মুক্তিযুদ্ধের ছোটগল্প।। আব্দুল আজিজের জয় বাংলা।। ইমদাদুল হক মিলন
আব্দুল আজিজের মনটা ভালোই থাকে না।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তার এই অবস্থা। মনটা সবসময় খারাপ। সারাক্ষণ বিষণ্ন হয়ে থাকে। উদাস হয়ে গ্রামের এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ-খবর নেয়। চৌধুরী বাড়ির ছোট চৌধুরী সিরাজ মাস্টার তাদের স্কুলের বাংলা টিচার। বয়স্ক লোক, তবে চিরকুমার। বিয়ে তো করেননি। ঘর সংসার নেই। টাকা-পয়সা, জায়গা-সম্পত্তি ম্যালা। গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। টাকা-পয়সা দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে তাদের সহযোগিতা করেন।
সিরাজ স্যারের কাছে যুদ্ধের অনেক খবর।
দেশের কোথায় কী হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা কায়দায় নাস্তানাবুদ করছে পাকিস্তানি জন্তুগুলোকে, কোথায় কোথায় সামনাসামনি যুদ্ধ হচ্ছে, মিলিটারি কী হারে মারা পড়ছে, রাজাকার শান্তিবাহিনীর লোক, আল-বদর, আল-শামসরা কী হারে মারা পড়ছে সব খবর আছে স্যারের কাছে।
সুযোগ পেলেই সিরাজ স্যারের কাছে যায় আজিজ। দেশের খবর নেয়, যুদ্ধের খবর নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ে খুশিতে ফেটে পড়ে। ওই যে বঙ্গবন্ধু তাঁর সাতই মার্চের ভাষণে বলেছিলেন না, ‘আমরা তোমাদের ভাতে মারবো, আমরা তোমাদের পানিতে মারবো’ আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের ঠিক ওইভাবেই মারছে। গানবোট নিয়ে কোথাও যাচ্ছে পাকিস্তানি মিলিটারি, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা, আমাদের বিচ্ছুরা খাল কিংবা নদীর তীরে লুকিয়ে থেকে হঠাতই আক্রমণ করলো। গানবোট ডুবিয়ে দিলো। গুলি খেয়ে মরলো নরপশুরা, পানিতে ডুবে মরলো।
এইসব শুনে খুশি যেমন হয় আজিজ, আনন্দে মন যেমন ভরে যায়, সেই মন আবার খারাপও হয়। স্যারকে একদিন মন খারাপের কথাটা আজিজ বললো।
সন্ধ্যার পর নানান অছিলায় বাড়ি থেকে বেরোয় আজিজ। স্যারের বাড়ির কথা বলে বেরোয় কোনো দিন, কোনো দিন বেরোয় অন্য কথা বলে, মিথ্যা কথা বলে। একদিন হয়তো বললো, যাই সিরাজ স্যারের কাছে। দেশের খোঁজ-খবর একটু নিয়ে আসি।
মা কিছু বললেন না। পর দিনও হয়তো সিরাজ স্যারের কথাই বললো। মা আজ ধরলেন। রোজ রোজ সিরাজ স্যারের কাছে কী কাজ?
ওই যে বললাম দেশের খবর নিয়ে আসি। স্যারের ট্রানজিস্টার আছে। সন্ধ্যার পর স্যার তার ট্রানজিস্টারে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ধরেন। সেখানে শুধু মুক্তিযুদ্ধের খবর। কোথায় কোথায় খান সেনাদের মারছে মুক্তিযোদ্ধারা, ওগুলো তো আমরা বলি ‘মছুয়া’, মছুয়ারা কেমন মার খাচ্ছে ওইসব খবর পাওয়া যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় কোন ব্রিজ উড়িয়ে দিল, গানবোট ডুবিয়ে মারলো পাকিস্তানি কুত্তাগুলোকে এইসব খবর শুনতে যাই। ‘চরমপত্র’ নামে একটা অনুষ্ঠান হয়, সেটা শুনি, ‘জল্লাদের দরবার’ নামে নাটক হয় সেটা শুনি। এখন তো আর লেখাপড়া নাই, কী করব বলো? স্যারের কাছে গেলে দেশের খবর পাই, তাতে আমার খুব ভালো লাগে।
মা গম্ভীর। বুঝলাম কিন্তু রোজই খবর শুনতে যেতে হবে কেন? দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। এই অবস্থায় রোজ সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বেরোবার দরকার নেই।
মাকে পটিয়ে সেদিন হয়তো বেরোল আজিজ। পরদিন মা পারমিশান দিলেন না। আজিজ পালিয়ে চলে গেলো। হয়তো দু’তিনদিন এইভাবে পালিয়ে পালিয়ে গেলো। তারপর একদিন গেলো তার বন্ধু আজমলের বাড়ির কথা বলে। আরেকদিন গেলো রশিদের কথা বলে। তারপর আবার একদিন গেলো সিরাজ স্যারের কথা বলে। মার সঙ্গে কোনো রকমের চালাকি সাধারণত করে না আজিজ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে করতে হচ্ছে। কী করবে, বাড়িতে যে তার মনই টিকে না।
আজিজের বয়স ঊনিশ বছর। শরীর-স্বাস্থ্য দেখে ঊনিশ বছরের ছেলে তাকে মনে হয় না। মনে হয় বড়জোড় তার চৌদ্দ পনেরো বছর বয়স হতে পারে। পাঁচ ফুটের মতো লম্বা। অতি রোগা। একবার বৈশাখ মাসের বিকালবেলা স্কুল থেকে ফিরছে, হঠাৎ আকাশ অন্ধকার করে কাল বৈশাখি শুরু হলো। আচমকা এমন একটা দমকা হাওয়া এলো, আজিজকে আক্ষরিক অর্থেই কয়েক হাত দূরে উড়িয়ে নিয়ে ফেললো। ঝড় দেখে বইগুলো দু’হাতে শক্ত করে ধরেছিলো বুকের কাছে, বইপত্র উড়ে গেলো না। আজিজ নিজেই উড়ে গিয়ে দূরে পড়লো। সঙ্গের বন্ধুরা এই দেখে কী হাসি!
আজিজের চেহারাটা সুন্দর তবে গায়ের রং কালো। হাত-পা মাকড়সার হাত-পায়ের মতো। লিকলিকে। দাঁতগুলো চকচকে সুন্দর। মাথার চুল অতিরিক্ত ঘন। সমস্যা ওই শরীরটা। শার্ট-প্যান্ট পরলে কাকতাড়ুয়ার মতো দেখায়। ছাত্রও তেমন ভালো না আজিজ। তার বয়সি ছেলেরা কলেজে পড়ে আর সে এখন পড়ছে ক্লাস নাইনে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে দেখে স্কুলে যায় না। পড়াশোনা অনেকের মতো তারও বন্ধ। দেশ স্বাধীন হলে আবার শুরু হবে পড়াশোনা।
আজিজের স্কুলের নাম রাজদিয়া অভয় পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। গ্রামের নামও রাজদিয়া। বিক্রমপুর অঞ্চলের বিখ্যাত গ্রাম। স্কুলের বয়স হবে পঞ্চাশ বছর।
আজিজ তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। বাবা মারা গেছেন আজিজ যখন ক্লাস ফোরে পড়ে। আর্থিক অবস্থা খারাপ না আজিজদের। বাড়িতে বড় বড় ঘর আছে তিনটা। বাগানে গাছপালা আছে অনেক, বাঁশঝাড় আছে। মাঠে ধানের জমি আছে অনেক। সেইসব জমির ধানে মা-ছেলের সংসার ভালোই চলে। বাড়িতে পুরনো কাজের লোক আছে রহমান আর তার বউ। তাদের বাচ্চাকাচ্চা নেই। ওই দুজন মানুষই আজিজদের সংসার সামলায়।
যেদিনই সিরাজ স্যারের কাছে যায় আজিজ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের খবর শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
একদিন সিরাজ স্যার ধরলেন। তোর ব্যাপারটা কী রে?
: কোন ব্যাপারটা স্যার?
এই যে দীর্ঘশ্বাসের ব্যাপারটা? আমি খেয়াল করেছি মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের কথা শুনে, তারা ব্রিজ উড়াচ্ছে, মিলিটারি মারছে এসব শুনে তুই খুবই খুশি হয়ে উঠিস, গভীর আনন্দে হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠিস, তারপর মন খারাপ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিস। কারণটা কী?
: কারণটা আপনি বুঝতে পারেন না স্যার?
: না।
: আমি স্যার দীর্ঘশ্বাসটা ফেলি নিজের জন্য।
: নিজের জন্য?
: জি স্যার।
: কেন? তোর কী হয়েছে?
: এই যে স্যার আমি দেখতে এতো ছোট, এতো রোগা।
তাতে কী হয়েছে? দুনিয়ার সব মানুষ কি লম্বা চওড়া স্বাস্থ্যবান হবে নাকি? বেটে রোগা লোক থাকবে না? সব রকমের মানুষ নিয়েই তো মানুষের সমাজ, দেশ।
আমার দুঃখ এটাই স্যার। আমার বয়স ঊনিশ বছর। আমার বয়সি কতো ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে। দেশের জন্য যুদ্ধ করছে। পাকিস্তানি জন্তুগুলোকে মারছে। আর আমি ঘরে বসে আছি। দেশের এই দুঃসময়ে দেশের জন্য স্যার কিছুই করতে পারছি না। এজন্য মনটা খারাপ থাকে। ওই দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
সিরাজ স্যার তাঁর মায়াবী হাত রাখলেন আজিজের মাথায়। মন খারাপের কিছু নেই রে, পাগল! দেশের সব মানুষ তো আর মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেয়নি। সবাই যুদ্ধেও যেতে পারেনি। কিন্তু ঘরে বসেও যুদ্ধটা তারা করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে, আশ্রয় দিয়ে, খাবার দিয়ে। পাকিস্তানিদের খবরাখরব দিয়ে যে সহযোগিতা তাদের করছে এটাও মুক্তিযুদ্ধ। সেই অর্থে পাকিস্তানপন্থি কুকুরগুলো ছাড়া, অর্থাৎ রাজাকার আল-বদর, আল-শামস শান্তিবাহিনীর দালালগুলো ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ এখন মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে দেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করছে। সেই অর্থে তুইও মুক্তিযোদ্ধা।
সিরাজ স্যারের মুখের দিকে তাকালো আজিজ। মুখটা উজ্জ্বল হলো তার। চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। আমিও মুক্তিযোদ্ধা, স্যার? আপনি বলছেন?
হ্যাঁ নিশ্চয়। তুইও মুক্তিযোদ্ধা। আমিও মুক্তিযোদ্ধা। সরাসরি যুদ্ধ করছি না। যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করছি। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করছি। দেশের স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা করছি। আমার মুক্তিযুদ্ধ এটাই।
বুঝলাম স্যার। আপনি মুক্তিযোদ্ধাদের নানা রকমভাবে সহযোগিতা করছেন, টাকা-পয়সা দিচ্ছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধে আপনার একটা অংশগ্রহণ আছে, কিন্তু আমার কী আছে? যখন আমাদের এলাকার যুবকরা, পঁচিশে মার্চের পর দুজন চারজন করে কলকাতা আগরতলা ওসব জায়গায় যেতে শুরু করলো, ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হবে, আমাদের স্কুল মাঠে কয়েকদিন নানা রকম শরীরচর্চা করালেন ইপিআরের হাবিলদার সাহেব, আমিও স্যার সেই শরীরচর্চায় অংশ নিয়েছিলাম। টুকটাক শরীরচর্চা করলামও। হাবিলদার সাহেব সিলেক্ট করছিলেন কে কে যুদ্ধে যেতে পারবে। আমি তাকে ধরেছিলাম। তাকে সবাই ‘ওস্তাদ’ বলতো। আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওস্তাদ, আমাকেও পাঠান। আমিও যাবো। আমিও অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করবো। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। তুই যাবি যুদ্ধে? পাগল হয়েছিস নাকি? আরে তোর যা শরীর স্বাস্থ্য, তুই তো একটা থ্রি নট থ্রি রাইফেলই আগলে ধরতে পারবি না! তুই যুদ্ধ করবি কী করে? শুনে আমি খুব দুঃখ পেয়েছিলাম স্যার। আমার মুখটা ম্লান হয়ে গিয়েছিলো, মনটা ভেঙ্গে গিয়েছিলো। হাবিলদার সাহেব আমার মনের অবস্থাটা বুঝলেন। আপনার মতোই এরকমভাবে আমার মাথায় হাত রাখলেন। তুমি মন খারাপ করো না বাবা। যুদ্ধের সময় সবাই অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে পারে না। যোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা করাও যুদ্ধে অংশগ্রহণ। এমন কি যুদ্ধটাকে সাপোর্ট করাও যুদ্ধ। তুমি যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাও, পাকিস্তানিদের ধ্বংস চাও, জয় বাংলা স্লোগানে তোমার রক্ত যদি টগবগ করে ফোটে তাহলে তুমিও এক রকমের মুক্তিযোদ্ধা।
সিরাজ স্যার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ঠিক একদম ঠিক। হাবিলদার সাহেব একদম ঠিক কথা বলেছেন। এই যে তুই প্রতি সন্ধ্যায় কোনো না কোনো উছিলায়, মাকে বলে না বলে আমার বাড়িতে আসছিস, আমার সঙ্গে বসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনছিস, মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যে খুশি হচ্ছিস, চিৎকার করে না হোক, নিচু স্বরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিস, তুই তো মুক্তিযোদ্ধাই। আজ থেকে কিছুতেই আর মন খারাপ করে থাকবি না। ওরকম দীর্ঘশ্বাস ফেলবি না।
আব্দুল আজিজ খুবই খুশি হলো। মনের ভিতর চেপে থাকা পাথরটা নেমে গেলো তার। খুবই আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরলো সে।
২
সকাল নয়টার দিকে মা বললেন, বাজারে যা আজিজ। শুনলাম বাজারে বড় বড় ইলিশ উঠছে। একটা ইলিশ নিয়ে আয়। দামও নাকি কম। এক টাকায় বড় একটা ইলিশ পাওয়া যাবে।
নাশতাটা আজ খুব ভালো হয়েছে। গরম গরম চিতইপিঠা আর ঝোলাগুড়। ঝোলাগুড়ে চিতইপিঠা মাখিয়ে খেতে খুবই পছন্দ করে আজিজ। আজ সেই জিনিসই খাওয়া হয়েছে। খেয়ে বই নিয়ে একটু বসেছিলো। তখনই মা এসে ওকথা বললেন। আজিজ উঠলো। টাকা দাও, যাই বাজারে। তোমার ইলিশ মাছ নিয়ে আসি। তবে আমার দুটো কথা আছে।
: কী কথা?
দুপুরবেলা কড়কড়া ইলিশ ভাজা হবে আর বেগুন দিয়ে রান্না হবে ঝোল করে। আমি দু’টুুকরো ভাজা ইলিশ আর ঝোল ইলিশ খাবো এক টুকরা। সঙ্গে ঘন একটা ডাল থাকবে। দু’চামচ ঘিও দিতে হবে আমাকে। ডালের সঙ্গে একটুখানি ঘি থাকলে খাওয়াটা খুবই জমবে।
মা হাসলেন। আচ্ছা ঠিক আছে। তুই আমার একটা মাত্র ছেলে, তোর কথা কি আমি ফেলতে পারি?
: এবার অন্য কথাটা বলি?
: বলো।
: একটা টাকা বেশি দিবে আমাকে?
: কেন?
নন্দর দোকানের রসগোল্লা খাবো। এক টাকায় মুঠো সাইজের চারটা রসগোল্লা পাওয়া যাবে। বাজারে গিয়ে প্রথমে ইলিশ মাছটা কিনবো তারপর চারখানা রসগোল্লা খেয়ে বাড়ি ফিরবো। বাজারে যেতে যেতে খিদা লেগে যাবে। চারটা রসগোল্লা খেলে বাজারে যাওয়া-আসার কষ্ট থাকবেই না।
: ঠিক আছে। দেবো। যা।
সব মিলিয়ে টাকা দিলেন মা তিনটা। যদি ইলিশের দাম দু’চার আটআনা বেশি হয়!
তিন টাকা পকেটে নিয়ে বাজারের দিকে হাঁটতে লাগলো আজিজ।
সিরাজদিখান বাজার মাইলখানেক দূরে। আজ রোদও উঠেছে বেজায়। মা বলেছিলেন, ছাতা নিয়ে যা আজিজ। আজিজ নেয়নি। ছাতা জিনিসটা সে খুব একটা পছন্দ করে না। বোঝা মনে হয়। রোদের যতো তেজই হোক, বাংলাদেশের রোদ তো! এই রোদ গায়ে মাথায় লাগলেই তো ভালো! বাংলাদেশের রোদ হাওয়া বৃষ্টি এসবের কি কোনও তুলনা আছে?
চটের একটা ব্যাগ হাতে রওনা দিয়েছে আজিজ। পরনে লুঙ্গি আর হাফহাতা সবুজ রঙের শার্ট। কালো রাতে সিরাজ স্যারের কথা শোনার পর থেকে মন খুব ভালো। গ্রামের রাস্তা দিয়ে হনহন করে হাঁটছে আজিজ আর গুন গুন করে গান গাইছে।
জয় বাংলা বাংলার জয়, হবে হবে হবে, হবে নিশ্চয়…
বাজারের উত্তর দিকটায় খাল। জেলেরা মাছ নিয়ে বসে ও-দিকটায়। বাজারে ঢুকে ওদিকটায় মাত্র পা বাড়িয়েছে আজিজ এসময় রব উঠলো, মেলেটারি আসতাছে, মেলেটারি আসতাছে…
মিলিটারিরা এরকম হানা দিচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। সঙ্গে থাকে রাজাকাররা, শান্তিবাহিনীর লোকেরা। জন্তুগুলো আসছে শুনলেই মানুষ যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। গ্রাম খালি হয়ে যায়, বাজারঘাট দোকানপাট খালি হয়ে যায়। সব ফেলে মানুষ পালায় প্রাণের ভয়ে।
আজও তাই হলো। মিলিটারি আসছে শুনে মুহূর্তে বাজার ফাঁকা হয়ে গেলো। দোকানপাট সাওদাপাতি ফেলে প্রাণভয়ে পালিয়ে গেলো বাজার করতে আসা লোকজন আর দোকানীরা।
আজিজ দিশাহারা। সেও দৌড় দিলো। দুর্ভাগ্য আজিজের, বুঝতে পারেনি কোনদিকে দৌড় দেবে। যেদিকে দৌড় দিলো সেদিক দিয়েই বাজারে এসে ঢুকেছে মিলিটারিদের দুটো জিপ। আজিজ তাদের মুখোমুখি পড়ে গেলো।
আর উপায় কী! থতমত খেয়ে দাঁড়ালো আজিজ।
মিলিটারি আর রাজাকাররা গাড়ি থেকে নেমেছে। বাজারে ঢুকে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে গেছে। এই দোকান ওই দোকানে ঢুুকে যা যা ইচ্ছা নিয়ে গাড়িতে তুলছে। কাজটা করছে রাজাকাররা। ওরা তো পাকিস্তানিদের চাকর-বাকর। চাকর-বাকরের কাজটাই করছে।
বাজারে কোনও লোক নেই, শুধুই আজিজ।
জিপের সামনে দাঁড়ানো তিনটি মছুয়ার একটি ইশারায় আজিজকে ডাকলো। এ লাড়কা, ইধার আও।
আজিজ গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়ালো। ভয়ে আতঙ্কে গলা শুকিয়ে গেছে। বুক ধড়ফড় করছে।
যে জন্তুটা আজিজকে ডেকেছে তার হাতে রিভলবার। রিভলবারটা বেশ কায়দা করে ঘোরাচ্ছে সে। যেন জিনিসটা নিয়ে খেলছে। অন্যগুলোর হাতে রাইফেল। রাইফেলের ডগায় চকচকে বেয়নেট। আজিজ একটা ঢোক গিলে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মছুয়াটি তীক্ষ্ণ চোখে আজিজকে দেখলো। তারপর বললো, বোলো, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। আজিজ মাথা নিচু করলো।
মাছুয়া রিভলবার ঘোরাতে ঘোরাতে বললো, কিয়া হুয়া? বোলো বোলো। বোলো, পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
কাল রাতের কথা মনে পড়লো আজিজের। সিরাজ স্যারের কথা মনে পড়লো। স্যার বলেছেন, আজিজও মুক্তিযোদ্ধা। সে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছে না, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ। মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যে আনন্দে ফেটে পড়ছে। দেশের স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা করছে। কোনও মুক্তিযোদ্ধা কি ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলতে পারে?
: না পারে না। কিছুতেই পারে না।
আব্দুল আজিজ তার ডানহাত মুঠো করে আকাশের দিকে তুললো। গলা ফাটিয়ে, চিৎকার করে বললো, জয় বাংলা।
মছুয়া হতভম্ব। তার হাতের রিভলবার থেমে গেলো, কেয়া, কেয়া বোলা?
চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো তার। সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো, মারো ছালে কো…
সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে ঝাপিয়ে পড়লো কুকুরগুলো। রাইফেলের বাট দিয়ে যে যেভাবে পারে মারতে লাগলো আজিজকে। আজিজের মাথা ফেটে গেলো, কপাল ফেটে গেলো। নাক থেতলে গেলো, ঠোঁট ছিন্নভিন্ন হলো, মুখের ভেতর খসে পড়লো বেশ কয়েকটা দাঁত। রক্তে ভেসে গেলো মুখ। আজিজ লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। কালো কুকরের লেজের ডগার মতো মোচ পালের গোদাটির। সেই মোচে তা দিয়ে মছুয়া বললো, ওঠাও ছালে কো। জন্তুগুলো টেনে তুললো আজিজকে। মছুয়া বললো, ছোড় দেঙ্গা, জারুর ছোড় দেঙ্গা তোমকো। বোলো, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। বোলো, বোলো…
ডানহাতে মুখের রক্ত মুছে সেই হাত আবার আকাশের দিকে তুললো আজিজ। সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। সে কিছুতেই ওই স্লোগান দিতে পারে না। গলার সবটুকু শক্তি দিয়ে আজিজ আবার বললো, জয় বাংলা।
এবারের মার আরও তীব্র আরও ভয়ানক। হাত-পাঁজর ভেঙ্গে গেছে, চোয়াল মাথা চৌচির আজিজের। নাকের জায়গায় নাক নেই, চোখের জায়গায় চোখ নেই, শুধু প্রাণটুকু আছে আজিজের। চেতনা লোপ পাচ্ছে। চোখে গভীর অন্ধকার দেখছে। এই অবস্থায় আবার টেনে তোলা হলো তাকে। আবার সেই গলা। বোলো, পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
আজিজ মুমূর্ষ গলায় টেনে টেনে বললো, জয় বাংলা। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো মছুয়ার রিভলবার। ঠুস ঠুস ঠুস…। চারটি রাজাকার ছুটে এসে হাত-পা ধরে চ্যাঙদোলা করে আজিজের দেহটি নিয়ে গেলো খালের ধারে। ছুঁড়ে ফেলে দিলো খালে। বাংলার জল গভীর মমতায় গ্রহণ করলো তার এক বীর সন্তানের মরদেহ।
সেদিন বাংলার আকাশ কেঁদেছিলো আজিজের জন্য, হাওয়া আর গাছেরা কেঁদেছিলো, মাঠের শস্যচাড়া আর রোদ কেঁদেছিলো, মাটি আর নদী কেঁদেছিলো। ফুল, পাখি-প্রজাপতি, জলতলার মাছেরা কেঁদেছিলো।
মানুষ কেঁদেছিলো আজিজের জন্য।