উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। অষ্টম পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। প্রথম পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। দ্বিতীয় পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। তৃতীয় পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। চতুর্থ পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। পঞ্চম পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। ষষ্ঠ পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। সপ্তম পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। অষ্টম পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। নবম পর্ব
- উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। দশম পর্ব
অষ্টম পর্ব
হামিদ ভাইয়ের কথা মত একটু বেশি রাতেই মেডিকেলে গেলাম। কফিনের ভ্যান আগেই ঠিক করে রেখেছি। তাছাড়া মেডিকেল থেকে আমাদের বাসার দুরত্ব বেশি নয়। মেঘলা রাতে এটুকু রাস্তা চোখের পলকেই চলে আসতে পারব। মেডিকেলে এসে হামিদ ভাইয়ের দেখা পেলাম না। অনেক খুঁজে পেতে একজনকে পেলাম যে লাশের ট্রলি টানে। সেও নতুন। কিছুদিন এসেছে। যার সাথে হামিদ ভাইয়ের কথা হয়ে আছে তার নাকি মেয়ের হঠাৎ জ্বর ওঠায় বাড়িতে গেছে। নতুন-এর কাছে সব দায়িত্ব বুঝে দিয়ে গেছে। চাবিও এর কাছে।
নতুন লোকটা দেখি ভয়ে আধমরা। লাশ-কাটা ঘরের ভয় নাকি অবৈধ কাজ করার ভয় ঠিক বুঝলাম না। কিন্তু নাচতে নেমে আমাদের এখন আর ভয় পেলে চলবে না। তাছাড়া বাসায় বসে ভাবার চেয়ে একবার স্পটে চলে আসলে ভয়ডর অনেক কমে যায়। তখন কাজই বড় হয়ে দেখা দেয়। যেখানে রাতের পর রাত হামিদ ভাই পাহারা দিচ্ছে সেখানে সামান্য সময়ের জন্য ঢুকেই বের হয়ে আসবো। এতে ভয়ের কি!
নতুন লোকটা চাবি দিয়ে ভয়ে ভয়ে মর্গের দরজা খুলে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। প্রায়ান্ধকার ঘর। লাশেরা বোধ হয় উজ্বল আলো সহ্য করতে পারে না। প্রায়ান্ধকার ঘরে লাশের সারি সারি ড্রয়ারগুলো দেখতে পাচ্ছি। আর দেখছি ট্রলির উপরে সাদা চাদরে ঢাকা লাশ। বোধ হয় সদ্য আনা। আমি লোকটার দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম, ‘ব্যাপার কি? বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবা নাকি? ভেতরে এসে কোন লাশটা আমাদের দেখাও। ধরে নিয়ে কফিনে ঢোকাও।
লোকটা ধীর পায়ে মর্গে ঢোকে। ভয়ে ভয়ে কোন দিকে না তাকিয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। হাসান ধমক দেয়, ‘আমাদের পিছনে হাত-পা গুটিয়ে না দাঁড়িয়ে দেখাও কোনটা তোমার লাশ। লাশের কাছে যাও। নামাও ট্রলি থেকে।’
লোকটা পায়ে পায়ে হেঁটে একটা ট্রলির পাশে এসে দাঁড়ায়। এই ট্রলিটা কেমন যেন একটু ব্যাতিক্রম। চাকার কাছে ইট দেয়া। নষ্ট ট্রলির ব্যাপার স্যাপার হয়তো! ও নিয়ে মাথা ঘামালাম না।
লোকটা এবার যেন একটু সাহস সঞ্চয় করে সাদা কাপড় ঢাকা লাশটা মুড়িয়ে বেঁধে ফেলে।
হাসান বলে ‘লাশের গায়ে জামাকাপড় ছিল না?
‘জ্বে ছিল।’
‘খুলে নিয়েছো?’
লোকটা উপর নিচ মাথা নাড়ে।
আমরা তিনজনে ধরে আপাদমস্তক মুড়ানো লাশটা বারান্দায় রাখা কফিনে ঢোকাই।
কফিন নিয়ে বাইরে ভ্যানের উপর তুলতে দেখি ফিসফিস করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির জোর আরো বাড়ার আগে এই মধ্যরাতে বাসায় পৌছাতে হবে।
বাসার কাছে এসে দেখি গোটা এলাকায় ইলেকট্রিসিটি নেই। শহরের একটু বাইরে এই এলাকায় গ্রাম্য ভাব প্রবল। আর সে কারণেই একটু বৃষ্টিবাদলা হলেই লাইন অফ থাকে। ঝড় বৃষ্টি চলে গেলেও সে লাইন আর আসে না। সেজন্য ডজন ধরে মোমবাতি কিনে রাখি।
অন্ধকারের মধ্যে ভ্যানওয়ালা সহ কফিন ধরে দোতলায় তুলি। মোবাইলের আলোয় পথ দেখে প্লাস্টার না করা সিঁড়ি ভাঙছি। আর কোন ভাড়াটে না থাকায় অহেতুক প্রশ্নের ঝামেলা থেকে বেঁচে গেছি।
ভ্যানওয়ালা এত ধরাধরি করায় চুক্তির চেয়ে আরো বিশটাকা বেশি দেই। লোকটা খুশি হয়ে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়ে।
রুমে ঢুকে হাসান মোমবাতি ধরাতে ধরাতে বলে, ‘বৃষ্টির যে বেগ সাথে ঝড় বাড়ছে আজ রাতে আর কারেন্ট আসবে না বোধ হয়। কোথাও ট্রান্সফর্মারটার গেছে হয়তো।’
বারান্দায় রাখা কাঠের ভারী কফিনটা একপাশে সরিয়ে বাথরুমে যাওয়ার পথ বের করতে করতে বলি, ‘মোমের আলোতে শুটিং করবি নাকি?’
হাসান উত্তেজিত গলায় বলল, ‘সেইটাই একসেলেন্ট হবে মনে হচ্ছে। মোমের স্বল্প আলো-আধাঁরীতে লাশ-কাটার পরিবেশটা আরো ভয়ের হবে। ভয়ের ছবিতে পরিবেশটাই আসল।’
‘ঠিক আছে কাজে যখন হাত দিয়েছি তখন সেটা শেষ করাই ভাল।’
‘আগে খেয়ে নেই নাকি বলিস?’
‘তুই খেতে চাইলে খা। কোন খাবার এখন আমার মুখে উঠবে না। খিদে নষ্ট হয়ে গেছে।’
‘আমারও খাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। নতুন কিছু করার উত্তেজনায় খিদে নষ্ট হয়ে গেছে। উত্তেজনা খিদে নষ্ট করে।’
‘তুই তোর ক্যামেরার লেন্সটেন্স সব ঠিকঠাক কর। আমি একটু হাতমুখ ধুয়ে আসি।’
‘হাতমুখ ধোয়ার আগে কফিন থেকে লাশটা বের করতে সাহায্য কর। ডিসেকশান টেবিলে তুলে দে। টেবিলে লাশ থাকলে ক্যামেরার এঙ্গেল ঠিক করতে সুবিধে হবে। আর হাতমুখ ধুয়ে করবিটা কি? এখনই তো ছুরিকাঁচি নিয়ে লাশ কাটতে হবে।’
‘ঠিক আছে লাশ ধরছি। শোন, তুই ড্রয়ার ট্রয়ার থেকে যেখানে যা ডিসেকশানের যন্ত্রপাতি আছে বের কর। আর মাংসের টুকরা যে করবি কসাই খানা থেকে চাপাতি এনেছিস? নাকি বটি দিয়ে করবি?’
হাসান মৃদু গলায় বলল, ‘এনেছি। তোর টেবিলের তলায় খবরের কাগজে মোড়া আছে। সাবধানে নিস। নতুন জিনিস।’
আমি আর কিছু না বলে কফিন থেকে লাশ বের করার কাজে মনোযোগ দিলাম। সব গুছিয়েই রেখেছে তাহলে? হাসান ভয়ংকর ছবি তৈরি করবেই। আজ রাতেই।
বাথরুম থেকে রুমে ঢুকে দেখি রুম আলো আলো। ক্যামেরার নির্দিষ্টমুখী আলো পড়ে আছে সাদা চাদরের ফাঁক থেকে বের করা কালো সবল দুটি পায়ের পাতার উপর। টেবিলের উপর লাল রঙের মোমবাতি জ্বলছে। বাইরে ঝড় বৃষ্টি। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমক। অদ্ভুত আলোআঁধারি পরিবেশ।
হাসান আমাকে দেখে বলল ‘বাইরের বিদ্যুৎ চমকটা ধরতে পারলে আরো এক্সাইটিং হতো। অবশ্য ল্যাবেও করা যাবে। ভাবছি, বাইরে ঝড়বৃষ্টির দৃশ্য আর ফাঁকে ফাঁকে বিদ্যুৎ চমকানি দিয়ে দেব।’
আমি কালো পা দুটোর দিকে তাকিয়ে তোয়ালে দিয়ে হাতের পানি মুছতে মুছতে বললাম, ‘শুধু পায়ের কাছে খুললি কেন? পুরো চাদরটাই সরিয়ে ফেল।’ বলে আমি চাদর ধরে টান দিতে যেতেই হাসান ঘাড়ের উপর ক্যামেরা ধরে রেখেই হা হা করে আমার হাত থেকে চাদর ছাড়িয়ে নিল।
‘কি করছিস কি? এখনই পুরো চাদরটা খুলে ফেললে আমার প্ল্যান ভেস্তে যাবে। শোন, আমি যেভাবে বলি সেভাবেই কর। আমি এখন ক্যামেরাম্যান কাম পরিচালক। তুই আমার অভিনেতা।’
আমি একটু রাগী গলায় বললাম, ‘কি করতে হবে বল?’
‘পুরো লাশেরই ছাল আমরা ছাড়াব কিন্তু আস্তে আস্তে। পা থেকে ছিলতে ছিলতে মাথা পর্যন্ত উঠব। তাহলে গোটা চামড়া ছাড়ানো শরীর দেখলে দর্শক ভিমরি খাবে। আর পুরোটা খুলে চামড়া ছাড়াতে থাকলে প্রথমে একটু ভয় পেলেও খালি শরীর দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে আর ভয় পাবে না। চামড়া ছাড়ানো শরীর দেখেও না।’