উপন্যাস

নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী

জলের ভেতর জলের বিসর্জন

নাট্যোপন্যাস

. মুকিদ চৌধুরী

চরিত্রচিত্র

কথকঠাকুর (সূত্রধর), ননী (ঘেটুপুত্র), কায়া (আত্মা), শংকর (মহাজন), ঘনশ্যাম (মহাজনের দাদা), কমলিকা (মহাজনের বউদি ও ঘনশ্যামের স্ত্রী), বাইজি (নৃত্য ও সংগীত শিল্পী), বায়বাহাদুর (ভূস্বামী), নায়েব (রায়বাহাদুরের প্রধান কর্মচারী)।

ননী : একজন ঘেটুপুত্র। শংকরকে ভীষণ ভালোবাসে। শংকরের কাছে প্রতিনিয়ত নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ও সঙ্গীপরায়ণতা প্রমাণ করার জন্য তৎপর থাকে। নায়েব মহাশয় যখন ক্ষিপ্ত হয়ে ননীকে ধমকের স্বরে তিরস্কার, ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে তখনও সে শংকরকে অনাদর ও অবহেলা করতে পারেনি। নায়েব মহাশয়ের গালমন্দের প্রতিবাদ ঠিকই করে। শংকরের দেখাশোনা ও সেবাযত্নের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি সে। সে ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে। রান্না করে। জামাকাপড় কেচে দেয়। এভাবে শংকরের বাড়ির লোকজনের মাঝে সে একটি স্থান করে নেয়। তবে সে থেকে যায় শংকরের নিয়ন্ত্রণে, কোনও অবস্থায়ই তার নির্দেশ অমান্য করে না। সে অবশ্য চঞ্চল স্বভাবের যুবক। শংকরও তার চাঞ্চল্য ও উচ্ছলতাকে দমন করতে ব্যর্থ। কারণ, ননী প্রথাকে টিকিয়ে রাখতে চায় না, চায় সোহাগ, চায় অপ্রতিহত প্রেমের অধিকারী হতে। তাই এমন কোনও কাজ নেই শংকরের প্রেমলাভের জন্য করে না। মাঝেমধ্যে সে নিজের ওপর ক্ষুব্ধ হয়, প্রতারণাকে সে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে অস্বীকার করে। সে মানবতাবাদী চরিত্র। 

 কায়া : ননীর প্রতিচ্ছবি। ননীর মুক্ত আত্মারূপ, হয়তো-বা তার বিপরীত রূপও বটে। সে দার্শনিকের মতো উচ্ছল কথা বলে। সে স্তব্ধ ভীতির জগৎ সৃষ্টি করে, শাসন করে, নিষেধও করে। এই প্রতিচ্ছবির মধ্য-দিয়ে ননীর বিদ্রোহী মানসিকতার ইঙ্গিত প্রকাশিত হয়। এখানে প্রতিচ্ছবিটি হয়ে ওঠে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহী প্রতীক। সে যেকোনও সংকটের বিরুদ্ধে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারে। সে ননীর চিন্তা ও কর্মের একনিষ্ঠ সমর্থক। কায়াকে রূপকাশ্রয় দিয়ে ননীর অন্য-এক বলবান সত্তার জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে।

কমলিকা : স্নেহ-মমতাপূর্ণ হৃদয়ের একজন নারী। অনুভূতি ও প্রকাশক্ষমতা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানবী। সে শংকরের বউদি ও ঘনশ্যামের স্ত্রী। সে ননীকে পুত্রের মতোই আদর-স্নেহ করে, ভালোবাসে। সে ঘনশ্যামের দুঃখ-বেদনার সমব্যথী। ঘনশ্যাম অজ্ঞান হয়ে পড়ার ভণিতা করলে তাকে উন্মাদ হতে দেখা যায়। দেখা যায়, নায়েব মহাশয় যখন খাজনার টাকা পরিশোধের জন্য ঘনশ্যামকে অন্যায়ভাবে শাসন করতে থাকে, তখন সে ঘনশ্যামের মুক্তির জন্য মানসিকভাবে অস্থির হয়ে ওঠে। সে ঘনশ্যামের প্রতি তার একনিষ্ঠ আনুগত্য অটুট রেখেই নিজের দেহদানের মাধ্যমে খাজনা পরিশোধ করে, এ-ই হচ্ছে তার জন্য চ‚ড়ান্ত শাস্তিভোগ। সে জানে, এই ঘটনাটির পর, সে আর ঘনশ্যামের কাছে ফিরে যেতে পারবে না, তবুও তার স্বামীর মুক্তির জন্য নিজেকে ‘জলের ভেতর জলের বিসর্জন’ দিতে কুণ্ঠিত নয়। পরিবেশ-পরিস্থিতিই তাকে ব্যক্তিত্বময়ী করে তুলেছে; তাই কমলিকা এই নাট্যোপন্যাসের আরেক সফল কেন্দ্রীয় চরিত্র।

শংকর : ঘেটুদলের প্রধান। একজন মহাজন। ননীর রক্ষাকর্তা। তার প্রেমে উচ্ছল ননীকে সে যখন অন্যায়ভাবে শাসন করতে শুরু করে তখন থেকেই তার মন কমলিকার দিকে ঝুঁকতে থাকে। সে মানসিকভাবে অস্থির। কড়ির পেছনে ছুটতে অভ্যস্ত। মাঝেমধ্যে ননীকে মায়াকামে বুকে টেনে নেয়। তবে সে তার কর্মকাণ্ডের দ্বারাই ঘেটুনাচ জিইয়ে রাখে।

রায়বাহাদুর : এই নাট্যোপন্যাসের সামন্তবাদী প্রতিনিধিত্বশীল এক চরিত্র। তিনি ভূস্বামী। ভাটিদেশের নেতৃত্ব তারই অধীনে। ঘেটুনাচের উৎসব তার নির্দেশেই অনুষ্ঠিত হয়। তিনি প্রতারণার আশ্রয়স্থল। তিনি তার দীর্ঘকালের দাম্পত্যজীবনকে অস্বীকার করে পরদেহ ভোগে লিপ্ত হন। তিনি মানবতাবিরোধী শক্তির যথার্থ প্রতিভূ। শোষণের শীতল সাম্রাজ্যের সম্রাট। এক মূর্তিমান আতঙ্ক, তবে নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে ননীর হাতে।

নায়েব : ভাটিদেশের একজন মোড়ল। সে রায়বাহাদুরের প্রধান কর্মচারী। সামন্তপ্রভুর অনুগত। খাজনা আদায়ের সুযোগে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তৃত করে। সে রায়বাহাদুরের অপকর্মের দোসর। সে মানুষের চেতনাকে বিকশিত হতে দেয় না। অধিকারবোধ জাগ্রত হওয়ার যেকোনও পথে সে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ঘেটুনাচের উৎসবকে কেন্দ্র করে সে দরিদ্র কৃষকের ওপর আরও বেশি শোষণ করে। অতএব সে দয়ামায়াহীন মানবতাবিরোধী এক চরিত্র। সে দুর্বলচিত্তের লোক; কারণ তার চরিত্রে কোনও প্রকার দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যায় না, বরং সর্বক্ষেত্রেই তাকে রায়বাহাদুরের কথার সুরে সুর মেলাতে দেখা যায়।

ঘনশ্যাম : শংকরের দাদা। এই চরিত্রে দৃঢ়তার প্রকাশ অল্প, তবে সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী চরিত্রটি যথাযোগ্য মর্যাদায় বিকশিত হয়। সে বিপদ ও ক্লেশমুক্ত থাকতে পছন্দ করে। সে তার স্ত্রীর সেবা-শুশ্রূষা তৃপ্তিভরে উপভোগ করে; প্রয়োজনে ভণিতার আশ্রয় নিতেও কুণ্ঠিত নয়। তবে তার স্ত্রীর চ‚ড়ান্ত শাস্তিভোগের সময় নিঃশব্দে পলায়ন করতে তার কোনও সমস্যা হয় না, যদিও সে কমলিকাকে খুবই ভালোবাসে।

বাইজি : সে একজন নৃত্য ও সংগীত শিল্পী। এর মাধ্যমে প্রতিফলিত হয় সামাজিক দ্বন্দ্ব, মূল্যবোধের অবক্ষয়, মানবান্তরের অন্তর্দ্বন্দ্ব—যা মানুষের সম্পর্কের মধ্যে থাকে, দৈনন্দিন ও পারিবারিক জীবনে থাকে, এমনকি একই ব্যক্তির মনোলোকেও থাকে। মানুষের সার্বিক মুক্তি ও স্বাভাবিক বিকাশের আকাক্সক্ষা এই চরিত্রের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে প্রকাশ ঘটে। এর সঙ্গে প্রকাশ করা হয়, সাধারণ মানুষকে কীভাবে বিভ্রান্ত করে, লোভ দেখিয়ে শোষণের প্রক্রিয়া সচল রাখা হয়।

রাধারমণ-সংগীত

মাইয়া যে হয় অনঙ্গ মঞ্জরী

মাইয়ার প্রেমে উদয় হয় কিশোর কিশোরী।

মাইয়া কৃষ্ণ-ভজনের মূল

পাথারে সাঁতার দিয়ে অনায়াসে মিলবে কূল।

কথকঠাকুর

নমস্কার। গড় হয়ে নমস্কার করি গো সকলকে। কাহিনি তো খুঁজে পাই না, কী যে বলি, কী যে বলি, ভেবে হই আকুল, বলার কথা তো অনেক, কিন্তু কোন্টা বলি আর কোন্টা রাখি। এটি ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল ভাটি-বাংলার এক তরুণের কথা। ভাটি-বাংলার কাহিনি অমৃত সমান। যুগে যুগে হয় তার নূতন ব্যাখ্যান, আর তাই তো মনে পড়ল ননীর কথা। এক অভাগা তরুণ সে। এই মুহূর্তে সে নৌকার ওপর বসে একটি মশালের সাহায্যে বিলে জাল ফেলেছে, মাছ ধরার প্রত্যাশায়।

নৌকার চারপাশে এক রকম গা-ছমছম-করা অদ্ভুত ভৌতিক পরিবেশ। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে সে চমকে ওঠে, যেন জলেরও চোখ আছে, দেহ আছে। কী করবে বুঝতে পারছে না সে; তবুও গলাখাঁকারি দিয়ে জালটি আশাহীনভাবে জলের ভেতর থেকে টেনে ওপরে তুলে আনে। জালের সঙ্গে যে-জল ওপরে ওঠে আসে সে-রংও কালো, ভীষণ কালো, ভীত কালো। কিছুক্ষণ সে নিশ্চুপ থেকে এক টানে মশালের পিছলানো আভায় জালটিকে ছায়ামূর্তির মতো দাঁড় করিয়ে দেয়। অবিরাম জল গড়াতে থাকে। অন্ধকারাচ্ছন্ন ভৌতিক পরিবেশে আর মশালের আবছায়ায় দাঁড়িয়ে জালটিকে আলিঙ্গন করে। জালের বুকে হাত রাখে। মনের মধ্যের বিশাল চিলের ডানায় মোড়ানো গচ্ছিত ভয় প্রবল উত্তাপে উত্থিত। তবুও সমস্ত জালটি তন্নতন্ন করে মাছের সন্ধান করে, কিন্তু তার দৃষ্টির জোর ভীষণ ক্ষুধার্ত, উগ্র, অকপট—যেন তীব্র নির্লজ্জ দুর্ভিক্ষ। জালের গায়ে মাছের গন্ধ ছাড়া আর কীইবা থাকতে পারে! এর স্বাদ ভাটিদেশের মানুষের জন্য আলাদাই বটে, তাই হয়তো তার কাছে গন্ধটা তীব্র মনে হয় না; কিন্তু এই গন্ধে নিশ্বাস নিয়ে জালটি আবার জলে ফেলে সে। জালটি দেখতে দেখতে ক্রমশ হারিয়ে যায় বড় স্থির জলের ভেতর। তারপর কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে থাকে জলের দিকে, প্রথম প্রেমের সাক্ষাতে বোকা পুরুষের মতো। তখনই একটি মøানকণ্ঠ জেগে উঠল। বলল : আবৃত্তি করো।

কে? প্রশ্ন করে ননী।

প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই। ননীর চোখে-মুখে ভয়-তাড়িত এক রকম অসহায় ছাপ ফুটে উঠল; কিন্তু সে জানে না এর পরিধি কতটুকু? অবিকল ঈগলের ডানার মতো সে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। মøানকণ্ঠটি আবার বলল : আবৃত্তি করো আমার নামে।

ফের নিশ্চুপ ননী, কিন্তু উৎকণ্ঠা নিয়ে সে মনে মনে বলল : ভূত নাকি! ভূত কি এই নির্জন জলভূমিতে আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে এসেছে? এখন কোনও কথা বলার চেষ্টা করলে বড্ড আহাম্মকি হবে। ননী তার কাঁধের গামছায় কপালের ভাঁজগুলো মোছার চেষ্টা করতে করতে স্বগতোক্তি করল : কী বলল কণ্ঠটি? এখন আমার কী হবে! সে কেন আমাকে ডাকছে? আর কোনও কথা বলছে না কেন সে? জালটি তো জলের ভেতর বিসর্জনই দেওয়া আছে, তাহলে সে কেন কোনও কথা বলছে না?

জালে বাঁধা মশালের আলো চম্পাকলির মতো স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। চারদিকে শুধুই চিহ্নহীন জল। মাঝেমধ্যে জলঘাস। মাথার ওপর ঘন মেঘছায়া। অকস্মাৎ মনে হল : তুমি জল, তুমি পথ, তুমি পরিধেয়। আমি নৌকা নিয়ে দ্রুত সরে যাই। তখনই ভেসে এল : কে বলেছে আমি জল? জলের দিকে তাকাও। জালের দিকে তাকাও।

ননী শুধাল, তাহলে কে তুমি?

উত্তর এল : তোমার কায়া।

এমনই এক গাম্ভীর্যের অপ্রসন্নতা জলের ভেতর থেকে খেলে উঠল, ননী মনে মনে বলতে লাগল : কায়া! এই পৃথিবীতে নিজের ছায়ার কাছেই ঠাঁই নেই; আর কায়া! কিন্তু এই ভেসে আসা কায়ার কণ্ঠে রক্ত-মাংসের কোনও চিহ্ন নেই। তাকে ছোঁয়ার অধিকারও আমার নেই। তারপর প্রকাশ্যে বলল : বলো, হে চন্দ্রাহত মায়াবী কান্তি, তুমি কেন এসেছ?

উত্তর এল : এসেছি আবারও এই ভাটিদেশের স্বাদ নিতে।

ননীও জানে সে অবলীলায় অপমান-আহত হয়ে চলেছে। এই ডাক তাই তার সমস্ত হৃদয়জুড়ে এক নীরব বিপুল আবেগের সৃষ্টি করল। এক রকম কষ্টই উৎপন্ন হল। হবেই-বা না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণেই হয়তো সে বলে উঠল : স্বাদ? প্রতিশোধ নাকি উত্তরপুরুষের খোঁজে?

প্রশ্নটি শুনে কায়া ভাবতে লাগল : ননী তাহলে আমাকে ভয় পাচ্ছে। সে মনে করছে, ওকে মেরে ফেলার জন্যই আমার আবির্ভাব ঘটেছে। এত ভয়ংকর কথা কায়া হয়তো-বা কোনও দিনই শোনেনি। কেউ বুঝবে না, বাঁচার স্বাদ কী! এ-যে এক বিভীষিকাময় যন্ত্রণা। কেউ শুনতেও চাইবে না এর অর্থ কী! তারপর শান্তকণ্ঠে কায়া বলে উঠল : বিভীষিকাময় যন্ত্রণা! তারপর শান্তকণ্ঠে প্রতিবাদ করল : না, না!

কায়াটি কেন এভাবে ‘না, না’ বলল? ননীর বুকের মধ্যে এই শব্দ দুটি আকুল হয়ে বাজতে লাগল। এটি কি সিংহের শান্ত হিংস্র গর্জন, নাকি যমদূতবৎ বাণী, নাকি তার বিস্তার অনন্তকালব্যাপী? অসমাপ্ত কিন্তু ক্ষতবিক্ষত কবিতার মতো ননী আনমনেই বলে উঠল : থামো, আর অগ্রসর হয়ো না। নিজের দিকে ফিরে তাকাও। চারদিকে স্তব্ধবাক রাত্রি। আর নৌকার বক্ষে মশালের আলোক। তবে জানতে ইচ্ছে করে, এই ভাটিদেশের প্রবহমান জলে সাঁতার কাটতে এসেছ কি?

উত্তর এল : থামো, ননী, থামো! জীবনে সুস্থিতির মূল্য আছে। অনেক শ্রম করে সেই সুস্থিতি অর্জন করতে হয়। এইটুকু পেতে অনেকের সমস্ত জীবন চলে যায়, কেউ-বা একে সারা জীবনেও লাভ করতে পারে না। তুমি সেই সুস্থিতিকে, সমৃদ্ধিকে জন্মসূত্রেই পেয়েছ। একে এখন অবহেলা কোরো না। কোন্ উন্মাদনা তোমার মস্তিষ্ককে উত্তপ্ত করেছে এই নিগূঢ় নিশীথে? এই দেখো, দূরে… রায়কুটিরটি দেখা যাচ্ছে। সে আমাকে অদৃশ্যের আড়াল থেকে মহাপ্রকৃতির অপূর্ব আহ্বান করে চলেছে। তুমি হয়তো-বা আমাকে খুঁজে পাবে তারই ইটের ভাঁজে ও অভাঁজে, যার উৎস লীন হয় মহাজলভূমিতে সেখানে নয় অবশ্যই।

ননী মনে মনে বলল : এই তো, এই তো তুমি আমার কথা শুনতে পেয়েছ। গ্রীবা ঘুরিয়ে দেখছ। তোমার ভ্রমরের মতো কালো আয়ত চক্ষু দুটি আমার ওপর এক মুহূর্ত ন্যস্ত হল। কত স্মৃতি এই রায়কুটিরটিকে কেন্দ্র করে তোমার মনে পড়ছে! এ-যে তোমার কৈশোরের প্রেম, তোমার মর্মসঙ্গীও! সেইসব বাসন্তী দিন, চৈত্র চাঁদের রাত্রি, তুমি কি সব ভুলে গেছ? নাকি, ভুলে যাওয়ার অভিনয় করছ? দ্যাখো, ভালো করে ওকে দ্যাখো। তোমার সোনার হরিণীকে দ্যাখো। আর প্রকাশ্যে বলল : তাহলে তুমি পূর্বকালে কী ছিলে?

সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর এল : বৃক্ষ তো অবশ্যই ছিলাম না। ছিলাম না কোনও লালাঝরা বাইজির নির্বোধও।

ননীর কাছে মনে হল, কথাগুলো খুবই নির্বোধ। সে অসহায় প্রাণের সহায় হতে চায়; কারণ সে নিজেই অসহায়! অসহায়ের সহায় ছাড়া সে আর কীইবা হতে পারে! এই অবোধ কথাগুলো কি সত্যিই ননীর কায়ার? সে আর ভাবতে পারছে না, বলল : তাহলে তুমি পুরুষ বা নারী ছিলে, নাকি বালক বা বালিকা?

কায়া দেখতে পেল ননীর দৃষ্টি আবার ঘুরছে। তার অন্বেষী চক্ষু জলের ভেতর কাকে যেন খুঁজছে! কায়া মনে মনে বলল : আমাকে? তুমি কি আমাকে খুঁজছ? ভাবছ, জলের ভেতর থেকে কে তোমাকে এমন করে ডাকছে? খুঁজতে খুঁজতে স্তিমিতালোকে হয়তো তুমি আমাকে খুঁজে পাবে। তাই তুমি স্থির, অপলক নেত্রে জলের তাকিয়ে রয়েছ। কায়া বিহ্বল স্বরে বলল : না, না। তোমার মুখে এসব কথা আমি শুনতে আসিনি। যদিও লজ্জা হয় বলতে মনুষ্যজনমের চেয়ে ঢের ভালো ছিল আমার বৃক্ষজনম।

ননী মাথা ঝাঁকাল। গ্রন্থিবদ্ধ তার কেশভার খুলে ছড়িয়ে পড়ল তার মুখের চারপাশে। অসহিষ্ণুর মতো বলে উঠল : তাহলে কি তুমি বৃক্ষ হয়ে অতীতকে চিনে নিতে চাও? তোমার ছেড়ে যাওয়া মৃত্তিকাকে?

লাস্যে, হাস্যে, বিভঙ্গে উত্তর এল : মৃত্তিকা… ভাটিদেশের মৃত্তিকা… এ তো কেবলই মরীচিকা। জীবন এক আদিম সর্পিণী। কোনও-না-কোনও সময় সে দংশন করবে। তার দংশন আসবে রোগ, জরা আর মৃত্যুরূপে।

ননী ভাবতে লাগল। মশালের আলোকে নিজেকে খুঁজে চলল, কিন্তু সেরকম কোনও কান্তিময় অস্তিত্বের সন্ধান পেল না কোনও দিকে! যাকে খুঁজে পেল তা তার অন্ধকারময় জীবনই। তখন সে বলল : আচ্ছা, তোমাকে একটা প্রশ্ন করি। এই যা বলছ, এসব আসলে তোমার নিজ দুর্বলতাকে আচ্ছাদিত করার কৌশল নয় তো?

আত্মগত স্বরে উত্তর এল : আহ, ননী তুমি মূর্খ! তুমি ভুলে যাও দংশনের কথা। জীবনকে উপভোগ করো তার সমস্ত উপচারের মধ্যে। জীবনকে অতিক্রম করতে যেয়ো না। জীবনকে অতিক্রম করাও যায় না। তুমি আমাকে মৃত্যুর বন্ধনের দিকে ঠেলে দিয়ো না। আমি মৃত্তিকা চিনি না, মানুষকেও চিনি। মানুষকে বুঝিয়ো না। সবই ভ্রান্ত। আমি জীবনের মস্তবড় নিষ্ঠুর অবদানকে জেনে ফেলেছি। তোমার প্রতি ঈশ্বরের অবদান যেমন সত্য, ঠিক তেমনই! আমি মূর্তিমান প্রলোভন। আমি তোমাকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াব, জলের ভেতর জলের বিসর্জনের মতো। জীবনের স্বাদ নেওয়াব। তোমার অধরে তুলে ধরব মধুভরা জীবনের পানপাত্র। তুমি সেই ফেনিল সুরা পান করে উন্মাদ হয়ে যাবে। এসো, ননী, আমার সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করো।

ননীর চক্ষু সজল হয়ে উঠেছে, জলের ভেতর থেকে অস্ফুট পরামর্শ তার হৃদয়ে প্রবেশ করেছে, কিন্তু কেন সে এই মুহূর্তে তার হৃদয়কে কঠিন করছে? তার স্বপ্ন তো ঝরাপাতা নয়। উজ্জ্বল তার ভবিষ্যৎ, জীবনে সুখী হবে, কালক্রমে হবে প্রেমে বিজয়ী, এইটুকু স্বপ্ন দেখা তার পক্ষে কি অন্যায়? তাই হয়তো সে বলে উঠল : কী অদ্ভুত! আশ্চর্য সব মায়াবী কথা!

অয়স্কান্ত কায়ামুখ এক মুহূর্তে জলের অর্গল ঠেলে জলের ভেতর থেকে অন্ধকারেই বেরিয়ে এল, বলল : মনে রেখো, তুমি কোনও স্বর্গের অপ্সরা নও; নও কোনও দেবনর্তকও; নও, নও কোনও দেবপুত্রও।

ননীর হৃদয় তোমার বধির হয়নি, তবু তার দুই চোখ থেকে অশ্রুমার্জনা করে আবার কঠিন হয়ে উঠেছে। কায়ার কথাগুলো শুনেও শুনছে না। তার ওষ্ঠের প্রান্তে কায়ার জন্য অবজ্ঞাই ফুটে উঠছে। সে কোন্ বিচিত্র ধাতুতে নির্মিত, যুবক? সে বলতে লাগল : আমি তাহলে কে?

দ্রুত, এই নৈশ প্রহরে উত্তর এল : তা অপ্রকাশ্য। তবে প্রকাশ্য এই-যে, আমি তোমারই কায়া, তোমারই কৃষ্ণাত্মা। আমি তোমার প্রতিদ্ব›দ্বী। আমিই তোমার অন্তর্নিহিত পাপপুরুষ! আমি ভাটিদেশের জলসৌন্দর্যের পিয়াসী। কামনায়, বাসনায়, যাতনায়, দ্রোহে খুঁজে চলি কেবলই তাকে। তুমি দেখবে আমাকে ভাটির প্রেমে, অনাবিল সরোবরে, রাজহংসের মিথুনে। আমি শুধু ভাটিদেশের হৃদয়ে, তারই ধমনিতে, আনন্দ-উল্লাসে, সত্যের প্রকাশ ঘটাই।

Series Navigationনাট্যোপনাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব চার >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *