উপন্যাস

উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব দুই

দুই

স্বপ্নধোঁয়া যমুনার জলে দলবেঁধে বালিহাঁস, পাতিহাঁসের মাছ শিকার আর পানকৌড়ির টুকটুক করে দেয়া নিত্যকার ডুবের সঙ্গে মাখামাখি আজিরনের প্রমত্তা শৈশব। ঈগল, মাছরাঙা মাছের নিশানায় তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে— মাছের দেখা পেলেই ঝপাৎ করে ধরে নিয়ে উড়ে যায় কাশফুলের গহিন অরণ্যে। সাদা বক চকচক হেঁটে চলে যমুনার জলে পা ভিজিয়ে মাছের নেশায়। ছোট ছেলেমেয়েরা বড়শিতে তাজা পুঁটি মাছ ঝুলিয়ে দেয় বক ধরার নেশায়। বক ধরা পড়লে— মনের আনন্দে উজানের সুরে গান ধরে, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’। তা-ই নয় কেবল, দুরন্ত ছেলেমেয়েরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বক নিয়ে মিছিল করে, আমতলায় গিয়ে চড়ুইভাতিতে মাতে।

যমুনার হিমজলে কেবল ঈগল আর মাছরাঙা চোখ রাখে না। হটটিটি আর সারসও খাবারের খোঁজে পাখনা মেলে উড়ে বেড়ায় এচর-ওচর। ঢেউয়ের বুক চিরে পাল তুলে নৌকা বয়ে যায়। মাঝিদের কণ্ঠ থেকে ভেসে আসে কখনো ভাটিয়ালি কখনো উজান গাঙের গান। বাতাস না থাকলে মাঝিরা সরাৎ সরাৎ শব্দে যমুনার জলে ছন্দ তুলে দাঁড় বেয়ে বা দলবেঁধে গুণ টেনে চলে যায় দূর-দূরান্তে। কিশোরী আজিরন ফুফুর সাথে যমুনার কিনারে দাঁড়িয়ে উন্মুখ হয়ে তা দেখে। দখিনা বাতাসে কাশবনে ঢেউ খেলে যায়। সই-সখীদের নিয়ে কাশবনে লুকোচুরিতে মেতে থাকে আজিরন। দুপুর হলে মরুময় চরের তপ্ত বালি যখন চিকচিক করে তখন আজিরনের বাবা কলাগাছের ঢোঙা তুলে তার জন্য জুতা বানিয়ে দেয় বালিতে হাঁটার জন্য। সেই জুতা পায়ে হেঁটে আজিরন বালুচর মাড়িয়ে চলে যায় যমুনার ঠান্ডা স্বচ্ছ জলে গোসল সারতে। ভেজাবালিতে বসে বালি দিয়ে অট্টালিকা বানায়। নলনল আর ঝাপুর-ঝুপুর পায়ে বাজত রূপার নূপুর। কতরকম জলকেলিতে না মন ভাসায় কিশোরী আজিরন।

জ্যৈষ্ঠ মাসে মাদার বাঁশ ওঠে। মাদার বাঁশ উঠলে আজিরন তার ফুফুর সাথে মাদারে চেলা বা সহযোগী হিসেবে নাচে। মাদারধরা মেয়েদের সাথে নাচলে অবশ্য মজার মজার খাবারে ভাগ বসানো যায়। দুধ-কলা, ফুটা খই, চাল ও আখের গুড়ের নাশতা, বিচিত্র ফলমূল। ফুফু খায়, সাথে আজিরনও। এভাবে ফুফুর চেলা হিসেবে নাচতে নাচতে কিশোরী বধূর দিন কাটতে থাকে। পরের জ্যৈষ্ঠ মাসে আবার মাদার বাঁশ ওঠার সাথে সাথে আজিরনের মাদারধরা শুরু হয়। মাদারদের বিভিন্ন নামে ডাকা হয়; কালু মাদার, গাজী মাদার, ন্যাংড়া কালি মাদার। এ নিয়ে গীতও আছে। মাদারধরা ব্যক্তির গীতটা এ রকম—

’হায় মাদারের খেলা গো
খেলমুই তো আমরা গো
আইসেন আইসেন আইসেন গো
কালু মাদার আইসেন গো
আমার ঘরে ওকি হায় গো…’

এ মাদার বাঁশ নিয়ে মাদারদের প্রচলিত নানান নিয়ম-রীতি। পৌষ মাসের অমাবস্যা রাত, স্থানীয় ভাষায় যাকে পুশুরাত বলে, লম্বা সমান্তরাল বাঁশে দা দিয়ে কোপ মেরে রাখে এবং নিয়মিত সেই বাঁশের যত্ন করা হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসে সেই বাঁশ কেটে তাতে লালসালু মুড়িয়ে দেয়। ঘোড়ার ফিকের চুল, মানুষের মাথার লম্বা চুল দিয়ে চোমর বানিয়ে মাদার বাঁশে বেঁধে দেয়া হয়। সেই সাজানো বাঁশে রং-বেরঙের রঙিন কাগজ কেটে তাজা ফুল বেঁধে দেয়। আকর্ষণীয় এই বাঁশকেই মাদার বাঁশ বলে। একশ্রেণির লোকজ ঐতিহ্য-পাগল মানুষ সেই বাঁশ কাঁধে নিয়ে ঢাক-ঢোল-সানাই বাজিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাঁশের লাঠি খেলা ও বিভিন্ন রকম শারীরিক কসরত দেখিয়ে সারা মাস ধরে টাকা কামায়। মাদারধরা মেয়েদের মাদার বাঁশের চোমর ধোয়া পানি খাইয়ে মাদার ছাড়ানো হয়। মাদারধরা মেয়েদের নাচকে স্থানীয় ভাষায় ‘ধামাইল নৃত্য’ বলে।

আজিরন অভাবি ঘরের সন্তান। দারিদ্র্যের কারণেই একমাত্র মাদার ছাড়া যৌতুক হিসেবে আর কিছুই আনতে পারেনি। তবুও আজিরনের প্রতি স্বামী বছির উদ্দিনের ভালোবাসার কমতি নেই। অভাবের সংসারে খরচ চালিয়ে স্ত্রীর জন্য লাল ফিতা, চুড়ি, আলতা, স্নো, কদুর তেল কিনতে ভুল হয় না তার।

স্বামীর ঘরে পরম সুখে কাটছে আজিরনের। বছিরউদ্দিনের সহায়-সম্বল বলতে গমের ডাঁটার ছাউনিওয়ালা দো-চালা দুটো ঘর। একটি থাকার জন্য, অন্যটি ঢেঁকিঘর; টাকার বিনিময়ে অন্যের ধান ভানে সেখানে। দক্ষিণ পাশে কেরাম ব্যাপারির বাড়ি, পশ্চিমে বাঁশঝাড়। উঠোনে দুটি বড়ো আমগাছ, যেন প্রকাণ্ড দুই প্রহরী। বছিরের বাবার আমলের জলপাই কাঠের একটি ঢেঁকি আছে। এ জন্যই তার দ্বিতীয় ঘরটি তোলা।

জীবনের পরমানন্দের মুহূর্তগুলো খুব তাড়াতাড়ি চলে যায়। সময়ও তার নিয়মেই চলতে থাকে। দিন ফুরিয়ে আসে মাস, মাস ঘুরে বছর। আজিরনের কোলজুড়ে আসে ছেলে। মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখে আজিবার। বছির উদ্দিনের চার বোন ছাড়া কেউ নেই। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে তারা। দেখা-সাক্ষাৎ খুব একটা নেই। সংসার নিয়ে তারাও ব্যস্ত। নিঃসঙ্গ সংসারে সন্তানের আগমনের আনন্দে আত্মহারা বছির। তাও আবার ছেলে সন্তান। তার আনন্দ যেন বহুগুনে বেড়ে গেছে।

বছিরদের গ্রামে ছেলে হলে খুশি যেন আটকানো যায় না। ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম জুড়ে। সে খুশি যমুনার জলের মতো বয়ে চলে। মেয়ে হলে সবার মুখ ভার থাকে। শুধু তাদের গ্রামে কেন, প্রায় ঘরেই এমন দৃশ্য দেখা যায়। বছির উদ্দিনের বিষয়টা আলাদা। কারণ, সে হতদরিদ্র মূর্খ মানুষ। তাই বোঝে না ছেলে-মেয়েতে কী হয়। তার সংসারে নিঃসঙ্গতা ভাঙার জন্য একজন মানুষ দরকার। সেই মানুষ এসেছে। এটাই আনন্দের বিষয় তার।

বছির উদ্দিন কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় যায়, ঘরে থাকে আজিরন। খুব দুশ্চিন্তা হয় তার। এখন আর আজিরনের একলা থাকতে হবে না। এসব ভেবে ছেলের জন্ম-সংবাদ জানতেই দৌড়ে গিয়ে ওজু করে আজান দেয়। তারপর ছেলের মুখ দেখে আনন্দ আত্মহারা বছির। সে আনন্দ জীবনে কোনোদিন হয়নি। বাবা হওয়ার আনন্দ এমন ভাবতেও পারেনি সে। এ আনন্দ সব দুঃখ-কষ্টের উর্ধ্বে। রাত পোহাতেই হাফিজার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে হালাইকার পাড়ায় গিয়ে পাঁচ কেজি গুড়ের কটকটি ও ঝুরি কিনে এনে পুরো পাড়া বিতরণ করে ছেলে হওয়ার সংবাদ জানায় বছির।

ছোট্ট আজিবার একটু একটু করে বড়ো হতে থাকে। আজিরন ব্যাস্ত থাকে আজিবারকে নিয়ে। ছেলের লালন-পালন, হাসি-আনন্দে কাঁটে তার দিন।

বর্ষায় যমুনা টইটম্বুর হয়ে মাঠঘাট তলিয়ে দেয়। বর্ষার পানি খালবিলে ঢোকার সময় খালের মুখে বানা লাগিয়ে জুইতা ও পাচার সাহায্যে বোয়াল মাছ শিকার করে এক শ্রেণির মানুষ। মূলত ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ কথাটা বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার সময় বেশি মনে পড়ে। মাছে মাছে খালবিল থইথই করে। এ সময় শৈল, গজার, বাইম, মাগুর, শিং, বোয়াল, রুই, কাতলা, ইলিশ, মৃগেল, কৈ, বেলে, ঘোর বেলে, আইড়, বাঘাইর, টেংরা, পুঁটি নানা মাছের সমাবেশ ঘটে যমুনায়। মাছ ধরার কৌশলও চোখে পড়ে নানা রকম। প্রত্যেক এলাকার মানুষের মাছ ধরার একটা নিজস্ব পদ্ধতি আছে। যেমন আইড় ও বাঘাইর ধরার জন্য লম্বা সুতাওয়ালা সুত বড়শি গভীর পানিতে ফেলে। মাছের খাবার হিসেবে তেলাপোকা, ঘুঘড়া, পিঁপড়ার ডিম বড়শিতে ঝুলিয়ে দেয়। ইলিশ ধরার জন্য কারেন্ট জাল। টেংরা, পুঁটি, চিংড়ি, কৈ, টাকি, শিং, মাগুর ধরার জন্য মই জাল, পলো, তইরা জাল, ধিয়াল ব্যবহার করতে দেখা যায়।

বর্ষা এলে অন্যদের মতো বছির উদ্দিনও মাছ ধরতে যায় যমুনায়। সে লম্বা বাঁশের ছিপে নাইলনের সুতা লাগিয়ে বড়শিতে জীবন্ত তেলাপোকা গেঁথে নদীর কিনার দিয়ে ভাটির দিকে ঘাইরা দেয়, কচা, বাছা মাছ ধরার আশায়। কমবেশি মাছ ধরাও পড়ে। তাতে ভালোই চলে যায় বছির আর আজিরনের। বর্ষার সন্ধ্যায় রান্নার জন্য প্রতিদিন মাছ ধরে সে।

Series Navigation<< রহস্য উপন্যাস।। রহস্যময় বারান্দা।। মালেক মাহমুদ।। শেষ পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *