হাবীবুল্লাহ শিরাজী’র কবিতা
মুকুন্দপুর আর কতোদূর
বদল ক’রে ব ত—বাটি এক নিমিষে উড়াল দিচ্ছি
হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বৃক্ষ থেকে বৃক্ষে যাচ্ছি
এ গাঁও সে গাঁও মুকুন্দপুর আর কতোদূর?
এই যে আমার সেই যাচ্ছে তিন মহিলা নয় যুবতী
কিশোরী আর শিশু মিলে জন সতেরো
আমি যে এক নূহের নৌকা
অথৈ জলে পাল তুলেছি
আমার বয়স, ঢেউ খেলানো টেরি মিলে
লেপ্টে আছে বনমোরগের বন্যগন্ধ বন মউ মউ বুক-ফুলেরা,
নষ্ট আমি, আমি না তো, নষ্ট চোখের মণি দুটো
উল্টে দিয়ে সামনে যাচ্ছি— আর কতোদূর মুকুন্দপুর?
হাতে গোলাপ চোখের এ পাপ, বদলে এখন ছুরি ও সাপ:
নায়ক আমি, প্রতিনায়ক খুঁজে ফিরছি দিন-দুপুরে
পাল্টা ঘরে— মুকুন্দপুর, আর কতোদূর?
হরিপদ জনাবালী দারুন ব্যস্ত হাট-হাটুরে
তাদের সঙ্গী নিত্য আমি রকেট বিড়ি কল্কে ফুঁকে
দোসর আমার আমিই জানি, মুকুন্দপুর এই এখানে
ভাটার শহর উজান এনে
ভিড়িয়ে দেবো নূহের নৌকা— সওয়ারী আর কোথায় আমার?
আমি কেবল আমার নৌকার একলা সওয়ার এই ভূমিতে
নেমে যাবো উলোটপালট যুদ্ধক্ষেত্রে, সিঁড়ি বেয়ে
এই দুপুরে,— মুকুন্দপুর রাজ্যভূমে!
সুধীরঞ্জন ও ভোরের গাড়ি
‘ভোরের গাড়িতে যাবো, জাগিও সময়ে’
…বলেই নামলো জলে সুধীরঞ্জন
সুধীরঞ্জন তিনি, হস্ত-পদ ব্যেপে
খেলে যায় ঢেউমালা
সবুজ আঁচল জোড়া বালা
নামে অঙ্গে, ভাঙে দেহ
জলে-জলে বিস্তারিত সুশীল শয়ন।
ওঠে-নামে ঢেউ
বাষ্পীয় শকট ডাকে দূরে…
মস্তিষ্কের কোষে-কোষে ভোরের বিজনে
অজগর ফুঁসে ওঠে
গিলে খায় সুখ-চিত্র, নৈশ শব্দ-স্মৃতি
বেলা-বেলা তীরবর্তী সুচারু তৈজস!
সুরম্য সংসার নিয়ে দেখো
প্লাটফর্মে থেমে আছে ভোরের ইঞ্জিন,
কাচে-কাচে রুগ্ন মুখ
কুয়াশা বরফ,
পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা
অলস চুলের গোছা, রতিবতী জায়া
উন্মুখ, উন্মনা।
ভোরের গাড়ির সাথে
ঢেউ থামে কৃষ্ণবর্ণ ঘাটে,
অতল পাতাল থেকে হুঁইশিল বাজে
সুধীরঞ্জন তিনি নামেন গভীরে;
প্লাটফর্ম শূন্য হয়
থামে জল-খেলা,
জলচারী সুধীরঞ্জন।
ভয় ও মৃত্যু
ভয় সামনে এলে উল্টে যায় চিত্রফল
জলের বিলাস থেকে রৌদ্রের সাহস
সে সরল হ’তে পারে অথবা সবল
তাকে অতিক্রম করে খাটো তীব্র ফ্রেম
ফিরিস্তির কোনো অংশ বুঝি সত্য মৃত্যু
ভয় যদি নদী ও অন্ধকারের ঝুল
কিংবা কোনো নির্ধারিত যাত্রায় বদল
বালিঘড়ির ওপাশে পুষ্প কিংবা ফেনা
গিঁট ছুঁয়ে কোনো মুগ্ধ বুঝি মিথ্যা মৃত্যু
ভয় যদি আজ তবে মৃত্যুর আগামী
খুলে দেয় অন্ধ সম্মোহন
মেলে দেয় নগ্ন বিবেচনা
ফের দগ্ধ ফের মাটি
পুনরায় নবীন সূচনা।
শিপুর জন্য কবিতা
কোথাও রোদ উঠলে ভাবি
ভালোবাসার গাছ বেড়ে উঠছে ধীরে,
নিশ্চিত হ’য়ে যাই
এবার চেতনা পাবো
সহজেই চিনে নেবো নিম ও জারুল…
কখনও মেঘ ডাকলে বুঝি,
বৃষ্টিতে ভিজে যাবে উত্তর-দক্ষিণ
সামনে যে জন আছে
সেও বুঝি
স্নানঘর ফেলে রেখে বাইরে দাঁড়াবে…
কাউকে বৈশাখে পেলে বলি:
সময় তো ব’য়ে যায়,
এসো না এবেলা
আমরাও গান গাই—
‘আমার দোসর যে জন ওগো তারে
কে জানে, কে জানে…’
লাল মৃত্যু
মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে পেন্ডুলাম
গির্জার ঘড়ির নিচে টিকটিকি
থিকথিক অন্ধকারে বড়োদিন মাথা তুলে বোঝে
কতোখানি পাহারায় মানুষ!
সাঁকো এখনো ভাঙা, ক্ষতি নেই
পিঁপড়েরা বেঁধেছে বাঁধ
সর্ষের হলুদে যারা তারাও কি কুয়াশা
এবছর প্রজনন শেষে মৃত্যু ভোর হবে?
ভোর হবার জন্য যারা অপেক্ষা করছিলো
তারা একফোঁটা চন্দ্রবিন্দুতে ঝাঁপ দিলো
লাল একটি বল ঠেলে দেওয়ার জন্য
আকাশবাহিনী প্রস্তুত
তারপরও মৃত্যু কি খুব কঠিন?
কবর লাল হবার জন্য রক্তের প্রয়োজন ছিলো
ব্লাড ব্যাংকে ছুটতে থাকলো এ পজেটিভ
আর জীবনের মধ্যে জেগে থাকার লোভে
একটি লাল মৃত্যুর নাম : একত্রিশে ডিসেম্বর!
মানকচু
কোনো মান-ই ধরি না আর তো অপমান!
যেমন রেড়ির তেলে জ্ব’লছে সলতে
আর জলপাই তেলে ভাজা হ’চ্ছে রূপচাঁদা
সব এক!
মান-অপমান ভাই-ভাই হ’য়ে খেলছে
সুতো হাতে লাটিমের দিকে তাকিয়ে আছে বাচাল
আবার বোবাও মজা চুমুক দেয় প্লাস্টিক গ্লাশে
বরাবর সমান!
ভোটের বাক্স খোলার পর জারিজুরি ফাঁক হয়
বিজয়ও পরাজয়ের ঘরে চিহ্ন দিয়েছে
এখন হ্যাজাক জ্বালিয়ে মানকচু দিয়ে ভাত খাবো!
একটি অসম্পূর্ণ ম্যাজিক
অন্ধকার না বুঝেই ঝাঁপ দিয়েছিলো বিড়াল
খাদও কিছু সামলানোর না পেয়ে পাতে বুক
হিশেব না পেয়ে মধ্যবর্তী অংশ হারিয়ে ফেললে সময়
যে ব্যাপারটি কিংবা বিষয়গুলো প্রস্তুত হয় নতুবা ঘটতে পারে
তার কোনো বর্তমান থাকতে নেই…
বিড়ালটি বিদেয় করা হ’লেও বুকে আঁচড় কেটেছিলো
খাদটির গভীরতা নিয়ে কেবল মৃত্যুর আন্দাজ পাওয়া যেতে পারতো
বিষয় হলো বাড়তি একটি সমীকরণ
এবং বর্তমান, সময়ের সঙ্গে লেগে থাকা বাহানা
মিশতে-মিশতে হারিয়ে যায়…
বিড়াল শূন্য, খাদ শূন্য, সময় শূন্য, বিষয় শূন্য
আর বর্তমানকে মহাশূন্য ধ’রে নিলে
আকাঙ্ক্ষার ভেতর ফুটতে থাকে দানাবীজ
একটি অসম্পূর্ণ ম্যাজিক।
হৃদয় মেলিয়া কাক দেখিলাম
অবসর খাকি টুপি জমা দিলে
টুটাফাটা জুতো হা-মুখে তাকায় —
ডুবে থাকা ঘাড়ে ছেঁড়া ফিতে বেঁধে
লগ এলাকায় মামলা নামায়!
ঢিলে চামড়ায় জমে থাকা নুনে
ফাটা আঙুলের দায় শতকণা —
দুই চোখে ঠুলি, তুলো গোঁজা কানে
সোনার ওজনে তামা বনিবনা!
হাঁটুতে বুদ্ধি হোঁচটে লালসা
যা সকল ডান তার সব বাম
লুট করে নিলে শাপলার বিল
হৃদয় মেলিয়া কাক দেখিলাম!