প্রবন্ধ।। ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান এবং সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট।। পিয়ারা বেগম
আবহমানকাল থেকেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশে প্রচলিত পরিবার প্রথা চলে আসছে। মূলত স্বামী স্ত্রী নিয়েই পরিবার গঠিত হয়। কোন কারণে যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্কে স্থায়ীভাবে বিচ্ছেদ ঘটে। তখনই ঐ স্বামী-স্ত্রীর দুর্ভাগা সন্তানদের বলা হয় ব্রোকেন ফ্যামিলের সন্তান। ব্রোকেন ফ্যামিলি! মানে ভাঙ্গা সংসার! কী ভয়াকুল ভূকম্পন! শব্দ দুটো মূলত ঐ পরিবারের সন্তানদের সম্ভাবনাময় স্বপ্নের করুণ ট্রাজেডি! সমাজের স্বঘোষিত আদালত ঐ সন্তানদের গায়ে “ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান” তকমা লাগিয়ে দেয়। এ যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। তবে সংসার ভাঙ্গার কারণ যাহাই হোক না, ঐ পরিবারের সন্তানদের দুঃখকষ্ট ভোলার মতো নয়। মা-বাবার বিচ্ছেদ! কোন সন্তানের কাছে যেমন গ্রহণীয় নয়, তেমন স্বেচ্ছায় বর্জনীয়ও নয়। ভূমিষ্ট হবার পর থেকে সন্তান মূলত মাতৃপালিত এবং পিতৃলালিত। এতে মা-বাবার প্রতি সন্তানদের অটুট ভালোবাসার সুনিবিড় বন্ধন থাকে সুদৃঢ়। আবার মা-বাবার প্রতিও সন্তানদের ভালোবাসার শেকড় প্রোথিত হয় এক বিশ্বজনীন মায়া-মমতায়। অথচ সে মা-বাবারই বিবাহ বিচ্ছেদ! এমন একটা নিষ্ঠুর এবং কঠিন বাস্তবকে তারা সহজে মেনে নিতে পারে না। তাই যে মায়েরা স্বেচ্ছায় ঘর ছাড়ে, তাদের মতো হতভাগ্য ‘মা’ এ ত্রিভুবনে নাই। কেননা, মায়েদের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হিসাবে মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয় সন্তানরা। এসব সন্তানরাও হতভাগ্য! কেননা, বিনা অপরাধে অবধারিত শাস্তি! কি এক নির্মম নিয়তি! মা বেঁচে থেকেও নেই। ঐ সন্তানরাই মাতৃত্বের অপূর্ণতা নিয়ে একাকী, বৈরী পারিপার্শ্বিকতায় বেড়ে ওঠে। প্রতিনিয়ত মানসিক নির্মম পেষণে নিজেকে মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়। এই যে আশৈশব অতৃপ্ত চাহিদা, মায়ের প্রতি অবিশ্বাস। মূলত তাদের কল্পনার জগতটাকে দুমড়েমুচড়ে নড়বড়ে করে দেয়। শিশু মনের ওপর মায়ের ভালোবাসা ও সততার ওপর অনাস্থা। মূলত শিশুটির ননীকমোল হৃদয়ে স্থায়ীভাবে আসন গেড়ে বসে।
বাবার বেলায়ও তাই। স্ত্রীকে ডিভোর্স করার প্রতিক্রিয়ার প্রভাবও সমানভাবে প্রতিফলিত হয় সন্তানদের জীবনে। ঐ বাবাও আমৃত্যু সন্তানদের কাছে যেন এক মূর্তিমান আতংক।
ব্রোকেন পরিবারের সন্তানদের কাছে সবচেয়ে কঠিন ও নির্মম বাস্তবতা বাবা-মায়ের নতুন বিয়ের মুহূর্ত! কি নিদারুণ ভাগ্য বিড়ম্বিত জীবন তাদের! এমনি তাদের অহর্নিশ তাড়া করে মা-বাবার বিচ্ছেদ মুহূর্তের দীর্ঘশ্বাস! এর ওপর মা-বাবার নতুন বিয়ে! এই যেন জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ফেলা পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতাকে হার মানায়! আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-প্রযুক্তি, বানিজ্য ও অর্থনীতির আকাশছোঁয়া সাফল্যে জাপান একসময় বোমার ভয়ংকর সে ক্ষতচিহ্ন মুছে ফেলেছে। কিন্তু শিশু মনের ওপর মা-বাবা প্রদত্ত আঘাতের দগদগে ক্ষতচিহ্ন মুছে দেবে কে? এই দাগ যে পারমাণবিক বোমার চেয়েও বহুগুণ শক্তিশালী ও সুদূরপ্রসারী! তাদের নিষ্কলুষ কোমলতন্ত্রীর কোমলতাকে চিরদিনের জন্য নির্মম করে দেয়। মা-বাবা হয়তো নতুন সংসার পেয়ে মানিয়ে চলে। কিন্তু ওরা? ওরা তো পরিবারকে আর ফিরে পায় না। উপরন্তু সমাজের মূলস্রোতের অনান্য সন্তানদের মতো স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠতে দিচ্ছেনা আমাদের তথাকথিত সমাজ! অভিভাবকরা তাদের বাচ্চাদেরকে মিশতে দেয় না। ফলে বিদ্যালয়েও তাদের ঝরে পড়ার প্রবণতা তুলনামূলক ভাবে বেশি। পাঠে অন্যমনস্ক, খেলাধূলায়ও থাকেনা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ! ওদের চোখমুখ বিষণ্নতা আর হতাশার যুগপৎ আক্রমণ তাদেরকে শারিরীক ও মানসিকভাবে করে রাখে বিষাদগ্রস্ত। এর বিরূপ প্রভাব ফেলে তাদের মনোজগতে! ফলে ব্রোকেন পরিবার সন্তানেরা সাধারণত দুর্বল ব্যক্তিত্বের হয়। তাদের আত্মবিশ্বাস কম থাকে। হীনমন্যতায় ভোগে। খড়কুটোর মতো ভাসমান এই সন্তানরা সুখী হতে পারে না দাম্পত্যজীবনেও। খোটা আর অপবাদের তপ্ত আঁচ ওদের সংসারজীবন হয়ে ওঠে নরকযন্ত্রণার কারাগার!
নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ডিভোর্সি মায়েদের ঠাঁই হয় না ভাইয়ের সংসারে। বৃদ্ধ মা-বাবার ওপরেও বোঝা! এসব সিঙ্গেল মায়েদের শেষমেশ শেষ আশ্রয় গার্মেন্টসে। নিষ্পাপ সন্তানটির শেষ গন্তব্য রেলস্টেশন। “কিশোর অপরাধের অন্যতম প্রধান কারণ শিশুর প্রতি ভালোবাসার অভাববোধ।” যখনই শিশুরা চিন্তা করতে শুরু করে যে, সে তার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। কেউ তাকে ভালোবাসেনা। তখনি তার প্রবণতা থেকে সরে আসে। ভালোবাসার কাঙাল এসব পথশিশুরাই অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। আর কন্যা সন্তানেরা শিকার হয় যৌন নির্যাতনের। কিংবা দালালদের খপ্পরে পড়ে ঠাঁই হয় পতিতালয়ে। তাদের হৃদয়ের সুনামির তোড় কতটা স্পর্শকাতর, কতটা যন্ত্রণাদায়ক! আল্লাহ মালুম!
ডিভোর্সী অনেক মেয়েরা অনন্যোপায় হয়ে সন্তানকে নিয়েই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। স্বামীদেবতা প্রথম প্রথম বেশ মোলায়েম কথা বলে। সন্তানটিকে বাবার ভূমিকায় উজার করে দেয়। কিন্তু তার পরিবার এটা কখনোই মেনে নেয় না। শুরু হয় গৃহদাহ। প্রবাদ আছে, এক গাছের বাকল অন্য গাছে লাগে না। সন্তানটি দিনে দিনে বুঝতে পারে এ সংসারে সে অবাঞ্ছিত, পরগাছা। সে তখন তার শেকড়কেও কাছে পায় না। অমানুষ, পাষণ্ড বাবা তাকে হৃদয় থেকে মুছে দিয়েছে। তখনই হতাশাগ্রস্ত হয়। কেউ কেউ ডিপ্রেশনে ভুগে। উচ্চবিত্ত পরিবারের ব্রোকেন সন্তানরা নানা-নানির আদরে তারা উচ্ছৃঙ্খল বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত হয়। হালপাল বিহীন নৌকার মতো গন্তব্যহীন জীবন তাদের।
উচ্চবিত্ত পরিবারের অনেক স্বামীরা ব্রান্ডের পোশাক বদলানোর মতোই স্ত্রী বদলায়। আর উচ্চবিত্ত অনেক স্ত্রীরা? গ্লাস থেকে গ্লাসে পানি ঢালার মতোই রেওয়াজ চালু করেছে স্বামী পরিত্যাগ করার। এতে কলুষিত করছে সমাজ। সৃষ্টি করছে অগণন ব্রোকেন পরিবার। ধ্বংস করছে সন্তানদের অমূল্য সম্ভাবনাময় জীবন।
তাই বলছি, অনেকেরই অভিমত, মনের ওপর আইন চলে না। এই অযুহাত খাড়া করে আর যাই হোক নিজেদের নিষ্কলুষ ভাবার কোন যৌক্তিকতা নেই। সুতরাং স্বামী-স্ত্রীর ডিভোর্সের হার কমাতে হবে। বাংলাদেশে বহু বহু অসুখী দম্পতি আছেন যারা যন্ত্রণায় ডুবুডুবু থেকেও সংসার করছেন। তারা সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মানিয়ে-গুছিয়ে দাম্পত্যজীবন পার করছেন।
আসলে, ভালোবাসা আর মোহ এক কথা নয়। একসময় মোহ ভেঙে যায়। তখন সংশোধনের সময় অতীতের গহ্বরে। তখন কঠিন বাস্তবতা একসময় প্রতিধ্বনিত হয়ে নির্মম অট্টহাসিতে বিদ্রুপ করে। বিবেকের আদালতের অদৃশ্যমান শাস্তি! আহা রে জীবন! হারিয়ে যায় যৌবনের অহংকার! অস্থিচর্মসার দেহে মর্মবেদনায় ভুগতে ভুগতে বিদায় নেয় এ পৃথিবী থেকে। তবে ক্ষণিকের মোহে পড়ে সন্তানদের কষ্ট দেওয়ার দায় থেকে রেহাই দেয় না প্রকৃতিও। কেননা, প্রকৃতি ছাড় দিলেও ছেড়ে দেন না কিছুতেই।
লেখকঃ কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক