উপন্যাস

নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব সাত

কোথায় গেল-রে ননী, এখনও ভাত দিলি না! কী হল তোর, বেলা যে বয়ে যাচ্ছে! শংকরের কথা ননীর কানে এসে পৌছানো মাত্রই, তাড়াতাড়ি ছুটে আসে ভাতের থালা নিয়ে। আসনে ওপর থালাটি রেখে, আচমকা, দুই হাত প্রসারিত করে মিনতি জানাল; তারপর বাড়ানো হাতের ওপর কপাল রেখে অবাধ্য আবেগে কাতরে উঠল : একটু দেরি হয়ে গেল। আমাকে ক্ষমা করুন। ক্ষমা করুন।
অগ্নিদগ্ধ মাটিকণাকেও মৃত্তিকা আত্মগত করে নেয়, কিন্তু শংকরের কাছে ননীর কাতর-আবেগ অন্ধর্স্বাথ। আড়বাঁশির মতো যুক্তিহীন। অত্যন্ত তুচ্ছ ব্যাপার। ভাটিদেশের ভূমিহীন প্রসঙ্গ যেন। হিংসার মতোই অবিবেচক। ননীকে এভাবে দেখে শংকরের মনে জেগে ওঠে, অতীতের কত লাথি, কত প্রহার, কত খিঁচুনি, কত ঘা, পিটনি আর মার! মাথা ফুঁসছে যেন জীবন্ত গোসাপের চামড়ার মতো। এই ফুঁস নিয়েই শংকর বলল, তোর মনের উত্থান-পতন সামাল দে ননী। ঘরের কাজে মন দে। অন্ততপক্ষপ, ঘেটুনাচ র্পযন্ত তোর মনের পাগলা ঘোড়াটাকে একটু দমন করে রাখ্।
একেবারে বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতো ননী বলে উঠল, আমরা তো সবাই পাগল বা উন্মাদ তো বটেই মহাজন। কেউ টাকার পাগল, কেউ-বা নামের পাগল, কেউ-বা ক্ষমতার
পাগল। আমি কী করব বলুন? পাগল বা উন্মাদ যা-ই বলুন মহাজন, তবে কলের গাড়ি নই। ইচ্ছে করলেই সবকিছু কলের গাড়ির মতো করতে পারি না। দেখুন না…

অকস্মাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে শংকরের কণ্ঠ, বলল : আমার দেখার সময় নেই। আমি কি তোকে গরম ভাত এনে দেওয়ার কথা বলেছি কখনও? বলেছিলাম, সাতসকালে পান্তাভাত খেয়ে আমি কাজে চলে যেতে চাই। এত ঝামেলা আমার সহ্য হয় না। তুই গরম ভাত খা। আমি চললাম।
আড়ষ্ট হয়ে গলে ননী, কোনও কথাই মুখ দিয়ে প্রকাশ পেল না। শুধু ভাবতে লাগল : মহাজনের জন্য মায়াবন্ধনের কোনও র্অথই নেই। নিজগুণেই সে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
কমলিকা এতক্ষণ আধো-ঘুম আধো-জাগরণের মধ্যে একটু আলস্য করিছল, শংকরের তীব্র তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে সে ছুটে এল; এসে দেখল শংকর চলে গেছে। তার কৌতূহল বেশি। সকালের রোদ তখনও নিবিড় হয়নি। চড়া গলায় কমলিকা বলল : কী হল-রে ননী, ঠাকুরপোর মাথাটা বুঝি বিগড়ে দিলি!

এতক্ষণে স্বর বেরোয় ননীর কণ্ঠ দিয়ে। স্বাভাবিকতা বজায় রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে গিয়ে অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ ও বিকৃত একটা স্বরই বেরিয়ে এল ননীর গলা দিয়ে, বলতে লাগল: তুমিই বলো না, সাতসকালে পান্তা খেয়ে কি কেউ কাজে যায়? তাই তো তোমার রান্না-করা গরম ভাত…
এবার তাড়া দিয়ে উঠল কমলিকা, গরম ভাতের আবার কী হল?
অস্পষ্ট অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে উত্তর দিল ননী : ভালোর জন্যই তো সাতসকাল কষ্ট করে আমি গরম ভাত এনে দিলাম, কিন্তু একটু দেরি হওয়ায় মহাজনের মাথা ছাপ্পান্ন হয়ে গেল।
একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল এতক্ষণে কমলিকার, তবুও স্তম্ভিত হয়ে বলল: ঠাকুরপোকে তুই এখনও চিনিল না-রে ননী। ও হচ্ছে কড়ির পাগল, সময়মতো না গেলে কড়ির জোগাড় করবে কীভাবে, সেকথা কি তুই বুঝিস না!
কোনও মতে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল ননী, আমার এত কড়ির প্রয়োজন বুঝে লাভ নেই। দুই বেলা দুই মুঠো খেয়ে বাঁচতে পারলেই হয়। তার চেয়ে বেশি কিছুর আমার প্রয়োজন নেই!

কিছুক্ষণের জন্য যেন কমলিকা অসাড় নিস্পন্দ হয়ে গেল; তারপর স্পন্দন ফিরে পেয়েই বলল : অমন কথা বলিস না-রে ননী। তুই কোন্ জগতে থাকিস! গ্রামসুদ্ধ সকলের ঘুম মরে ভূত হয়ে গেল রায়বাহাদুরের আগমনের র্বাতা শুনে। সবাই স্বপ্ন দেখছে, কীভাবে কত কড়ি হাতিয়ে নেওয়া যায়। কে কত ভালো ঘেটুনাচ দেখাতে পারে। কে কত সুন্দর ঘেটুপুত্র উপহার দিয়ে রায়বাহাদুরের মনের জমি চাষ করতে পারে।
এইবার ননী খানিকটা প্রকৃতিস্থ হয়। তার কণ্ঠস্বরও সম্ভবত খানিকটা বার্ষ্পাদ্র হয়ে এসেছিল। জোর করে সে কণ্ঠকে সহজ করতে গিয়ে কেমন যেন অস্বাভাবিক রকমের কঠোর শোনাল। সে বলে উঠল: তা কে না জানে, তবে ঘেটুনাচ দেখিয়ে মহাজনের লাভ কী?
শিউরে উঠল কমলিকা, তারপর বলল, রায়বাহাদুরের মন জয় করতে পারলে অনেক অনেক কড়ি পাবে।

কিন্তু ননীর কপাল। বোধ হয় ওর জন্মলগ্নে সকল কুগ্রহ এক সঙ্গে বাসা বেঁধেছিল, নইলে এমন হবে কেন? দুদিনের জ্বরে বলতে গেলে ধড়ফড়িয়ে মারা গেল বাবা, মার ধরল রাজযক্ষ্মা। যেন গ্রামসুদ্ধ র্দুভাগিনীর র্ঈষার নিশ্বাসেই মা জ্বলেপুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল। ননী একেবারে র্সবস্বান্ত হল। চিরদিনের র্গবিত ননী এক মুষ্টি অন্নের জন্য পরমুখাপেক্ষী হল। ওর যে কী জ্বালা তা শংকর বোঝে না। বরং সে কড়ির জ্বালায় নিজে জ্বলছে আর ওর চারিদিকে যারা আছে তাদের জ্বালাচ্ছে এই জ্বালায় ননীও দগ্ধ হচ্ছে। কিন্তু উপায়ই বা কী? তাই ননী বলল : মহাজনের অবাধ্য হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তা জানি, তবুও ঘেটুনাচ দেখিয়ে আমার প্রাণ শান্তি পাবে না। আমি শুধু চাই তাকে যে আমাকে দিতে পারে মনের সন্ধান। এতে কোনও লাজ নেই, কোনও লজ্জাও নেই।

Series Navigation<< নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব ছয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *