রহস্য উপন্যাস

উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। প্রথম পর্ব

অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ

পর্ব-১
আগের দিনে গ্রামের মধ্যে যাদের টাকা পয়সা বেশি ছিল, বা হতো তারা হজ্জ্বে যেতো। এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন গ্রামের টাকাওয়ালা লোক হজ্জে ছেলেমেয়েদের শহরের বেসরকারি ভার্সিটি বা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়। ধর্মের পাশাপাশি মানুষ শিক্ষাটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আমার বাবা অবশ্য দুটোই করেছে। তার টাকা পয়সার অভাব নেই। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তিনি। তাছাড়া তিনশ বিঘের লীজ-ঘের আছে আমাদের। কাজেই দশ-বার লাখ টাকা দিয়ে ছেলেকে বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তি করানো এবং মাকে নিয়ে হজ্জে যাওয়া বাবার কাছে কোন ব্যাপারই না।

বাবা হজ্জ থেকে আসার পরে আমাদের গ্রামের একটু পরিবর্তন হয়েছে। লঞ্চঘাটের ভাড়ার ভিসিআর দেখানোর ছোট ছোট হলগুলো উঠে গেছে। সেই সাথেবন্ধ হয়েছে খুপরির মত দোকানের পিছনে ফেন্সিডিল এবং গাঁজার পুরিয়া বেঁচা। যে কারণে ফেন্সিডিলের দামও উঠে গেছে প্রায় দ্বিগুণ। আগে যারা দোকানের পিছনে এসব বিক্রি করত এখন তারা বলতে গেলে বাড়ি বাড়ি ফেরি করেই ডাইল, গাঁজা এসব বিক্রি করে। আমার অবশ্য সমস্যা নেই। আমার সাপ্লাই সময়মতই আসে। চেয়ারম্যানের ছেলে হওয়ার অনেক সুবিধে। প্রদীপের নিচেই অন্ধকার।

আর কদিন পরেই বেসরকারি মেডিকেলে পড়তে ঢাকায় চলে যাব বলে যা খাওয়ার খেয়ে নিচ্ছি। মানে ডাউল, গাঁজা এসব। ঢাকায় ওসবের জোগান কিভাবে পাব আল্লাই জানে! ব্যবস্থা নিশ্চয় একটা হয়ে যাবে। টাকা থাকলে এবং আন্তরিক ভাবে চাইলে কি না পাওয়া যায়! তবুও হাতের কাছে যা সহজভাবে পাচ্ছি তাই কায়দা মত গলাধঃকরণ করি। ডাউল খাওয়ার জন্য সন্ধ্যের পরপর ঘেরের সবচেয়ে দূরের কুঁড়ে ঘরে চলে এসেছি। পানির উপরে টোঙঘরের মত এই ঘরে বসে বাবার কর্মচারীরা ‘হোয়াইটগোল্ড’ চিংড়ীমাছ পাহারা দেয়। কর্মচারীরা প্রায় সবাই আমার বয়সী ডাইলখোর হওয়ায় এবং আমাকে ছোটকর্তা হিসাবে মানে বলে ওদের এখানে এসে সবচেয়ে নিরাপদে ডাইল সেবন করা যায়। তবে ডাইল কেনার পয়সা আমাকেই দিতে হয়। আজ বিকালে ওদের একজনকে ‘হোন্ডার পিছনে বসিয়ে সেই সীমান্ত এলাকা থেকে বোতল নিয়ে এসেছি।

চারিদিকে অন্ধকার নেমে যেতেই ডাইল সেবন শুরু করলাম। বোতলের মুখ খুলে ঢক ঢক করে গলায় ঢেলে দিলেই হলো। ধীরে ধীরে দুনিয়া অন্যরকম হতে থাকে। অনেকে অবশ্য নেশা আরো বাড়াতে জুতোর কালি শোকে। চাষাড়ে টাইপের লোকে গোবর শোকে। ওতে নাকি অন্যরকম ফিলিংস হয়! আমি পরীক্ষা করে দেখেনি। ডাউলখোর হলেও অতটা নীচে নামেনি। তাছাড়া আমি ছাত্রও খারাপ না। বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তি হতে সর্বনিম্ন যে মার্ক লাগে সেটা আমার আছে। আর তার সাথে আছে বাপের টাকা। আমাকে ভর্তি করাতে ডোনেশনও দিতে হয়েছে মনে হয়।

নেশা হলে গায়ের জামাকাপড় খুলে ফেলতে হয়। শরীরে গরম ডেকে যায়। হাস-ফাঁস লাগে। সবাই গায়ের জামা খুলে বসেছি। আমরা চারজন। একজন প্রায় বন্ধুস্থানীয়। সব কাজে আমার সাথে ছায়ার মত থাকে বাবুল। বাকি দু’জন ঘেরের পাহারাদার। ওরা রাতে এই কুঁড়ে ঘরেই থাকে। ডাউলের বড় উপকারীতা মদের মত তা মাতাল করে না। স্বাভাবিক থাকা যায়। শুধু ঝিম মেরে বসে থাকতে হয়। আমরা চারজনই ঝিম মেরে বসে আছি। কেউ কোন কথা বলছি না। বৈশাখ মাস। হু হু করে বাতাস বইছে। ঘেরের খোলা জায়গার বাতাস শরীরের ভেতরটা ঠাণ্ডা করে দিচ্ছে। ঝিম ধরা অবস্থায় হঠাৎ একটা জিনিস মনে পড়ল। জিনিসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি মাথা তুলে কারো দিকে না তাকিয়েই বললাম, ‘আমার একটা লাশ দরকার।’
বাবুল চমকে উঠে বলল, ‘লাশ!’
তার চমকানোর কারণ ছিল। আমার বড় ভাই, এলাকার সবচেয়ে উচ্ছৃঙ্খল ছেলেটি, কিছুদিন আগে একজনের বউয়ের পেটে গরু জবাইয়ের ছুরি বসিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। সে এখন ফেরারী আসামী। সেই বউয়ের সাথে ভাইয়ের পরকীয়া ছিল। কিন্তু বউ ভাইয়ের সাথে পালিয়ে যেতে রাজি না হয় আমার কুরাগী ভাই বউটাকে শেষ করে দিয়ে নিজেই পালায়। কাজেই তার ছোট ভাই লাশ চাইলে একটু অবাক হওয়ারই কথা!

ঘেরের পাহারাদার পেটানো শরীরের কালো ষাঁড় হামিদ খসখসে গলায় বলে ওঠে, ‘ছোটভাই, কন কার লাশ ফেলে দিতে হবে। আপনি বললে যে কারো লাশ ফেলে দিতে পারি। শুধু আপনি একটু পিছনে থাকলে হবে।’
আমি নিজেও কেমন যেন ধন্ধে পড়ে গেছি, ‘নির্দিষ্ট কারোর লাশ নয়। যে কোন লাশ হলেই হবে।’
ইয়াছিন ভাই বলে উঠল, ‘ছোট ভাই, যে কোন লাশ দিয়ে কি করবেন? কারোর উপর রাগ থাকলে বলেন লাশ ফেলে দেই।’
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘মানে ব্যাপারটা তা না। আমার যে কোন মরা লাশ হলেই হবে। লাশ পড়তে হবে। ডাক্তারি পড়তে লাশ লাগে। লাগে লাশের হাড়গোড়।’
বাবুল আবার চমকে উঠল, ‘মরা লাশ! পড়তে!’
‘হু। আমাদের স্যারেরা বলে দিয়েছে ফাস্ট ইয়ারে লাশের হাড়গোড় পড়তে হয়। তাই ভাবলাম কই না কই পাব। যদি গ্রাম থেকে নেয়া যায় তো ভাল। শুনেছি হাড়গোড়ের বেশ দাম। ঢাকা শহরে দশ বার হাজার টাকা লাগে হাড় পেতে।’
হামিদ ভাই আগের মত খসখসে গলায় বলল, ‘ছোট ভাই কি কন? লাশের হাড়ের দাম দশ হাজার টাকা? তাহলে তো প্রত্যেকদিন একটা করে লাশ নিয়ে ঢাকায় যেয়ে বেঁচে দিতে হয়। শুধু টাকা আর টাকা।’
‘যেরকম সহজ ভাবছ ওরকম সহজ না। ঝামেলা আছে। তাছাড়া অত লাশ তুমি পাবা কই?’
হামিদের বুদ্ধিশুদ্ধি কম বলেই মাথা চুলকে বুদ্ধি বের করার চেষ্টা করে বলল, ‘তা ঠিক। গ্রামের লোক সহজে মরেও না।’
ইয়াছিনের মাথা ঠাণ্ডা, সে ভেবে বলল, ‘ছোটভাই মরা লাশের কথা বলছিলেন। কবর দেয়া লাশ হলে চলবে?’
‘কতদিন আগে কবর দেয়া? শুনেছি বেশি আগের কবর দেয়া হলে হাড়গোড়ের গায়ে মাটির দাগ হয়ে যায়। ওই হাড় আর পড়া যায় না।’
ইয়াছিন হাতে কর গুনে বলল, ‘দুইদিন আগের। আজ বুধবার। লাশ মাটিতে পুতে ফেলেছে সোমবারে।’
‘হু। তাহলে হবে। শুনেছি তিনদিনের আগে হলে কাজ চালানো যায়। লাশে তেমন পঁচন ধরে না। হাড়গুলো ফ্রেশ থাকে।’
‘ফ্রেশ থাকতে পারে। বেশ ভাল লাশ। যুবতী বৌ-তো। আর এনড্রিন খাওয়া। বিষ খাওয়া লাশ সহজে পচে না।’
হামিদ ওপাশ থেকে বলল, ‘ইয়াছিন ভাই কার কথা বলছ?’
‘কেন বাগদী পাড়ার সন্ন্যাসীর বউ। এনড্রিন খেয়ে আত্মহত্যা করে মরল। তারপর সেই লাশ মাটিতে পুঁতে ফেলেছে না!’
আমি একটু অবাক গলায় বললাম, ‘বাগদীরা পোড়ায় না নাকি?’
ইয়াছিন বলল, ‘মনে হয় না। পোড়াতে অনেক খরচ। ওরা অত খরচ পাবে কই? সব দিন আনে দিন খায়। তারপর বিষ খাওয়া, অপঘাতে মরা লাশ। পা ভেঙে সোজা করে মাটিতে পুঁতে ফেলে।’
বাবুলও দেখলাম ওই বাগদী বৌয়ের মরার কথা জানে। বলল, ‘ওই লাশে ঝামেলা আছে কিন্তু। বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে ভেবে পুলিশ টুলিশও এসেছিল। চেয়্যারম্যান চাচাই তো পুলিশদের ঠান্ডা করে রেখেছে। পুলিশ মনে হয় এখনো গ্রামেই আছে।’
হামিদ হাত দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার মত করে বলল, ‘দুর, দুর। পুলিশ কি আর এখনও পাহারা দিয়ে বেড়াচ্ছে নাকি? রাত দুপুরে মাটি খুঁড়ে লাশ তুলে আনলে পুলিশের চৌদ্দ গুষ্টিও জানবে না। ছোটভাই, আপনার লাশ কবে লাগবে?’
‘বাগদীর বউয়ের হলে আজ রাতেই তুলে ফেলা ভাল। তিনদিন হয়ে গেলে আমার আর কোন কাজে আসবে না। আর নতুন লাশ হলে দু’একদিন পরে হলেও চলবে।’
ইয়াছিন বলল, ‘নতুন লাশ তো বললেই পাওয়া যাবে না। কারোর মরার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। না হলে নিজেরাই কাউকে লাশ বানিয়ে ফেলতে হবে। তারচেয়ে বাগদী বৌতে যদি কাজ হয় তো চলেন আজ রাতে লাশ তুলে ফেলি।’
আমিও ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘সেটা করাই ভাল। দেরী হলে লাশ নষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া মাংস খসিয়ে হাড়গোড় বের করতে বেশ সময় লেগে যাবে।’
বাবুল বলল, ‘তুই কি রাতে থাকবি নাকি এখানে?’
‘হু। আমি না থাকলে লাশের মাংস ছাড়িয়ে হাড় বের করার সময় খেয়াল রাখবে কে? একটু এদিক ওদিক হলে হাড় নষ্ট হয়ে যাবে। আর আমার সাথে সাথে তুইও থাকছিস। কোন অসুবিধে আছে তোর?’
‘নাহ। আমার আর কি অসুবিধে? দু’চারদিন বাড়িতে না ফিরলেও কেউ খোঁজ নেবে না। সৎ মা থাকার সুবিধে অনেক।’
‘কিন্তু আমার বাড়িতে একটু খবর দিয়ে আসতে হবে। আর খাওয়া দাওয়ার কি ব্যবস্থা হবে?’
হামিদ এক গাল হেসে বলল, ‘ও নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আপনি খাবেন। রাজহাঁস কেটে দিয়ে রান্না চড়িয়ে দেব এখানেই। শুধু বাড়ির থেকে চাল আনতে হবে। আর সব আছে এখানে। আপনার কথা বললেই দেবে। বলব পিকনিক করছি।’
‘ওই চিন্তা বাদ দাও হামিদ ভাই। লাশ-টাশ ঘাঁটাঘাঁটির রাতে ওসব না করাই ভাল। লাশের মাংস ছাড়িয়ে কেউ গোশ দিয়ে ভাত খেতে পারবে না। সব বমি হয়ে যাবে। তাছাড়া কাজও অনেক। পিকনিকের পিছনে সময় নষ্ট করা যাবে না। ওর চেয়ে তুমি আমাদের কথা বলে বাড়ির থেকে ভাত নিয়ে এসো। ইয়াছিন ভাই, কয়টার দিকে বেরুলে ভাল হয়?’
‘সবাই ঘুমিয়ে পড়লে রাত একটু বাড়লে বের হই। আজ রাতটা বেশ ভাল আছে। ঘুটঘুটি অন্ধকার চারিদিকে। কাজ সারতে সুবিধে হবে।’
বাবুল চিন্তিত স্বরে বলল, ‘আকাশে কিন্তু কালো মেঘ আছে। বৃষ্টি এসে না পড়লেই হয়।’
হামিদ ধমকের স্বরে বলল, ‘একটা লাশ তুলতে আর কতক্ষণ লাগবে? বৃষ্টি পড়ার আগেই কাজ সেরে ফেলতে পারব।’
যোগাড় যন্ত্র চলতে থাকে। ডাইলের এখনও ক’টা ফুলবোতল আছে। ও কয়টা পরে কাজে লাগবে। হামিদ চলে গেল আমাদের জন্য বাড়ি থেকে ভাত নিয়ে আসতে। এশার আজান হয়ে গেছে। গ্রামের দিকে কেরোসিনের তেল পোড়ানোর ভয়তে লোকজন সন্ধের পরপরই খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কাজেই আমরাও খেয়ে দেয়ে লাশ তুলতে বেরিয়ে পড়তে পারব।

Series Navigationউপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। দ্বিতীয় পর্ব >>

One thought on “উপন্যাস ।। অন্য মানুষ ।। প্রিন্স আশরাফ ।। প্রথম পর্ব

  • Tahmina Sunny

    পরের পর্বের অপেক্ষায়…

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *