উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব চার
চার
বছর ঘুরে আসে ঈদুল আজহা। সবার চোখ পড়ে আজিরনের গরুর ওপর। তারা বলাবলি করছে বছির উদ্দিনের গরুটা বেশ মোটাতাজা হইছে। বাইর বাড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় খোকা ব্যাপারি বলে, ‘গরুডা ব্যাঁচলে আমারে দিও কইলাম, পাঁচ হাজার ট্যাহা দিমু; এর বেশি অইলে মাইনষেরে দিও।‘ অনেকেই বলে গরুর দামের কথা। প্রতিবেশী কেরাম ব্যাপারিও পাঁচ হাজার টাকা গরুর দাম বলে যায়। ঘরে বসে গরুর দাম শুনে মহাখুশি আজিরন। কারণ, বারোশ’ টাকা দাম ধরে গরু আনছিল। পাঁচ হাজার বেচতে পারলে তিন হাজার আটশ’ টাকা লাভ হবে। অর্ধেক মণ্টু মাতব্বরকে দেবে। অর্ধেক তারা পাবে। তাতে উনিশশ’ টাকা হবে। এই হিসেব করে আনন্দে হাফিজা বেগমের কাছে যায়। তাকে জানায় গরুর দাম পাঁচ হাজর কইতাছে। লাভের অর্ধেক পাইলেও মোরা উনিশ’ শ পাব। এই টাকা দিয়া আর একটা বাছুর কিনমু। হাফিজা বেগমের মুখে কোনো আনন্দ নেই। আজিরনকে উৎসাহ দেখায় না সে। কেমন নিথর দাঁড়িয়ে আছে। দেখছে আজিরনের মুখ। ভাবছে এই আনন্দ থাকবে ওর! কারণ, সে জানে মন্টু মাতব্বর ভালো মানুষ না। আজিরনকে কত টাকা দেবে সেটাই কথা। এমনিতেই তার কাছ থেকে গরু পালক আনাটা ভালোভাবে নেয়নি হাফিজা বেগম।
হাফিজা বেগম কিছু না বলায় বাড়িতে চলে আসে আজিরন। সামনের বারান্দার খুঁটি ধরে ভাবিসুখের ভাবনায় মগ্ন। গরু বিক্রি করে যে টাকা পাবে তা দিয়ে গরু কিনবে; খুব যত্ন করে গরুটাকে বড়ো করবে; সেই গরু বিক্রি করে দোচালা টিনের ঘর করবে। এরকম নানা স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে আজিরন। রাতে খাবার সময় স্বামী বছির উদ্দিনকে বলে, ‘হোনেন, আজিবারের বাপ, কাইল ব্যানা মন্টু মাতবরের বাড়িতে য্যায়া গরু বেচার কতা কইবেন। কোরবানির ছিন্নির চান উঠল দুই দিন অয়। মাতবর তো কিছু কয় না। গরুর তো সবাই দাম কইতাছে। কেরাম ব্যাপারি পাঁচ হাজার কইল। মোরা কত পাব জানেন? উনিশ’শ। তা দিয়ে একটা গরু কিনমু।’ খাবার রেখে আজিরনের দিকে তাকায় বছির। বলে, ‘আজিবারের মাও, গরু বেচার কতা মতব্বরেরে কইছি। মাতবর হ্যাঁ-না কিছুই কইল না। কেমন ভাবলেশহীন তাকায়া রইল। মনে হইল আমার কতা গা করল না।’
আজিরনের মন খারাপ হয়। কেমন একটা দুশ্চিন্তা চাপে মাথায়। মাতব্বর কিছু কইলেন না কেন! তাহলে গরু বেচতে চান না তিনি? না অন্য মতলব আছে। হাফিজা খালাও তো কিছু কইলেন না। কিছু বুঝতে পারে না আজিরন। পরদিন সকালে বছির কাজে যায়। বলে সন্ধ্যায় ফিরে মাতব্বরের কাছে যাব। আবারও কইয়া দেখি গরু বেচার কতা। দেখি কী কন তিনি।
আজিরন ভাবছে সেও যাবে আজিবরের বাপের লগে। তখন ঘাস নিয়ে এলো আজিবর। তা গরুর সামনে দিয়ে মাকে বলল, মাছ ধরতে যাই। আজিরন কিছু বলল না। সে ঘরে গেল। মন্টু মাতব্বর এলেন তখন সেজাব মোল্লাকে নিয়ে। গরুর সামনে দাঁড়িয়ে আজিরনকে ডাকলেন। আজিরন ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই গরুর দড়ি খুলে হাতে নেন মাতব্বর। আজিরন অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। কেন মাতব্বর গরুর দড়ি খুললেন। তা জিজ্ঞেস করতে পারছে না। মাতব্বর বললেন, ‘শোন্ আজিরন, আমার ছেলে আসছে ঢাকা থেকে। সে বড়ো চাকরি করে। ছেলের বউ বায়না ধরেছে পালের গরু কোরবানি দেবে। গরুটা নিয়া গেলাম। রাতে বছিরকে আমার বাড়িতে পাঠাবি। যা পাস হিসেব কইরা দিয়া দিমু।’ এ কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় আজিরন। অপ্রস্তুত গলায় বলে, ‘হোনেন মাতবর সাব, গরু যহন হাটে বেঁচবেন না তহন গরুর দাম কত অইবো দশজনের সামনে বইলা আমার ট্যাহা দিয়া গরু নিয়া যান।’ এমন পরিস্থিতি হবে সেটা মন্টু মাতব্বর জানতেন। এবার তিনি দাঁড়ালেন। তার সাথে আসা সেজাবকে বললেন, ‘সেজাব তুমিই বলো, গরুর দাম কত হইবার পারে?’ সেজাব গরুর কাছে আসে। ঘুরে দেখে বলে, ‘তা মাতবর সাব, বেশি অইলে হাজার তিনেক হইব। গরু তো পাতলা। এর বেশি দাম উঠবে না।’ আশপাশের পড়শিরাও এসে আজিরনের উঠোনে দাঁড়ায়। মাতব্বর উপস্থিত দশজনের উদ্দেশে বলেন, তোমরা হগলে কী কও? সেজাব মোল্লা যা কইছে ঠিক? তিন হাজার টাকা দাম তো কম হয় না।’
সবাই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ায়। তিন হাজার টাকা দাম ঠিক আছে।
এমন সম্মতিতে আজিরনের বুকটা কেঁপে ওঠে। সবার মুখের দিকে তাকায়। কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। কিছু বলে না। মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। মন্টু মাতব্বর বলেন, ‘শোন আজিরন, গরুর দাম তিন হাজার হলে চালানের বারোশ বাদ দিলে থাকে আঠারশ। তুমি পাও নয়শ’ টাকা। তোমাকে এক হাজার দিলাম। তুমি গরিব মানুষ। আমার কত টাকা কতজন খায়। আল্লায় আমারে দিছে। আমি মানুষ ঠকাইতে চাই না। আরও কুরবানি দেব।‘ আজিরনকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ দেয় না মন্টু মাতব্বর। এক হাজার টাকা তার হাতে তুলে দেয়। সেই সাথে একশ’ টাকা বকশিস দেয়। গরু নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। টাকা হাতে নিয়ে বোকার মতো ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে গরুর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে আজিরন। যতক্ষণ দেখা যায় গরু চোখ ফিরাতে পারে না সে। খুব মায়া হয়। আবার মনে মনে ধিক্কার জানায়; পাঁচ হাজার টাকার গরু তিন হাজার টাকায় নিয়া একশ’ বকশিস দেয়! কত কথা শুনিয়ে গেল নিজের সম্পর্কে। হায়রে দুনিয়া! এই গরু কেরাম ব্যাপারির পালানের ধানখেতে মুখ দেয়ায় মুরগি বিক্রি করা একশো টাকা জরিমানা গুনতে হইছে তার। সবাই মতব্বরের পক্ষে কথা কইল। তার কষ্ট কেউ দেখল না।
সবাই যদি কইত না মাতব্বর। তিন হাজার কম হইয়া যায়। ন্যায্য কথা বলতে তাদের যেন বড়ো অপারগতা। গরিব বলেই হয়তো তারা প্রতিবাদ করতে পারে নাই। ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। গরু নিয়ে যাওয়ার সময় একটুও আদর করতে পারে নাই আজিরন। সেই কষ্টে হঠাৎ উতলে উঠল বুক। গরুটাকে বড়ো করতে কম কষ্ট করতে হয়নি, সন্তানস্নেহে শুধু পালনই করেনি, লালনও করেছে। শেষবারের মতো গরুটারে আদর করতে না পারায় ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। আজিবর বাড়ি ফেরে দেখে গরু নাই। ঘাস পড়ে আছে। ছুটে যায় মায়ের কাছে। গম্ভীর মুখে ঘরে বসে আছে মা। অস্থির কণ্ঠে আজিবর বলে, গরু দেখি না আম্মা। কই গেল? এবার দুঃখ আগলে রাখতে পারল না আজিরন। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। এরপর আঁচলে চোখ মুছে বলল, মাতব্বর নিয়ে গেছে গরু। টাকাও ঠিকঠাক দিলেন না। আজিবার কিছু বলে না। মন খারাপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ঘটনা শুনে বছিরও আফসোস করে। এত কম টাকায় গরু নিয়া গেল। আজিরনকে স্বান্ত্বনা দেয়া ছাড়া তার কিইবা করার আছে! বিষয়টা ভুলে যেতে চায়। কারণ, এ বিষয় নিয়ে যত ভাববে ততই মন খারাপ হবে। গরিবের মন খারাপ হতে নাই। তার থেকেও ভালো তাদের মন থাকতে নাই। সেটা আজিরন না বুঝলেও বছির বোঝে।
গরু বেচা টাকা থেকে তিনশ’ দিয়ে স্বামীকে একটি প্যানাসনিক রেডিও কিনে দেয় আজিরন। যেটা বিয়ের সময় তার বাবার দেবার কথা ছিল, কিন্তু অর্থের অভাবে দিতে পারেনি। বাকি সাতশ’ টাকা দিয়ে সারা গায়ে উকুনভর্তি একটা দামরা বাছুর কিনে আনে। শুরু হয় তার নতুন যুদ্ধ। গরুকে খাওয়ানো, গোসল করানো, হাফিজা বেগমের পরামর্শে আতাফলের পাতা বেটে গরুর সারা গায়ে মাখে। মুখে টোনা বেঁধে রাখে। যাতে শরীর চাটতে না পারে। শুকিয়ে গেলে গোসল করায়। উকুন মারার প্রাণান্ত চেষ্টা করে সে। তিন ছেলে আজিবার, হারান, পরানের যত্ন নেয়া, স্বামীর সেবাসহ শত ব্যস্ততার মধ্যেও সংসারে সুখের কমতি নেই আজিরনের। একদিন রাতে ছেলেরা ঘুমিয়ে গেলে স্বামীর বুকে মাথা রেখে আজিরন বলে, ‘আজিবারের বাপ, আপনেকে একডা কতা কইবার চাই, যদি রাগ না হন তয় কমু। ’তোমার সাথে কোনোদিন রাগ হইছি? সংসারে টানাটানির মধ্যেও কত কষ্ট কইরা সংসার চালাও তুমি। কোনোদিন টুঁ শব্দও করো না আজিরন। তোমার মতো বউ পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার। কও কী কবার চা’ শুনে বুক ভরে যায় আজিরনের। আনন্দ আর আহ্লাদে চোখে পানি এসে যায় তার। সে যে সন্তানসম্ভবা সে কথা স্বামীকে জানায়। এও বলে সে নাকি স্বপ্নে দেখেছে তার মেয়ে হবে। বছির মেয়ে হবার কথা শুনে খুব খুশি হয়। উঠে বসে। আজিরনকে জড়িয়ে ধরে। কপালে চুমু খায়। তিন ছেলের পরে মেয়ে যেন তাদের ঘর আলো করে আসবে।
প্রথম ছেলে আজিবার বেশ বড়ো হয়েছে। যদিও হালকা-পাতলা গড়নের, তবে মুখমণ্ডল গোলাকার, চোখ দুটো মায়াভরা। খেলাধুলার পাশাপাশি মাকে সাহায্য করার জন্য গরুর ঘাস কাটে। বাবা কামলা দিলে তাতে খাবার জন্য গেরস্থ যে আধা সের চাল দেয় তা আজিবারই এনে দেয়। মাঝে মাঝে আজিরন বলে, ‘বাবা আজিবার, গেরস্থের বউ কাউন মেশানো চাউল দিলে আনবি না কইলাম। আমাগোর কাউনের চাউল ভাজ দিয়া খাইতে অয়।’চাল আনতে গেলে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়। গেরস্থের হাতের কাজ শেষ করে তারপর দেয়। অন্যের বাড়ি গিয়ে ফকির-মিসকিনের মতো চাউলের জন্যে বসে থাকাটা পছন্দ করে না আজিবার। তার বিরক্ত লাগে। একবার মায়ের কথামতো চাউল নেবার সময় আজিবার গেরস্থের বউকে কাউন মেশানো চাউল দিতে নিষেধ করে, গেরস্থের বউ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলে, ‘জমিদারের বাচ্চায় কয় কী! কাউন খাবে না। যত বড়ো মুখ না ততো বড়ো কথা! তোকে চাউল দেব না। তোর মাকে আসতে বলবি।’আজিবার রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে মাথা নিচু করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে আসে। এ ছাড়া তো তার আর কোনো কিছু করার নেই।
