মুক্তিযুদ্ধের গল্প।। একাত্তরের মেঘনা।। পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
মেঘনা। অনেকের কাছে নদী কারও কাছে ইলিশের বাড়ি কারও কাছে প্রবহমান ইতিহাস কিংবা রক্তগাঙ। মেঘনার সাথে পাগলীর রোজ কথা হয়। পাগলীটাকে রোজ মোলহেডে মেঘনার পাড়ে দেখা যায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি একটানা বসে থাকে। ঠায় সে নদীর দিকে তাকিয়ে কী যেন বিড় বিড় করে। পঞ্চাশ বছর ধরে সে একই কাজ করে আসছে। আশেপাশের টং দোকানদাররা সবাই এই কথাই বলে আসছে তার ব্যাপারে। বৃদ্ধ সোলেমান চাচা গত পঞ্চাশ বছর ধরে মোলহেডে চা বিক্রি করছেন। তিনিও দেখে আসছেন তাকে। ঠিক একইভাবে সকাল হতে সন্ধ্যা মেঘনার পাড়ে বসে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে নদীর জলের দিকে। দেখে মনে হয়, মেঘনার কাছে তার অসংখ্য প্রশ্ন জমা আছে। কিন্তু মেঘনার স্বচ্ছ জলের সে প্রশ্নের উত্তর হয়তো জানা নেই।
মোলহেড এক অতি নান্দনিক নৈসর্গিক স্থান। তিনটি নদী এখানে মিলিত হয়েছে সঙ্গমে। পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া। এখানে সূর্যাস্তের সৌন্দর্য যেমন অভূতপূর্ব তেমনি সূর্যোদয়ের লালিমাও অনবদ্য। স্থানীয় ভাষায় একে ঠোঁডা বলে। ঠোঁট থেকে ঠোঁডা। মেঘনা-নিবিড় এ জনপদ কালের এক অনন্য সাক্ষী। উনিশশো একুশ সালের মে মাসের কুড়ি তারিখ এখানে এক নৃশংস ঘটনা ঘটেছিলো। আসামের চা-বাগান হতে পায়ে দলে ফেরৎ আসা কুলিরা ভিড় করেছিল এই মেঘনার পাড়ে বড় রেলওয়ে স্টেশনে। তাদের গন্তব্য ছিল নৌপথে গোয়ালন্দ হয়ে নিজভূমে ফিরে যাওয়া। কিন্তু নির্মম বৃটিশ পুলিশ আর ইউরোপীয় চা-বাগান মালিক সমিতির বর্বরতায় এখানে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। গুর্খা পুলিশের অত্যাচারে প্রায় ত্রিশ হাজার চা-বাগান শ্রমিককে গুলি করে এবং বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয়। এদের সবাইকে ফেলা হয় মেঘনার বুকে। মেঘনা যে কতো ভার নিয়ে বয়ে চলেছে সেই থেকে!
মোলহেডে আছে একাত্তরের বধ্যভূমির স্মৃতিসৌধ ‘রক্তধারা’। উপর থেকে রক্তের টাটকা ফোঁটা যেন পড়ছে চুয়ে চুয়ে। এ রক্ত বাঙালির চেতনার ক্ষরণ। মোলহেডে রক্তধারার প্রতিষ্ঠা আমাদের মনে করিয়ে দেয় একাত্তরের বধ্যভূমির কথা। রক্তধারার রক্তের ফোঁটায় মেঘনার জলে যেন নিত্য দীর্ঘশ্বাস ওঠে। পাগলী রাতে কোথায় যায় তা কেউ জানে না। কেনই বা সে মেঘনার তীর ঘেঁষে বসে থাকে কেউ সে রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। মাছের আড়তের আড়তদার উত্তমবাবু এখানে কাজ করেন বাপদাদার আমল থেকে। তার কাছে জানতে চায় সিদ্ধার্থ। দাদু, বলেন তো, এখানে ঠিক কী ঘটেছিলো এই মেঘনার তীরে? পাগলীটা কেন এখানে বসে বিড় বিড় করে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত? উত্তম বাবু বলেন, দাদুরে, পাগলী কেন এই মেঘনার পাড়ে বসে থাকে তা আমি কইবার পারমু না। তয় মেঘনার লগে কী অইছিল হেইডা কইতে পারুম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এই বড় ইস্টিশন ঠোঁডা আছিল পাকিস্তানি হারামিগো নির্যাতন কেন্দ্র। আহা দাদু! মাইনষেরে তারা কী যে অইত্যাচার কইরত্যো। কম বয়সী মাইয়া ধইরা আইন্যা তারা রেলের বগিতে আটকাইয়া হেগো চাহিদা মিটাইতো। হেরপর রাইতভর নির্যাতন কইরয়া ভোর অইলে আধামরা কইরয়া মেঘনা নদীতে ফালাইয়া দিতো। তাগো লগে লগে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে যুবকদের আইন্যা বেয়নেট দিয়া খোঁচাইয়া খোঁচাইয়া মাইরয়া মেঘনায় স্তূপ মাইরয়া ফালাইয়া দিত। হেই ঘটনার পর বহুতদিন এই এলাকার মানুষ মেঘনার চিংড়ি মাছ খায় নাই। জাউল্যারা দ্যাখছে, চিংড়ি মাছে মরা শরীল ঠোকরাইয়া ঠোকরাইয়া খাইতাছে। এই মেঘনা নদী অনেক ইতিহাসের সাক্ষী দাদু। উত্তমদাদুর কথা শুনে সিদ্ধার্থ মনে মনে মেঘনাকে স্যালুট করে। আলমগীর কবীরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’ মানুষের পাপের ভারে আজ শ্লথ। মেঘনার জলে কত যে রক্তের স্রোত আজও বয়ে যায়!
সিদ্ধার্থ মাঝে মাঝে পাগলীকে খাবার যাচে। কখনো নেয়, কখনো সে নেয় না। অনেকদিন খেয়াল করেছে সে কী বলে মেঘনাকে। লিপ রিডিংয়ের চেষ্টা করেছে। কিন্তু কিছুই সে উদ্ধার করতে পারেনি। সিদ্ধার্থ থেমে থাকে না। উত্তমদাদু তাকে জীবনমাস্টারের কথা বলে। এই মোলহেডের ইতিহাস জীবনবাবুই বিস্তারিত বলতে পারবেন।
জীবনবাবু এ শহরের এক প্রগতিশীল মানুষ। সাহসী যেমন তেমনি জানেনও ভালো। আগে মাস্টার ছিলেন একসময়। এখন শহরের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন মহান উপদেষ্টা। সিদ্ধার্থ তাঁর বাসা চিনে। একদিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে জীবনবাবুর বাসায় যায় সিদ্ধার্থ। নবতীপর বৃদ্ধ হলেও স্মৃতি টনটনে। বাসায় গিয়ে দরোজায় কলিংবেল চাপতেই তাঁর নাতি এসে দরোজা খুলে দেয়। জীবনবাবুর কথা বলতেই ভেতরে যাওয়ার অনুমতি মেলে। জীবনবাবুর পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করে সিদ্ধার্থ। এ যুগের তরুণের কাছে এরকম শিষ্টাচার পেয়ে তিনি অভিভূত হয়ে যান। সিদ্ধার্থ তার পরিচয় দেয়। নিজেক একজন সাহিত্য কর্মী বলে পরিচয় দেয়ায় জীবনবাবু খুশি হন। তিনি আন্তরিকতার সাথে জিজ্ঞেস করেন, কী মনে করে দাদু এ অচল বুড়োর কাছে এসেছো? তাঁর বলার ধরনে সিদ্ধার্থ হেসে দেয়। কে বলেছে দাদু আপনি অচল বুড়ো! আপনি হলেন এ শহরের সজীব তরুণ। দাদু, আপনি কি বড় স্টেশন মোলহেডের সেই পাগলীটাকে চেনেন? জীবনবাবু সিদ্ধার্থের প্রশ্ন শুনে বলে উঠে, ওহ্! তুমি দাদু মল্লিকা পাগলীর কথা বলছো? তাকে চিনবো না কেন? আলবাৎ চিনি। সে একজন বীরাঙ্গনা দাদু। তার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিল। সে ছিল মাধ্যমিক স্কুলের মাস্টার মশাই। মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন সহযোগিতা করতো তেমনি নিজেও একসময় মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। বাচ্চু রাজাকার তাকে ধরিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি আর্মির হাতে। সে সময় এই বড় স্টেশন মোলহেড ক্যাম্পে ছিলো এক কুখ্যাত মেজর, নাম শওকত। তাকে সবাই জল্লাদ শওকত নামেই চিনে দাদু। বাচ্চু রাজাকারের লোভ ছিলো মাস্টারের মেয়ে মল্লিকার ওপর। যুদ্ধের সময় মল্লিকার বয়স ছিল মাত্র পনর বছর। একদিন বাচ্চু রাজাকার দলবল নিয়ে রাতের গভীরে মাস্টারের বাড়িতে হানা দেয়। মাস্টারকে ঘরে না পেয়ে মল্লিকা ও তার মাকে ধরে নিয়ে আসে ক্যাম্পে। মা ও মেয়ের ওপর রাতভর চলে অকথ্য নির্যাতন। পাকিস্তানি আর্মিদের লোলুপতা শেষে রাজাকাররা হামলে পড়ে। পরদিন মুক্তিযোদ্ধা মাস্টার ধরা পড়ে। মা-মেয়ে আধা মরা অবস্থায় দেখতে পায়, মাস্টারকে তারা কী নির্যাতনটাই না করেছে। সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়া থেকে শুরু করে নখ উপড়ানো, মলদ্বার দিয়ে গরম পানি দেয়া এমন কিছুই তারা বাদ রাখেনি। রাতে মাস্টারসহ আরো কয়েকজনকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়। রাতভোর হলে ছুনুয়া ডোম আসে পরিষ্কার করার জন্যে। মাস্টারের মৃতদেহ মেঘনায় ছুঁড়ে ফেলা হয়। মল্লিকা জ্ঞান হারিয়ে মরার মতো পড়ে থাকে। স্বামীর মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে নির্যাতনে আধামরা হওয়া মল্লিকার মা-ও মারা যায়। ছুনুয়া ডোম বুঝতে পারে মল্লিকার দেহে তখনও প্রাণ ছিল। তাই সে মল্লিকাকে পানিতে না ফেলে কূলে রেখে যায়। এই মল্লিকাই আজকের বেঁচে যাওয়া সেই পাগলী। বীরাঙ্গনা পাগলী মেয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তার পরিবারের অবদান অবিস্মরণীয়।
ভারী একটা মন নিয়ে সিদ্ধার্থ জীবনবাবুর বাসা থেকে বের হয়ে আসে। রাস্তায় নেমে সোজা চলে আসে মোলহেডে। এখনও আলো আছে। সন্ধ্যা নামেনি। মেঘনার বুকে অস্তগামী সূর্যের লালিমা মাত্র ব্যাপ্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে। গোধূলির আলোছায়ায় মেঘনার মুখ যেন ভারী হয়ে আছে শ্রাবণ-মেঘের মতো। সিদ্ধার্থের মন আর মেঘনার বুকে জমে আছে দুর্বহ বেদনার বাষ্প। যেখানে মল্লিকা বসে থাকে সকাল-সন্ধ্যা, সেখানে পৌঁছে দ্যাখে জটলা। কী ব্যাপার তা দেখতে দ্রুত এগিয়ে যায় সিদ্ধার্থ। কোলাহল ছাপিয়ে যে শব্দ তার কানে আসে তাতে সিদ্ধার্থের আর বুঝতে বাকি থাকে না, বীরাঙ্গনা মল্লিকা মেঘনার কাছে তার বেদনার ভার জমা রেখে চলে গেছে মা-বাবার কাছে। সিদ্ধার্থ আর সেখানে থাকে না। তার মনে হু হু করে শ্রাবণ-হাওয়া বইছে। দুচোখে প্লাবন নেমেছে। জীবনবাবু বলেছিল,মল্লিকা নাকি বিড় বিড় করে বলে, মেঘনা, আমার বাবাকে ফিরিয়ে দে, মেঘনা আমার মাকে ফিরিয়ে দে। মেঘনা, আমার বাবাকে তুই ফিরিয়ে দে, মেঘনা আমার মাকে ফিরিয়ে দে…
