উপন্যাস

নাট্যোপনাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব চার

রাধারমণ—সংগীত


প্রাণ সখি রে, ঐ শোন কদম্বতলে বাঁশি বাজায় কে
বাঁশি বাজায় কে রে সখি, বাঁশি বাজায় কে
এগো নাম ধরিয়া বাজায় বাঁশি তারে আনিয়া দে
অষ্ট আঙুলের বাঁশের বাঁশি, মধ্যে মধ্যে ছেঁদা
এগো নাম ধরিয়া বাজায় বাঁশি, কলঙ্কিনী রাধা
কোন্—বা ঝাড়ের বাঁশের বাঁশি, ঝাড়ের লাগাল পাই
এ—গো জড়ে পেরে উগরাইয়া, সায়রে ভাসাই
ভাইবে রাধারমণ বলে, শোনো গো ধ্বনি রাই
জলে গেলে হবে দেখা, ঠাকুরও কানাই।


পড়ন্ত বিকেল। হাট থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক মনে হেঁটে চলেছে ননী। মনে তার অভিমানের আগুন অনির্বাণ। জ্বলন্ত অঙ্গারের মতোই তার অন্তরে বিচ্ছেদ প্রজ্বলিত। এ—যেন কঠিন বিচ্ছেদ। যে—আগুনে তার মন পুড়ছে, সেই আগুন নিবারণের জন্য কোথাও কি কোনও জল নেই! হয়তো—বা আছে!
ঠিক তখনই নায়েব মহাশয় তার দিকে দৃষ্টিপাত করতে করতে এগিয়ে এল। চোখ তুলে ননী তাকাতেই দেখতে পেল, নায়েব মহাশয়ের চোখে কেমন যেন বিস্ময়ভাব ফুটে উঠেছে। সে তাকে দেখতে থাকে। চওড়া মানুষ। মাংসল দেহ। মাথায় অবশ্যই বুদ্ধি কম নয়, বাহুতেও শক্তি আছে; তাই হয়তো কেউ খাজনা না দিলে তার বলদটাকে স্বচ্ছন্দে গোয়াল থেকে টেনে বের করে নিয়ে আসে। তবে তার মুখ চিন্তায় নত। আসলে সে বদমেজাজি হলেও ভীতু মানুষ। হঠাৎ নায়েব মহাশয় স্পষ্টভাবে নড়ে ওঠে, আওয়াজ তুলল : জমির দিকে তাকিয়ে এমনভাবে হাঁটতে নেই—রে ননী। জমি কষ্ট পাবে।
ননীর মনেও সংশয় আছে, তবুও বলল : কী—যে বলো না—গো নায়েব মহাশয়, আমার দৃষ্টির শক্তি নেই, জমি কষ্ট পাবে না।
ননীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে, যেন ভাটিদেশের জমির ভরাটে মমতাময়ী স্তন দুটি তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, যেন এই স্তনযুগলের করুণাময়ী দৃষ্টি আছে, কল্যাণময়ী স্নিগ্ধতাও, সুপুষ্ট মনও। নাম তার জমি, কিন্তু স্বভাব যেন তার রমণীর মতো। বুক আলগা—চিত—হওয়া অনাবৃত এক অকাট্য নারী যেন। বহন করে চলেছে ভাটিদেশের হিংসার উদ্ভিন্নতা ও চাষ। ছুরিবিদ্ধ নিলামি তটভূমি তার, যদিও ভাটিজলের প্রগাঢ় রেখায় লাশ ভেসে যাওয়ার চিরকালের চিত্রটি হিংস্র পশুর মাতলামো আত্মায় ধরা দেয়নি। ননীর মুখে হাসি দেখে নায়েব মহাশয় ঠিক বিরক্ত হয়। তবুও বলল : দৃষ্টিকে নাক বরাবর রেখে পা ফেলতে হয়। দূরের মাটিও যেন বোঝে তাকে অবহেলা করিস না। তাহলেই জমি কষ্ট পাবে না। রুঠাজমি, ডোবাজমি, কাদাজমি, ফাটলধরা—জমি—সব জমিই মানুষের একান্ত আপন, কোনওটার প্রতিই অবহেলা করা উচিত নয়।
ঈষৎ বিরক্ত স্বরে ননী উত্তর দিল : অবহেলা তো করছি না নায়েব মহাশয়, শুধু আপন মনে হেঁটে চলেছি।
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ননীর মুখপানে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করল নায়েব, আজকাল দেখছি তোর চোখে—মুখে কষ্টের ছায়ার শেষ নেই! এত কষ্ট কীসের রে ননী!
ননী নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে, তাই প্রশ্ন করল : কষ্ট পেতে কি মানা, নায়েব মহাশয়?
মিটিমিটি হেসে নায়েব বলল : অবশ্যই না, তবে শুনেছি, তোর বাড়ির লোকজন তোকে নাকি খুব বকাঝকা করে?
ননীর ব্যক্তিত্ব যেন নতুনভাবে বিকশিত ও প্রকাশিত হল নায়েবের কথায়। ঈষৎ বিরক্ত হয়ে আহত সিংহের মতন গর্জে উঠল সে, বকাঝকা করছে তো কী হয়েছে? যে সোহাগ করতে জানে তারই তো অধিকার থাকে বকাঝকা করার। তাই আমি পল্লির পথপ্রান্তে প্রাণ খুলে কষ্ট ছড়িয়ে বেড়াই। আর এই আশ্চর্য আনন্দ প্রকাশের মাধ্যমে আমার সোহাগকে সন্ধান করে চলেছি।
ননীর মুখে এমন কথা শোনার জন্য নায়েব একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। সে বুঝতে পারল ননী সাহসী, তার বুদ্ধি আছে।
নায়েব চরম ক্ষমতার অধিকারী। আত্মদম্ভে ডুবে থাকলেও সে বিচক্ষণ মানুষ। উৎসুক চোখে ননীকে দেখে নিয়ে বলল, তোর দেখছি লজ্জা—শরমের বালাই নেই। এতই যদি সোহাগের সন্ধান করিস, তাহলে আমার কাছে আসিস না কেন রং মাখতে! পারিস না আসতে?
নায়েবের এই প্রস্তাব শুনে ননী এবার সত্যই হতবাক হয়ে গেল। নায়েব এতটা প্রমত্ত যে, তার সমস্ত কাণ্ডজ্ঞান রহিত হয়ে গেছে। মৃদুহাস্যে ননী বলল, রং তো বলিনি ও—গো নায়েব মহাশয়। বলেছি, আনন্দ। তাছাড়া সোহাগহীন মন রং বিলাবেই—বা কেমন করে? এই সত্যটি কি তুমি জানো না?
ননীর মুখে এমন কথা শোনার জন্য নায়েব একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। সে বুঝতে পারল ননীর বুদ্ধি আছে, তবুও অস্থিরভাবে বলল : জানালেই জানি। তোকে সোহাগ করতে আমারও তো মন চায়।
নায়েবের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাল; তারপর হতাশা—মেশানো গলায় ননী বলল : তাই বুঝি!
ননীর কথা শেষ হতে—না—হতেই বাঁ—হাত দিয়ে ননীর গাল টিপে দিল। ওর সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল। হাসল, বলল : হ্যাঁ, তা—ই।
অধৈর্য গলায় অনুসন্ধিৎসু ননী জিজ্ঞেস করল : ও—গো নায়েব মহাশয়, সোহাগ আর দেহভক্ষণ যে এক জিনিস নয় একথা তো জানো। এখন সত্যি করে বলো দেখি, তোমার মনটা আসলে কী চায়?
নায়েবের মুখমণ্ডলে যে সামান্যতম আনন্দ ফুটে উঠেছিল তা ননীর কথায় নিভে গেল আবার। নায়েব বলল, দিন—দুপুরে কি এসব কথা খুলে বলা যায়! আয় না রাতে, আখড়ার ওধারে, সবই বুঝিয়ে দেব। তুই তো জানিস, মনের কথা বলতে লাগে রাত, দিনে লাগে লাজ। তোর কি কোনও লাজলজ্জা নেই—রে ননী!
এমনটি বলেই নায়েব হেসে ফেলল, তার এই রসিকতায় ননীও খিলখিল করে হাসতে লাগল। এই হাসি দেখে নায়েব আরও ঘন হয়ে এল ননীর কাছে। ননী চটে উঠে ভুরু তুলে তাকাল নায়েবের চোখে! বলল : লাজলজ্জা! তবে আমি সহজভাবেই বুঝি গো নায়েব মহশায়, দিন—দুপুরেই তোমার যত বাঁধ। মিথ্যের আশ্রয় নাও শুধু রাতের প্রশান্তিতে। আঁধারেই করো প্রকাশ নিজের আঁধারিরূপকে, তখনই ঘটে তোমার সত্যের প্রকাশ। আর দিনে চলে তোমার যতসব ভণ্ডামি। কিন্তু—গো নায়েব মহাশয়, তুমি ভুলে বসে আছ, আমি বেলাজ—বেহায়া এক মানুষ। দিন—দুপুরেই করি সত্যের প্রকাশ, খুঁজি সোহাগের নীড়।
নায়েব আর—একবার দেখে নিল ননীকে, তারপর বলল : কিন্তু—রে ননী, সোহাগের নীড় যে হয় সৃজন রাতেরই আঁধারে। শুধু অসভ্যরাই বিলায় সোহাগ দিনের প্রকাশে।
বড় ঘৃণার সঙ্গে ননী উচ্চারণ করল : ও—গো নায়েব মহাশয়, আমি যে অসভ্য জানোয়ার, রাত ছেড়ে দিন খুঁজি প্রকাশিতে সোহাগ। তাই তো দিনেরই পরতে পরতে মনের তুলিতে আঁকি ভালোবাসার স্বাদ।
একথা বলে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে রইল ননী। তার চোখ—মুখ এবারে কঠিন হল, নিশ্বাসে বিরক্তির ছাপ। নায়েব তৎক্ষণাৎ বুঝল তার ভীষণ ভুল হয়ে গেছে। এই ভাবল একটুক্ষণ; তারপর বলল : অতশত বুঝি না, এখন তাহলে পালাই।
নায়েব মহাশয় পালাতে থাকলে ননী হাসতে হাসতে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল : সারা জীবন ননী খেলে গো নায়েব মহাশয়, ঘোলের স্বাদ নিলে না, তাহলে কেমনে পাবে হরির সন্ধান, যদি কলঙ্ক না জোটে কপালে।

আমার প্রাণ যায় প্রাণ বন্ধু বিহনে গো, প্রাণ গুনগে
একা কুঞ্জে শুয়ে থাকি, শুইলে স্বপনে দেখি গো
আমি জাগিয়ে না হইলাম দিশেহারা, প্রাণ গুনগে
বন্ধুহারা জিতে মরা, হয়েছি পাগলের ধারা গো
আমি পাগল না হয়ে পাগলিনীর মতো, প্রাণ গুনগে
প্রাণ গুনগে, আমার প্রাণ যায় প্রাণ বন্ধু বিহনে গো
ভাইবে রাধারমণ বলে, প্রেমানলে অঙ্গ জ্বলে গো।

ননী এগিয়ে চলেছে নদীর তীর ঘেঁষে। নদী ছলছল করে বইছে। সে এক মনে ভাবতে লাগল : এই নদীরও মৃত্যু ঘটবে। নদীর নিচে কি শ্মশান আছে? তাই হয়তো—বা গভীর রাতে এই ভাটিদেশে কেমন সব অদ্ভুত আর্তনাদ শোনা যায়। এই অঞ্চলের বেশিরভাগ লোকই ক্ষেতমজুরি করে; কিন্তু খরার সময় রিকশা বা ঠেলাগাড়ি চালায়; আর বর্ষার মৌসুমে নৌকা চালানো ছাড়া তাদের অন্য কোনও উপায় থাকে না। তবে সকলেই শংকরকে সম্মান করে। ইজ্জত দেয়। কারণ, তার কণ্ঠে সব সময়ই চমৎকার সুর খেলে বেড়ায়। হঠাৎ তার কানে একটি সুর ভেসে এল। মনে হল এটি যেন শংকরের সুরেলা কণ্ঠস্বর। ক্ষীণভাবে রাধারমণের সংগীত। সে স্থির জলের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলতে লাগল : কোমল হৃদয়ের গন্ধটা এখন আমার অন্তর দখল করে আছে। মন নিবেদন তো একবারই হয়। তুমি হারিয়ে যেয়ো না। তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসি। তোমার ভালোবাসা পেলে আমি ঠিকই সুন্দর হয়ে উঠব, দেখে নিয়ো।
নদীর জলে আবারও কায়াটি ভেসে উঠল; তবে এর কোনও হাত নেই, ত্বক নেই, মুখ নেই, শুধুই কায়া। সুন্দর একটি কায়া। সে বলল : ভালোবাসলে সবই হয়! ভালোবাসার ছোঁয়ায় যা হয়নি, তা—ই বুঝি নদীর জলের প্রেমে ফুটিয়ে তুলতে চাও! তবে মনে রেখো, প্রেম হচ্ছে বাতাসের মতো—আভা, বস্তু নয়। প্রেম থাকলেই বাতাস তা বয়ে নিয়ে যায়।
এই সূক্ষ্মস্নিগ্ধ কায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে ননী। এক মুহূর্তের জন্য নীরবতা জলকে আচ্ছন্ন করে। তারপর নীরবতার মধ্যে চৈত্র—হাহাকার—করা মরুতৃষ্ণিত বুকে জল ঢালার মতো শব্দ ওঠে। এই শব্দের কারণেই সে আবার কায়াটির দিকে তাকাল; তারপর বিড়বিড় করতে লাগল : ঠিকই বলেছ। তুমি আবার দেখা দিলে?
চারধারে গভীর নীরবতা। ননী নিশ্চল হয়ে মাথা ঝুঁকে বসে কায়ার উত্তরের অপেক্ষা করছে। শ্লথগতি হলেও কায়া সদাচঞ্চল। নড়ে—চড়ে, ঘন হয়, পাতলা হয়। সুতরাং এক সময় হঠাৎ চমকে উঠে ওপরের দিকে তাকালে ননীর শীর্ণমুখে এক ঝলক গোধূলিলগ্নের কমলারঙের আলো পড়ে। স্বচ্ছপরিষ্কার মেঘমুক্ত আকাশে চাঁদের চিক্বণ রেখা ভেসে উঠেছে। স্নিগ্ধ প্রশান্ত চন্দ্ররেখা দেখে অকারণে সভয়ে সে আবার জলের দিকে তাকাল। ওপরে চন্দ্ররেখা হয়তো হেলেদোলে হাসেও। নির্দয় এই হাসি।
দূরে কোথাও একটা কুকুর ডাকতে শুরু করে। ননীর মনে হয় একটি হিংস্র কুকুর তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বলে। তারপর সে দেখে, জলের ভেতর লাঙল—দেওয়া মাটির মতো বাঁকা হয়ে ভেসে উঠেছে অর্ধ—উলঙ্গ কায়াটি, একেবারেও নিশ্চল নয়। তার শীর্ণমুখে চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। কায়া বলতে লাগল : যখনই একাকী মনে জলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করো, তখনই তুমি আমার দেখা পাও। শোনো, প্রেমের সমস্ত কাব্যকাহিনি তোমার শত্রম্ন, তাহলে এমন উদাস মনে কী ভেবে চলেছ?
শীঘ্র তার পিঠ শিরশির করে ওঠে। পিঠে সাপ চড়েছে যেন। বুকে হাতুড়ি—পেটা শুরু হয়। এবার নিতান্ত নিঃসহায় বোধ করতে শুরু করে, ফলে মুখ থেকে একটা ক্ষুদ্র কিন্তু তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরিয়ে এল; তারপর ননী বলল : তাহলে কী করব! আমার হৃদয়ের ভেতর যে একটুকুও আলো নেই, থাকলে স্থির হতে পারতাম।
কায়া বলল, তুমি যা ইচ্ছে তা—ই করো। ভাবনার কী আছে!
এখন আবছা দেখাচ্ছে কায়াকে, তবে সে আর নিরাকার বর্ণহীন নয়। তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই ননী বলল, আমি তাহলে কী!… না, না, ভাবছি না… শুধু কল্পনা করে চলেছি।
কায়া জানতে চাইল, কীসের কল্পনা?
ননীর নাকে মাটির গন্ধ লাগে। মাথা তুলে সে ধীরেআস্তে এধার—ওধার তাকায়, বাঁ—দিকে, ডান দিকে। কেউ নেই। মাঠে কেউ নেই। দূরে একটা কুকুর বেদনার্তকণ্ঠে আর্তনাদ করে চলেছে। তাছাড়া চারধার নিঃশব্দ। এক চোখা চন্দ্ররেখা সহস্রচোখে জনশূন্য পথপ্রান্তর পর্যবেক্ষণ করে চলেছে যেন। চন্দ্ররেখা নয়, যেন কল্পনা। তারপর ননী জলের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল : বা—রে, তুমিই তো বলেছিলে কল্পনা করতে, কল্পনাকে ভালোবাসতে, তা—ই করছি।
ননীর মুখ বিষাদাচ্ছন্ন। চোখে উদ্ভ্রান্তি। কেবল থেকে—থেকে নিচের ঠোঁটটি থরথর করে কাঁপে। কিছুক্ষণ সে বসে থাকে নতমুখে। আবার যখন সে মুখ তোলে তখন কায়ার পুনরাগমন ঘটে। এই কায়াকে ভেদ করে কেমন অহেতুক, উদ্দেশ্যহীনভাবে সে তাকানোর চেষ্টা করে। চোখে এখন নিস্তেজ ভাব। তখন কায়া শুধোল, এই অবেলায় নদীকে নিয়ে কীসের কল্পনা করছ?
ননীর মন গভীর অবসাদে আচ্ছন্ন হলেও, সেখানে কোনও ভয় নেই যেন। যে—মানুষ নিদারুণ ভয়ে বিকৃতমস্তিষ্কের মতো দিগি¦দিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটাছুটি করে, সেরকম মানুষ সে নয়। ননী ভয়হীন চিত্তে বলল : আমার কল্পনা কৃপণ নয়; সে সময়—অসময়, জল—মাটি মানে না।
তাহলে বলো, কী কল্পনা করছিলে?
চঞ্চল, বিদ্বেষপরায়ণ ও হিংস্র এক পঙ্খিরাজের।
একথা বলে রুদ্ধনিশ্বাসে ননী জলের দিকে তাকিয়ে থাকে, দৃষ্টি নিশ্চলনিঃশব্দ কায়ার ওপর নিবদ্ধ। তারপর তার বুক কাঁপতে শুরু করে, ক্রমশ হাতে—পায়ে সারা দেহে কাঁপন সৃজিত হয়। অবশেষে মৃত্তিকাও কাঁপতে শুরু করে, জলও স্থির থাকে না। শুধু কায়া নিশ্চল, নিস্তব্ধ। হঠাৎ সে জানতে চাইল, পক্সিখরাজ, মানে!
কিছুক্ষণ পর জল—স্থলের কম্পন থামলে ডুবতে ডুবতে বেঁচে যাওয়া মানুষের মতো ঝোড়ো বেগে নিশ্বাস নেয় ননী। তারপর হয়তো সাহসের জন্য কায়ার দিকে তাকায়, কিন্তু কায়ার মায়াবী হাস্যমুখ দেখতে পায় না। সে কিছুই বুঝতে পারে না বলে অবশ দেহে বলতে লাগল : আমার জীবনই হচ্ছে এক রকম কল্পনা। কল্পনা করছি যে, মানুষের দেহ অপেক্ষা মন কি প্রবল সতেজ হয়? আর তা যদি হয় তাহলে তার জীবন কেমন করে চলে? তাই ভেবে চলেছি, নদীর জল যেভাবে আপন মনে বয়ে চলে সমুদ্রের সঙ্গে মিলনের বাসনায়, ঠিক তেমনই বাতাসে ভর করে পক্সিখরাজে চড়ে নীল আকাশে উড়ে বেড়ানো কি সম্ভব? সম্ভব হলে খুঁজে নিতে পারি, গাঢ় সুগন্ধি ধূপ জ্বালানোর ধূপদানিতে গুঁজে থাকা অর্ধেক পোড়া চন্দনকাঠির নিবিড় গন্ধকে।
তাই নাকি!
একথা শুনে ননী এবার গভীর দৃষ্টিতে কায়াকে দেখতে থাকে। না, কায়ার কোনও তারতম্য ঘটেনি। স্বচ্ছ। কৃষ্ণকালো কায়ার হাস্যোজ্জ্বল মুখ ঝকঝক করছে। অপরিসীম তৃপ্তির সঙ্গে সে ভেবে চলে : জলের ভেতর জলের বিসর্জনের শেষ নেই। কিন্তু কায়াটি মোহিনীময়। এই মোহিনীময় কায়াকে উদ্দেশ্য করে ননী বলল, হ্যাঁ তা—ই! মিথ্যে এই জীবন, মিথ্যে এই সময়, মিথ্যে এই পৃথিবী, মিথ্যে এই গোধূলির মদিরাশ্চর্য লগ্নের ভাস্কর্যটিও। বিশ্রুত সন্ধ্যায় নিঃশব্দ শিশির জমে থাকা নদীতীরের ঘাসগুলোও মিথ্যে, তাই হয়তো নদীর বুক গলিত দৃষ্টির মতো আমি বোবা হয়ে গেছি।
কায়ার গলা ঝনঝন করে ওঠে, তোমার কথার ধরন আমাকে শিহরিত করছে। কেমন যেন বিরসবিকৃত করে তুলছে আমাকে! তার চেয়ে বরং বলো, তুমি পক্সিখরাজে চড়ে কোথায় উড়ে যেতে চাও?
নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করে ননী। সচকিত হয়ে জলকে একবার দেখে নেয়। জল নিশ্চল। জলে গোধূলিলগ্নের আলো। এই জলকে দেখে ক্ষণকালের জন্য ননী স্বস্তিই বোধ করে। এই স্বস্তিবোধ নিয়েই ননী বলল : নীল মেঘের আড়ালে, যেখানে হয়তো—বা অপেক্ষারত আমারই সোহাগ। সেখানেই নিজের করে পেয়ে যেতে পারি তাকে।
সোহাগ, সোহাগ, সোহাগ! সোহাগ দিয়ে তুমি কী করবে?
ননীর স্বাভাবিক স্থৈর্য—গাম্ভীর্যে সহজে তারতম্য ঘটে না। কিন্তু একটি ব্যাপারে সে অসংযত হয়ে পড়ে। এই ব্যাপারটি সোহাগ। ননী অসংযত কণ্ঠেই বলল, সোহাগ খুবই বিস্ময়কর একটি অনুভূতি। চরমানন্দের সহস্রগুণ অধিক সুখের সন্ধান পাওয়া যায় এই অনুভূতিতে। হওয়া যায় পরিপূর্ণ। পাওয়া যায় নবজীবন।
চোখ নিমীলিত করে ননী। তার নিমীলিত চোখের পানে তাকিয়ে থাকে কায়া, তারপর লক্ষ করে, তার মুখ ভাবনাচ্ছন্ন। তখনই কায়া প্রশ্ন করল, এই জীবন কি বাস্তব?
অস্পষ্টভাবে ননীর ঠোঁট নড়ে, দেহ নিস্পন্দ। নিস্পন্দ কণ্ঠেই সে বলতে থাকে : তা—না—হলে, অর্জুনকে কে শিখাল প্রেমের মুরতি গড়ার কৌশল?
কায়ার মধ্যে যেন ঘোরতর পরিবর্তন এল। যেন অকস্মাৎ তেজহীন হয়ে পড়ল। মুখে আর কথা নেই, শুধু একটি শব্দ বেরিয়ে এল : কী!
একবার ঝুঁকে কায়ার চোখ দেখার চেষ্টা করে ননী, কিন্তু তা ছায়াচ্ছন্ন বলে মনে হল তার। সে একটু ক্ষুণ্ণ হয়। এই ক্ষুণ্ণকণ্ঠেই বলতে লাগল : ভাবছি, তোমাকে আর কত বলা যায়! তুমি কি আমার কল্পনা বোঝার যোগ্য? ব্রাত্যপুত্রের কল্পনানেত্রে দেখা কামনা—বাসনা, জীবন—বাস্তবতা কি তুমি পছন্দ করো? অবশ্যই না, করবেও না কোনও দিন।
সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর এল : কেন করব না, বলেই দেখো।
ননীর মুখ ফ্যাকাশে, রক্তহীন, কিন্তু চোখে অত্যুজ্জ্বল দীপ্তি, অলৌকিক তৃপ্তি—সন্তোষ ভাব। এই ভাব নিয়েই ননী জানতে চাইল, অর্জুন কি সত্যি প্রেমের মুরতি গড়তে জানতেন?
কায়া তার কণ্ঠের বিশৃক্সখল—দৃঢ়তা পরিত্যাগ করে একটু কেমন যেন বিহ্বল হয়ে বলল : জানি না, তবে আদিকবির রচনা পড়ে উদ্দীপ্ত হয়েছি, জেনেছি, প্রেমের মুরতি গড়ার জন্য অর্জুনের হাত—পা কেঁপে উঠত।
তুমিও দেখছি আমার মতোই বদ!
বদ, হা—হা—হা, ভালোই বলেছ। আচ্ছা, তুমি কি কল্পনানেত্রে সবই দেখতে পাও?
চরম উদাসীনতা নেমে আসে ননীর মুখে। নিস্পৃহমুখ দেখে মনে হয় তার যেন কোনও আশা—আকাক্সক্ষাই নেই; তাই হয়তো তার কণ্ঠে শুধু প্রকাশ পেল : কল্পনানেত্রে!
ননীর উদাসীনতা সমর্থন করে কায়া বলল : হ্যাঁ, কল্পনানেত্রে।
একটু কেশে গম্ভীরভাবে ঘোষণা করে ননী : আমি কল্পনানেত্রে দেখতে পাই, পক্সিখরাজে চড়ে নীল মেঘের আড়ালে প্রেমের মুরতি সৃষ্টি হতে।
ননীর চোখ দুটি অতিশয় বিস্ময়ে ভরা। তাতে কেমন তীক্ষ্ণ খুরধার। শুধু তাই নয়। এক পলকের জন্য সে এক বিশেষ দৃষ্টিতে কায়ার দিকে তাকায়, তার অর্থ কায়া বোঝে না। ইশারায় সে যেন তাকে কিছু জানাতে চায়। ননীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কায়া বলল, সেকথা ভাবাও পাপ। পাপ নিয়ে খেলা করছ তুমি!
তীক্ষ্ণ কিন্তু হৃদ্যতার সঙ্গে শ্রান্ত গলায় ননী বলল : বলেছিলাম না, তুমি ব্রাত্যপুত্রের জীবন—কল্পনা বা জীবন—বাস্তবতা বুঝবে না। তবে একথাও সত্য যে, আমি পাপ নিয়ে খেলা করি না। শুধু সন্ধান করে চলেছি সেই প্রেমের মুরতিটিকে। বলো তো দেখি, রাধা—কৃষ্ণকে নিয়ে ভাবলে যেমন পাপ হয় না, তেমনই…
ননীকে তার বাক্য সমাপ্ত করতে না দিয়ে কায়া বলল, একথা আমি ভাবতে চাই না।
কিন্তু আমি চাই; চাই দিন—দুপুরে মাতাল হতে; চাই অসভ্য হতে। ননীর বয়স আঠারো, কিন্তু তার শীর্ণ মুখে, অনুজ্জ্বল চোয়ালে বয়োতীত ভাব : যৌবনভার যেন বেশি দিন সহ্য করতে পারেনি। এই মুখে যৌবনসুলভ দাড়ি নেই। থুতনির নিচে কেমন উলঙ্গ ভাব। তীক্ষ্ণ নাক, কপাল ঈষৎ সমুন্নত, চোখে একটু কাঠিন্য ভাব। এই চোখে সরলতা আর অসহায়তার বাস। মাঝেমধ্যে উদ্ধত ভাব ও দম্ভ—ঔদ্ধত্য দেখা যায়, কিন্তু একটুও অহংকার নেই। একটু ইতস্তত করে অবশেষে খনখনে গলায় ননী বলল : আর কথা নয়, এবার আমি চললাম।
ননী উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে কায়া বলল, কোথায় যাচ্ছ? ক্ষণিকের জন্য দাঁড়াও। দুদণ্ড শুধোও তোমার অসভ্য কল্পনার কথা!
সজোরে নিশ্বাস নিয়ে ননী বলল : না, না। আর নয়। আমি আর শোনাতে চাই না। শুধু চাই পক্সিখরাজে চড়ে নীল মেঘের আড়ালে প্রেমের সন্ধান করতে। হতে চাই রাধারমণ।
ননী আর দাঁড়াল না। ঘরাভিমুখে হাঁটতে শুরু করল। কমলা রঙের সূর্যকিরণে আবৃত তার শীর্ণ শরীর দীর্ঘ মনে হয়, পদক্ষেপে অসীম দুর্বলতার আভাস দেখা গেলেও তাতে সংকোচ বা দ্বিধা নেই। তার মনে নায়েবের নিদারুণ কথার আঘাতে যে প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, সেই বিক্ষুব্ধতা বিদূরিত হয়েছে। কোনও দিকে না—তাকিয়েই সে দ্রুতপদে হাঁটতে থাকে। সে আর ভাবে না।

Series Navigation<< নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরীনাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব পাঁচ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *