বিশেষ সংখ্যা

অদ্বৈত মারুতের জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন

এখন বিশেষ কী আর খাই!
সকালটা ঘুমিয়েই কাটাই
দুপুরে পাতলা ডাল দিয়ে একমুঠো ভাত,
বিকালে শুধু দুগ্লাস পানি। আর রাতে
দিনের ক্লান্তি ফেনিয়ে ফেনিয়ে দেখি
দুধমাখা চাঁদ—
রূপশালী ভবনে শুয়ে আছে আয়েশ করে।

সেখানে রান্না হচ্ছে পোলাও, গরুর মাংস
গন্ধ ছুটে আসছে; আমরা টের পাচ্ছি—
খাওয়া শেষে সবাই পান চিবুচ্ছে,
চলছে হালকা গল্প-গুজব

একজন শিল্পপতির মৃত্যুসংবাদের ছায়া
কপালের ভাঁজে ভাঁজে ঢেউ খেলছে তার।
টিভিতে চোখ— রিমোটে ঘুরছেন তিনি বলিউড পাড়া
আয়েশে ঘুমাবে তারা তাজা ফুলের ওপর।

আমরা চারজন।

আমাদের চারপাশ অন্ধকার।
আমরা একমাসের খাবার চারমাস ধরে খাচ্ছি।
বাড়িভাড়া বাকি।
আমাদের বাড়ি নাই, ভাড়ার টাকা নাই।
বাড়িওয়ালা নেমে দেবে নাকি—
এই ভয়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছি।

মৃত্যু হেঁটে এসে ফিরে গেছে বলে
আবার পথে নেমেছি, দেখছি
সোজা পথ বক্র হয়ে গেছে বিস্তর রোদে

কেউ আর কাউকে চিনছেই না যেন!

যাই না বলে যাব না কখনোই— বলিনি একবারও
নদীই তো; সমুদ্র হলেও ঝাঁপ দিতে করিওনি ভয়
জলে ফুঁ দিয়ে ভাসিয়ে দেব প্রমত্তা সংসার, আরও
গাঢ় হয়ে একান্ত সঙ্গোপনে গড়ে নেব মৃৎ-বলয়।

প্রলয়ের সলতে জ্বেলে ও-মুখের পরিখায় নামিনি
তাই বলে নামব না কোনোদিন, বলিনি একবারও
মাস্তূল ভেঙে চোখে সন্ধ্যা এলেও কখনো ঘামিনি
ঘামে জেরবার হইনি, হয়ও-নি প্রণয়ে ভর কারও!.

চলো, আমরা পাতা হয়ে যাই, উড়ি পৃথিবীর বাঁকে
সুতোহীন ঘুড়ি হয়ে পরস্পর দিই সুড়সুড়ি নাকে।

মেঘ সাবেক প্রেমিকার মতো দারুণ আবেগ
নিমিষেই গলে পড়ে, হেসেই ঘোরাচ্ছন্ন করে
প্রভূত সৌন্দর্য তার হৃদয়ে থাকে যেন উল্লেখ

বেলেবাতাসে মেঘডানা ভাসে সন্ধ্যার তরাসে
আসলে কৌশলে নিতে চায় সুদাসলে আশ্বাস
আগুনে পুড়বার পরও ফের যেন হৃদয়ে ভাসে

যেন তারে আবেশের ঘাড়ে একবারে দিই তুলে
মনোহর অধর ছুঁয়ে দিলে চুয়ে পড়ে আস্থাজল
আনত মস্তকে যেন থাকি অবিরত নগ্ন আঙুলে

চোখ যেন শোক হয়ে না আসে জ্যোৎস্না ধুয়ে
নরক-বাতাসে না ভাসে প্রান্তর, সূর্যের সন্ত্রাসে
হৃদয় অভিমুখ করে সঙ্গত হৃদয় যেন দিই ছুঁয়ে

তরুণ করাত বর্ষাভাত কেটে উষ্ণতায় রয় স্থির

কোনো কোনো মানুষ, তার মুখ, চোখ, নাক
পাথর ভাঙা হাত, দুখানা পা আর অদেখা মন
কখনো কখনো নিজের হয়ে কাছে থাকে না
কোনো এক অদৃশ্য ইশারায় হাওয়া হয়ে যায়।

কেন কখন কোথায় যায়, এভাবে হারায় একলা
পাখি হয়ে থাকা মানে ঘরহীন নয় কোনো বনে—
গাছে পাতার ফাঁকে ঝাঁঝালো রোদও ঢুকে পড়ে
ফাঁকা ফাঁকা মন ঘরে ফিরবার কালে কোনোদিন।

অথচ ঘর নেই; মনে পড়বার মতো করেওনি সন্ধি
পরস্পরের কাছে পরস্পর— হয়নি-এ মনও বন্দি!
তাই হারতে থাকে, দূরত্ব বাড়তে থাকে বনের বাগানের
পাহাড়ের সমতল ভূমির; আগুনপাখি হয়ে ওড়ে…

মরে পড়ে থাকে কারও হৃদয়; ঘুমধুন মেঘসমুদ্দুর
কখনো জানা হয় না মনবাড়ির সীমানা কত দূর!

ডানা মেলে উড়ে ও পাখি, যাও যত দূর
সন্ধ্যা হবার পর আমাদের সাক্ষাৎ চাই
ও পাখি, উড়বার ডানায় মেখো রোদ্দুর
মুখ ডুবে শুয়ে থেকে যেন উষ্ণতা পাই।

আলিঙ্গনে আমরা কাটাব সারা দিন-রাত
বেহাত হলে হোক দুদিনের এ ঘর-সংসার
উটপাখি হয়ে বালিতে গুঁজব মুখ, আঁতাত
সংঘাত-প্রলুব্ধ মানুষের দেখব না কারবার।

বাগাড় মাছের পেট ধরে নাচবে বেল্লাল ভাই
শেষরাত খলবল করে উঠলে উঠুক পুকুরে
আমরা শুনব না থুত্থুরে বুড়ির দোয়ানো গাই
কে গোয়াল থেকে খুলে নিয়ে গেল সমুদ্দুরে…

আমরা আমাদের হয়ে চাঁদবুড়ির আলুভাজা খাব
পরস্পরের উষ্ণতায় আমরা পরস্পর নদী সাঁতরাব।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, শিশুদের বয়স দুরকম। একটি হলো জন্ম থেকে ছয় বছর এবং আরেকটি হলো ছয় থেকে চৌদ্দ বছর। বয়সের এ দুঅংশ মিলেই শিশুর শৈশব। এই শৈশব নামক রঙের দুনিয়া লাল-নীল ঝিকঝাক বাতির মতোই। আলো ছড়িয়ে ভরিয়ে রাখে ছোট্ট হৃদয় ও মন। এই বয়সে মনে কোনো ক্লেদ থাকে না। লেদ মেশিনে পলিশ করাই থাকে চিন্তার জগৎ। কোনো পাপ এসে গ্রাস করে না তার ছোট্ট হৃদয়; মেদমুক্ত শিশুমন অপার অসীম উজ্জ্বলতায় কল্পনার রাজ্যে ভাসতে থাকে সারাক্ষণ। শিশুমন হয় কোমলমতি। তার মন ও মানসে সর্বদা বিরাজ করে নিরেট সরলতা। একটা সাদা খাতার মতোই এই মন ঝকঝকে পরিষ্কার। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘শিশু প্রকৃতির সৃজন’।

কিন্তু তারা বড়দের দেখে শেখে। বড়দের আচরণ, অভিব্যক্তি দেখে বা শুনে শিশুরা দ্রুত তা আত্মস্থ করতে পারে। এ কারণে শিশুদের সঙ্গে বড়দের আচরণ ও ব্যবহার এবং তাদের শিক্ষাপ্রদানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট যত্নশীল হতে হয়।

শিশুমনের সাদা খাতা সৃজনের তুলিতে অংকিত করার দায়িত্ব প্রথম শিক্ষক মা; বাবা, পরিবারের অন্য সদস্য এবং সর্বোপরি একজন লেখকের। সুপ্রাচীন কাল থেকেই লেখকেরা সেই মহান দায়িত্ব পালন করে আসছেন অত্যন্ত সৎ থেকে, নিষ্ঠার সঙ্গে। শিশুদের প্রকৃতি, মন-মেজাজ, আচরণ, কৌতূহল, আগ্রহ ইত্যাদি বিষয় খেয়াল রেখেই লেখকেরা লিখে যাচ্ছেন শিশুর জন্য সাহিত্য। একজন শিশুসাহিত্যিক মানবপ্রকৃতি, প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং শিশুদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানার্জন করেই লিখতে বসেন। বয়স বিবেচনায় নিয়ে লিখে যান মনন ও সৃজন বিকশিত রচনা।

বাংলা ভাষায় শিশুসাহিত্য রচনা শুরু হয় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতাস্কুল-বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত নীতিকথা নামক গ্রন্থের মাধ্যমে।
দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, স্বর্ণকুমারী দেবী প্রমুখের রচনার মধ্য দিয়ে।

তৃতীয় পর্যায় অর্থাৎ এর পর রবীন্দ্রযুগ। শিশুসাহিত্য হয়ে ওঠে আনন্দদায়ক। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার, কাজী নজরুলইসলাম, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমেন্দ্রপ্রসাদ, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, সুখলতা রাও, মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী, হাবিবুর রহমান, ইমদাদুল হক, ইব্রাহিম খাঁ, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, বন্দে আলী মিয়া, মোহাম্মদ মোদাব্বের, হবীবুল্লাহ বাহার, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, জসীমউদ্দীন, কাজী কাদের নেওয়াজ, ফররুখ আহমদ, মোহাম্মদ নাসির আলী, শওকত ওসমান, আতোয়ার রহমান, হাবিবুর রহমান, জসীমউদ্দীন প্রমুখ বাংলার শিশুসাহিত্য সমৃদ্ধ করেছেন। বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ রচনা করে আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আশরাফ সিদ্দিকী, রোকনুজ্জামানখান, মাহবুব তালুকদার, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, হুমায়ুন আহমেদ প্রমুখের হাত ধরে বাংলা শিশুসাহিত্য পেয়েছে বিশেষ গতি।

কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষ আর নব-নব আবিষ্কার পৃথিবীবাসীকে যেমন নতুন জীবন দিয়েছে, তেমনি এই প্রজন্মকে করে তুলেছে যন্ত্রনির্ভর। ব্যাপারটা এত দ্রুতগতিতে ঘটে যাচ্ছে যে, আমাদের শিশুসাহিত্যিকরা এই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারছেন কমই। প্রযুক্তির আধুনিকায়নের ফলাফল এত দ্রুতগতিতে ঘটছে যে, আগামী প্রজন্ম আরও কতদূর এগিয়ে যাবে, তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। কিন্তু শিশুসাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে এই প্রজন্মের মেজাজ, কৌতূহল, শখ, আগ্রহ ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে লেখকের ঘাটতি থাকায় শিশুদের মধ্যে বই-পাঠোভ্যাস খুব দ্রুততার সঙ্গে কমে যাচ্ছে। শিশু হয়ে উঠছে বইসঙ্গ-বিমুখ। ফলে শিশুমনের জাদুর পৃথিবীটা একটি একটি করে হারিয়ে যেতে বসেছে। অথচ আমরা চাই, আজকের শিশু অবিরাম আনন্দে ঘুরে বেড়াক লাগামহীন টাট্টু ঘোড়ার পিঠে। তারা নতুন দিগন্তের সব্ধান করুক । আহা, তারা যেন বইমুখী হয়।

রোদের সাথে গল্প জমে বেশ।
গল্পটা হয় সকালবেলা, যখন থাকে স্নিগ্ধ পরিবেশ।
উড়ছে চড়ুই। কাকের সাথেও রইছে দারুণ ভাব।
উড়ে উড়ে ইচ্ছে হলে করে দৌড়-ঝাঁপ।
ওদের সাথে গল্প করি। আব্বু বলেন—বন্ধু বানাও ওদের।
যারা তোমার একলা একায় আনন্দ দেয়, খেলার সাথি রোদের।

রোদকে ভালো দেখতে পারি? মোটেও নয়।
দুচোখ জ্বলে; রোদের গায়ে আগুন জমে রয়!
তার ওপরে বাড়ির পরে বাড়ি।
যেন রোদের সাথে ভীষণ আড়ি!
জানলাগুলোর ফাঁক গলে যে রৌদ্র ভাসে
মুখ থাকে ভার। করুণ চোখে রয় তাকিয়ে আর—
ওদের সাথে যায় কী খেলা? যায় না পাওয়া ছায়া সারি-সারি।

ও জয়িতা, চল বাড়ি যাই; দত্তবাড়ি।
মেঘের গায়ে ঝুলছে রে মা গাছের সারি।
চিনবি এবার আল-মেঠোপথ শাপলা ও জুঁই
দেখবি খেলা দাদির হাতে কাঁথা ও সুই।

ও জয়িতা, মেহদিমাখা ছোট্ট দুহাত
কপালে টিপ খেলার সাথি রাঙা প্রভাত
কিচির মিচির পাখির ডাক আর কচুরিফুল
সাঁঝের মায়া সন্ধ্যাবাতি নদীর দুকূল…

চল বাড়ি যাই, ও জয়িতা ডাকছে দাদি
চালের পিঠার জন্য রে মা মনটা বাঁধি
আধাআধি ভাগ করে তুই আমি খাব
চল তো রে মা, আমরা বাড়ি আজই যাব।

হাওয়ায় ভাসার স্বপ্ন নিয়ে
বলছি মাকে—উড়ি
দূরের আকাশ;
ঢেউ তুলেছে রোদসমুদ্দুর;
ঘুড়ি!

মা, ওগো মা, যাই?
ভাঙব শিকল মেঘ বাঁধানো
করছি প্রতিজ্ঞাই
সূর্যমামার কড়কড়ে রোদ
ভাল্লাগে না—ছাই!

এই ভাষাতেই বলছি কথা হাজার বছর ধরে
ইতিহাসের পাতায় লেখা সোনালি অক্ষরে—
কবিতা, গান এবং নানান রীতিনীতির বাণী
ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সেসব কথা জানি।

বদ্বীপের এই দেশে—
একেক সময় একেক রাজা দখল নিতে এসে
নিপীড়ন আর বঞ্চনাতে করত জীবন নাশ
সেসব বাধা ভাঙতে সবার কাটত বারোমাস!

ব্রিটিশেরই শিকল ভেঙে পাকশাসকের গ্রাসে
বাঙালি এই জাতির মনে দুঃখ নেমে আসে।
মানুষ নামে দানব ছিল শোষণ ও শাসনে—
পাকি ছিল এই দেশেরই ক্ষমতার আসনে।

মায়ের ভাষা কাড়তে ওরা হিংস্র হয়ে ওঠে
দখল নিতে ছুড়ল গুলি কত্ত বোমা ফোটে!
‘উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা’ করলে হুকুম জারি
দাবির মিছিল বীরছেলেদের রক্তে হলো ভারী।

দাঁতভাঙা তার জবাব পেয়ে পেছাল ফের ওরা
বাংলা আমার প্রাণের ভাষা ভালোবাসায় মোড়া।
বাংলা মায়ের ভাষা আমার বাংলা সবার সেরা
হাজার যুগের আশার আলো স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা।

নদীটার পাশ দিয়ে মেঘডুবো চাঁদ
হেঁটে যায় ধীরলয়ে সন্ধেবেলায়
তবু রুচি মেলে দিল তার দুটো হাত
চাঁদটার সাথে সে যে মাতবে খেলায়।

নদীটাও চুপচাপ, আছে মাছ ডুবে
হেঁটে হেঁটে চাঁদ বুঝি মেঘে দিয়ে ডুব—
যাচ্ছে দখিন থেকে; রোজ যায় পুবে
শরতের সাথে তার আছে ভাব খুব।

রুচির দুহাতে আলো—আঁধারির ঢেউ
খেলা করে কাশফুল দুই চোখজুড়ে
রাত বাড়ে, টর্চ হাতে নদীটায় কেউ
আঁধার কাটতে দেয় তোড়াজাল ছুঁড়ে।

নদীটার পাশ দিয়ে চাঁদ যায় বাড়ি
রুচিও ঘুমাতে যায় খুব তাড়াতাড়ি!

জানি, তুমি বনের রাজা বশ না মানা হাতি
চেটেপুটে খেয়েদেয়ে চওড়া বুকের ছাতি
সাধারণের গলা কেটে ধনী রাতারাতি।

যে মরে প্রায় প্রতিদিনই তাকেই ধরে মারো
তাকে পথে বসিয়ে ফের মুখের খাবার কাড়ো।

আরও মারো তাকেই—

ঘর নাই যার বাইরে থাকে
হাজার ডেকেও পায় না মাকে
যে শিশুটার অসুখ-বিসুখ; সর্দি নাকে
যে বুড়োটা বয়সভারে রইছে পড়ে দুর্বিপাকে
কাজের খোঁজে ফেরারি ওই জোয়ানটাকেই!

আরও মারো তাকেই—

হাড় জিরজির শরীরখানা
অন্ধ, প্রতিবন্ধী, কানা
যেই লোকটা খেটেও মোটে পায় না খেতে
যেই লোকটা জীবনযুদ্ধে হারতে হারতে জেতে
তাকেই?

মরতে জানে— মারো।
মৃত্যুকে ও ভয় পায় না
ধারে না আর ধারও।

জানি, তুমি হাতি।
কারও বুকের ছাতি
কাতলা হয়ে এই এখানে এক-কে করো দুই।
পড়তে পারে হঠাৎ ভেঙে ঘরের চালের টুই!

তার চেয়ে বরং ভালোবেসে
ফোটাও গোলাপ, জুঁই।

এদিক সেদিক যেদিক তাকাই
সবার ভেতর দেখছি রে ভাই
দিলখোলা এক হাসি,
টানাপোড়েন, পকেটে টান;
সে আলাপ আজ বাসি।

হাঁটছে নিজের খেয়াল-মতো
হয় না কেউ আর কোথাও নত
পায় সে সমাদরই,
নতুন দিনের নতুন রোদে
ভাসায় নিজের তরী।

সবগুলো মুখ-চোখের ভাষা
পড়ার মতোই— শব্দ খাসা
সোনার জলে ধোয়া,
মনবাড়িতে নেই কোলাহল
শান্তির আছে ছোঁয়া।

আমার মনই শান্তিতে নেই
পকেটে টান চরম যে-সেই
টানাপোড়েন কী যে!
উপোস পেটে ভাবি— ও সুখ
ভালোই আছে নিজে!

মারতে পিষে কেউ ছাড়ে না!

হাজার টাকায় হয় না বাজার
সব জিনিসের মূল্য বেশি
হোক বিদেশি কিংবা দেশি।

দামের ঘোড়ার পায়ের চাপে
পিষ্ট ‘মানুষ’ নেই তো সুখে
নেই বলার সেই ভাষাও মুখে!

এইভাবে যে যায় না বাঁচা
দেখেও দেখি কেউ দেখে না
দুখের কথা কেউ লেখে না!

সবকিছুর দাম বাড়ে, কেবল
গরিব লোকের দাম বাড়ে না
মারতে পিষে কেউ ছাড়ে না!

শুকলাল আমায় বলল ডেকে—দাদা,
আপনি নাকি জীবন্ত এক ধাঁধা?
তালটাকে তিল বানান ভালোই নিজে
চোখের জলে সবাইকে দেন ভিজে,

সত্য পুরুষ; বীর বাহাদুর কী-যে!

শুনে আমার লাগল ভালো, বেশ—
ভক্ত বটে, নেই মনে তার ক্লেশ।
ভূষি-মালের কাটতি বেশি চাই
ভক্ত বাড়ুক, ছড়াবে রোশনাই।

কিন্তু এ কী! পাড়ায় দেখি আজ
শুকলালেরই মাথায় বীরের তাজ!
ওর চোখে রোদ-বৃষ্টি দারুণ খেলে
বলছে লোকে, এ পাড়ার ওই ‘পেলে’!

লেজ গুটিয়ে ভাবছি যাব বনে
পাখপাখালির দীক্ষা নেব মনে,
মনটা উদাস হচ্ছে বলেই ভালো
মানুষ হওয়ার বাসনা জন্মালো।

তুমি কার, কে তোমার
এই নিয়ে দ্বন্দ্বের—
মিটমাট হলো না তো
কালা আর অন্ধের!

অন্ধের পোয়াবারো
কালাও তো কম নয়
ক্ষমতার লাভালাভ
নিয়ে নেই সংশয়।

একরোখা দুজনেই
পথ তবু ভিন্ন
কেউ কারো চাইল না
এতটুকু চিহ্ন!

হানাহানি মারামারি
করে করে এই তো
আজ শুনি উভয়ের
নীতিবোধ নেই তো!

কালা আর অন্ধের
দ্বন্দ্বের গ্যাঁড়াকল;
চাপ খেয়ে জনতার
নেই বুকে মনোবল!

আয়নায় মুখ রেখে জয়ী পূর্ণতা দেখল, চুলগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। প্রতিদিন গোসলের পরই মা চুল আঁচড়িয়ে দেন। এটা মায়ের অভ্যাস। আজও দিয়েছিলেন বলে মনে পড়ল তার। কিন্তু এখন এলোমেলো। সে তো চুলে হাত দেয়নি। তা হলে কেমন করে এমন হলো? জয়ী পূর্ণতা কিছুই বুঝতে পারছিল না। তাই সে নিজেই চুল আঁচড়িয়ে নিতে চাইল। আয়নার সামনে গিয়ে চিরুনিটা খুঁজতে লাগল। কিন্তু পেল না। যেখানে সবসময় প্লাস্টিকের চিরুনিটা থাকে, সেখানে এখন নেই। খাটের নিচে খুঁজল। পেল না। পড়ার টেবিলের ওপর খুঁজল। পেল না। খেলনার ভেতরে খুঁজল। পেল না। রান্নাঘরে গিয়েও খুঁজল। পেল না। খুঁজতে খুঁজতে একসময় জয়ী পূর্ণতা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। কোথাও চিরুনিটা পেল না। কোথাও সে রেখেছিল কিনা, খানিকক্ষণ ভাবল। কিন্তু মনে করতে পারল না। আসলে সে চিরুনিটা ধরেইনি। মা তার চুল আঁচড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপরই রেখেছিলেন। তার মনে পড়ল। তবে কি চিরুনির পাখা গজালো? উড়ে দূরের কোনো বনে গিয়ে পাখিদের চুল আঁচড়িয়ে দিচ্ছে এখন? —এমন ভাবনাও ভাবল জয়ী পূর্ণতা। মনে জিদ চেপে বসল। যে করেই হোক, চিরুনিটা খুঁজে তাকে পেতেই হবে। প্লাস্টিকের ওই চিরুনিটা তার চাই-ই চাই।
মাকে ডাকবে কিনা, জয়ী পূর্ণতা একবার ভাবল। কিন্তু রাগ করতে পারেন ভেবে ডাকল না। তবে জয়ী পূর্ণতার মনের কথা ঠিকই বুঝল একটা রঙিন প্রজাপতি। সে তখন ডানা মেলে উড়ছিল।
উড়তে উড়তে এসে বসল আয়নার গায়ে। ডাকল জয়ী পূর্ণতাকে—

‘জয়ী পূর্ণতা, এই জয়ী পূর্ণতা, এই যে আমি, এখানে।’
জয়ী পূর্ণতা মায়ের দিকে তাকাল। ভালো করে দেখল মায়ের চোখ ও মুখ। না, মা তো ঘুমিয়েই আছেন। তা হলে কে ডাকল? জয়ী পূর্ণতা যখন ভাবতে লাগল, তখন আবার ডাকটি শুনতে পেল—

‘জয়ী পূর্ণতা, এই জয়ী পূর্ণতা, এই যে আমি, আমার দিকে তাকাও। আমি একটা প্রজাপতি। তোমার চিরুনিটা কোথায়, তা আমি জানি।’
জয়ী পূর্ণতা প্রজাপতির দিকে তাকাল। কী যে সুন্দর রঙিন প্রজাপতি। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকল। ভালো করে দেখতে লাগল। কথা বলে কিনা, খেয়ালও করল। কিন্তু না, আয়নার গায়ে প্রজাপতিটি চুপচাপ বসেই আছে। নড়ছেও না, চড়ছেও না। দেখে তার মনে হলো, প্রজাপতিটা আসলে উড়তেই পারে না। কোনোদিন ওড়েওনি। বহুবছর ধরে আয়নার গায়ে এভাবেই লেগে আছে। একবার ধরতে চাইল। পরে কী মনে করে আর ধরল না। চুপচাপ তাকিয়ে থেকে প্রজাপতির রঙিন পাখা দেখতে লাগল।
‘এই জয়ী পূর্ণতা, অমন করে কী দেখছ? আমার পাখা খুব রঙিন, দেখতে সুন্দর, তাই না?’
‘হুম, খুব রঙিন, খুবই সুন্দর। এমন সুন্দর প্রজাপতি আমি আগে কখনো দেখিনি’—জয়ী পূর্ণতা প্রজাপতির সাথে কথা বলতে শুরু করল।
প্রজাপতি বলল—‘তুমি মনে হয় আমাদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানো না। শোনো, পৃথিবীতে আমার মতো বিশ হাজার ধরনের প্রজাপতি আছে। একেকটা দেখতে একেক রকম। একেকটার একেক রকম সৌন্দর্য। সুন্দর প্রজাপতির প্রতিযোগিতা হলে তুমি সবগুলো দেখে বলবে সুন্দর। যেমন কিছু প্রজাপতির পাখার নিচটা বেশ লম্বা আর ঝোলানো। রং হয় বেগুনি। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। আবার কিছু প্রজাপতির ডানা লাল বা কমলা। ডানার চারদিক ফিতার মতো। কিছু প্রজাপতির ফিতা ডোরাকাটা চিতাবাঘের মতো। কিছু প্রজাপতি ময়ূরের মতো। আরও কত কত রঙের যে প্রজাপতি বাস করে এ দুনিয়ায়! ওহ হো, আমাকে নিয়ে বলতে গিয়ে আসল কথাটাই তো বলতে ভুলে বসে আছি! আচ্ছা, তুমি কি চিরুনিটা আর খুঁজবে না? ওটা কি তোমার আর দরকার নেই?’

‘হুম খুঁজব তো’—বলল জয়ী পূর্ণতা। কিন্তু প্রজাপতিটা দেখতে এত সুন্দর যে, চিরুনির কথা আর মনে করতে চাইল না সে। প্রজাপতির ডানার দিকে তাকিয়ে রইল আপনমনে।
প্রজাপতি জয়ী পূর্ণতাকে ডাকল। উকুন আর চিরুনির গল্প শোনাতে চাইল। বলল, জয়ী পূর্ণতা, তুমি কি জানো, তোমার চুলের জন্য কোন চিরুনি ভালো? আর তোমাদের প্লাস্টিক চিরুনি কোথায় চলে গেছে?’
জয়ী পূর্ণতা বলল—‘না, না, কিচ্ছু জানি না তো’।
‘তবে শোনো, তোমাকে একটা গল্প শোনাই’ বলে প্রজাপতি একটু নড়ে উঠল। তার নড়াচড়া ভালো করে খেয়াল করল সে। দেখল, একটা টিকটিকি চুপিচুপি প্রজাপতির দিকে এগিয়ে আসছে। আর ঠিক তখনই প্রজাপতিটা উড়ে এসে বসল জয়ী পূর্ণতার কাঁধে। আয়নায় তা দেখল জয়ী পূর্ণতা।

প্রজাপতি বলল, আজ থেকে তিন হাজার সাতশ বছর আগের কথা। ইসরায়েল নামে এক দেশ আছে। সেই দেশের লাগেজ থেকে পাওয়া যায় একটা চিরুনি। সেটা আবার পাথরের। সেই চিরুনিতে লেখা ছিল মাত্র সাতটি শব্দ। তাও আবার ক্যানানাইট ভাষায়। লেখা ছিল—এই চিরুনি চুল ও দাড়ি থেকে উকুন সরাতে পারে।
প্রজাপতি জয়ী পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বলল—কিছু বুঝলে?
জয়ী পূর্ণতা বলল, না, কিছুই বুঝিনি।

প্রজাপতি বলল, উকুন সরাতে চিরুনির জন্ম হয় বহুকাল আগেই। তবে চুল সুন্দর রাখতেও চিরুনি ব্যবহার করত তারা। কিন্তু এখন বাজারে কত রকমের চিরুনি যে পাওয়া যায়, তার ঠিক নেই। তোমার মা গোসল করিয়ে দিয়ে ভেজা চুল যেভাবে প্লাস্টিকের চিরুনি দিয়ে আঁচড়িয়ে দেয়, তা মোটেও ঠিক নয়। তাতে চুল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আর প্লাস্টিকের চিরুনিও চুলের ক্ষতি করে।
জয়ী পূর্ণতা বলল, তা হলে কি দিয়ে চুল আঁচড়াতে হবে?
প্রজাপতি বলল, গোসলের পর চুল শুকিয়ে নিতে হবে প্রথমে। তার পর কাঠের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে নিতে হবে। দেখবে চুল কী ঝরঝরে থাকে, দেখতে কত সুন্দর লাগে।

জয়ী পূর্ণতা বলল—আচ্ছা, তা না হয় বুঝলাম কিন্তু প্লাস্টিকের চিরুনি কোথায় হাওয়া খেতে গেল!
প্রজাপতি এবার বলল, হ্যাঁ, সেই কথাই তো বলার জন্য তোমার কাছে এসেছি। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে। তোমার চুলগুলোও পছন্দ করে। চুলগুলো যাতে নষ্ট না হয়, কী করলে ভালো থাকবে, আমার কাছে জানতে চাইল। আমি ওকে পাখায় তুলে দূরে ফেলে দিয়ে এসেছি। আর তোমার জন্য নিয়ে এসেছি কাঠের চিরুনি।

জয়ী পূর্ণতা আয়নার সামনে দেখল একটা চিরুনি।
প্রজাপতি বলল—আরে, চিরুনিটা ধরেই দেখো না!
তখনই কাঠের চিরুনিটা কথা বলে উঠল। বলল—জানো জয়ী পূর্ণতা, আমি ছিলাম বিশেষ এক ধরনের কাঠ। আমাকে কেটে, ছেঁটে মসৃণ করে এভাবে চিরুনি বানানো হয়েছে। আমি তোমার চুলের যত্ন নেব। তবে কী জানো, আমাদেরও অনেক দুঃখ আছে। গাছপালা কেটে সব শেষ করে ফেলা হচ্ছে। মানুষ যে কেমন!

কাঠচিরুনির কথা শুনে জয়ী পূর্ণতা অবাক হলো কিন্তু ভয় পেল না। কাঠচিরুনি খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথাগুলো বলায় মুগ্ধ হয়ে শুনল সে। বলল—আরও কিছু বলতে চাও তুমি?

কাঠচিরুনি বলল, হ্যাঁ, আমাদের নিয়ে কেউ ভাবে না। আমরা না থাকলে যে পরিবেশও ভালো থাকবে না, থাকে না, এ কথা মানুষ বুঝতে চায় না। এই দেখো না, গাছপালা উজার হওয়ায় তুমি কত কষ্ট পাচ্ছ গরমে। তোমার মাকে ফ্যান চালিয়ে ঘুমোতে হচ্ছে। আবহাওয়া মোটেও ঠিক নেই। গরম আর গরম।
জয়ী পূর্ণতা জানতে চাইল, এখন আমাকে কী করতে হবে বলো?

কাঠচিরুনি বলল, একটা গাছ কাটলে দশটা গাছ লাগাতে হবে। মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে।
জয়ী পূর্ণতা বলল, আমি তো ছোট মানুষ। আমি কীভাবে বলব? আমাকে তো কেউ চেনে না।
কাঠচিরুনি বলল, সে আমি জানি। কিন্তু তোমার অনেক কিছু করার আছে। যেমন ধরো, তোমাদের বারান্দার টবে, বাসার ছাদে গাছ লাগাতে অনুরোধ করতে পারো মা-বাবাকে। তোমার চারপাশ সবুজে ভরে দিতে মানুষকে অনুরোধ করে একটা ভিডিও বানাতে পারো।

জয়ী পূর্ণতা বলল, তারপর কী করব?
কাঠচিরুনি বলল, খুব সোজা। তোমার মায়ের রান্নার ইউটিউব চ্যানেলে সেটা প্রকাশ করবে। দেখবে কত্ত মানুষ দেখে, মন্তব্য করে, লাইক দেয়। তোমার মিষ্টি গলা শুনে মানুষ আনন্দ পাবে। পরিবেশ সম্পর্কেও সচেতন হবে। মনে রেখো, তুমি বয়সে ছোট হলেও মনের দিক থেকে অনেক বড়। জানি, তুমি পারবে। তাই তো তোমার কাছে এসেছি আমি। আমাদের একসাথে লড়তে হবে, পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। পরিবেশ ভালো থাকা মানে সবার ভালো থাকা।

জয়ী পূর্ণতা মনে মনে অনেক বড় হয়ে যায়। সে পরিবেশ নিয়ে ভাবতে থাকে। সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ কীভাবে সুস্থ রাখা যায়, তা নিয়ে ভাবতে থাকে। নতুন নতুন পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনায় মা-বাবাকেও রাখে। তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে। আরও কী কী করা যায়, তা তিনজন মিলে ঠিক করে নেয়। বাবাকে দিয়ে প্রথমে গাছ ও টব কিনে নিয়ে আসে। মাটি আনায়। টবগুলো মাটি দিয়ে ভরাট করে। গাছ লাগায়। প্রতিদিন সকাল-বিকাল গাছে পানি দেয়। সার দেয়। গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দেয়। এভাবে যত্ন নেয় তিনজন মিলে।

গাছগুলো দিনে দিনে বড় হয়ে উঠছে। নতুন নতুন ডালপালা গজিয়ে উঠছে। সবুজ পাতায় ভরে উঠছে গাছগুলো। সবুজে সবুজে ভরে উঠছে বারান্দা ও ছাদ। গাছের ডালগুলো যে যেদিক পারছে, ছড়িয়ে পড়ছে। এখন প্রজাপতি এসে ডালে বসে, ফড়িংরা দল বেঁধে আসে। চড়ুই, টুনটুনিও এসে খেলা করে আপনমনে। ময়নাও কথা বলে তাদের সাথে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে জয়ী পূর্ণতা সবুজ পাতাগুলোর সাথে কথা বলে। সময় পেলেই কথা বলতে থাকে। গাছ এখন তার বন্ধু। গাছের সাথে কথা বলতে তার খুব ভালো লাগে। কথা বলে মনে মনে। তাতে পাতারাও সাড়া দেয়। তার সাথে মন খুলে কথা বলে। চুপে চুপে। আলতো বাতাস দোলা দিলে পাতারা জয়ী পূর্ণতাকে ছুঁয়ে দেয়। কী যে আনন্দ পায় সে।
তোমরাও বাড়ির চারপাশ নানা ধরনের গাছ লাগাতে পারো। ওদের যত্ন নিতে পারো। চুপে চুপে কথা বলতে পারো। ওদের তো প্রাণ আছে। কথা বলতে পারে। তবে চুপে চুপে বলে। এ কথা শুনতে হয় হৃদয় দিয়ে। যার মন সুন্দর, হৃদয় নরম, সে-ই কেবল সবচেয়ে ভালোভাবে কথাগুলো শুনতে পারে। গাছপালার সাথে চুপে চুপে কথা বলার মজাই আলাদা। কী যে আনন্দ লাগে!

অদ্বৈত মারুত, সময়ের বিচারে একবিংশ শতকের প্রথম দশকের কবি। কবি, হ্যাঁ, কবিই বলি। এটাই সহজ সম্বোধন। যার ঝুলিতে ইতোমধ্যে দুটি কাব্যগ্রন্থ জমা হয়েছে, তাকে কবি সম্বোধনে দ্বিধাও নেই।
প্রথম দশকের শুরু থেকেই নিজেকে কবিতা মাধ্যমে সচল রেখেছে মারুত। সেই সচল রাখার প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত নিজেকে লেখার টেবিলে ধরেও রেখেছে। যদি সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখি, তাহলে আমাদের সামনে বিচার্য মারুত দীর্ঘ দেড় দশক ধরে কী লিখেছে? সেগুলোর শিল্পমূল্য কতটুকু? কালের বিচারে তার স্থান কোথায়? সমালোচনার ক্ষেত্রে এসবই তো বিচার্য। কিন্তু সমালোচকের দৃষ্টির পরিবর্তে আমি মুগ্ধতার দিকেই দৃষ্টি দিতে আগ্রহী। এই আগ্রহ আমার সীমাবদ্ধতা থেকেই। কারণ, শিল্প বিচারের ক্ষেত্রে যে মানদ- নির্ধারণ করতে হয়, যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে তাকে তুলাদ-ে ফেলে পরিমাপ করতে হয়, শিল্পের মতো এত নাজুক এবং অনুভূতিশীল বিষয়ের ক্ষেত্রে তাকে আমার অসম্ভবই মনে হয়। যে মানদ- যে বিচারের ভার মহাকালের হাতে, তাকে কেন নিজের হাতে নিতে ক্ষতবিক্ষত করতে যাব? তাই ভালোলাগার দৃষ্টিকোণ থেকেই আমি কবিতার পাঠক। আর পাঠের সময়ে আমার মন মুগ্ধই হতে চায়। অন্য কিছু নয়। এখন সোজা কথায় একটানে যদি মারুতের কবিতার ভুবনে চলে আসি, তাহলে প্রথম প্রশ্ন উত্থাপন হতে পারে, অদ্বৈত মারুতের লেখা কি ভালোলাগে? টানে? পাঠের আগ্রহ তৈরি করে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তরও এক কথায় দেওয়া সম্ভব না। একজন লেখকের সব লেখা পাঠককে টানবে তা যেমন অসম্ভব, তেমনি সব লেখাই ভালোলাগা অনুভূতি নিয়ে আসবে, তাও সত্যি না। একই সঙ্গে সব লেখাই পাঠের আগ্রহ তৈরি করবে, এই বাক্যেও সমর্থন দেওয়া সম্ভব না। তবে অদ্বৈত মারুতের অনেক লেখাতেই এই বাক্যগুলোর সমর্থন আছে কি না, তা মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। আর সেই মিলিয়ে দেখার কাজটিই আমার মন করেছে, তার কবিতা পাঠের সময়ে। মারুতের প্রথম কবিতার বইটিও পাঠের সুযোগ হয়েছিল, সেই ধারাবাহিকতাতেই দ্বিতীয় বইটি পাঠের সুযোগ। কৌতূহলী পাঠকের আগ্রহ থেকেই আমি চেষ্টা করেছি কবিতাগুলোর পাঠের। অদ্বৈত মারুত যখন লেখে

‘প্রতিদিন বাড়ি ফেরার আগে দোকান হয়ে যাই। টুকটাক কিছু কিনি। কাউকে ফোন দেওয়ার ভান করে দেখে নিই পকেটের সব ঠিকঠাক আছে কি না। তারপরই খুঁজতে থাকি অসহ্য বেদনাবাহন!
প্রতিদিন নতুন কিছু খুঁজি নতুন গাড়ি, নতুন বাড়ি; নতুন মানুষের বেষ্টনে গুঁজে রাখা মোবাইলটাও দেখে নিই কতটা দামি।
বাড়ি ফেরার পথে প্রতিদিন নতুন কিছু দেখি; নিয়ন আলোয় ভেজা শুকনো পাতার মতো বিচ্ছিন্ন কিছু…
ঘরে ফিরে শুধু তোমাকেই বন্ধু মনে হয়, আপন মনে হয়!’ (বাড়ি ফেরার পর)

তখন ভালোলাগার আবেগ মনে ছড়িয়ে পড়ে। কবিতার আলোচনার ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত তার গদ্যাংশ নির্মাণের দিকেই বেশি আগ্রহী হয়ে উঠি। এ ক্ষেত্রে কবিতাটি যেহেতু গদ্যেই লেখা, তার অতিরিক্ত ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ছে না। বরং সহজ এবং প্রচলিত শব্দের ভেতর দিয়ে উঠে আসা গল্পের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অনুভূতি। এখানে আবেগ রয়েছে, যুক্তি রয়েছে, দৈনন্দিনতা রয়েছে, সেই সঙ্গে রয়েছে কবিতাও।

সবারই চেষ্টা থাকে লেখার ভেতরে নিজেকে নিজের অনুভূতিকে ধরে রাখার। আর সেই অনুভূতি যেন অন্যের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়, সে চেষ্টাও থাকে। কারণ লেখার ভেতর দিয়ে লেখকের অনুভূতি যখন অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত হবে, তখনই সেই লেখাটি পাঠকের কাছে গ্রহণীয় হয়ে ওঠার সুযোগ পায়। এই চেষ্টায় যিনি যতটা সফল, তিনি ততটাই সার্থক। আর তাই অন্তর্গত বেদনার সঙ্গে মিলিয়েই কবি তার চেনা দৃশ্য, চেনা পরিবেশকে করে তোলেন অন্য এক জগৎ, যা একই সঙ্গে দৃশ্যমান এবং অদৃৃশ্য। আর এই দুয়ের মিলনে যে রহস্যময়তা, তাই ঘোর তৈরি করে পাঠকের সামনে। যাতে করে পরিচিত দৃশ্যাবলি হয়ে উঠতে থাকে অদ্ভুত এবং স্বপ্নময়। যাতে করে ভালোলাগা তৈরি হয় মনের ভেতরে। চেনা শব্দরাই ভীষণ অচেনা হয়ে ওঠে। অদ্বৈত মারুতেরও চেষ্টা এখানেই।

একই সঙ্গে আরো একটি কথা এই অবসরে বলে রাখা ভালো, ওর সময়ের কবিদের সঙ্গে মারুতের পার্থক্য তাও খুঁজতে আমি যাইনি। তবে মারুত সময়কে ধরে রাখতে চেয়েছে। সময়ের ভেতর থেকে উঠে এসে দেখিয়ে দিতে চেয়েছে ওর নিজস্ব স্বর। এ ক্ষেত্রে কবিতা নির্মাণের চেয়ে হয়ে ওঠার জন্য যে শ্রম তাকেই গুরুত্ব দিয়েছে। শব্দকে নিজের মতো করে ব্যবহার করতে চেয়েছে। এই চাওয়ার কারণ আমাদের মধ্যবিত্ত জীবন। আমরা আধুনিক হয়ে উঠছি। কিন্তু আমরা যারা আজ আধুনিক হয়ে ওঠার সংগ্রাম করছি, তাদের সবারই শেকড় গ্রামে। এখনো আমাদের গায়ে কাদামাটির গন্ধ। আমরা যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও মাঝরাতে এখনো ঝিঁঝিপোকা আমাদের ডাকে। পাটখেতের শুঁয়োপোকার কিলবিল করে চলে যাওয়ার দৃশ্য আমাদের পোড়ায়। বুকের মধ্যে ফেলে আসা নদীর জল তড়পায়। ফলে অদ্বৈত মারুতের শব্দরা উঠে আসে সোঁদাগন্ধ মাখা মাটি থেকে। সেখানে পাটশোলার বেড়া, বেনোজল, বাস্তুভিটার মতো ফেলে আসা জীবনের গল্প যেমন ভিড় করে, তেমনিভাবে মোবাইল, শ্যাম্পু, নিয়ন আলো, ট্যাপের মতো আধুনিকতার অনুষঙ্গমাখা শব্দরাও উঁকি মারে।

স্বর ভাঙার গান
অদ্বৈত মারুত
প্রকাশক : দেশ পাবলিকেশনস
প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৫
প্রচ্ছদ : দেওয়ান আতিকুর রহমান
মূল্য : ১২০ টাকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *