উপন্যাস

নাট্যোপনাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব এগারো

রাধারমণসংগীত

কারে দেখাব মনের দুঃখ গো আমি বুক চিরিয়া
অন্তরে তুষের অনল জ্বলে গইয়া গইয়া
ঘর বাঁধলাম প্রাণবন্ধের সনে কত কথা ছিল মনে গো
ভাঙ্গিল আদরের জোড়া কোন্ জন বাদী হইয়া
কার ফলন্ত গাছ উখারিলাম কারে পুত্রশোকে গালি দিলাম গো
না জানি কোন্ অভিশাপে এমন গেল হইয়া
কথা ছিল সঙ্গে নিব সঙ্গে আমায় নাহি নিল গো
রাধারমণ ভাবে রইল জিতে মরা হইয়া।

ননী দৌড়ে এল বাড়িতে। দেবালয়ের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়, তারাফুলের ঝাপসা আলো-ছায়ায়। পশ্চিমাকাশের সন্ধ্যার সূর্যটি নিপাট ঘুমে আচ্ছন্ন। উত্তেজিত গলায় ননী বলল : বউদি, বউদি, ওগো বউদি।
বউদি নিশ্চুপ। ননী দরজার ওপর বর্শার ফলার মতো তাকিয়ে থাকে। তারপর দেবালয়ের জানালা দিয়ে একবার ঝুঁকে তাকায়, দেখতে পায়, বউদি প্রার্থনার ভঙ্গিতে প্রতিমার সামনে দুই হাত তুলে বিড়বিড় করে সংস্কৃতাক্ষর মালায় মন্ত্র জপছে। সে দ্রুত পায়ে বউদির পাশে এসে দাঁড়াল। বলল : বউদি, তোমার কি মন্ত্র জপা থামবে?
মন্ত্রজপা শেষ করে অন্যমনস্ক কমলিকা বলল, এই তো শেষ।
কমলিকার আরও কাছে সরে এসে ননী উত্তেজিত স্বরে বলল : বউদি, আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। সব শেষ, একেবারে শেষ।
কমলিকা স্থির কঠিন কণ্ঠে বলল, কী হয়েছে, খুলে বল্?
ননী প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কেঁদে উঠল; তারপর বলল : নায়েব মহাশয় ও তার দলবল দাদাকে বেঁধে নিয়ে গিয়েছে। মহাজনও গঞ্জে, আজ ফেরার কোনও সম্ভাবনা নেই।
কমলিকার প্রকৃতিটি ভীষণ অদ্ভুত। তার মস্তিষ্ককে ধর্মশাস্ত্র অধিকার করে রাখলে তার হৃদয় পতিভক্তির আলয়। স্বামীর কোনও অঘটন ঘটলে তার অন্তরে প্রবল যন্ত্রণার জন্ম দেয়। সে-যন্ত্রণা যত তীব্র, ততই কঠোর। সে বলল, কী বলছিস!

কমলিকার গলায় কান্না দলা পাকিয়ে আটকে গেল। মস্তিষ্কের চূড়ান্ত স্বপ্নাঞ্চল অবধি, যেখানে কামনার সূক্ষ্মতম স্তর, সেখানে কে যেন তীব্র ঘা বসিয়ে দিল। গভীর কষ্টে সে নিস্তব্ধ। কী করবে বুঝতে পারছে না। কার কাছে গিয়ে তার স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইবে? সংসারে এই ঘটনা তুচ্ছ হতে পারে, কিন্তু তা ভাটিদেশের একটি সামান্য নারীর কাছে, কমলিকার কাছে, তুচ্ছ নয়। ত্বরিতে কালক্ষেপ না-করে সে তার জীবনের অনশ্বর যাত্রা শুরু করে, অর্থাৎ অন্য কোনও উপায় না-পেয়ে ননীকে সঙ্গে নিয়ে কমলিকা রায়কুটিরের উদ্দেশ্যে ছুটতে লাগল। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা উপচে উপচে তার চোখে-মুখে ছলকাতে থাকে। তার চলনে স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা নিশ্চল, কিন্তু দিশেহারা। এর নেশা তার গলা-ভর্তি। এ-যেন পেট-পূর্তি নেশা, খিদে-নাশক। এই নেশায় এক পা এক পা করে এগিয়ে চলল সে। রায়কুটিরের রাজপথ ভেঙে কমলিকার পিছু পিছু এগিয়ে চলল ননীও।
দ্রুত পদবিক্ষেপে কমলিকা ও ননী রায়কুটিরে এসে উপস্থিত হল। তাবৎ ভাটিদেশের লোক যেন রায়কুটিরের উদ্যানে এক মুহূর্তে এসে জমেছে। বন্যার জলের মতো উজাড় হয়ে এসেছে যেন তারা। তারা দূরে দাঁড়িয়েই দেখছে। কমলিকাকে চেনা যাচ্ছে না। তার মুখ যেন রক্তচাপে ফেটে ঘেমে পড়ছে। দুই পাশে পাঁচিল, মাঝখানে উন্মুক্ত উদ্যান, পেছনেও পাঁচিল। ডানে-বাঁয়ে কোথাও পালানোর শক্তি নেই। রায়বাহাদুর কিছুই বলছেন না। লোকটির কত বয়স হয়েছে, তা বোঝার উপায় নেই। ষাট হতে পারে, আবার সত্তরের ওপরেও হতে পারে। পাকানো চেহারা, মুখে একটিও বয়সের দাগ নেই, অথচ দাড়িগোঁফ সব শাদা হয়ে গিয়েছে। মাথার কেশভার পলিত। তিনি একটা পাঞ্জাবি পরিধান করে আছেন। হস্তে একটি লাঠি। মাঝেমধ্যে এই লাঠি দিয়ে কী যেন নির্দেশ করছেন।

ঘনশ্যামের প্রতি নায়েব মহাশয় যা শুরু করেছে তা দেখে কমলিকার দুই চোখ ছলছল করছে। ভাটিদেশের মানুষও কেউ কোনও কথা বলছে না। সমবেত সবাই স্থির দর্শক মাত্র। বিশীর্ণ এলোমেলো কমলিকা হঠাৎ ছুটে এসে তার স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠল, আমার স্বামীর গাত্রে হস্তার্পণ কোরো না। তার পূর্বে আমাকে হত্যা করতে হবে। তারপর রায়বাহাদুরের উদ্দেশ্যে নরমবিনীতকণ্ঠে বলল, অনুগ্রহ করে আমার স্বামীকে ছেড়ে দিন। আপনার কাছে হাত জোড় করে বলছি, ওর কোনও দোষ নেই। ওকে ক্ষমা করে দিন।
কমলিকার মুখপানে চোখ তুলে তাকানো মাত্রই নিতান্ত বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন রায়বাহাদুর। নায়েবকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কে এই নারী? অপূর্ব! যত দেখছি ততই উৎসাহিত হচ্ছি।
ফিসফিস করে নায়েব বলল : প্রভু, যাকে আমরা বন্দি করে এনেছি সে তারই স্ত্রী, কমলিকা।

কমলিকার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলেন রায়বাহাদুর, কমলিকার কী মাধুর্য! তিনি যেন দর্পণে স্বর্গের অপ্সরী উর্বশীকে দেখতে পেলেন। অবিকল তারই মতন, শুধু কমলিকা পার্থিব একজন নারী! অবিকল তারই প্রতিকৃতি! পার্থক্য যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে তা তার বেশবাসে এবং কেশপারিপাট্যে। কমলিকার বেশবাস অতি সাধারণ; পরনে সামান্য শাড়ি, বাসন্তী রঙের একটি বক্ষবস্ত্র। কটিদেশ পর্যন্ত নেমে এসেছে কেশদাম। বক্ষের ওপর বেণির মতো প্রলম্বিত। কপালের ওপর চূর্ণকুন্তল। এইসব ছাড়া স্বর্গের অপ্সরী উর্বশীর সঙ্গে কোনও প্রভেদ নেই। তার গৌরবর্ণ, তার আয়ত লোচন, বাঁকা স্কন্ধ, ললিত বাহু—সব, সব এক!
মুগ্ধ বিস্ময়ে কমলিকাকে দেখতে দেখতে রায়বাহাদুর স্বগতোচ্চারণ  করলেন : ঈশ্বর তুমি করুণাময়! জমির শেষ হয়, জীবন চলে যায়, সম্পত্তি ফুরায়, মানুষ হয় ভিখারি, তবুও অরণ্যে থাকে বৃক্ষ, জলে থাকে মাছ, আর ভাটিদেশে উর্বশী লুকিয়ে থাকে। অতঃপর নায়েবের দিকে তাকিয়ে প্রকাশ্যে বলতে লাগলেন : এই ভাটিদেশে এমন সুন্দরী রমণী! উত্তরের অপেক্ষা না করেই কমলিকার উদ্দেশ্যে যোগ করলেন : তোমার স্বামী ঠিকমতো তার পাওনা পরিশোধ করেনি, তাই তাকে বন্দি করে এখানে আনা হয়েছে।
কমলিকা সামান্য ইতস্তত করে বলল : প্রভু, ওকে ছেড়ে দিন। আমিই সব পাওনা পরিশোধ করে দেব।

রায়বাহাদুরের শিরোদেশে অসহ্য যন্ত্রণা হতে লাগল। তার মাথার ভেতরে ‘কমলিকা’ নামটি যেন দলা পাকিয়ে প্রলয়কাণ্ড বাঁধাচ্ছে। নির্বাক হয়ে তিনি কমলিকাকে দেখতে লাগলেন। ভাটিদেশে এও সম্ভব! উর্বশীর সঙ্গে কমলিকার এতটা সাদৃশ্য! সাদৃশ্য বললে ভুল হয়, একজন যেন অন্যজনের হুবহু অনুকৃতি! রায়বাহাদুরের মনে হল, উর্বশী নিজেই যেন অন্য প্রকার বেশভুষা ধারণ করে তার সম্মুখে দণ্ডায়মান! বিস্ময়ের জড়তা ক্ষণপরে অপসারিত করে কমলিকার উদ্দেশ্যে বললেন, তোমাকে দিয়েই তাহলে তোমার স্বামীর পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা করা হবে। আর নায়েব মহাশয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, ঘনশ্যামকে ছেড়ে দাও। এই নারীকে দিয়েই পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা কোরো।
নায়েব করযুক্তভাবে বলল, যথাজ্ঞা প্রভু। আপনার নির্দেশ অনুযায়ীই ব্যবস্থা করা হবে।
ঘনশ্যামকে ঘিরে সঙ্গে সঙ্গে ভিড় জমে উঠল। কেউ একজন জলে ভেজা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিল তার মুখ। পিঠের জামা খুলে ফেলে কেউ কেউ দেখল নায়েবের লাঠির তীব্র আঘাতের দাগ বসে আছে। কেউ একজন দাঁতে-চেবানো ঘাস আর কচুরস লাগিয়ে দিল ঘনশ্যামের ক্ষতস্থানে। তারপর তাকে কয়েকজন টেনে নিয়ে এল রায়কুটিরের ত্রিসীমার বাইরে।
কিছুক্ষণ পর ভিড় হালকা হল। কমলিকার প্রতি মানুষের তেমন আর কোনও কৌত‚হল রইল না। দু-একজন যারা বসে ছিল তারাও উঠে চলে গেল। শুধু পড়ে রইল কমলিকা। তার ওপর দৃষ্টি নিক্ষেৎপ করে, তার কানে কানে, নায়েব বলতে লাগল : এজন্যই কি বলে—সুন্দর মুখের জয় হয় সর্বত্র!

রায়বাহাদুরের গৃহেই স্থান হল কমলিকার। কয়েক মুহূর্ত ননী কী করবে, কী করবে বুঝতে পারল না। অবশেষে ননী রায়বাহাদুরের গৃহের একটু দূরে অন্ধকারাচ্ছন্ন বকুলতলায় এসে বসে রইল। কমলিকার খুব কষ্ট হচ্ছে। রায়বাহাদুরের কি কোনও মানবিক নীতি নেই? এমনই এক সূচিভেদ্য যন্ত্রণা কমলিকার বুকের ভেতর ফুটতে থাকে। রায়কুটিরের টানাপাখার ঝালরে ময়ূরপুচ্ছ ঝুলে আছে, যেন কৃষ্ণপ্রেমের চিহ্ন। কমলিকা সেই দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে : কৃষ্ণ কেন এই লীলাকাণ্ডের প্রতিরোধ করতে পারছেন না! অদ্ভুত! তার কাছে কি ভাটিদেশের নারীদের কোনও মূল্যই নেই! ভাটিদেশে কি ব্রজগোপী থাকেন না?
হে মোর সুন্দরী, আমার স্বপ্নের পরি, আমার বুকে এসো। তোমার স্বাদ গ্রহণ করে আমি পরিপূর্ণ হতে চাই।
রায়বাহাদুরের কথায় কমলিকা সচকিত বিরক্তিতে মুখ ঝটকায়, কী বকছেন আপনি!
কিন্তু এতে রায়বাহাদুরের কিচ্ছুই যায়-আসে না, বরং তার ভঙ্গিতে স্বপ্নালোর রঙিনরেখা ফুটে ওঠে। এর জন্য অবশ্য লজ্জিত হওয়ার কিছুই নেই তার।

কমলিকার পাশে যতই এগিয়ে যাচ্ছেন রায়বাহাদুর, ততই তার মন কুৎসিত হয়ে উঠছে। এই বর্বরতার অন্য কোনও অর্থ নেই। নিতান্ত দুর্বহ। কমলিকা স্তব্ধ হয়ে ভাবতে থাকে : রায়বাহাদুরের মনের বর্বরতার অদৃশ্য ধূলিকণাগুলোকে ঝেড়ে পরিষ্কার কেন তিনি করছেন না? এই রায়কুটির এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা সত্ত্বেও তার মন কেন এত বিষাক্ত? তার এই আচরণের ব্যাখ্যা কমলিকার মতো মানুষের কাছে অজানাই থেকে যায়। তবুও সে সুস্পষ্ট শুনতে পায় রায়বাহাদুরের কণ্ঠস্বর, তিনি বলছেন : তোমার দৃষ্টি, তোমার চিবুক, তোমার ওষ্ঠ আর অধর, তোমার গাল, কপাল, চুল—সবকিছু মিলিয়ে তুমিই আমার চিরন্তনী নারী। তোমার আহত ঠোঁট দুটি আমার মনে বিস্ময়ে বিদ্ধ চিত্রার্পিত রহস্যজাল সৃষ্টি করে চলেছে।
কমলিকার তীব্র অস্বস্তিতে বাতাসের নিশ্বাসও বন্ধ হয়ে আসছে প্রায়। রায়বাহাদুরের পশুসুলভ আচরণে কমলিকা বিমূঢ়। অত্যন্ত সম্ভ্রমে আর লজ্জায় নিথর পাথর যেন। তার কপাল কুঞ্চিত। চোখ ছলছল করছে। রায়বাহাদুর বলতে লাগলেন, তোমার নগ্ননির্জন দুটি হাতকে আমি আদর করতে চাই। তোমার হাতগুলোর কারুকাজ আমাকে মগ্ন করেছে। তুমিই আমার সেই নারী। সেই কামিনী। আমার কাম। আমার স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা  বিলীন হওয়ার একমাত্র ঘাসবীজ।
একথা শুনে কমলিকা ভাবতে থাকে : কী করব? তার চোখে-মুখে ভাবাবেগের চাপে অন্তরে ফুটে ওঠা কত প্রকারই তরঙ্গ খেলে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ সে গর্জে ফুঁসে উঠল, আমাকে আপনি ছেড়ে দিন। আমাকে আমার স্বামীর কাছে যেতে দিন… আমার স্বামীর কাছে যেতে দিন… হায় ঈশ্বর!
কমলিকা আচমকা বিহ্বল হয়ে পড়ে।

Series Navigation<< নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব দুইনাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব বারো >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *