বিশেষ সংখ্যা

”৭১ এর হৃদয় থেকে” বিজয় দিবস সংখ্যা- ২০২৪

একদিন চলে যাবো যে যার গন্তব্যে একা একা
কোনো বাঁশি বাজাবে না বৈকালিক সুর
কোনোরূপ মিত-হাওয়া দেবে না প্রবাহ সাহসের
কেবল স্মৃতির নৌকো দোল দেবে চোখের সাগরে
নির্জন সৈকতে বসে শুধু তুমি কবিতার
পঙক্তি আওড়াবে।

একদিন রমণীয় আঙুলও বুলাবে না বৃত্তের আঁচড়
কপোলের নম্র বেলাভূমে
বিপরীত স্রোতে আমি ছেড়ে দেবো অস্থির রুমাল
উড়ে উড়ে যতদূর যায়!

জীবিতরা নিরুদ্দেশ। বিউগল বাজেনি, হয়নি একুশবার তোপধ্বনি─ তারপরও জয়বাংলার রক্তগালিচায় ঢেকে সসম্ভ্রমে যাদের রেখে
এসেছিলাম তোমার জিম্মায়─ আমি তাদের ফিরিয়ে নিতে এসেছি। হে বিবর্ণ আম্রকানন, ফিরিয়ে দাও আমার যৌবন। অকস্মাৎ ঘন
কুয়াশায় ঢেকে যায় রৌদ্রকরোজ্জ্ব দিন। হিমশীতল জলের চাবুকে আর্তনাদ করে ওঠে বেআব্রু বনভূমি। সেই বার্তা পৌঁছে যায় বটতলায়
কবিদের আড্ডায়।

কী এক অলৌকিক উচ্ছ্বাসে রাতুল দেববর্মণের রাজসিক চোখ থেকে মুখ থেকে রাশি রাশি নক্ষত্র ঝরে পড়ে। ‘বুঝলানি বাংলার কবি,
আমি তহন বাইশের যুবক। লিচু বাগানে লাইন ধইর‌্যা হেরারে ঘুম পাড়াইয়া রাখছিল। ছুডু ছুডু পোলাপাইন সব। ব্যানার্জি বাড়ির লিচু,
কী যে মজা আছিল তার! অহন কিচ্ছুই খুঁইজ্যা পাইবা নারে পরানের ভাই। তাকডুম তাকডুম বাজে…!’
‘কেডা কইছে, নাই? আছে, আছে, হগ্গলতেই আছে। ফরেস্ট রিসার্চ সেন্টারের কংক্রীটের তলে ঘাপটি মাইর‌্যা আছে।’ গোমতী হাসে।
‘মেলাঘর, তুমারে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। বুঝি বুঝি, তোমারও বুক চিনচিন করে! পাহাড়ের বেডি আমি। হাজার বছর ধইর‌্যা ঘর করি
পাষাণের লগে। কিন্তু মানুষ এমুন পাষাণ ক্যান─ বুঝি নারে ভাই!

মোল্লাচর থেকে কালাসোনা চর পর্যন্ত হেঁটেছে
কতদিন, বালুচর পাড়ি দিয়ে গিয়েছে উত্তরে
নদীতে সাঁতার
আঁধারের রাত শরীরে মিশানো শিহরনে
পার হয়ে গেছে শত্রু কবলিত রসুলপুরের
বাঁধ, ঠাঁই নিয়েছিল কখনো গোয়াল ঘরে
কখনো পলের পুঞ্জে, শীতকে করেছে
পরাজিত, উষ্ণ
আশায় আশায়। ভাসানো ভেলায় গেছে
উজানে স্রোতের বিপরীতে
উলিপুর। দূর নয়, জনতার কাছাকাছি থেকে
রেখেছিল হাত, রাইফেলে─
জনতার জন্যে, অরণ্যে ফুটেছে ফুল
বরেণ্যে বলেছে
তাঁকে─‘মুক্তি’ ‘মুক্তি’।

একটি জগদ্দল পাথর গলে গলে পড়ছে 
পূর্ণিমার রাত এসে ধুয়ে দিচ্ছে অমাবস্যার কালো 
একদল যুবক শিস দিতে দিতে চলে যাচ্ছে রাস্তার ওপারে । 

কানে এসে লাগছে জলপ্রপাতের শব্দ 
উচ্ছ্বসিত মানুষ দৌড়াচ্ছে ভয় ও নিজের ছায়াকে অতিক্রম করে 
বিস্ময়ের আয়নায় তারা দেখলো 
একটি অন্যরকম সূর্য উঠে আসছে লালাভ আভা ছড়িয়ে । 

বিষণ্ণতা পেরিয়ে , নিঃস্পৃহতা পেরিয়ে 
ঝাঁপ দিয়ে আনন্দ এলো লোকালয়ে 
আমাদের ভীতি ও ত্রাসের অপনোদনে আমরা হয়ে উঠলাম 
একেকজন হারকিউলিস , একেকজন স্পার্টাকাস ।

মা’কে মনে পড়ার মতোই ভোরের গায়ে গায়ে
মিশে থাকে স্বপ্ন- সকল দ্রোহের কুয়াশা ছড়ায়ে
কেউ না আসুক, নেমে আসবে আকাশ
সজোরে ধাক্কা দিতে দিতে
আবার দেখা হবে মাঠে,মন্দিরে
অন্য এক প্রভাতে
কিংবা মিনারের চূড়া থেকে কেউ দিয়ে যাবে হাঁক-
ওগো প্রতিবেশী, তোমার কাছেই হাতিয়ারটি গচ্ছিত থাক
দরকারে চেয়ে নেবো। এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করে
বিজয়ের যুদ্ধ থেকে যারা ফিরেছিল ঘরে
এই ভূমি আজও তাদের পথচেয়ে রাত্রি পোহায়
এসো পুত্র,এসো কন্যা একাত্তরের দ্রোহের ছায়ায়
জিয়নকাঠিতে যে মেঘ, কল্যাণের তারা হয়ে ওড়ে
শহীদস্মৃতিতে আঁকা, কোটি রেখা বনে ও বাদাড়ে। 

[১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরে কমান্ডার কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে জামালপুরের কামালপুরের যুদ্ধে শহীদ একজন অচেনা মুক্তিযোদ্ধার অব্যক্ত কথায় নির্মিত এই কবিতাটি]।

মার্চ একাত্তর
তখন মুখে মুখে শুনেছি শুধু
দানব শাসকের রক্তচক্ষুর কথা
তখনও দেখিনি
জলপাই রঙের হেলমেট
রাইফেল, ট্রিগার, কার্তুজ
তখনও হাতে-কলমে
নেইনি প্রশিক্ষণ যুদ্ধের
যাইনি—পাহাড় তোরায়, ত্রিপুরায়
তুমিও বুঝোনি তখন
যুদ্ধ মানে ঘাতক কাঁটা
যুদ্ধ মানে পুব-পশ্চিম খেলা
যুদ্ধ মানে কাজল চোখ, কাজলা পুকুর
যুদ্ধ মানে তোমায় ছেড়ে যুদ্ধমাঠেই যাওয়া
যুদ্ধ মানে হাজার নদীর প্রেমময় বাংলাদেশ

২.

সেদিন তোমার হাত না ছুঁয়ে
জানলা ছুঁয়েই দৌড়ে গেছি যুদ্ধে
বাঁচবো কিনা, কেউ জানি না
তবু রাতের আঁধার ফাঁকি দিয়ে
মায়ের আঁচল, বোনের কাজল…
মুছে দিয়ে—যুদ্ধে গেছি মুক্তিযুদ্ধে
মুক্তিযোদ্ধা কাকে বলে
কেউ জানি না?
শুধু জানি—দেশ বাঁচাতে লড়তে হবে
হানাদাদের মারতে হবে
জয়বাংলা কণ্ঠে নিতে হবে
জয় পতাকা ওড়াতে হবে
শেখ মুজিবের ৭ মার্চ বুকে নিয়ে
অস্ত্র হাতে নেমে গেলাম যুদ্ধমাঠে
কানের ভেতর আওয়াজ এলো
‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’
কানের ভেতর আওয়াজ এলো
‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’
বুকের ভেতর মানচিত্র
বুকের ভেতর মন পতাকা
অস্ত্র হাতে করছি লড়াই
হটে যাচ্ছে পাকবাহিনী শত্রুসেনা
আঁধার কেটে সূর্য এসে ভরিয়ে দেবে সবুজ মাঠ
এই আশাতে সমর সম্মুখ যুদ্ধ করছি

৩.

যুদ্ধমাঠে বাবার কথা মনে পড়ে
মায়ের কথা মনে পড়ে—তোমার মুখও
যুদ্ধ থেকেই লিখি তোমায় প্রেমের চিঠি
চিঠি তো নয়, ভালোবাসার ছবি যে তা
কখন তোমার দেখা পাবো—এই আকুতি!

৪.

অবশেষে তোমায় লিখি শেষ চিঠি:

‘প্রিয় সুলিখিনি, আজ ৫ ডিসেম্বর, কামালপুরে শত্রু পক্ষের সঙ্গে চূড়ান্ত যুদ্ধে যাচ্ছি, বাঁচবো কিনা জানি না, তবে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি স্বাধীন হবেই। তুমিও লাল-সবুজের প্রিয় পতাকা নিয়ে উচ্চারণ করবে: ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল রক্তলাল…’ এই লালে আমাকেও খুঁজে পাবে…তোমাকে হয়তো পেলাম না কিম্বা তুমি আমাকে…এতে আমার কোনো কষ্ট নেই! আমি তোমাকে একটি পতাকা দিয়ে গেলাম—স্বাধীন পতাকা। শুধু অনুরোধ পতাকার মতো আমাকেও তোমার ব্যথাতুর বুকে রেখে দিও…ইতি যোদ্ধা’।

মাটিতে দু’হাত রেখে বলো তাতে কতটুকু সমর্পিত ছিলে
ঘুমিয়ে পড়লে বারবার কেঁপে উঠেছিলে দোদুল্য চিন্তায়

অন্তরীক্ষ ছুঁয়ে বলো, কতটা বারুদগন্ধে মানুষ নিয়েছে শ্বাস
কী ভীষণ দাবদাহ পিঠে জ্বলেপুড়ে ভস্ম হলো লক্ষ ঘরবাড়ি
যতটা তাণ্ডবলীলা, জিঘাংসা চরিতার্থ হলো, কী বলবে তাকে
ভূলুণ্ঠিত মানবতা, হত্যায় উত্তুঙ্গ রাত, ধর্মের উদ্দেশে খুন?

পৃথিবীর বহুনদী সাঁতরে পেয়েছ পদ্মা তোমার, নিজস্ব যমুনা নদী
বহুপথ মাড়িয়ে এসেছ স্নিগ্ধ মেঠোপথ, খালবিল প্রত্যন্ত স্বদেশ
তোমার হাঁটুতে ক্ষত, পাঁজরে বুলেট, মস্তিষ্কে গ্রেনেডবিদ্ধ আজো
এই তো এসেছ ফিরে, তপ্ত মাটি, শূন্য ভিটে, ক্ষয়িত শস্যের ক্ষেতে
আদগ্ধ এসেছ চলে পৃথিবীর মহার্ঘ মৃত্তিকা, স্বাধীন বাংলায়

কেবল বাঙালি তুমি? তুমি যোদ্ধা, তুমি বীর, তুমি আত্মা শূচিশুদ্ধ
তুমি শহীদ, অকুতোভয় তুমি, মুক্তিযোদ্ধা, ইতিহাসে সেরা নাম!
তোমার গর্জনে কাঁপা সাম্রাজ্যবাদ, তোমার ট্রিগারের টানে সমাহিত
পশ্চিমী রোষ, তোমার ঐশ্বর্যে সিক্ত বাঙালির মাতৃক্রোড়, ধন্য মহাকাশ

ততটা মহান তুমি, চারদিকে রক্তস্নানের ভেতর জেগে ওঠা পবিত্র অর্জন
তুমি ততটাই অনিবার্য, প্রতিটি শিশুর─ যতটা ভূমি ও অন্নের প্রয়োজন

এইতো সেদিনের আশা নিরাশা শুদ্ধতার প্রেম
অবশেষে অধীর আগ্রহে স্মৃতির নিবাস সৃজন
নিবাসের ভেতরের শুভ্র দেয়ালে মৃত প্রজাপতি
নানান রঙের প্রজাপতি নান্দনিক রূপে প্রদর্শিত
প্রজাপতিগুলো অর্ধশতাব্দী ধরে যত্নে নিদ্রারত

কালো মেঘে হঠাৎ বজ্রপাতের অশনি সংকেত
বুকের পাঁজরে আঘাতে আঘাতে অতৃপ্ত সত্তায়
ব্যথা বিষাদের হাতে নান্দনিক প্রজাপতি হত
নিস্ময়ে ঘরের বাইরে লক্ষ বিদ্রোহী প্রজাপতি
মনে হচ্ছে বাতায়নের কাঁচের দেয়াল ভাঙবে

স্মৃতির প্রজাপতি হনন বন্ধু প্রজাপতির ক্রন্দন
হেমন্তে জীবন্ত প্রজাপতির অনন্ত বাসনা কেন
হৃদয়ের গভীরে প্রজাপতি অনন্তকাল স্মরণীয়
বসন্তকালে দেখবে প্রজাপতি হয়তো বরণীয়।

তোমাদের শহরে চুপচাপ বসে আছি- একাকি
গ্রামের উঠোনে খেলেছিল দুটো শালিক
সকাল সকাল পড়ি কবিতা-বুকে ফোটে হাহাকার
একটি শব্দে আটকে যায় চোখ-‘বিজয়’
এই ‘বিজয়’-আমাকে ভাবিত করে-পাখি ডাকে
আকাশে জমে মেঘ; জলে ভেসে যায় উঠোনের শালিক
রাত বাড়ে-অন্ধকার চারিদিক। গাছে পাতা ঝরে…
চুপিসারে বিরহগীত আর নিঃসঙ্গ গাছের গল্প শুনি
রাস্তার মোড়ে-পল্টু পাগল বিজয় বিজয় বলে ছুটে চলে স্মৃতিসৌধের দিকে
‘বিজয়’ এক আশ্চর্য শব্দ- আনন্দের অন্তরালে কত না কষ্ট…

এটাই ছিল অপরাধ
ওরা হেঁটেছিল দৃপ্তপায়ে মিছিলে মিছিলে
ছিনিয়ে এনেছিল নতুন পরিচয়,
নতুন একটি দেশ
এটাই ছিল অপরাধ
ওরা চেয়েছিল আলোকিত মানুষ তৈরি করতে;
ওরা চেয়েছিল লাল সবুজের পতাকা।
ওরা চেয়েছিল
উদ্ভাসিত সূর্যের কিরণ ছড়াতে।
এইখানে নেমেছে রক্তের বন্যা
চাপ চাপ রক্তের ভেতর থেকে
ভেসে আসে বাঁচার আকুতি,
পৌঁছায় না কারও কানে।
এইখানে মাটি-পানি ভেদ করে
রক্তের ধারায় মিশে গেছে গভীর থেকে গভীরে
এখনও কোনো নির্জন দুপুর কিংবা মধ্যরাতে
কান পাতলে শোনা যায় বেঁচে থাকার আহাজারি।
এই রক্তের ধারা এসে লেগেছে লাল-সবুজ পতাকায়।
এখনও ওরা এসে বসে আছে
আমার হৃদয় ছুঁয়ে কোটি কোটি বাংলার মানুষের হৃদয়ে।
ওরা আছে, ওরা থাকবে
বাংলার নদী, জল, সবুজ প্রান্তর ভালোবেসে।

বিশুদ্ধ বাতাসে ভাসছে মহামারি
ক্ষয়ে যাচ্ছে জীবন
শেষ অংকটা কষা হয়নি এখনও
বয়ে যাচ্ছে সময়, সস্প্রীতি হয়নি পরস্পরে
তবুও চেয়ে থাকি আমি বিসর্জণের অবাক বিস্ময়ে।
মেঘগুলো যেন ধূলিমাখা মধুরিমা
রক্তকরবীর লাল নীল আহবানে
মৃদু আঁচে জ্বলে ওঠে শৈত্যপ্রবাহের যন্ত্রণা
আমি তাদের ভীড়েই অন্তরাল হই
জেনে কিংবা না জেনে।
যদি আবার দেখা হতো অবেলার সেই মুক্তবাংলা
যদি শুভ্রতার কালো তিলে ঢেকে যেত মেঘ
তবে লেখা হতো হয়তো
একটি অসাম্প্রদায়িক নামলিপি।
অনুভূতির ঘরে ঝুলুক বদ্ধ তালা
আবেগের আবেদনপত্রগুলো যাক বাতিলের দলে
একটা শূন্য খাঁচা চাই,চাই মুক্ত পাখির চিৎকার
মরীচিকার মতোই ঝাঁঝ, গন্ধ, বর্ননাবিহীন
অবাক বিস্ময়ে নশ্বর পৃথিবীর আলো জ্বলে উঠুক
আগ্নেয়গিরি ছড়াক জীবন নিরাপদ আনন্দে।

কালো মেঘে ঢেকে গেছে
ডুবছে তারা
চাঁদ টা নিভু নিভু
সাগরে চলেছে ভেলা।

চারিদিকে অথৈ ঢেউ
করছে খেলা
এই বুঝি ডুবল
এত শখের ভেলা।

কে ধরবে হাল
কে তুলবে পাল
কে দেখাবে দিক?
মৃত্যুর ভয়ে ভীতু
নয় যে নাবিক।

কত কবিতা লিখতে পারি একটু জমি পেলে 
কাটতে পারে এই জীবন দারুন হেসে খেলে ।
সেই জমিটা আছে এখন আমার আশেপাশে 
ফড়িং ছানা উড়ে বেড়ায় 
ফুলের গাছে গাছে। 
এই স্থানে
জেগে আছে আমাদের মন 
এই স্থানে কাটাতে চাই সোনালি জীবন।

একটি পতাকা লাল-সবুজের, জাগ্রত করে রাখে,
বুকের গভীরে মন ও মননে চেতনায় পড়ে থাকে।
এই পতাকার জন্য জীবন দিয়েছে বাঙালি বীর,
পৃথিবীর বুকে এই পতাকায় আমাদের উঁচু শির।

একটি পতাকা উড়ছে আকাশে শহর-নগর-গ্রামে,
বিজয় চিহ্ন লেখা আছে ওই লাল-সবুজের খামে।
এই পতাকায় হৃদয়-খচিত ইতিহাস লেখা আছে,
এই পতাকার জন্য বাঙালি সম্মান নিয়ে বাঁচে।

একটি পতাকা বুকের গভীরে ব্যথা-বেদনার কালে,
চির উজ্জ্বল, চির প্রজ্বল সবুজের সাথে লালে।
এই পতাকার জন্য বাঙালি চিরদিন রবে জেগে,
কখনো কোথাও নষ্ট হবে না আকাশের কালো মেঘে।

একটি পতাকা পাদদেশে তার সমবেত হয় জাতি,
যুগ যুগ ধরে এই পতাকাই ঘন আঁধারের বাতি।
একটি পতাকা লাল-সবুজের, জাগ্রত করে রাখে,
বুকের গভীরে মন ও মননে চেতনায় পড়ে থাকে। 

.নির্ভীক বাঙালিরা নয় কারো দাস
শুনতে কি পাস?
নতুন পতাকা মানে স্বাধীন আকাশ।
নিশ্বাসে নিশ্বাসে বিজয়ের গান
বাঙালিরা বাংলার বীর-সন্তান,
বাপ-দাদাদের লেখা লাল-ইতিহাস-
বাঙালিরা অন্তরে রাখে বারো মাস।
সাব্বাশ, বীর-ছেলে, আহা সাব্বাশ।

ভোরবেলা জেগে ওঠা সূর্যের ন্যায়
হৃদয়ের জানালায় খুশি উঁকি দেয়,
মেঠোপথ, সাইকেলে কিশোর বিভোল
বাংলার পতাকাটা হাতে খায় দোল।
সরিষার ফুল আর মিঠে রোদ্দুর
মনের গিটার জুড়ে বিজয়ের সুর।
‘আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়’
বিজয়ের অনুভূতি হাওয়ায় হাওয়ায়।

আনন্দ! আমাদের যুদ্ধে বিজয়-
রঞ্জিত ইতিহাস রবে অক্ষয়।
(বিজয়ের মালা মানে ফুলের বাহার
খুঁজে নাও হিংসায় মন কার ভার!)

ফুটপাতে, রাস্তায়, শহুরে পাড়ায়
ছোট্ট কিশোরী তার দুহাত নাড়ায়-
তুলতুলে গালটাতে পতাকার ছাপ
জয় বাংলায় চলে মিষ্টি আলাপ।

আনন্দে ভরে যায় বিজয়ের ভোর
লাল-সবুজের রঙে সাজলো শহর।
কুচকাওয়াজে সুখী প্যারেডের মাঠ
বুঝেছিস! বাঙালিরা সাহসী বিরাট।
রিক্সার হুডে আঁকা পতাকার রঙ
যুদ্ধং বিজয়ং, দেশ স্বাধীনং।
আমরা বীরের ছেলে, আমরাই বীর
পাক-সেনাদের হাত ফেটে চৌচির।
মুঠো মুঠো আনন্দ! আমরা স্বাধীন,
এই দেশ ঘুরে যাও, এসো আলাদিন।

কাকতাড়–য়া নামে বাংলাদেশে একটি গ্রাম আছে আমার জানা ছিল না। পত্রিকার সম্পাদক আমাকে এ গ্রামের কথা প্রথম বলেন। তিনি জানান, সরকারি গেজেটেও গ্রামটির নাম আছে এবং ১৯৭২ সালে আমাদের দৈনিক পত্রিকায় কাকতাড়–য়া গ্রামের একটি খবর ছাপা হয়েছিল।
আমি জানতে চাই, কী ছাপা হয়েছিল?
সে কথা বলতেই তো তোমাকে ডেকেছি। তুমি যাবে সেখানে। একটা ফলো আপ নিউজ করবে।
আমি কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, কেন যেতে বলছেন? আবার নতুন কোনো ঘটনা ঘটেছে?
আগামী ১২ তারিখ ওখানে একটা স্মরণসভা হবে। তুমি সেটা কভার করবে।
কার স্মরণসভা?
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ নিয়ামত। ঐ গ্রামের প্রথম শহীদ। বলা হয়ে হয়ে থাকে নিয়ামতই ঐ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ। শুনেছি তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতেই এই সভার আয়োজন করা হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য এ রকম স্মরণসভা আয়োজনের গুরুত্ব রয়েছে বলে আমি মনে করি।
তুমি এর উপর একটা স্টোরি করবে।
এই স্মরণসভা সম্পর্কে আপনি কী করে জানলেন? কে বলল?
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সম্পাদক হাসলেন। বললেন, তুমি যে খবর সংগ্রহ করো তা তোমার নামে কি সবসময় ছাপা হয়? কখনো কখনো নাম গোপন রেখেও সেটা ছাপা হবে। তার অনেককারণ থাকতে পারে। তুমি সবেমাত্র এ লাইনে কাজ শুরু করেছ। ওসব এখনি বুঝবে না। একটা
বিষয় মনে রাখবে, কার মাধ্যমে থেকে পাওয়া গেল সেটা নয়, খবরটা সঠিক কি না সেটা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। যাক, সে কথা, তুমি গ্রামটা দেখে আস। ফিরে এসে একটা প্রতিবেন জমা দেবে, ঠিক আছে?
জ্বি।
আরেকটা কথা, চোখকান খোলা রাখবে। সবদিক খেয়াল রাখবে। আর সাবধানেও থাকবে, গ্রাম মানেই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মনোভূমি নয়। ভালোভাবে যাও এবং ফিরে আসো
একজনের কাছে যতটুকু জানতে পেরেছিলাম তথ্যের উপর নির্ভর করে রওনা দিয়েছিলাম।
চট্টগ্রামগামী ট্রেনে উঠতে হবে। মেল ট্রেন নয়, মেল ট্রেন ঐ স্টেশনে থামবে না। লোকাল ট্রেনে চড়তে হবে। তাই চড়েছিলাম। লোকাল ট্রেনে উঠে ভালই লাগছিল, আগে আর এমন ট্রেনে উঠিনি। এমন কি ট্রেনে করে গ্রামে যাওয়ার কথা চিন্তাও করিনি। এদেশের মানুষ দেখতে চাইলে আমার মনে হয় লোকাল ট্রেনে চড়লে দেখা সম্ভব। এ ট্রেনের সিট দ্রুতগামী ট্রেনের মতো নয়।
এ ট্রেনের যাত্রীরাও দ্রুতগামী ট্রেনের যাত্রীদের মতো নয়, তাদের নানান রকম মুখ, নানান রকম পোষাক হলেও কোথাও একটা সাধারণ মিল রয়েছে। আমার চোখে সবচাইতে আকর্ষণীয় লাগে রঙিন পোষাক গায়ে শিশুদের, তারপর নারীদের, যাদের অধিকাংশই বোরকায় মুখ আবৃত।
পুরুষলোকগুলো শিশু আর বাক্সপেটরা সামলানোয় ব্যস্ত। ট্রেন ছেড়ে দেবার আগে ট্রেনের কামরায় আর যেন একজনেরও জায়গা নেই। তাছাড়া মাথার উপর হ্যাঙারে অথবা পায়ের কাছে স্তুপ করে রাখা।

ট্রেন ছেড়ে দেবার পর হৈচৈ থেমে গেল, শিশুরা জানলা দিয়ে অবাক চোখে বাইরে তাকিয়ে দেখতে লাগল কেমন করে ফসলের মাঠ, পথের পাশের হাট, গরুর পাল, ঝমঝম শব্দ করে পুলের তলের নদী, গ্রাম এসব পাড়ি দিয়ে ট্রেন তালে তালে শব্দ করে ছুটে যাচ্ছে।
প্রতিটা স্টেশনে ট্রেন থামছিল আর যাত্রীরা উঠানামা করছিল। স্টেশনে ট্রেন থামার আগে ট্রেনের কামরায় যাত্রীদের হুলুস্থুলু, চেঁচামেচি, নারী যাত্রীদের উৎকণ্ঠা, শিশুদের কান্না সব মিলিয়ে এমন পরিবেশ আমি আগে আর দেখি নি। নানা বিচিত্র মানুষের বিচিত্র আচরণ আর অভিব্যক্তি দেখতে দেখতে আমিও আমার গন্তব্য স্টেশন খুঁজতে থাকি। সারাক্ষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে থাকলেও গ্রাম আর জনপদ দেখে দেখে আমি অভিভূত হতে থাকি। আমার ছোটোবেলায় পড়া ছড়া ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’র অনুভ‚তি হতে থাকে। অনেকগুলো স্টেশন পেরিয়ে একসময় যে স্টেশনের নাম চোখে পড়ল দেখলাম এর নামের সঙ্গেই শহর জুড়ে আছে। আমি দেরী না করে ট্রেন থেকে নেমে পড়ি এবং আরো বেশি অবাক হয়ে দেখি এটা নামেই শহর, আসলে অজপাড়াগাঁ। আমি ছাড়া দুএকজন যাত্রী যারা নেমেছিল তারা আমার ধাতস্থ হতে হতে কে কোন দিকে চলে গেছে জানতেও পারি না।

তারপর যেদিকে তাকাই কেবল মাঠ আর দূরের গ্রাম। দেখতে পাই। যেন পথঘাট আর দিকচিহ্নহীন একজনপদে এসে ট্রেন থেকে নেমে পড়েছি। রেল লাইনের ধারে গোচারণে রত রাখাল বালকদের দেখতে পাই। ওদের কাছে জানতে চাই, কাকতাড়–য়া গ্রাম কোন দিকে? ওরা এ ওর মুখের দিকে তাকায়
তারপর মাথা নাড়ায়। কেউ চিনতে পারে না।
একজন রেল লাইনের পাশ দিয়ে আমাকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে যেতে থাকলে তাকে ডাকি, শুনছেন?
লোকটা জিজ্ঞেস করে, কার বারিত যাইবাইন?
আমি তাকে গ্রামের নামলেখা কাগজটা দেখাই। তারপর প্রশ্ন করি, চেনেন কাকতাড়–য়া গ্রামটা?
লোকটা দাঁড়িয়ে মাথা চুলকায়, তারপর বলে, আবার কইনছেন, গ্রামের নামডা।
আমি বলি, কাকতাড়–য়া।
সে বলে, চিনছি। তাওরা।
কী বললেন?

তাওরা। হ, ঠিক স্টেশনেই নামছেন। সে বলে, আমার লগে আসেন।
আমি তাকে অনুসরণ করি। কিছুদূর গিয়ে দেখি রেল লাইন থেকে একটা মেঠোপথ নেমে গেছে, যার দুপাশে ফসলের মাঠ। আমি ভাবতে ভাবতে তার সঙ্গে পা বাড়াই। আরো কিছুদূর এগিয়ে গেলে দেখি সমূহ বিপদ। একটা কবরস্থানের কাছে মেঠোপথটা দুভাগে ভাগ হয়ে দুদিকে চলে গেছে। আমি থমকে দাঁড়াই।
হাঁটতে হাঁটতে জেলাবোর্ডের রাস্তা পাইবাইন। রাস্তায় উঠলে আরো দুতিন গ্রাম পর। সামনে চাইলে দেখবাইন একটা উঁচা তালগাছ, ঐ গ্রামডাই তাওরা।
সুনসান পথ। একটা তিনচাকার বাহনও নেই। পায়ে হাঁটা ছাড়া কোনো উপায় নাই। ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে গেছে। আমি হাঁটতে থাকি। এরপর আর প্রকৃতি আমাকে টানে না। আমি ছুটতে থাকি কাকতাড়–য়ার দিকে।
একসময় জেলাবোর্ডের রাস্তায় উঠে সামনে তাকাই। একটা উঁচু তালগাছও দেখতে পাই।
পথনির্দেশকের কথামতো গাছটাকে নিশানা করে এগিয়ে যেতে থাকি। নির্দেশিত গাছ লক্ষ্য করে হাঁটতে গিয়ে কখনো বা ফসলের মাঠেও নামতে হয়। আড়াক্ষেত মাড়াতে হয়। কারো বাড়ির আঙিনা, কারো গোয়ালঘরের পেছন দিয়ে, কারো বাড়ির পেছনের কাঁচা পায়খানা মাড়িয়ে একসময় লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাতে সক্ষম হলাম।
একটা গুম্বুজওয়ালা জুম্মা মসজিদ পেয়ে গেলাম। মসজিদের উত্তর পাশে কয়েকটি বৃক্ষ, পত্রপল্লবে ছাওয়া। পীতাভ অন্ধকার আর স্তব্ধ শান্ত পরিবেশ। পেছনে একটা দীঘি। দীঘির অপরপাড়ে বাড়িঘর।
পুরোনো পত্রিকার বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়। এই মসজিদের পাশেই শহীদ নিয়ামত আলী সমাহিত হয়েছিলেন। আমি কয়েকটা ফটো তুলে নিলাম। আসরের নামাজ শেষে মুসল্লিরা বের হয়ে আসছেন। একজন আগন্তুক অথবা আমার ফটো তোলা দেখে মুসল্লিদের কেউ কেউ দাঁড়িয়ে পড়লেন।

একজন মন্তব্য করলেন, আপনেরে ত চিনলাম না।
দ্বিতীয় জন: কার বারিত যাইবাইন?
তৃতীয়জন: কোনহান থন আইছেন?
চতুর্থজন: অ, আপনে সম্বাদিক। মিটিং ত কাইল।
আমি কারো কথার জবাব দেবার আগেই যে যার মতো চলে গেলেন। তাদের এমনতর ব্যবহার আমার দুর্বোধ্য ঠেকে। কিন্তু সে বিষয়ে ভাববার সময় আমার নেই। আমি বেলা থাকতে ক্যামেরায় শহীদ নিয়ামতের কবরের কয়েকটি ফটো তোলার কথা ভাবলাম। দেখলাম, কয়েকজন লোক কবরের চারপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করছে। তাদেরকে একটু সরতে বলব ভাবছি এমন সময় ঈদের পোশাকে একজন লেন্সের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
ইতিহাসের খোরাক যত খুশি লইবেন। বহুদূর থেকে আসছেন, আগে মুখে দানাপানি দেন, বিশ্রাম লন। তিনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
লোকটা এমন আন্তরিকতা নিয়ে আমার হাত চেপে ধরলেন যেন আমি তার বহুদিনের চেনাজানা কেউ। তার হাসি হাসি মুখে তাকানো দেখে আমারও বিভ্রম হতে লাগল, কোথাও কি আগে দেখেছি? তখন মনে পড়ল, তিনি তো নিজের পরিচয় দেন নি। অনুমান করি, সাংবাদিককে একটু তোয়াজ করার আগ্রহ কারো কারো থাকে। কিন্তু আমি তো এখনো আমার পরিচয় দিই নি। লোকটা বেশ বুদ্ধিমানও বটে। আমার হাবভাব দেখেই আন্দাজ করে নিয়েছেন যে আমি সাংবাদিক। আর তখন মনে পড়ে, আমিও তো রাত্রি যাপন, খাওয়া-থাকার কথা কিছু ভাবি নি। রাত হতে তো তেমন দেরী নেই। ক্যামেরার সামনে আমি আঁধারের উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছি। আমার খাওয়া-থাকার জন্য এমন একজন বুদ্ধিমান লোকের সাহায্য তো নিতেই পারি, যা আমার না হলেই নয়।

এরপর আঁধার ঘনিয়ে আসার আগে লোকটার বাড়িয়ে দেয়া হাত আমার মুঠোয় বেশ আরামপ্রদ মনে হলো। আমি কাদের বখতকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলে তিনি পরিচয় দিলেন, আমার নাম এডভোকেট কাদের বখত।
আমার মনে পড়ল, আসার পথে মাইকে মিটিং-এর ঘোষণায় এ নামটা শুনেছি। বারবার ফলাও করে বলা হচ্ছিল।
আমি আপনার নাম শুনেছি।
শুনে থাকবেন। এই এলাকার লোকে কাদের বখতকে চিনবে না? পত্রপত্রিকার লোকজন গ্রামে এলে পর সচরাচর আমার বাড়িতেই উঠে। অজপাড়ায় এমন থাকা-খাওয়ার জায়গা আর কোথায় পাবে, বলুন?
কাদের বখতের কথায় এবং বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার বোধোদয় হলো। সে বিষয় না ভেবে আমি বরং কাদের বখতকে নিয়ে ভাবছি, এমন অতিথিপরায়ন মানুষও গ্রামে আছেন তাহলে।
কী ভাবতাছেন?
না। তেমন কিছু না।
অজপাড়ায় আসছেন বলে। চিন্তার কিছু নাই। আমি তো আছি। আসছেন যখন আমার বাড়িতে থাকবেন, বেড়াবেন, গ্রাম দেখবেন।
ফটকের কপালে ‘পল্লী কুটির’। আর দুপাশের খিলানে ফুল-পাখি-লতাপাতার মোটিফ। কাদের বখত আমার কৌতুহল খেয়াল করলেন।
মৃদু হেসে বললেন, বাড়িটার নাম আমার বিবি রেখেছে।
কেবল ফটকে নয়, পল্লী কুটিরের আঙিনায় ফুল ও ফলগাছের সমাহার। প্রহরারত সান্ত্রীর মতো নারকেল-সুপারির সারি। পুকরে নিটোল জল, লাস্যময়ী পদ্ম। অন্যপাড়ে বাঁশঝাড়─ সেখানে সান্ধ্যপাখির কিচিরমিচির। আর দক্ষিণে দিগন্তজোড়া মাঠ। ধানক্ষেত থেকে চোখ ফিরিয়ে আনলে আবার কাদের বখতের আতিথেয়তামাখা দৃষ্টির সুখদ পরশ।তিনি বললেন, চলেন, ভেতরে আসেন। বাড়িতে কেউ থাকে না। আমিও আজই এসেছি। মেয়েটা কলেজে পড়ে। সে জেদ করল, তাই ওকে সঙ্গে আনতেই হলো।

আপনি তাহলে শহরেই থাকেন?
গ্রামে কি থাকার জো আছে? নাই রাস্তাঘাট, নাই শিক্ষা, নাই ডাক্তার, খালি ধুলাবালি-প্যাক-কাদা-রোগ-বালাই আর কাইজাফাঁসাদ, গ্রামে কি থাকা যায়?
পাশাপাশি চৌচালা দুটি টিনের ঘর ইংরেজি এল অক্ষর তৈরি করেছে। জাফরি নকশিকাটা অভিন্ন টানা বারান্দা। কইরে, রজব। মেহমান আসছে। নাস্তাপানির ব্যবস্থা কর। আসেন।
রজব নামের লোকটি একটা দরোজা খুলে দিল। ভেতর থেকে জানালা খুলতেই দক্ষিণের হাওয়া এসে ঘর ভরে গেল আর আমারও ক্লান্তি জুড়িয়ে দিতে লাগল। বিছানা পাতা আছে দেখে শুয়ে পড়তেও ইচ্ছা করল। সান্ধ্যপাখির কাকলি আর মুয়াজ্জিনের আযান মিলেমিশে দিনের আলো বিদায় দিল। এর পর চা আর নাস্তা নিয়ে রজব ঘরে ঢুকল। আর পেছন পেছন স্বয়ং কাদের বখত। আমি একের পর এক আশ্চর্য হচ্ছি, এমন অপ্রত্যাশিত আতিথেয়তা আমার জন্য ছিল কী করে চিন্তা করব?
মাগরিবের নামাজের জন্য নাস্তা দিতে দেরী হয়ে গেল। নিন, কিছু মুখে দিয়ে নিন। রাতের খাবার খাওয়ার সময়ও হয়নি, আর রান্নাও হতে সময় লাগবে। মেহমানকে তো আর যাতা খাওয়ানো যায় না। তাও শহরের সাংবাদিক। আপনি আপনি আবার ভাববেন না, সাংবাদিক বলে বাড়তি খাতির করছি। সাংবাদিক না হলেও আমার বাড়িতে মেহমানের খাতিরযত্নের ঘাটতি হয় না।
আমি প্রসঙ্গটা পাল্টাতে চাই, বাড়ির পরিবেশটা কিন্তু খুব মনোরম। নিরিবিলি আর চারিদিকে কেবল সবুজ আর সবুজ। চোখ জুড়িয়ে যায়।
আমার বিবির পল্লীকুটির খুবই পসন্দ। ভাসা পানিতে ছইওয়ালা নৌকায় নাইওর করা তার শখ।
ভরাভাদরে তার গ্রামে আসাই লাগব।
আমি প্রসঙ্গটা লাইনে ফিরিয়ে আনতে বলি, গ্রামের সমস্যা নিয়ে বলছিলেন, এসব বিষয়ে আপনার কাছে আরো শুনতে চাই।

হ্যাঁ, তারপরও গ্রামে আসা লাগে। মানুষের দুর্দিনে না আসলে হয় না। গেল বন্যার সময় প্রথমে আমি নিজের তহবিল খরচ কইরাই রিলিফ লইয়া স্যালু নৌকায় গ্রামে আসি। মাঠের জমি-জিরাত, পথঘাট সব পানির তলে। জমির ফসল গেছে, ঘরবাড়িও পানির তলে, মাইনষের কী যে পেরেশানি। চোখের পানি মিশে বানের পানিতে। খাওন নাই, আশ্রয় নাই, আঁশমুরগী, হালের গরু সব ভাসে বানের পানিতে। লোকে খাইব কী? আমার কাছে টাকা ছিল, আমি নগদ টাকা দিলাম। যদিও জানতাম এ টাকা তারা আর নগদে শোধ করতে পারব না। শেষ পর্যন্ত হয়তো জমিই লিখে নিতে হবে। জান না বাঁচলে জমি দিয়া কী অইব? গ্রামের মানুষকে সাহায্য করতে পারলাম, তাদের জান বাঁচাতে পারলাম, এটাই আমার সান্ত্বনা। যাক, অভাব অনটনের কথা বলে আর
কী হবে? আপনে আসছেন শহীদ নিয়ামতের বিষয়ে জানতে। সে কথা কাল শুনবেন। বিশ্রাম নেন।
আমি ঐ দিকটা সামলায়া আসি।
কাদের বখত সম্পর্কে আমার ভেতরে শ্রদ্ধাবোধ উপচে পড়বার অবস্থায় উনীত হয়।
চাচা বারিত আছেন নি?
আছি। খাড়া। আইতাছি।
কয়েকজন লোক এলে কাদের বখত বেরিয়ে গেলেন। আমি অস্পষ্ট হলেও তার এবং লোকজনের কথা শুনতে পাচ্ছি।
সব ঠিক আছে ত?

সিমেন্ট শট পরছে।
বারান্দায় আছে। লয়া যা। জলদি সাইরা ফালা। হিয়ালও টের পায় না যেন। বাদুড়ও যেন না দেখে।
তারপর স্তব্ধতা নামল। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। কিছুক্ষণ পর খুব কাছেই কয়েকটা শেয়াল হাঁক দিল।
তারপর অনেকগুলো একসঙ্গে। আর তখন নারীকণ্ঠের ‘মা গো’ চীৎকার শুনতে পাই। আমি আন্দাজ করি, কাদের বখতের মেয়ের কণ্ঠ। তারপর ঘরের দরোজার কপাট বন্ধ করার শব্দ। তখন ভয়ে আমারও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। যেন অন্ধকার বেড়ে গেছে।
আলো হাতে কাদের বখতের কলেজপড়–য়া মেয়ে আর রজব খাবার নিয়ে ঘরে ঢোকে। সলতের মৃদু আলোয় কোনো তরুণীর মুখ এমন উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে পারে আমি প্রথম দেখি। আমি বিস্মিত না হয়ে পারি না। সে আমার জন্য খাবার টেবিলে সাজিয়ে রাখতে থাকে আর আমি নির্বাক তাকিয়ে মেয়েটিকে দেখতে থাকি। এমন করে আর কখনো কোনো মেয়েকে আমি দেখিনি, যেন ওকে দেখার জন্য আমার চোখ প্রতীক্ষা করে ছিল। যেন ওর জন্যই আমার এতদূর পথ হেঁটে আসা।
এখনো খান নি!
কাদের বখত ফিরে এলেন। বাপ এলে ঘরে ঢুকতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রজব দাঁড়িয়ে রইল। বলল, ভাইজান, আপনার খাওয়া কি এহানেই দিমু?
কী কস, গাধা? ঘরে মেহমান খায় নাই। আমি তারে রাইখা আলাদা খামু? দে। জলদি কর। আমাকে বললেন, আসেন। অনেক রাত হয়া গেল।
নিয়ামতের কবর পাকা করতাছি। বহুদিন যাবত বুকের ভিতর একটা অবিলাষ জাইগা আছে। অতদিন কাউকে বলি নাই। কবরস্থানের ধার দিয়া যতবার যাই আসি ততবারই মনে পড়ে। কাল সে অবিলাস পুরণ হবে।
খেতে খেতে কাদের বখত কথা বলছেন। আমি কৈ মাছের কাঁটা সাবধানে ছাড়িয়ে খেতে থাকি আর তার কথা শুনতে থাকি।

আমেনা বেগম ছিলেন এই গ্রামের বীরমাতা। শহীদ নিয়ামতের জননী। আমি তারে সাহায্য করতে চাইলাম। আফসোস, তিনি আমার কথা শুনলেন না। জেদ কইরা চইলাই গেলেন। তিনি কারো সাহায্যের ধার ধারেন না। গ্রাম ছাইড়া চইলা গেলে কি মনের দুঃখ দূর হয়া যায়? সব শেষ হয়া যায়? ইতিহাস কি মুছে যায়, আপনিই কন?
আমি শুনছি আর কল্পনার চোখে নিঃসীম অন্ধকারে এক বীরমাতার ছবি আঁকবার চেষ্টা করছি।
কাদের বখতের গলা ধরে আসছিল। ঘরের চালে টুপ টুপ শিশির ঝরে পরিবেশ আরো ভারাক্রান্ত করে তুলছে।
আমি জানতে চাইলাম, শহীদ নিয়ামতের লাশ দাফন কী করে হয়েছিল?
আমি তো বিশ্বাস করতে পারতে ছিলাম না। আমি তখন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলাম, আমারে কেউ খবরটা দিল না। আমি অবশ্য শহরে ছিলাম, গ্রামে ছিলাম না। পরে জানতে পারি, পাগলা মুত্তালিব আর শাহজাহান রাতের আঁধারে লাশ নিয়া আসছিল। আর পঁচাত্তরের আগে তো গ্রামে আসি নাই। আইসা শুনি শাহজাহান ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করছে। আর দেখি, মুত্তালিব লাপাত্তা। থাক সে কথা, আমেনা বেগমের ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারলে আমি ধন্য হবো।
মনে করব, দেশের জন্য কিছু করতে পারলাম।

তখন অন্ধকার চীৎকার করে করে ঘোষণা করতে লাগল, শহীদ নিয়ামত আলীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আগামীকালের জনসভায় ভাষণদিবেন… এডভোকেট কাদের বখত। আপনার দলে দলে যোগদান করবেন।…মাইকের ঘোষণার সাথে সাথে কয়েকটি কুকুর ঘেউ ঘেউ শুরু করল।
কাদের বখত উঠে পড়লেন, রাইত অইছে। ঘুমায়া পড়েন। ঘরের দরোজার খিল লাগায়া দিয়েন। গ্রামে শিয়াল-কুকুর ডাকবেই। ভয়ের কিছু নাই। আরাম কইরা ঘুমান।
রাত হলেও মাইকের ঘোষণার প্রেক্ষিতে কুকুরের ডাক যেন ব্যঙ্গ-প্রতিবাদ মনে হতে লাগল।
সবকিছু ছাড়িয়ে তমোময় রাতটাকে আমার অন্যরকম আঁধার কবলিত মনে হতে লাগল। বাতি নিভিয়ে দিলে পর অন্ধকারের সমুদ্রে যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলব মনে হতে লাগল। এরূপ সঙ্কটে আমি সচরাচর যা করি, নিজেকে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে কাজের কথা ভাবতে থাকি। আজ
যা যা ঘটেছে, যা শুনেছি তার একটি ফিরিস্তি খসড়া মনে মনে সাজাতে থাকি। মনে মনে আমি সাজাতে থাকি, এই অঞ্চলের প্রিয় নেতা কাদের বখত। তিনি শহীদ নিয়ামত আলী বীরপ্রতীকের কবর পুননির্মাণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রেখেছেন। তার অবদান জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি পাওয়া দরকার। তিনি এক বীরমাতার শেষ ইচ্ছা পূরণ করেছেন। তার শহীদ সন্তানের কবর পাকা করে দিয়েছেন। আজ তিনি বেঁচে থাকলে দেখে খুশি হতেন। কিন্তু তিনি কখন গ্রাম ছেড়ে গেছেন কেউ দেখেনি। তিনি আজ কোথায় আছেন, বেঁচে আছেন কি না গ্রামের কেউ বলতে পারে না। কাদের বখত এখনো তার সন্ধান করছেন। সন্ধান পেলে তাকে গ্রামে ফিরিয়ে আনবেন। এমন মহৎ লোক বাংলাদেশে কমই আছে।

মসজিদর সামনের খোলা জায়গায় সভার আয়োজন করা হয়েছে। আর কিছুদূরেই শহীদ নিয়ামত আলীর কবর। সে কবর ঘিরে এখন রক্তলাল ইটের দেয়াল উঠেছে। এতদিন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ কেউ নেয়নি। কেউ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতে
সাহস পায় নি। এ এলাকার বিশিষ্ট রাজনীতিক কাদের বখত এ গাঁয়ের প্রথম শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে উদ্যোগ নিলেন।
কাদের বখত মুক্তিযুদ্ধের অজ্ঞাত-অর্বাচীন ইতিহাস বর্ণনা করতে স্যেম্য মূর্তিতে মঞ্চের উপর মাইকের সামনে দাঁড়িয়েছেন। মাঠে লোকারণ্য। কিন্তু সকলেই নির্বাক, বিস্ফোরিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে এই এলাকার মানুষ এতটা সমীহ করে বলেই যেন সকলে বাকহারা।
তিনি কথা শুরু করবেন, এমন সময় একজন মঞ্চে উঠে এলেন। তার মুখ দাড়িগোঁফে ঢাকা। পরনে ময়লা কাপড়। অনেকদিন চুল কাটেন নি।
কিন্তু লোকটাকে আমার চেনা মনে হয়। যেন খুব চেনা একজন। এমনও মনে হয় যেন, আজই লোকাকে আমি দেখেছি। মনে করতে পারছি না। একবার ভাবি, ট্রেনে আসার সময় কোনো স্টেশনের প্লাটফর্মে দেখে থাকব হয়তো। আবার মনে হয়, তাহলে তো অমন চেনা মনে হওয়ার কথা

নয়। আমি তার দিকে তাকিয়ে স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে থাকি।
এই নাম বলছি।
না, আমি সব ফাস করে দেব। কে আছিস, পাগলটাকে নামা। তোরা ওকে মঞ্চ থেকে নামা।
কিন্তু কেউ সাড়া দেয় না। কথাও বলে না। তারা সব যেন অভিনয় দেখছে। আমার মনে হয়, বহুদিন পর আমি যাত্রাপালার অভিনয় দেখছি। অভিনেতাকে তো আর কেউ নামিয়ে নিতে পারে না।
সেই ফাঁকে আরো একজন, একজন মধ্যবয়সী নারী মঞ্চে উঠে এলেন। তার পরনেও অগোছালো ময়লা একটা শাড়ি। ঐ নারী মঞ্চে উঠে সেই লোকটাকে নামাতে চেষ্টা করেন। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলেন, আয় বাপ, নেমে আয়। তোকেও খুন করে ফেলবে। তুই চলে যা, এখান থেকে চলে যা।
এবারও কেউ মঞ্চে উঠে আসে না। বরং চুপচাপ বসে অভিনয় দেখতে থাকে। এমন সাবলীল অভিনয় দর্শক দেখেনি। আমিও আর কখনো দেখিনি। আমি পরবর্তী দৃশ্য দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকি।

পাগল: আপনারা শোনেন, অনেক রক্ত খেয়েছে শকুন।
নারী: আমার ভিটিবাড়ি কাইড়া নিয়া বাগানবাড়ি বানাইছে। নাম দিছে পল্লীকুটির।
পাগল: এইবার লেবাস পাল্টায়া আসছে। নিয়ামতের কবর পুজি কইরা রাজনীতির ব্যবসা করতে চায়।
আপনারা সেই সুযোগ আর ভন্ডটাকে দিবেন না।
নারী: রক্তচোষা শকুনের কবল থেকে আমার নিয়ামতকে বাঁচান।

কাদের বখত তবু উত্তেজিত নন। শান্ত কণ্ঠে তিনি দর্শকশ্যোতাকে বললেন, পাগলের কথায় আপনারা কান দেবেন না। শহীদ নিয়ামতের স্মরণসভা একটা পাগল আর পাগলি নষ্ট করে দিবে এটা আমি হইতে দিতে পারি না। আমি চাই এদের পাগালমী চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দিতে। আমি আপনাদের
চোখের সামনেই এদের উপযুক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমি আগে পাগলটাকে ঠাণ্ডা করে দিই, কী বলেন?
কেউ কোনো মন্তব্য করল না। দর্শক এবার যেন আরো বেশি শান্ত।
কাদের বখত স্বস্থানে দাঁড়িয়েই তার আস্তিনের হাতা গুটিয়ে বাম হাত পাগলের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। গ্রামবাসীর সঙ্গে বসে আমি দেখতে লাগলাম কাদের বখতের হাত লম্বা হয়ে লোকটার গলার নাগালে গিয়ে থামল। এ পর্যায়ে হাতের আঙুলগুলো শকুনের গলা আর চঞ্চুতে রূপ নিল। ব্যাপারটা

আমার কাছে যাদুর মতো মনে হতে লাগল। অন্যদের মুখের দিক তাকিয়ে দেখতে পেলাম অপলক তাকিয়ে সকলেই যাদুর মতো উপভোগ করছে। তীক্ষ্ন চঞ্চু পাগলের গলায় বসে গেল। ফিনকি দিয়ে রক্তও বের হতে লাগল। পাগলের কণ্ঠ রুদ্ধ, চোখ বিস্ফোরিত। সে হাত পা ছুঁড়ছে। সভাস্থল স্তব্ধ। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। হঠাৎ মনে পড়ায় কাদের বখত আমার দিকে তাকালেন। আমার গলা শুকিয়ে গেছে। আমি কিছু বলতে চাইছি, কিন্তু কে যেন আমার গলাও চেপে ধরে রেখেছে।

আমি তাকিয়ে দেখি অন্ধকার কাটেনি। তখনো ভোর হয়নি। কিন্তু কে ডাকল! আবার দরোজায় টোকা পড়ল। কিন্তু খুলব কি?
দরোজা খুলুন।
আমি গলা চিনতে পারলাম। রাতের সেই মুখ মনে পড়ল। দরোজা না খুলে পারলাম না।
আপনাকে এত ডাকছি, কিন্তু সাড়া দিচ্ছেন না। কী হয়েছিল বলেন তো।
আমি কী দেখলাম, কোথায় এলাম আমি?
কী দেখে ঘুমের মধ্যে এমন চীৎকার করছিলেন?
আমি মেয়েটিকে কী বলব? যা দেখেছি তা তো দুঃস্বপ্ন।
আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। কথাটা এখনি বলা না হলে আর হয়তো বলা হবে না। ফজরের নামাজ শেষে আব্বা ঘরে আসবে। তখন আর বলা যাবে না।
আমি মেয়েটির মুখের দিক তাকিয়ে থাকি। এমন সুন্দর মুখও বুঝি আগে দেখিনি। আমি নীরব তাকিয়ে থাকলে হয়তো সে বুঝে নেয় আমি ওর কথা শুনতে চাই।
কী লাভ হবে মিথ্যা কথা পত্রিকায় লিখে, মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করে?
কী বলতে চাইছেন, ঠিক বুঝতে পারছি না।
যা শুনবেন তা প্রকৃত সত্য নয়। সত্য এখানে আঁধারে ঢাকা। অবশিষ্ট সত্যও কবর দেয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। যদি পারেন আঁধারের তল থেকে সত্য উন্মোচন করুন।
মেয়েটি নিজের ঘরে চলে গেলে বাইরে তখনো আাঁধারের নিঃশব্দ কুহক পদচারণা টের পাই।
মেয়েটির মুখ আর ওর কথা আমার মনের ভেতর রেখে আমি অতঃপর ভোরের জন্য প্রতীক্ষা করি।
রচনাকাল ১৯৯০

‘পিচ্চি তুই কি করছিসরে?’
‘আঁকছি বাবা।’ মোটা সাদা কাগজের ওপর উবু হয়ে থেকেই জবাব দিল পিচ্চি।
বাবা ওকে খেপানোর জন্য এবার বলল, ‘কি আঁকবি তা তো জানি, শেষে কাগজ কুটি কুটি করে বাস্কেটে ফেলে দিবি।’
‘ফেলে দিব, তাতে কি হয়েছে? তুমি কি কাগজ কিনে দেও? মা আর দাদু কিনে দেয়।’
পিচ্চির কথাটা বাবার একদম বুকে গিয়ে লাগল যেন। যুক্তিসংগত কথাই বলেছে পিচ্চি। বাবা সারাদিন ব্যস্ত থাকে অফিস নিয়ে। কোনোদিন
জিজ্ঞাসাও করে না, পিচ্চি তোর রঙ পেন্সিল লাগবে কি না, কাগজ লাগবে কি না।
বাবা এবার মেঝেতে বসে পড়ল। পিচ্চি একমনে মেঝেতে উবু হয়ে বসে এঁকেই চলেছে।
আজ বাবার ছুটি। মানে শুক্রবার। বাজার থেকে ফিরে ঘরে ঢোকার পরই খেয়াল করেছে পিচ্চি ওর ঘরের মেঝেতে বসে কিছু একটা আঁকার চেষ্টা করছে।
তাই নিজের ঘরে না গিয়ে পিচ্চিকে খেপাচ্ছিল।
পিচ্চি এবার ফাইভে উঠেছে। বাবা-মায়ের আদুরে মেয়ে। কথা বলে টকাস টকাস। পরশু দিন ছাব্বিশে মার্চ, এবার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে স্কুলের বাংলার মিস সবাইকে ছবি আঁকার জন্য বলেছেন। সেই সব ছবি থেকে বাছাই করে তিনটা ছবিকে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় পুরস্কার দেয়া হবে।
সেই পুরস্কারের জন্যই পিচ্চি নিষ্ঠার সঙ্গে ছবি এঁকে চলেছে।
বাবা দেখছে পিচ্চি স্মৃতিসৌধ আঁকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আঁকা প্রায় শেষের দিকে। মাঝখানের পিলারের মাথায় একটা পতাকা এঁকে সবুজের
বুকে লাল রঙ দিচ্ছে। বাবা যে ওর পাশে বসে একমনে আঁকা দেখে যাচ্ছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপই নেই।
বাবা বলল, ‘ লাল রঙটা ভাল করে দে।’

কিছুটা বিরক্তি নিয়ে পিচ্চি বাবার দিকে তাকাল একবার। কিছু না বলে আবার নিজের মত আঁকা শুরু করল।
বাবা বুঝলো, পিচ্চি বিরক্ত হচ্ছে। তাই আর একটা কথাও বলা যাবে না। নীরব দর্শকের মত আঁকা দেখে যাচ্ছে মেয়ের।
একসময় আঁকা প্রায় শেষ হয় পিচ্চির।
বাবা এবার বলল, ‘ভালই তো আঁকছিসরে পিচ্চি।’
‘বাবা একশ’তে কত দিবা আমাকে?’ পিচ্চি ভারিক্কি চালেই কথাটা বলল।
বাবা বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। কত দেয়া যায়। কম দিলে টকাস টকাস করে কিছু একটা বলে বসতে পারে। সব দিক হিসেব করেই বলতে হবে।
বাবা কিছু বলছে না দেখে পিচ্চি বলল, ‘কি এতক্ষণ লাগে?’
‘না মানেই ভালই হয়েছে।’
‘ভালই হয়েছে মানে কি? একশ’তে কত দিবা?’
‘পঁচাত্তর পেতে পারিস।’
‘এত কম কেন? ভাল হয় নাই?’
‘হয়েছে, তবে…’
‘তবে কি?’
‘শুধু স্মৃতিসৌধ আঁকছিস তো, মানুষ থাকলে ভাল হত। ধর কিছু মানুষ ফুল দিচ্ছে, কিছু মানুষ দূর থেকে দেখছে।’
‘আহা বাবা আমি তো মাত্র আঁকলাম। এখনই কি মানুষ আসবে? একটু সময় দেও। তারপর দেখো।’
‘ও।’ বাবা ছোট করে জবাব দিল। বাবা বুঝলো মেয়ে উপস্থিত বুদ্ধিতেও পাকা। কিভাবে যুক্তি দেখালো ওর আঁকা শেষ হয়নি এখনো।
‘তুমি গোসল সেরে আসো। এসে দেখবে মানুষজনে ভরে গেছে। কেউ কেউ ফুল নিয়েও আসবে।’
‘তার মানে কি আমি এখন চলে যাবো এখান থেকে?’ বাবা বলল।
‘হ্যাঁ চলে যাও। আমি একটু পরে আবার আঁকা শুরু করবো। তারপর এসে দেখো মানুষজন আছে নাকি নেই।’
‘আচ্ছা।’ বলেই বাবা মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াল। পিচ্চি বাবা মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো।
বাবা চলে গেল। পিচ্চি এবার ছোট ছোট করে মানুষ আঁকতে থাকে। কারো
কারো হাতে ফুলের তোড়া-এরকম ছবিও আঁকলো।
আঁকা শেষ হলে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একবার ডানে দু’কদম গিয়ে ছবিটার দিকে তাকালো। আরেকবার বাঁয়ে দু’কদম গিয়ে ছবিটার দিকে তাকালো।
ছবিটা নিজের পছন্দের মত হয়েছে কি না যাচাই করছে পিচ্চি।

পিচ্চির বয়স কতই বা হবে, বড়জোর এগারো। এই বয়সে যে ভাব নিয়ে কথা বলে বাবা-মা দুজনেই বেশ অবাক হয়ে যায় মাঝে মাঝে। একটু আগে বাবার সঙ্গে কেমন বুড়ো মানুষের মত আচরণ করলো। মুখের ওপর বলেই ফেলল─ তুমি কি আমাকে রঙ পেন্সিল কিনে দেও? তারপর যেমন বলল, একশ’তে কত দিবা?
পিচ্চির ভাল নাম, মানে স্কুলের নাম রাফিয়া তাবাসসুম রাহা। বাবা মা ছোট থেকেই আদর করে পিচ্চি বলে ডাকে। তাই রাহা নামটা আড়ালেই থেকে গেছে বাড়িতে। তবে স্কুলের বন্ধুরা রাহা বলেই ডাকে। বাড়িতে নতুন কেউ এলে সালাম দেবার পর অতিথি যখন জিজ্ঞেস করে কি নাম তোমার? তখন পুরো নামটাই বলে পিচ্চি।
মা-বাবা তখন দুষ্টুমি করেই বলে, ‘আমরা ওকে পিচ্চি বলেই ডাকি। ও আমাদের পিচ্চি মা তো।’

দুই

বাবা পিচ্চির ঘরে আবার এল। পিচ্চি আঁকা শেষ করে দূর থেকে একমনে দেখছে নিজের শিল্পকর্ম।
‘কিরে পিচ্চি আঁকা শেষ? ’ বাবা বলল।
‘হ্যাঁ।’ ছোট করে জবাব দিল পিচ্চি।
বাবা দেখল ছবিটা বেশ সুন্দর হয়েছে। স্মৃতিসৌধের সামনে শত শত মানুষ। শ্রদ্ধা নিবেদন করছে ফুল দিয়ে অনেকে।
বাবার গর্বে বুকটা ভরে গেল। এই এতটুকু মেয়েটা কি এক ভালবাসা নিয়ে ছবিটা এঁকেছে। দেশের প্রতি ভালবাসার আর কি বুঝবে এই বয়সে।
তবুুও কি নিষ্ঠার সঙ্গে রঙ দিয়ে এঁকেছে। স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল।
‘এবার কত দিবা বাবা?’ পিচ্চি বলল।
বাবা মেয়ের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল, অপলক। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
বাবা তার বাবার কাছে শুনেছে একাত্তরের সেই দুঃসহ দিনগুলোর কথা। ঢাকা শহর ছেড়ে মানুষ পালিয়ে গিয়েছিল যার যার গ্রামের বাড়িতে। ঢাকা শহরের এখানে ওখানে পড়েছিল লাশ আর লাশ। বাবার মুখে শোনা পাকিস্তানিদের বর্বরতার কথাগুলো বেশি মনে পড়ছে এ মুহুর্তে। ইশ্ বাবা যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তার ছেলের ছোট মেয়েটা কি পরম মমতা নিয়ে স্মৃতিসৌধের ছবিটা এঁকেছে। দেখে কি খুশিই না হতেন! পিচ্চির বাবা ভাবছে।
পিচ্চি আবার বলল, ‘কি বাবা, ছবিটা পচা হইছে, নম্বর দিতে চাইছো না?’
বাবা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। চোখের কোনায় আনন্দ অশ্রু বোধহয় এসেই যাচ্ছে। পিচ্চির কাছে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘মা রে অসাধারণ। বাংলাদেশে এরকম ছবি এর আগে কেউ কখনো আঁকতে পারেনি। খুব সুন্দর, খুব সুন্দর। একশ’তে একশ পেয়েছিস।’ বলেই
পিচ্চিকে কোলে নিল বাবা।
কাটল কিছুটা সময়।
একসময় পিচ্চিকে কোল থেকে নামিয়ে বাবা বলল, ‘তুই কি জানিস এই স্মৃতিসৌধ কাদের জন্য বানানো হয়?’
‘হ্যাঁ জানি তো বাবা। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন যারা। যারা একাত্তর সালে দেশের জন্য যুদ্ধ করে মারা গেছেন।’
‘তুই কোথায় জানলি এসব?’
‘আমাদের বাংলার মিস বলেছেন।’
বাবার কি যে ভাল লাগছে এ মুহুর্তে। এভাবেই পিচ্চিদের সচেতন মিসদের কাছ থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানবে একাত্তর সালের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা।
‘কি নামরে তোদের বাংলা মিসের?’
‘অরণি চৌধুরী।’
বাবা বলল, ‘তোর মিসকে আমার সালাম দিস।’
বাবা পিচ্চির আঁকা স্মৃতিসৌধের দিকে তাকাল। বাবার মনে হচ্ছে এ মুহুর্তে যেন মাঝের পিলারের উপরে পত পত করে উড়ছে লাল সবুজের পতাকাটা।

বসন্তের সেই দুপুর ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চলছে। যে দুপুরের কথা বলছি সেটা ছিল অদ্ভুত। দীর্ঘঘুম থেকে জেগে উঠছে নিঃসঙ্গ গাছগুলো। বাতাসের শরীরে বারুদের গন্ধ। ধ্বংসত্মাক উম্মাদনার নিচে চাপা পড়ে আছে শোকার্ত আর্তনাদ। ছেলে ফেরার অপেক্ষায় বৃদ্ধা মা। জীর্ণ শরীরে পথের পাশে দাঁড়িয়ে ঘোলা চশমার ভেতর ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে আছেন বাবা। সেই গাছে ফুল ফোটেনি যা পুড়েছিল হিংসার আগুনে। তবু নতুন স্বপ্ন বুনছে মালি। বাগান সাজাবে। ফুল ফুটাবে। কোকিল সুর দিয়ে সঙ্গীকে ডাকছে, সঙ্গম করবে। পথ ভোলা বাউল তানপুরা বাজাচ্ছে। সে সুর নির্জনতার দেয়াল ভেঙে হৃদয়ের গহীনে তরঙ্গ তুলছে। অভিকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন ছোট চাচা। বড্ড মন খারাপ তার। উদাসদুপুর আরও বেশি উদাস করে দিয়েছে। সেই দুপুরে চিৎকার করে উঠল উর্মি।
উর্মির থেকে নয় মাস বেশি হেঁটেছে অভি। এখন তারা স্কুলে যায়। পথ আলাদা নয়। তবু চুপচাপ থাকে অভি। শুধু পথে না, বাড়িতেও তেমন কথা বলে না। হাজারটা প্রশ্ন উর্মির। একটারও উত্তর দেয় না। মাকেও প্রশ্ন করে। জানতে চায় বাবা কোথায়? আসে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর কেউই দিচ্ছে না।
এক দুপুরে তারা হাঁটছিল স্কুলের পথে। একটা কুকুর হঠাৎ পথ আটকে দিল। ভয় পেয়ে গেল উর্মি। অভি সাহস দেখিয়ে বলল, ভয় পাইস না। কুকুরটাকে তাড়িয়ে দিল। উর্মি তাকিয়ে রইল। বুঝতে পারল ভাই তাকে আগলে রাখার চেষ্টা করে। তবে বাবার কথা বলে না কেন! ভাইয়ের হাত ধরে মুখের দিকে তাকাল, একটা কথা বলবি?
বিস্ময়ের চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায় অভি। জানতে চায় কী কথা?
আমাদের বসারঘরে ওই ছবিটা কার?
ছবির কথা বলল না অভি। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, স্কুলে দেরি হয়ে যাচ্ছে। পা চালিয়ে হাঁট। উর্মির কৌতূহল  দূও হচ্ছে না। অভির হাত ধরে থামিয়ে দিল। যেতে দিবে না স্কুলে। বল, ওই ছবিটা কার? তুই জানিস। আজ বলতেই হবে।
হ্যাঁ জানি। গম্ভীর মুখে বলল অভি।
তাহলে বলিস না কেন?
মাটির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে অভি বলল, বাবার। আর কিছু বলতে পারছে না। দুঃখ এসে তার গলা চেপে ধরেছে।
কিছুক্ষণের জন্য উর্মি নিস্তব্দ হয়ে গেল। বাবার ছবি। বাবা মানুষটা একদমই অচেনা। কখনো দেখেনি। এ্ শিব্দটাও তার মুখ কখনো বের হয়নি। এরপর বললম, আচ্ছা বাবার ছবি আছে, বাবা নেই কেন?
জানি না। বলে পায়ের দিকে তাকাল অভি। উর্মি বুঝতে পারল ভাই কষ্ট পাচ্ছে। কেন কষ্ট পাবে? বাবার কথাই তো জানতে চাচ্ছে। নতুন প্রশ্ন করল না। বাবা শব্দটা গেঁথে রইল মনে।
স্কুল থেকে ফিরে সেই ছবির সামনে দাঁড়াল উর্মি। তীক্ষè দৃষ্টিতে দেখছে। চোখ সরাতে পারছে না। খুঁটে খুঁটে দেখছে বাবার মুখ। এরপর কাগজ আর রং পেন্সিল নিয়ে বসল। বাবাকে আঁকবে। অনেকদিন চেষ্টা করেও আঁকতে পারেনি। বহু কাগজ, কালি নষ্ট করেছে। মন খারাপ হলো। তবু থেমে যায়নি। একদিন বাবার মুখ ভেসে উঠল কাগজে। সে কী আনন্দ। ছুটে এলো ভাইয়ের কাছে। চমকে দেবে। সে ছবি দেখে সত্যি চমকে উঠল অভি। অনেকক্ষণ পরে জানতে চাইল, তুই একেছিস?
মুখে হাসি মাখিয়ে মাথা নাড়ল উর্মি। হ্যাঁ, কেন, বাবার মতো হয়নি?
অভি কিছু বলছে না। উর্মির নতুন প্রশ্ন। চুপ করে আছিস কেন?
বাবাকে সত্যিই তুই আঁকতে পেরেছিস। কেমনে আঁকলি? না দেখলে এমন ছবি আঁকা যায় না। তোর হৃদয়ে আছে বাবা। নাহয় পারতি না।
উর্মি গেল মায়ের কাছে। বলল, আজ একটা কথা বলতেই হবে।
এত জোর দিয়ে কী জানতে চাচ্ছিস?
বাবাকে কি দেখেছে অভি?
অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন মা। মনে পড়ল সেই দিনের কথা। স্বপ্ন আর ভালোবাসা হারিয়ে গেল কুয়াশা মাখা সকালে। সেই স্বপ্ন আর ফেরেনি। পর্দা উঠে গেল স্মৃতির জানালার। ভেসে উঠল সেই মুখ। নিঃশব্দে গড়াচ্ছে চোখের জল। উর্মি অস্থির, বাবাকে দেখেছে অভি?
আঁচলে চোখ মুছে মাথা নাড়লেন মা। হ্যাঁ, দেখেছে। যে সকালে হারিয়েছে বাবা, সেরাতে খুব কান্না করেছিল অভি। শান্ত হলো বাবার কোলে উঠে। তখন ওর বয়স নয় মাস। কী বুঝেছিল জানি না। অফিস থেকে ফিরেই কোলে নিতেন বাবা। ঘুমন্ত মুখে চুমু খেতেন। শেষবার অভিই দেখেছে, আমরা দেখিনি।  
অন্ধকার হয়ে গেল উর্মির মুখ। ভাইকে আদর করত, আমাকে করত না?
গম্ভীর মুখে মা বললেন, না।
কেন?
সেই সকালের তিন মাস পরে তুই জন্মেছিস। তোকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। মুখটাই দেখতে পারলেন না। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল মায়ের বুক খালি করে।  
ছোট হয়ে গেল উর্মির মুখ। বাবা কেন হারাল? মায়ের কাছে তা জানতে চায় সে।
মা বললেন না। ছুটে এলো ভাইয়ের কাছে। অভিমানী কণ্ঠে বলল, তুই মিথ্যা বলছিস।
ঘাবড়ে গেল অভি। কোনটা মিথ্যে ?
বাবাকে দেখেছিস। তোকে অনেক আদর করত। শেষবার শুধু তুই দেখেছিস বাবার মুখ। আমাকে নাকি বাবা দেখেনি। আদর করবে কী! হঠাৎ কান্না পেল উর্মির। অনেকক্ষণ কেঁদে চোখ মুছল। জানতে চাইল, কোথায় হারিয়েছে বাবা জানিস?
মাথা নাড়ল অভি। বিশ্বাস কর, আমি দেখিনি।
তুই দেখেছিস। মা বলেছে।
দু’হাতে মাথা চেপে ধরল অভি। আমার কিচ্ছু মনে পড়ছে না। আমি শুধু জানি ওই ছবিটা বাবার।
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে উর্মি। মন খারাপ করে বলল, বাবাকে খুঁজে আনবি? তুই তো বড় হয়েছিস। কুকুরের সামনে দাঁড়াতে পারিস। ভয় পাস না। তাহলে তো বাবাকেও খুঁজে আনতে পারবি।
বোনকে সান্ত¡না দিল অভি। কাঁদিস না। বাবাকে খুঁজে আনব। কথা দিলাম।
উর্মির ম্লান মুখে হাসি ফুটল। সত্যি বলছিস? বাবাকে খুঁজে আনবি ?
মাথা নাড়ল অভি। হ্যাঁ, বাবাকে খুঁজে আনব। কিন্তু মনে তার অন্য কথা। কোথায় খুঁজবে বাবাকে? কেউ জানে না বাবার খবর। চাচা অনেক খুঁজেও পাননি। বাবা হারিয়ে গেছে। আর ফিরবেন না। উর্মির মতো তারও প্রশ্ন ছিল। মা বলতেন বাবা আকাশে। বহুবার সে আকাশকে বলেছে ফিরিয়ে দাও বাবাকে। আকাশ শোনেনি তার কথা। একদিন উর্মিকে বুঝিয়ে বলবে বাবা ফিরবে না। হারিয়ে গেলে কেউ ফেরে না।

উর্মীর মনে নতুন স্বপ্ন। বাবা আসবে। কিন্তু বাবাকে খুঁজতে যায় না অভি। অস্থির হয়ে এক বিকেলে ভাইয়ের সামনে দাঁড়াল উর্মি। তুই না বলছিলি বাবাকে খুঁজে আনবি। তা যাচ্ছিস না কেন?
যাব। সে অনেক দূরের পথ। একা যেতে পারব না। ছোট চাচাকে নিয়ে যেতে হবে। চাচা সময় পাচ্ছেন না।
চাচাকে বলব আমি?
না না , তোর বলতে হবে না। আমি বলব।
এক দুপুরে গম্ভীর মুখে অভি দাঁড়াল ছোট চাচার সামনে। কী হয়েছে অভি? মন খারাপ কেন? চাচার প্রশ্ন।
ধরা কণ্ঠে অভি বলল, বাবাকে দেখতে চায় উর্মি। ও বুঝতে চায় না বাবা হারিয়ে গেছে। বলে খুঁজে আন। সেদিন খুব কান্না করছে। বাবার ছবি আছে। বাবা নেই কেন?
নিচু হয়ে পড়ল চাচার মাথা। আট বছরেও বাবার কথা ভুলতে পারেনি ওরা। কোনোদিন ভুলতে পারবে না। ওদের কাছে বাবা এখন একটা শব্দ। যার কোনো অস্তিত্ব নেই। সেই শব্দটা জড়িয়ে অনেক প্রশ্ন। ক্রমশ ডুবে যাচ্ছেন চাচা সন্ধ্যার সূর্যের মতো। অনেকক্ষণ পরে মাথা তুললেন। তার সামনে বাবা হারা এক শিশু। যে বাবার খোঁজ চায়। তোর কী মনে হয়, বাবা বেঁচে ছন?
ভেজা চোখে অভি তাকাল চাচার দিকে। বেদনার্ত কণ্ঠে বলল, জানি না। বেঁচে না থকেল বাবার কবর কোথায়? নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। হয়তো পথ হারিয়ে ফেলছে। চলো,
একদিন খুঁজে দেখি।
কোথায় খুঁজব?
যেখানে হারিয়েছে, সেখানে খুঁজব। তুমি না বললে অনেক খুঁজেছ, মিরপুর, রায়েরবাজার। ওখানেই চলো একদিন। না পেলেও উর্মিকে বলতে পারব খুঁজেছি। পাইনি। ও শান্ত হবে। এক সময় ভুলে যাবে বাবার কথা। মনে করবে বাবা মানেই ছবি। জানো চাচা, ওর মনে অনেক কষ্ট। যখন কেউ বাবা ডাকে, ওর চোখ জলে ভরে যায়। এতটা দুঃখ জড়ো হয় মুখে, তাকানো যায় না। বলতে বলতে কান্না করে দিল অভি।
অভিকে জড়িয়ে ধরলেন ছোট চাচা। গোপন করতে পারলেন না চোখ থেকে বেরিয়ে আসা লোনা জল। বললেন, আচ্ছা, কালই যাব।
আমিও যাব তোমার সঙ্গে।  
হ্যাঁ, তোকে নিয়ে যাব। এই খোঁজ শেষ হবে না অভি। শেষ হয়ে যাবে পথ। হারিয়ে যাবে বেলা। তবু খোঁজ মিলবে না তোর বাবার। যা দেখবি তা আকড়ে ধরেই খুঁজে ফিরবি। কিন্তু বাবাকে পাবি না। এই কথাগুলো তার বুকের বেদনা আরও বাড়িয়ে দিল।

 ৩  

পরদিন চাচাকে নিয়ে বাবার খোঁজে বের হলো অভি। উর্মি আনন্দে আত্মহারা। বাবা আসবে। সে আজ খায়নি। চোখ দরজায় সাটিয়ে বসে আছে। কখন বেল বাজবে। সে গিয়ে জড়িয়ে ধরবে বাবার গলা। অভিকে নিয়ে চাচা এলেন মিরপুর, রায়েরবাজার। গাড়ি থেকে নেমে অনেকক্ষণ হেঁটে একটা পুকুরের সামনে দাঁড়ালেন। বললেন, এখানে হারিয়েছে তোর বাবা। আরও অনেকে। সেই সকাল ছিল হারানোর। শোকের। অসংখ্য মানুষ হরিয়ে গেলেন। আর ফিরলেন না।
অভি তাকিয়ে আছে পুকুরের অল্প জলে চোখ ফেলে। কোথাও দেখছে না বাবার মুখ। অন্য কোথাও চলে গেল কিনা? তবু আতিপাতি করে খুঁজল অনেকক্ষণ। চোখ রাখল আকাশে, মেঘের ভাঁজে। বাবার মুখ নেই। মন খারাপ করে বলল, চলো অন্য কোথাও যাই। এখানে নাই।
অভিকে নিয়ে তুরাগের পাড়ে এলেন চাচা। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অভি। কেনই যেন মন বলছে ভেসে যায়নি তো বাবা। কার কাছে জিজ্ঞেস করবে। মানুষ নেই। নিস্তব্ধ এলাকা। চাচা কিছু বলছেন না। খানিক সামনে হাঁটল অভি। দেখল একটা ব্রিজ। লোহার। ভাবল ব্রিজের ওপাড় যাবে। ওদিকটায় থাকতে পারে বাবা। চাচাকে বলল, চলো ওপাড় যাই। দেখি ওপাড় আছে কিনা বাবা।
থামালেন চাচা। ওপাড় গিয়ে কী করবি? এখানে দাঁড়িয়েই তো সব দেখতে পাচ্ছিস। কেউ নেই।  
কিছু বলল না অভি। মন খারাপ করে স্থির পায়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওপাড়ের সব দেখতে পাচ্ছে ঠিক। কোথাও কেউ নেই। হঠাৎ দেখল একজন মানুষ বসে আছে নদীর পাড়ে। খানিক আগেও দেখেনি। কী যেন বলছে মাটির সঙ্গে। জীর্ণ শরীর। মলিন কাপড়। এলোমেলো চুল। কিছুটা সাদা। বাতাসে ওড়ছে। নদীর দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। লোকটা পাগল নাকি! হতে পারে। চাচার কাছে এসে বলল, চলো- ওই লোকটার কাছে যাই। উনি জানতে পারে বাবার খবর। দেখ না কী সব বলছে একা একা।  
কিছুটা বিরক্ত হলেন চাচা। দেখতে পাচ্ছিস না লোকটা পাগল।
তবু যাবে অভি। তাই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেন চাচা। লোহার ব্রিজ পেড়িয়ে পাগলের কাছে এলেন। চুপচাপ বসে আছে পাগল। হাঁটু ভেঙে। মেরুদ- বাঁকা হয়ে গেছে ধনুকের মতো। নদীর দিকে তাকিয়ে আছে শ্যোন দৃষ্টিতে। কথা বলছে না এখন। চাচা দাঁড়িয়ে আছেন দূরে। অভি কাছে গেল। হাতের ইশরায় বসতে বলল পাগল।
অভি বসল। গম্ভীর কণ্ঠে পাগল জানতে চাইল, এহানে আইছ ক্যা? কেউ তো আয় না। আমিও যাই না কারো কাছে। বইয়া থাহি নদীর পাড়ে। দ্যাহি হেই দৃশ্য। যা হারায়া গ্যাছে। যা হারায়াছে তা সবাই দ্যাখতে পায় না। আমি দেখি আগুন। শুনি সেই চিৎকার।                  
এসব শুনতে চায় না অভি। সে জানতে চায় বাবার খবর। বলল, আমার বাবাকে দেখছেন?
হকচকিয়ে উঠল পাগল। কে তোর বাবা?
আ ন ম গোলাম মোস্তফা। আট বছর আগের এক সকালে হারিয়ে গেছে। আর ফেরেনি।
কোথায় হারাল?
জানি না। সেদিন সকালে কারা জানি তুলে এনেছে বাবাকে। আর ফেরেনি। শুনেছি এখানে এনেছিল। তাই এলাম। কোথাও দেখি না বাবার মুখ। না আকাশে, না জমিনে। আমার বোন দেখতে চায় বাবাকে।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পাগল। বাবা! আহ বাবা! আমিও একজন বাবা। খুঁজছি স্ত্রী, সন্তান। কোথাও খুঁজে পাই না।  
তারাও হারিয়ে গেছে? জানতে চায় অভি।
পাগল ডুবে গেল সেই রাতে। যে রাত তাকে পাগল বানিয়েছে। বলল, সেই রাতের তা-ব দেখেছি আমি। যে রাতে সবাই হারায়া গ্যাছে। আগুন আয়া গিল্লা খাইছে। হারাইতে পারি নাই আমি। আজও বাঁইচা আছি।
সেই তা-বের কথা জানতে চায় অভি। কী হয়েছিল সে রাতে?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সামান্য নড়ে বসল পাগল। বলল, ব্রিজের ওপাড় ছিল আমার ছোট্ট ঘর। বাঁশ খুঁটির। স্ত্রী আর দুই মাইয়া নিয়া থাকতাম। একটা সাইকেল ছিল। রোজ সকালে বাইরে যাইতাম। বিদ্যুতের লাইনে কাজ করতাম। ফিরতাম সন্ধ্যা কইরা। কোনো দিন রাইত হয়া যাইত। যুদ্ধ পাল্টায়া দিল জীবন। হারায়া গেল আনন্দ। রোজগার। নিয়া আইলো ভয়। রান্ধা নাই। খাওয়া নাই। জড়োসড়ো হয়া বয়া থাকি। কখন ওরা আয়া পড়ে। প্রাণ কাইরা ন্যায়। সেই অপেক্ষা শেষ হইলো এক রাইতে। ঘুমাইছিলাম একটু। ভাবছিলাম ওরা আইবে না। আমরা গরিব মানুষ। আমাদের মাইরা কী হইবে? রাইত কয়টা কী হইছে জানি না। আমাগো আখড়াটা হঠাৎ জ্বইলা উঠল। শুনছি চিৎকার চ্যাচামেচি। দৌড়ায়া বাইরে নামলাম। তখন এলোপাতাড়ি গুলি। দিক করতে না পাইরা ঝাঁপ দিলাম নদীতে। ডুব দিয়ে এপাড় আয়া শুয়ে পড়লাম চরে। দ্যাখলাম জ¦লছে গ্রাম। আমার ঘর। সেই আগুনের মধ্যে চিৎকার করছে আমার স্ত্রী, মাইয়ারা। পারছি না ছুইটা যাইতে। এক সময় সেই চিৎকার থামল। সব খাইয়া আগুন মরল। নেই আর্তনাদের শব্দ। কেউ বলছে না বাঁচাও। আমিও নড়ছি না। গাছের নিচে বয়া আছি। রাত পোহাইল, তবে পরিষ্কার হয় নাই আকাশ। দ্যাখলাম কিছু নাই। শশ্মান হয়া গ্যাছে। ছাই ওড়ছে বাতাসে। পোড়া মাংসের গন্ধো। ওপাড় গ্যালাম না আর। কার জন্য যাব? চোখ দুইটা ব্রিজে ঝুলাইয়া বইলাম।
গভীর রাইতে ওরা আইল। ধইরা আনল মানুষ। চোখ বানধা। ব্রিজের ওপর খাড়া কইরা গুলি করল। চিক্কর দিয়া উঠল তারা। কেউ বাবা, কেউ মা, কেউ আল্লাহ, কেউ হরি। ওই শেষ আওয়াজ। ধপাশ করে লাশ পড়ছে নদীতে। আবার ট্রাক ভইরা মানুষ লয়া আয়। মরা মানুষ। ফেইক্কা ফেইক্কা নদীতে ফ্যালে। ভাইসা যায়। এই নদীতে পানি দ্যাখা যাইত না। রক্ত ছিল। লাশের ওপর লাশ ভাসত।
কিছুক্ষণ থেমে আবার শুরু করল পাগল। তম্ময় হয়ে শুনছে অভি। কালির জামাই দৌড়াইতে শুরু করল। পালাইতে চাইল। পারল না। পুলের ওখান থেকে ধইরা লইয়া গ্যাল। ফিরল না আর। খবরও হইল না। হয়তো ভাইসা গ্যাছে। কত মানুষ লাশ হইল চোখের সামনে। মানুষ দ্যাইখা মানুষ ডরাইত। রান্ধা ভাতও খাইত পারত না। গলা দিয়া নামত না।
ধরে আসছে পাগলের গলা। বলতে পারছে না আর। খানিক পরে আবার শুরু করল। আমাগো পাশের ঘরখানা আছিল শোভার। সেই রাইতে পোলাপান লইয়া বাইর হয়া দৌড় দিছিল। পুলের ওই মুড়ায় গ্যাছে, আগুন জ¦লছে ঘরে। ভয়ে লাফায়া পড়ল নদীতে। হপায় এপাড় আয়া উঠছে। অমনি ধুমায়া গুলি। বাঁচতে পারল না। নদী সাঁতরাইল বৃথা। লাশ ভাইসা গেল।
সেদিন সবাইরে মাইরা ফ্যালত। যারা মাটিতে শুয়ে পড়ছিল তারা রক্ষা পাইল। গোলাপীর জামাইর খুলি উইড়া গ্যাল। আহ! ফকির চানেরে ধইরা নিল। আবার ছাইড়া দিল। ক্যান জানি মারল না।  
মুখ ঘুরিয়ে বিলের দিকে তাকিয়ে পাগল বলল, এই বিলে কত লাশ ভাসছে। কত লাশ দ্যাখছি। একদিন অনেক মানুষ ধইরা আনল। ব্রিজের ওপর দাঁড় করাল, গুলি করবে। একজন ব্রিজের ওপর দিয়া লাফ দিল। তারে আর পাইল না। ভাইসা ব্রিক ফিল্ডের দিকে গ্যাল। হামাগুড়ি দিয়া উইঠা কইল, আমারে বাঁচাও, বাঁচাও। দূরের ওই বড়দেশী গ্রামের মানু নৌকা লইয়া আইয়া তারে বাঁচাইল।
সেই লোকটা আমার বাবা নাকি? প্রশস্ত মুখে জানতে চাইল অভি।
পাগল থ। তা জানি না।
উনি আছে জানেন?
মাথা নাড়ল পাগল। না, জানি না। তবে তোমার বাবা হইব না।
কী করে বুঝলেন? হতেও তো পারে।
তাহলে তো বাড়ি ফিরতেন।
হয়তো পথ হারায়া ফেলছেন। তাই ফেরতে পারেননি।
এবার পাগল চুপ। ছেলে ভাবতে চায় বাবা বেঁচে আছে। স্বপ্ন দেখতে চায় বাবা ফিরবে। মিথ্যা স্বপ্ন। বেদনায় ভারি হয়ে গেল বুক। অনেকক্ষণ পরে বলল, শোনোÑ এই ব্রিজটা ছিল কসাইখানা। সারা রাত মানুষ কাটত। রাইত পোহালে সেই রক্ত ধুয়া ফ্যালত বিহারিরা। লাশ ভাইসা যাইত নদীতে। মানুষের সেই চিৎকার আজও শুনি। বাঁচাও বাঁচাও কইয়া চিৎকার করছে। বাঁচাইতে পারি নাই। ওদের মুখ হারায়া গ্যাছে আগুনের প্যাটে। ছাই হয়া গ্যাছে। নদীতে ভাসাইয়া দিছি ছাই। আকাশে উড়ায়া দিছি। তাই নদীর পাড়ে বইয়া থাহি।
পাগল উঠে দাঁড়াল। নদীর পাড়ে নেমে এক মুঠো মাটি তুলে আকাশের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। অভির চোখ পাগলের মুখে। ভাবছে মাটি দিয়ে কী করবে পাগল। সেই মাটি অভির হাতে দিল।
কী করব? জানতে চায় অভি।
বাবাকে খুঁজছ না, এই তোমার বাবা।
অভি অবাক। সে দেখছে মাটি। পাগল বলছে বাবা। কেমন কথা। পাগল বলল, তোমার বাবা মিশে আছে এই মাটিতে, পানিতে, আকাশে, বাতাসে। তুমি যেখানে যাবে সেখানে দেখবে বাবার মুখ। তোমার বাবা মানেই বাংলাদেশ।

৪      

উর্মি অস্থির। আজ তার মন খারাপ নেই। কত কথা বলছে। মায়ের চোখে জল। জমে গেছে বুক। নিশ^াস নিতে পারছেন না। দুপুর হারিয়েছে বিকেলের পেটে। ফেরেনি অভি। মায়ের চিন্তা বাড়ছে। ছেলেটা কোথায় গেল? তখন বেজে উঠল কলবেল। দারজার দিকে হাঁটলেন মা। তারও আগে ছুটে গেল উর্মি। উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভাসছে সে। দরজা খুলে দেখল ভাই আর চাচা। সেই হাসিটা হারিয়ে গেল। জড়িয়ে ধরল ভাইয়ের গলা। কেঁদে উঠল শব্দ করে। তুই যে বললি বাবাকে নিয়ে আসবি। তা বাবা কোথায়?
কথা বলতে পারছে না অভি। চোখের জলে ভাসছে গাল। উর্মিও কাঁদছে। চাচার সেই পাথর মুখেও জলের ¯্রােত। অনেকক্ষণ পরে উর্মিকে ছেড়ে দাঁড়াল অভি। হাতে দিল সেই মাটির ধলা।
উর্মি অবাক। এটা কী?
এর মধ্যে আছে বাবা। দেখবি মাটি। কিন্তু খুঁজলে বাবাকে পাবি। সবাই দেখবে না। তুই দেখবি। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল মাটি আর পানি বাবার শরীর। যেখানে যাবি সেখানেই দেখবি বাবার মুখ। আকাশের দিকে তাকালে, ওই পতাকায়, সর্বত্র ছড়িয়ে আছে বাবা।
চোখ মুছে সেই মাটির ওপর চোখ রাখল উর্মি। দেখছে একটা মানচিত্র। তার ওপর বাবার মুখ। এই মাটিতেই তাহলে বাবা আছে। চুমু খেয়ে ফিক করে হেসে উঠল। অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন মা। উর্মি হাসছে! এই যে কাঁদল। তাহলে বাবাকে খুঁজে পেয়েছে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *