উপন্যাস─ চন্দ্রভানুর পিনিস। নাসিমা আনিস ─পর্ব দুই
- উপন্যাস─ চন্দ্রভানুর পিনিস। নাসিমা আনিস
- উপন্যাস─ চন্দ্রভানুর পিনিস। নাসিমা আনিস ─পর্ব দুই
২
চওড়া পিড়ার উপর হাতগুলো ছড়িয়ে রেখে মাস্টারবাড়ির ঝিনুক, আসাব আর মিয়াবাড়ির মইরম ছড়া কাটে আঙ্গুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ─এচকি ভেচকি দোয়াই কেচকি শ্যাম লড়ে গুয়া লড়ে ডাব্বার ঝিয়ে বাড়া বানে
চাল কাড়াইন্ন্যা মামি গো মামা আইছে ঘামাইছে ছাতি ধর নামাইয়া ছাতির মিদ্যে ঘুঘুরা ভালা মাইষের মুগুরা
এন কাঠ বেন কাঠ রাজার বাড়ির চন্দন কাঠ।।
মাটিতে বিছানো পঁচিশটা আঙ্গুল তর্জনীর ডগায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় ছড়ার তালে। ছড়ার শেষ মাথায় গিয়ে কারো অনামিকা কারো কনিষ্ঠা কিংবা অন্য কোন আঙ্গুলের মাথা গুঁজে দেয়, গুঁজে দিয়ে আবার এচকি ভেচকি…।
সব আঙ্গুলের মাথা গোঁজা হয়ে গেলে হাতের তালু মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে সম্পদ হয়। ─হাতের ভিতরে কী? ─ ভিতরে গুড়মুড়ি, ভিতরে দুদভাত, ভিতরে ক্ষিরের নদী………।
ক্ষীরের নদীতেই সাঁতার দেবে তারা, সাঁতার দিয়ে জিব বের করে একটু ক্ষীর খেতে খেতে…।
ধানের বিনিময়ে আসাব ঝিনুকের মা ক্ষীর কিনে দিলেও মইরমের কপালে জোটেনি কোনো দিনই। তো ওরা আবার বলে, হাতের ভিতরে কী? ─ মাছের কাটাকুটা,─ হাতের ভিতরে কী? ─ শবরি কলা, কবরী কলা, সাগর কলা, চিনিচাম্পা কলা, আইট্টা কলা কিংবা ক্ষীরের নদী…
বলতে বলতে চেয়ে দেখে দক্ষিণধারের বারমাসি তালগাছের নিচে একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে চন্দ্রকাকি। শেষ বিকালে চন্দ্রকাকির এইখানে দাঁড়ানো মানে ওরা জানে।
এখন ওরা নিজেদের খেলা ছেড়ে কাকির খেলায় নিজেদের যুক্ত করবে। কালিনী কিংবা জমিলা মাজাপানিতে নামবে মাজা থালবাটি কিংবা পান নিয়ে। ওদের পাহারা দিবে কাবান্নি আর কাবান্নিকে পাহারা দিবে আড়াল থেকে চন্দ্রকাকি। কাবান্নির দুই হাতে দুইটা ঝুড়ি, একটায় ধোয়া জিনিস অন্যটায় আধোয়া জিনিস। যদি পান হয় তো কালিনী একটা করে পান নিবে আর পানসহ সে নিজে সাতটা করে ডুব দিবে, কাবান্নি গোনে এক দুই তিন…।
গোনার ফাঁকে ধোয়া পান যাবে ডাকনাওয়ালা এ্যালুমিনিয়ামের পানবাটায় যা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে চন্দ্রভানু। এভাবে পুরো বিকালটা চন্দ্রভানু কাবান্নি আর কালিনীর চলে গেলেও কোনো দিন একটা ডুবও কম দেয়া যাবে না। খেলতে থাকা শিশুরা তাই ঘাটকুলে না গিয়েও ছড়া কাটে ─কালিনী লো কালিনী পান কয়ডা ধুলিনী তাও পানে ধুলা কালিনী তুই, খাবি কাঁচা মুলা মুলায় খুব পাদ কালিনী তুই বাদ।
কাছারি ঘরে আজান শুরু হলে আর সেদিনের মত কালিনী পানি থেকে উঠে ঠকঠক কাঁপতে কাঁপতে ছোট ছোট পায়ে দৌঁড়ে দৌঁড়ে বাড়ি ফিরতে চায় কিন্তু পারে না। ফাল্গুনের বাউরি বাতাস ওর ভেজা কাপড় জড়িয়ে ধরলে ও আর নড়তেই পারে না যেন। শরীরের সমস্ত পশম খাড়া হয়ে উঠলে ও হুহু করে কেঁদে ওঠে যদিও ওর কান্না দেখার জন্য জগতে কোন লোক অপেক্ষা করে থাকে না।
চন্দ্রভানু হাঁটে সামনে, হাঁটার সময় ওর মেরুদন্ড থাকে টানটান, ঘাড় মাথা সমান্তরাল।
মাথার কাপড় পড়ো পড়ো কিন্তু পড়বে না। নিতম্ব ছোঁয়া বেনুনীর মাথাটা নিতম্বসহ সামান্য ডাইনে বাঁয়ে দুলে তা এমন একটা দ্যুতি ছড়াতে ছড়াতে যাবে যে আড়াল না হওয়া পর্যন্ত কেউ নিজেকে আড়াল করবে না।
ঘরে ঢোকার আগে সে পায়ের চপ্পল জোড়া পাল্টায় আর স্নান ঘরে ঢোকে। আর কাবান্নি চপ্পল জোড়া ধুয়ে মুছে বারান্দার বাক্সে তুলে রাখবে আর বিনিময়ে চন্দ্রভানু পাবে আরেক জোড়া চপ্পল। ভরা সন্ধ্যায় ঘন্টাখানেকের একটা স্নান শেষে এবার এ্যালুমিনিয়ামের বাটার পানগুলো বদল করে রাখবে রুপার পানবাটায়। আর পান বদলের সময় দুএকটা পান গভীর মনোযোগ আর সন্দেহ নিয়ে চোখের সামনে ধরে পর্যবেক্ষণ করতে করতে ভাববে, ডুবগুলো নেহাত ভাসা ভাসা, একেবারেই পরিষ্কার হয়নি, তারপর সন্দেহজনকটা নাকের কাছে নিয়ে শুঁকবে। নাক-মুখ কুঁচকে দূরে সরিয়ে রাখবে প্রবল ঘৃণায়। আর এ সময় কুদ্দুস সরকার বাড়ি থাকে না বলে কাবান্নি দক্ষিণধারের গর থেকে গুণে গুণে সাতটা ডুব দিয়ে পরনের কাপড় বদলে ৫/৬ হাতের একপ্রস্থ কাপড় পরে চন্দ্রভানুর ডাকের অপেক্ষায় থাকবে। ৬ হাতি ন্যাকরায় কাবান্নির থলথলে মাংশবহুল দেহে কোমরের এক প্যাচ দিয়ে কেবল সটান উঠে যায় কাঁধে, ফলতঃ যা হয়, বগলের দু’পাশ দিয়ে ঝুলতে থাকা প্রমাণ সাইজের অলাবুদ্বয় হয় দৃশ্যমান।
এই বস্ত্রে অপেক্ষা করতে হয় যতক্ষণ না ভিতর থেকে চন্দ্রভানু ডেকে উঠবে। ঘরে ঢুকে অবশ্য কাবান্নি নিয়মিত করা কাজগুলো করতে শুরু করবে অনুমতি ছাড়াই আর কোন প্রশ্ন করবে না। প্রশ্ন করা বা কোন কথা বলা মানে হলো কাবান্নির বিরাট ভুঁড়ির (যদিও তা খুব বেশী বড়ো না) দুর্গন্ধ মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসে সারা ঘর পূতিগন্ধময় ও জীবাণুযুক্ত করে তোলা।
যা হোক অনুমতি পেয়ে কাবান্নি হাতে পায় সাত প্রস্থ ন্যাকড়া, যা দিয়ে সে ঘরের দৃশ্যমান যাবতীয় জিনিস সাতবার করে মুছবে। কাঠের নিঁখুত সূক্ষ কাজের ভিতর সাতটা ন্যাকড়ার পাকানো সূঁচালো মাথা দিয়ে ঘঁষে ময়লা বের করতে করতে কাবান্নির আঙ্গুলের ডগা ক্ষয়ে আসে। মুছতে মুছতে কাবান্নি নকশাদার কাঠের কাঁরের দিকে তাকাবে, ফুললতাপাতার ঈষৎ আড়ালে অদ্ভুত এক নারীর মুখের এক পাশ প্রকাশিত। খোঁপায় কাঠালি চাঁপার ফুল, মুখে হাসি না বেদনা, কাবান্নি বুঝতে পারে না।
