন মারা গেলে বোঝানো যায় নিজেকে। কিন্তু জলজ্যান্ত পুতুলটাকে এতদিনের ভালবাসা বিসর্জন দিয়ে রেখে আসতে হবে তা কি ভেবেছি কেউ? বাবা মায়ের দিকে তাকাতে পারতাম না আমি। বাবা তারপরেও সবসময় খোঁজ রাখতো নিজুকোর। ওর সাথে কথা বলার কোন সুযোগ ছিলনা। বাবা অনাথআশ্রমের ল্যান্ডফোনে কল করে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতো শুধু নিজুকো কেমন আছে তা জানার জন্য। ওরা আর কোনো তথ্যই দিতোনা। বছরখানেক পর অনাথআশ্রমের কেয়ারটেকার জানায়, এক জাপানি দম্পতি দত্তক নিয়েছে তাকে। ব্যক্তিগত স্বার্থে ঠিকানা প্রকাশ করা যাবেনা।
ব্যাস! জাপানি পুতুল সম্পর্কে আমরা আর কিছুই জানিনা। আজ বিশটি বছর হয়ে গেল। পুতুলটা বাঙলা মনে রেখেছে কিনা কে জানে? দেশে এসে পাগলের মত কাঁদতাম ওর জন্য। সে কি তা জানে? তার কি মনে পড়ে আমার কথা? তাকে কি করে জানাবো আমি নিজেই এখন একটা পুতুলের মা। পরম স্নেহের কন্যার নাম আমি রেখেছি নিজুকো। জাপানি পুতুলটাকে ধরে রাখতে পারিনি, অন্তত জাপানি নামটা থাকুক আমার অস্তিত্বে। এই নামেই বড় হোক আমার বাংলাদেশী পুতুল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *