শিশুতোষ গল্প।। মুক্তিযোদ্ধার মা।। মোস্তাফিজুল হক
আজ ১৬ই ডিসেম্বর। একটা টিভি চ্যানেল থেকে অশীতিপর রেহানা বেগমের সাক্ষাৎকার নিতে এসেছে। সাংবাদিক রেহানা বেগমকে প্রশ্ন করছেন,
: মা, আপনি তো শহিদ জননী। আপনি আপনার ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং যুদ্ধকালীন ঘটনাগুলো আমাদের শোনাবেন কি?
রেহানা বেগম বললেন, তাহলে শোনো বাবা,
: ফাগুন মাস চলছে। অমাবস্যার রাত। চারদিকে ভয়ঙ্কর অন্ধকার। শীত কমে এলেও বাতাসের জোরে শীতের তেজ অনেকবেশি। উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা শেষ। বন্ধুদের প্রায় ঘুমিয়ে যাওয়া আড্ডার সময়গুলো আবার ক’দিনের জন্য একটু একটু করে জাগতে শুরু করেছে। তবুও তপু আড্ডায় যায়নি। যাওয়া হবে কি করে? শহরের পরিবেশ থমথমে। তাছাড়া আজ চালের গুড়া তৈরি হয়েছেন। ওদের একমাত্র বোন নিতু। দুদিন হল বাড়িতে এসেছে। তাই বাড়িতে পিঠার আয়োজন চলছে। এমনিতেই গরমপিঠা তপুর খুবপ্রিয়- তা আবার যখন মায়ের হাতের, তখন কি আর বাইরে যেতে মন চায়? আজ মা’র কাছাকাছি থাকাই যে ওর একমাত্র কাজ। রাত ন’টায় পিঠা বানানো শুরু করলাম। এই কর্মযজ্ঞ চললো প্রায় রাত এগারোটা পর্যন্ত। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। চোখে সবেমাত্র ঘুম ভর করেছে। এমন সময় বড় ছেলে অপু দরজায় নক করছে- “মা, দরজাটা খুলো।” আমি হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলে দিলাম। বেচারিকে দেখতে পাগলের মতো লাগছে। হারিকেনের মৃদু আলোতেও তার উস্কো-খুস্কো চুল আর খানিকটা লালচোখ দেখে মনেহচ্ছে খুবই আতঙ্কিত। আমি বলেই ফেললাম, তোকে পাগলের মতো লাগতাছে ক্যান অপু! কী হয়েছে তোর বাপজান? দুপুরে কী খেয়েছিস, বাবা?
“মা, আমি ভালো আছি। কিন্তু আর কতদিন ভালো থাকতে পারবো, জানি না। মাগো, তুমি তো আমাকে এই মাটিতে জন্ম দিয়েছ, কথাবলা শিখিয়েছ- তাই না, মা?”
হ্যাঁ, বাজান। তা হঠাৎ এই কথা ক্যান?
“মা, সকালে সব বলবো। এখন শুয়ে পড়ো।”পরদিন সকালে নাস্তা খেতে খেতে অপু বলতে লাগলো,
“মা, এই মাটি আর ভাষাকে রক্ষা করতে আমি যুদ্ধে যাবো।”
কিন্তু হঠাৎ তুই একাই যুদ্ধ করবি? পাগল হলি নাকি? তুই পড়াশোনা বাদ দিয়ে হুট করে ঢাকা থেকে বাড়িতে চলে এলি যুদ্ধ করতে?
“হ্যাঁ মা, আমার মতো লক্ষ লক্ষ অপুকে যুদ্ধে নামতে হবে। গতকাল সন্ধ্যায় পাকিস্তানি পশুরা ঢাকায় হামলা চালিয়েছে। নিরীহ মানুষের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। ভাগ্যিস আমি জামালপুরে ছাত্রলীগের সমাবেশে এসেছিলাম।”
কিন্তু, বাবা আমরা তো তোকে পড়াশোনা করতে ঢাকায় পাঠিয়েছি। রাজনীতি করে পড়াশোনার বারোটা বাজাস নে বাপ।
“মা, পড়াশোনা করলেই কী আমরা চাকুরী পাবো? ওরা আমাদের শোষণ করতে করতে পুরো জাতিটাকে পথের ভিখিরি বানাতে চায়। পাট বিক্রি করে এদেশের, টাকা জমা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। বাঙালিরা না খেয়ে মরে, আর ওরা আমাদের টাকায় ইসলামাবাদ শহর তৈরি করে।”
অপু, আমার মনেহয় তুই সত্যি সত্যিই পাগল হয়েছিস। কীসের যুদ্ধ? তোর বাবা তো এ বিষয়ে কিছুই বললেন না?
এবার অপুর বাবা আমিন সাহেব বললেন, “রেহানা, তুমি জানো না। অপু ঠিকই বলেছে। গতরাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার আগেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। আফসোস, আমার পা ভাঙা! আমি আমার দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেতে পারবো না।”
“বাবা, তুমি দুঃখ করো না। আমরা আছি না।”- অপু আর তপু সমস্বরে বলে ওঠে।
তুমিও শেষ পর্যন্ত ওদের প্রশ্রয় দিচ্ছ? তোমরা বাবারা কী বুঝবে? ছেলে পেটে ধরে মায়েরা। বাপজান তোরা যাবি না – বলেই আমি কাঁদতে লাগলাম।
“মাগো, তুমিই তো একদিন বলেছিলে, ‘সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন এ দেশের প্রতিটা মা তার যুবক ছেলেকে যুদ্ধের ময়দানে পাঠাবে। বলবে, খোকা একটা স্বাধীন দেশ এনে দে।’ মা, আজ সেই দিন এসেছে। সাড়ে সাতকোটি শোষিত, নিপীড়ত, অধিকার বঞ্চিত, ক্ষুধার্ত বাঙালিকে স্বাধীনতার লাল সূর্য এনে দিতে হবে। সেই টকটকে লাল ভোরের সূর্য, যা বাঙালিকে আশা-আকাঙ্ক্ষার নতুন আলো ছড়াবে।”
অপুর কথায় আমি কোনো প্রত্যুত্তর করি না।
এরপর দুইদিন গত হয়েছে। শেরপুরে এখনো যুদ্ধ পুরোদমে শুরু হয়নি। তবে প্রভাবশালী কেউ কেউ যুদ্ধকে প্রতিহত করতে রাজাকার ও বদরবাহিনী গঠন করছে। পাশের বাড়ির আবুল মাতুব্বরও রাজাকারের দলে নাম লিখিয়েছে। আমাদের বাড়ির দিকে ওর কড়া নজর। আমার স্বামী এদের প্রতি ভীষণ ক্রুদ্ধ। তাঁকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, “এরা মানুষ নাকি হিংস্র পশু? নিজের দেশ স্বাধীন হোক, এটাও কেউ চায় না!”
আরও একটা দিন চরম উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়ে চলে গেল। তবে আজ অপুর বাবাকে বেশ খানিকটা উৎফুল্ল দেখা যাচ্ছে। দেশে ভীষণ যুদ্ধ চলছে। আমি অপু আর তপুর প্রতি বেশ কড়া নজর রাখি। সেদিন রবিবার। ভাবছি, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আমার বাপের বাড়ি চলে যাবো। একেবারে ভারতীয় সীমান্তের কাছে; গারো পাহাড়ের পাদদেশে। কিন্তু ভোরে উঠেই দেখি, অপু-তপু দুজনের একজনও নেই। তবে বিছানায় বালিশের পাশে একটা চিঠি পাওয়া গেছে। তাতে লেখা আছে,
“মা,দোয়া করো। তোমার ছেলেরা আজ দেশ স্বাধীন করতে চলেছে। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিতেই আমরা তোমার কাছে ফিরে আসবো। আর যদি ফিরতে নাও পারি, তাহলে শতসহস্র গাজি মুক্তিযোদ্ধাকেই তোমার অপু আর তপু মনে করো। মাগো, বাবাকে নিয়ে তোমরা শীঘ্রই নিরাপদ স্থানে চলে যেও। সাথে নিতু আপুকেও নিয়ে যেও।মা, আজ আর নয়। একদম কাঁদবে না। আমরা শহিদ হলে, তুমি হবে শহিদ জননী। ফিরে এলে হবে বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজির মা।
ইতি- তোমার অতি আদরেরঅপু”
আজ সোমবার। আবুল ভাই এসে অপুর বাবাকে বলে গেলেন, “আমিন ভাই, তোমার পরিবার পরিজন নিরাপদ আশ্রয়ে যাবে- ভালো কথা। তবে ছেলে দুইটাকে আবার মুক্তিযুদ্ধে পাঠিও না। তুমি এলাকার চেয়ারম্যান ছিলা, তুমি আবার পালাইও না। তাছাড়া তোমার ব্যবসা আছে। দোকানের গোমস্তা বাবুলের মা তোমার খাবারের ব্যবস্থা করবো।”
তার কথায় আমাদের শঙ্কা বেড়ে গেল। এই অবস্থায় আর বাপের বাড়ি যাওয়া হল না।
আটমাস ধরে যুদ্ধ চলছে। জানি না, তপুরা কেমন আছে! কোনো খবর নেই। কিন্তু আজ ডিসেম্বরের প্রথম শুক্রবার আমাদের জীবনে এক দুর্বিষহ ঘটনা ঘটে গেল! দোকানের গোমস্তা বাবুল রাজাকার ক্যাম্পে খবর পৌঁছে দিয়েছে যে, অপু আর তপু মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে। আবুল মাতুব্বর দলবল নিয়ে এসে অপুর বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। এদিকে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
তারপর মা?
ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধে পাঠানোর অপরাধে আবুল রাজাকারের হুকুমে বাবুল গোমস্তা তপুর বাবার মাথা মুড়িয়ে মুখে চুনকালি মেখেছে। এরপর কোমড়ে দড়ি বেঁধে তাঁকে সারাশহর ঘুরিয়েছে! তারপর সন্ধ্যায় যিশু খ্রিষ্টের মতো বাজারের বটগাছে পেরেক মেরে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। এর কয়েকদিন পর ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হল। দেশ স্বাধীন হল। আমার ছেলেরা আর ফিরে এলো না। সেই থেকে আমি এদেশের লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার মা। আমি এক আত্মপ্রত্যয়ী শহিদের গর্বিত স্ত্রী।