আর অবাক হয়ে সে প্রতিদিনই ভাবে ফুলের বনে প্রজাপতির সাথে কেন মাছেরা ভ্রমণ করে। ছোট বড় মাছ, ছোট বড় প্রজাপতি। আর একঘেয়ে এই মোছার সময় প্রতিদিন সে একই কাজ করে। মোছে নকশাদার পালঙ্ক অথচ চোখ থাকে কাঁরের কাঠচিত্রে। দেখতে দেখতে কখন যে চিত্রগুলো ভেঙে ভেঙে যায়, একেক বার একেক রকম খণ্ড খণ্ড দৃশ্য হয়ে নতুন নতুন কাহিনী হয়ে চোখে এসে পড়ে। প্রজাপতিগুলো কখনো কাঁরের নীচে হাওয়ায় ভাসে, শ্যাওলায় লুকোচুরি খেলতে খেলতে হারিয়ে যায়, কখনো বা মাছগুলো সাঁতরে সাঁতরে প্রজাপতিদের ধাওয়া করে। আর নারী কখনো ফুল তোলে কখনো বা ছিপ ফেলে মাছ ধরে কিংবা প্রজাপতিদের পিছনে ছুটতে থাকে ঊর্ধ্বশ্বাসে। কাবান্নি ভাবে আসলে এই দৃশ্যে চন্দ্রভানু মাছ ধরে, মাছকে আধার দেয় তারপর কখনো প্রজাপতিদের সাথে কখনো বা মাছেদের সাথে খেলতে খেলতে হাঁপিয়ে যায় …হাঁপাতে হাঁপাতে তাদের অতৃপ্ত কামনা ভেজা দেয়াশলাইয়ের কাঠির মত ম্যাদা মেরে পড়ে থাকে পালঙ্কে। পালঙ্কের সুজনিতে বীজানু বিজবিজ করে, বিজবিজ করতে করতে নারীর সমস্ত গা ঢেকে ফেলে। তারপর নারীর ভিতর এক ভয়ানক জঙ্গম অসুর ভর করে। অসুর খেঁকশিয়ালের বেশ ধরে ছুঁকছুঁক ঘোরে অনিন্দ্যসুন্দর কোন পুরুষের কাছে। সেখানে কুক্কুরীবেশী নারীর কোন শুচিবাই নাই, এমন কি আধোয়া পান হেকিমপুরি জর্দ্দায় ঠেসে মুখে পুরে দিব্যি ছিনাল কি অনঙ্গকলায় চতুরা হয়ে উঠতে পারে।
হাতে এমনকি কুদ্দুস সরকারের পিতলের কলকিটাও থাকতে পারে, প্রকাশ্যে জীবনেও যা তার পক্ষে ঘৃণায় হাত দেয়া অসম্ভব। আর কলকির মাথায় থাকবে দা-কাটা কড়া তামাক, যে তামাক কাইলমোশলে এলিয়ে দিয়েছে হতির মা, যে কিনা পুরো মাসিক পর্ব কাটিয়ে দেয় কোন রকম ন্যাকড়া ছাড়া শুধু দুই থোরার ভাঁজ দিয়ে আটকে রেখে। কাবান্নির গা ঘিনঘিন করে উঠলে কাবান্নি পরিষ্কার দেখতে পায় সদরঘাটের অন্ধকার গলির খারাপ লোকগুলো চন্দ্রকে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় সে ছলনা করে বলছে, এরা আমারে কই নিয়া যায়, আমারে বাঁচান!
পালঙ্কে নতুন পাতা পাটির মোরতাকের বেতগুলোর দিকে চোখ ফিরিয়ে আনলে এবার দ্যাখে বেতগুলোর রঙ নড়েচড়ে, হালকা হয় গাঢ় হয়, সরল বুনন অসরল হয়ে ত্রিকোন চতুর্কোন দিতে দিতে সব ঘরগুলোকে একাকার করে দেয়।
কাবান্নি এবার মুখ ঘুরিয়ে দেখে কাঠের হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে উনি ঢুলছেন আফিমের আবেশে। এই সুযোগে কোন্ধ সিন্দুকের ভিতর সোনার বাসানটা থাকতে পারে সে কল্পনা করতে গিয়ে গালে হাত দিয়ে ফের চন্দ্রভনুকে আরেকবার দেখে নেয়। কাবান্নির মোছামুছি শেষ হলে ভরা সন্ধ্যায় পাকা শানের মেঝে টেনে টেনে সাতবার মোছে, মুছতে মুছতে ক্লান্তিতে প্রায় শুয়ে শেষ পোছটা দিতে গেলে ওর অলাবুদ্বয় মেঝেতে লুটোপুটি খায় আর চন্দ্রভানু আরক্ত চোখে সে দৃশ্য দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে ওঠে।