উপন্যাস─ চন্দ্রভানুর পিনিস। নাসিমা আনিস
- উপন্যাস─ চন্দ্রভানুর পিনিস। নাসিমা আনিস
চন্দ্রভানুকে কবরে নামানো হবে, চল্লিশ কদম পেরিয়ে গেলে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তোমার রব কে, মান রাব্বুকা? তোমার দীন কী? আর নবীকে দেখিয়ে প্রশ্ন করা হবে ইনি কে?…।
চন্দ্রভানু কোন উত্তর আপসে দিয়ে পার হয়ে যেতে পারবে না, এমন কি সে তো কোন প্রশ্ন বুঝতেই পারব না…
তারপর সেই অন্ধকার গভীর কালোতে চন্দ্রভানুকে যে কত সাপখোপ কীটপতঙ্গ দংশন করবে আর চন্দ্রভানু সে স যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে আর্তনাদ করতেথাকলেও রেহাই পাবে না…
এই দৃশ্যটাই এখন কল্পনা করছে উঠানে দাঁড়ান আমজনতা। যদিও চন্দ্রভানুর বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই তবুও ওরা সেই কোন জনমে পাওয়া তরুণীর গল্পট দক্ষিণধারের বুড়া মেন্দিগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আরো বহু বারের মতো আরো একবার আওড়ায়।
কোন ভিন দেশের তরুণী সুন্দরীর গল্প। যার অকালে মৃত্যু হলে (তাকেও তার গ্রামের লোকেরা অপছন্দ করতো খুব) তাকে কবর দিতে অস্বীকৃতি জানায় অনেকেই। শেষে গভীর রাতে নিকট আত্মীয়রা কবর দিয়ে বাড়ি আসতে আসতে কিছু অশুভ জিনিসের দেখা পায়। কিন্তু হায়, সেই রাতেই সে তরুণী কবরের আজাব সইতে না পেরে কবরের উপর উঠে নাচের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকে ভাবে পাকপবিত্র করে কবর দেয়া হয়নি বলেই এই অবস্থা। তারপর আবার নতুন করে গোসল, নতুন কাফনদাফন হলেও মধ্যরাতে সেই একই ঘটনা। লোকজন কুপি জ্বালিয়ে তল্লাশি চালায়, কোথায় সমস্যা, কোথায় না পাকের শয়তান। তারপর তারা খুঁজে পায় বাঁ হাতের কনিষ্ঠায় নখ পালিশের লাল রঙ, এই রঙ অজুর পানি ঢুকতে দেয় নাই, অজুও শুদ্ধ অয় নাই, তয় হেয় কবরের ভিতরে কেমনে থাকব গো…!
সারাটা সকাল বিশাল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে পুরো গ্রাম এসে দাঁড়ায় সরকার বাড়ির উঠানে। উঠান ভরে উত্তরধার দক্ষিণধার ছেয়ে যায় মানুষে। আর দক্ষিণধারে সব ফুল ফোঁটা শেষ হয়ে গেলেও বান্দরলাঠি গাছে অসময় ফোঁটা দুই ছড়া হলুদ ফুলের ঝাড় ঝুলে থাকে। আর আশ্চর্য, এত কিছুর মধ্যে সবাই কামারকারা শিকদার বাড়ির মানুষদের আগমনের সংবাদ জানতে চায় না। যেন জানাই আছে, চন্দ্রভানু জানান দিয়ে যাত্রা শুরু করা সত্ত্বেও চন্দ্রভানুর বাপের বাড়ির কারো নৌকা ঘাটলায় এসে ভিড়বে না। ঘাটলায় তো না, কার্তিকে নৌকা ভিড়ে নদীতে কিংবা খালে। দক্ষিণধারের ঘাটলা শুকনা, পানি থাকে নদীতে আর ছোট ছোট পুকুরে। গরগুলো এখন মাছ আর পানিতে থিকথিকে আর মাঠ ভরা প্রায় পাকা আমন নিয়ে বুক চিতিয়ে বাহাদুরি দেখায় গাঙ পর্যন্ত বিল। কাদা থিকথিকে বিলের জমির আলে তখন কত যে শাক কলমি গিমা সাচি! আর বক বেড়ায় ঝাঁকে ঝাঁকে একটু ছিপছিপে পানিতে মাছের আশায়।
যদি গন্ধরাজ কিংবা কদুর তেল কিংবা বলা যায় লক্ষীবিলাস তেল মাথায় নিয়ে সারা উঠানে স্মৃতি জাগানো মদিরা ছড়িয়ে বউ দু’ একটা দাঁড়ায়, সে সুগন্ধ কি বায়ুময় উঠান ছেড়ে বন্ধ দরজাকে টপকে ঘরের ভিতরে আছড়ে পড়বে না?
তখন সকলের অগোচরে টেনে টেনে নিশ্বাস নিতে নিতে চন্দ্রভানুর নাকমুখ, চোখকান, ত্বক- সব, এমনকি অপার্থিব এক আশ্চর্য ইন্দ্রিয়ও ছুঁয়ে ফেলবে সেই সুগন্ধ। তারপর চেতনে অচেতনে অবচেতনে সে অনুভব করতে গেলে সাট সাট করে সব দরজা জানালা খুলে যাবে। সে বুঝবে, এসব একদিন তারও ছিল।
হাজার হাজার সুগন্ধময় রাত, কুমকুম আতর লক্ষীবিলাস ত্রিফলা হিমানি চর্চিত মেদুর রাত, যেখানে সারা রাত কারুময় কাঁরের সাথে ছিল সীমহীন খেলা।
এখন সে ঘ্রাণ পায় এই প্লাবন জলাভূমির হাজার হাজার মানুষের হাজার বছরের অপেক্ষার।
যাদের সাথে তার কোনোকালে নৈকট্য রচিত হয় নাই, অথচ এখন সে বিষ্ময়ে-বিমোহিতে লক্ষ্য করে এরাই ছিল তার আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশী কিংবা হয়ত আরো আরো কাছের মানুষ।
আর মনে পড়ে, সেই অনাস্বাদিত জগতের স্বাদ কি বিস্বাদ নিয়ে সে যখন বাড়ি ফেরে তার কাপুরুষ স্বামী তাকে প্রথম ভাত খেতে দেয় সোনার থালায়। ─চন্দ্র ফিলা আইলে সোনার থালায় ভাত খাইতে দিমু, মানত করা সোনার থালাটার কথা সে মনে করতে পারে এখন। সোনার থালা পেয়ে স্বামীর কাপুরুষ তাকে বারবার ক্ষমা করতে চেয়ে আরো যে কত দূরে সরে এসেছে, যত ভেবেছে নিজের ভূত-ভবিষ্যত তত হয়েছে ক্ষমাহীন। আর সেই থালাই যেন ছিল তার অতৃপ্ত আত্মার, গভীর বেদনার একমাত্র স্মারক। রাত গভীর হলে সোনার থালা দিয়ে সমস্ত শরীর মাজতো আর তার সর্বাঙ্গ হয়ে উঠতো বৈশাখের সোনারুলু গাছের মত সোনাময়, কার্তিকের পাকা ধানের মত বিকচচর্চিত। তবু স্বামী কাছে আসতে যেয়ে চন্দ্রর চোখের দিকে তাকালে জঙ্গম এক প্রবাহ তার সব কিছু তছনছ করে ছেড়েছে।
এখন উঠানে ভালো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা আজিবর কি বলবে সে তার থালাটা চুরি করে কোথায় লুকাল!
আর বুকের গভীরে লুকিয়ে থাকা সেই তিন দিনের শিশু! এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ষোলআনা অধিকার থাকা সত্ত্বেও মরতে হয়েছে যাকে! পত্রবাহক হাবা! হায় হাবা, হায় কাবান্নি! পত্রে লেখা ছিল, শিশুকে মরতে হবে, তানা হলে ধুলায় মিশে যাবে সরকার বাড়ির সমস্ত ইজ্জত। কামারকারা শিকদার বাড়ির সমস্ত বাতাস থেমে যাক তাতে কি, তাকে মরতে হবেই।
ঢোঁড়া সাপরে পানক সাপ মনে কইরা তুমি এত ডড়াইলা সরকার!
কিংবা মনে পড়বে আলিঝালি অন্ধকার ঢাকার সদরঘাট কি রূপমহল সিনেমা হল। সিনেমার নায়িকার বেপর্দা অর্ধস্তন। সিনেমা দেখে ফেরার পথে কুদ্দুসের আমসিপানা মুখ, স্ত্রী হারিয়ে শিমুলচরে ফিরে সে কী বলে বলে কেঁদে বাড়ি মাথায় করেছিল! …আগো আমাল বউ ফিলাইয়া আইনা দাও! আমি চন্দ্ররে ছাড়া বাঁচুম না!
আর কুশাই মাঝির বউটা দুই বছর আগে মারা গেলে ঘটনার প্রায় ত্রিশ বছর পর আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে শিমুলিচরের মানুষজন। হায় আল্লাহ, কুশাইর গল্পই ক্যান মানুষ রাতদিন যুগযুগ করবে, তাদের আর কোন কাজকাম নাই! নাকি তারা মরার সময়ও জিব্রাইলের কাছে সময় চেয়ে নিবে! বলবে, রাইত হইছে তো কি, আকাশে চন্দ্র আছে গো, উডানে একটা পাটি পাইত্যা আমারে শোয়াও, আমি মরার আগে আরেকবার আউশ; মিডাইয়া চন্দ্রর কিচ্ছাডা কই…।
আর কুশাইর বউটাই বা এই বুড়া বয়সে গলায় দড়ি দিতে গেল কেন! গলায় দড়ি দেয়ার আগে সে যথারীতি তিনদিন খেতে পায়নি, খেতে পায়নি তো কী, সে কেন, এই গাঁয়ের কোন লোকটিই বা সারা জীবন পেট ভরে খেতে পেয়েছে!