জয় বাংলা শিশুসাহিত্য উৎসব।। অন্য রকম মুক্তিযুদ্ধ।। রফিকুর রশীদ

তিন রুমের এক চিলতে বাসার মধ্যে বন্দি থাকতে থাকতে পিকলু যখন সত্যি সত্যি হাঁপিয়ে ওঠে, তখনই একদিন ওর আম্মু সুসংবাদটা জানায়─ দুচারদিনের মধ্যে ওরা সবাই কুসুমপুরে চলে যাবে। পিকলুর আম্মুর আবার এ নিয়ে সাবধানতার অন্ত নেই। আব্বু অফিসে বেরিয়ে যাবার পর সারাদিন বন্ধ থাকে ঘরদোর, তবু সতর্ক চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে গলার স্বর নামিয়ে জানতে চায়,

পথে খুব কষ্ট হবে কিন্তু, পারবি তো যেতে? সে অনেক দূর।

খবরটা শোনার পর থেকে আনন্দে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল পিকলুর। এবার সে লাফিয়ে ওঠে,

পারব না মানে! কিসের কষ্ট?

মুখে আঙ্গুল চেপে থামিয়ে দেয় আম্মু,

চুপ! চুপ! আস্তে।

মন খারাপ হয়ে যায় পিকলুর। ভেবে পায় না এত সাবধানতা কিসের! কতদিন পরে তারা যাচ্ছে নানাবাড়ি, সে কথা এমন ফিসফিসিয়ে বলারই বা কী দরকার! কী হবে সবাই শুনলে? ওর আম্মু স্পষ্ট নির্দেশ জারি করে─ আমরা যে চলে যাচ্ছি, কাউকে বলবিনে যেন!

পিকলু ঘাড় গোঁজ করে চলে আসে বিছানার কাছে। বেশ নির্বিবাদে শুয়ে আছে ছোটবোন পিংকি। কোনো ভাবনা চিন্তা নেই। আম্মুর নিষেধাজ্ঞা মানতে ইচ্ছে করে না মোটেই। পিংকির তুলতুলে গালে টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

কিরে পিচ্চি, যাবি নানাবাড়ি?

আম্মু আবার চোখ কটমট করে তাকায়। ভ্রুক্ষেপ নেই পিংকির। সে কেবল ফোকলা মুখে মিটমিটিয়ে হাসে। পিকলু মজা পায়। একবার রাগও হয়─ ওই পিচ্চি ছাড়া কাকে বলবে সে!কে আছে এখানে?

এই ফ্ল্যাটের অবশিষ্ট তিনটি ফ্যামিলির মধ্যে হাসানরাও নেই, মুকুলরাও নেই। নিচ তলা একদম ফাঁকা। আছে কেবল সিঁড়ির ওপারে মুস্তাফিজুরদের ফ্যামিলি। তা ওদের সঙ্গে তো আজ কদিন একেবারেই চলাচল বন্ধ। তারপরও আম্মুর এত বেশি কড়াকড়ি আসে কোত্থেকে! স্কুল বন্ধ। ঘরের মধ্যে বন্দি। কথা সে বলবে কার সাথে?

সন্ধ্যার পর আব্বু বাসায় ফিরলে পিকলু চার পাশে ঘুরঘুর করে। নানাবাড়ি যাবার বিষয়টি সে নিশ্চিত হতে চায়। এর আগেও আম্মুকে কুসুমপুরে যাবার কথা বলতে শুনেছে। আব্বু কিছুতেই রাজি হয় না, সে খুব জানে। অফিসের চাপ তো আছেই, এদিকে কুসুমপুরের নানান দোষ –

বিদ্যুৎ নেই, ধুলোবালির একশেষ, গুমোট গরম, এমনই আরো কত কী! এই তো সেদিন মন্টুমামা কত করে বলল, কিছুতেই কাজ হলো না। এবার সত্যি রাজি হয়ে গেল আব্বু! বিশ্বাস হতে চায় না। আম্মুকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে পিকলু ফিসফিস করে জানতে চায়,

আব্বু, আমরা নানাবাড়ি যাচ্ছি কবে?

চোখ গোল করে তাকায় আব্বু,

নানাবাড়ি! কে যাবে সেখানে?

কেন, আমরা সবাই যাব।

তার মানে খবর আউট হয়ে গেছে?

ঘাড় কাৎ করে হেসে ওঠে পিকলু। আম্মুকে এগিয়ে আসতে দেখে সেই হাসির

লাগাম টেনে সে চুপচাপ উঠে আসে।

অবশেষে সত্যি একদিন খুব সকালে পিকলুরা সবাই মিলে রওনা দেয় কুসুম – পুরের উদ্দেশে। আগের রাতে এটা সেটা বাঁধা ছাঁদা নিয়ে আব্বু-আম্মুর ব্যস্ততা দেখে পিকলুর ভয়ানক হাসি পেয়েছিল। এটা নেয়া হয় তো ওটা বাদ যায়, ওটা নিলে সেটা এড়িয়ে যায়। থরে থরে সাজানো সুটকেসের কাপড়চোপড় সাতবার নামায়, আবার গোছায়। আব্বুর কড়া নির্দেশ ─ বেশি কিছু নিয়ে বোঝা বাড়ানো যাবে না। পথে অসুবিধা হবে। আম্মুও কম যায় না, গজগজ করে,

হ্যাঁ, তোমাকে ধরার জন্যেই তো সারা পথে মিলিটারি বসে আছে! তোমাকে না পেলে তো ওদের চলছে না!

আমাকে নয়, ওরা তোমাকেই ধরবে,

বুঝলে? বাইরের খবর তো জানো না কিছু, ঘরের মধ্যে বসে টেরও পাও না সে সব। পথে নেমে পা বাড়িয়ে দেখ!

পিকলু বুঝতে পারে না, সারা দেশে এ সব হচ্ছেটা কী! স্কুল বন্ধ। বাইরেও যাওয়া যাবে না। পাশের ফ্ল্যাটে গুলি হলো। একদিনে, মানে এক লহমায় মারা গেল পাঁচজন। মানুষের জীবনের কি দাম নেই! মন্টুমামা সেইদিনই ওদের বাসা থেকে উধাও। তার কথা কারো কাছে আবার বলাও যাবে না। মুস্তাফিজুরের আব্বা নাকি মন্টুমামাকে সন্দেহ করে। কিসের সন্দেহ তাও বোঝে না পিকলু। কিন্তু তারপর থেকে মুস্তাফিজুরদের সঙ্গে মেলামেশাটা ধীরে ধীরে কমে আসে। মিলিটারির ভয়ে সবাই জড়োসড়ো। কিন্তু মুস্তাফিজুরের আব্বা নাকি মোটেই ভয় করে না। নিচতলা থেকে হাসান এবং মুকুলদের ফ্যামিলি চলে যাবার পর পিকলুর আব্বুকে একদিন অভয় দিয়েছিল─ কোথাও যাবার দরকার নেই আপনাদের। ভয় কিসের,আমি তো আছি!

এই অভয়বাণী শোনার পরই পিকলুর আব্বু কুসুমপুরে যাবার সিদ্ধান্ত ফাইনাল করে ফেলে। তার মন বলে─ আর নয়।

কিন্তু দীর্ঘদিন পর নানাবাড়ি যাবার সংবাদে পিকলু যে রকম উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল, পথে নামার পর তার কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। সারা রাত ধরে ঝগড়াঝাটি করে বোঝা কমিয়েও শেষ পর্যন্ত ব্যাগ-সুটকেস মিলিয়ে গোটা তিনেক বেহাতি দাঁড়িয়ে যায়। আর ওই এক বছরের পিচ্চিকে যেহেতু কিছুতেই আম্মুর কোল থেকে নামানোর উপায় নেই, কাজেই বোঝার সংখ্যা চারই বলা চলে। পিকলু অবশ্য নিজেকে কখনোই বোঝা করে তুলতে চায়নি। বরং সে কাঁধে ওয়াটারপট ঝুলিয়ে টিফিনক্যারিয়ার আগলে রেখে সাধ্যমতো সহযোগিতাই করেছে। কিন্তু সে আর কতক্ষণ! একটানা দুদিন চলার পরও পথ যে কিছুতেই ফুরাতে চায় না। দূর মানে কি সত্যিই এতো দূর!

ট্রেন থেকে ঈশ্বরদী নামার পর আর বাস পাওয়া গেল না। জানা গেল─ এ অঞ্চলে বাস চলছে খুবই অনিয়মিত। সকালে আবার বাস পাওয়া যেতে পারে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ যমদূতের মতো তিনজন বিহারি এসে ওদের ব্যাগ- সুটকেস হ্যাঁচকা টানে কেড়ে নেয়। স্টেশনে মিলিটারি দেখে খুব ভয় পেয়েছিল পিকলু। কিন্তু এখন চোখ গোল করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে─ ওর আম্মুর গলা থেকে একটানে এরা ছিঁড়ে নেয় সোনার চেন। পিংকি আবারও চিৎকার করে ওঠে।

পিকলু চিৎকার করতে পারে না, তবে আব্বুর দিকে তাকিয়ে ভীষণ কান্না পায়।

একটা দোকানের চালার তলে সারা রাত কাটিয়ে সকালের বাস পেতে পেতে বেলা দশটা বেজে যায়। প্রচন্ড ভিড়। বাসে ওঠা দায়। এদিকে গতরাত থেকে পিংকির জ্বর, সঙ্গে বমি। গা পুড়ে যাচ্ছে। পিকলুরও সারা শরীরে ব্যথা। তবু কুসুম- পুরে যেতে হবে। নানাবাড়ির স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে ঝুলছে তার চোখে। বাস থেকে নেমে আবার পায়ে হাঁটা পথ।

পড়ন্ত বেলায় সেই পায়ে হাঁটা পথে পা ফেলেই দাঁড়িয়ে পড়ে পিকলুর আব্বু। বছর দুয়েক আগে পিকলুর ছোট খালার বিয়ে উপলক্ষে যখন এসেছিল, তখন শ্বশুরের পাঠানো ছইতোলা গরুগাড়ি ছিল তাদের অপেক্ষায়। বিয়ের পর যতবার এসেছে কুসুমপুরে, এই পথটুকুর জন্য এ বন্দোবস্ত বরাবরই থেকেছে। কিন্তু এবার এই পথ কিভাবে পাড়ি দেবে ভেবে পায় না। বটতলায় পিকলুদের বসিয়ে রেখে সে এদিকে সেদিকে ছোটাছুটি করে।গাড়ি- ঘোড়ার কোনো কিনারা হয় না। বাসের যাত্রী আরো দুচার জন নেমেছিল বটতলা স্টপেজে, তারা অনেক আগেই হাঁটতে শুরু করেছে। একজন উৎসাহী হয়ে জানতে চেয়েছিল─ তারা কোথায় যাবে। কিন্তু জবাব শোনার পর সেও দাঁড়ায়নি। যাবার আগে পরামর্শ দিয়েছে ─হাতে যখন বেহাতি নেই, হাঁটতে শুরু করেন। সন্ধ্যা লেগে যাবে যে!

পিকলুর আব্বু ফিরে এসে সেই কথাই বলে, ব্যাগ-ব্যাগেজ কেড়ে নিয়ে ওর ভালোই করেছে। নাও, সবাই পা চালাও।

এ সময়ে হঠাৎ ট্যাঁ ট্যাঁ করে কেঁদে ওঠে পিংকি। ওকে তো এক পাও হাঁটতে হবে না। তবু যেন এ সিদ্ধান্ত মোটেই পছন্দ হয় না ওর। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পিকলু প্রস্তাব দেয়,

হাঁটতে শুরু করব আব্বু?

তুই সত্যিই হাঁটতে পারবি?

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায় পিকলু,

হ্যাঁ।

তারপর আব্বুর হাতের আঙ্গুল ধরে আবদার জানায়─ আমাকেও একবার কোলে নিতে হবে কিন্তু।

মুখে বলে বটে, তবু কোলে ওঠার জন্য সে মোটেই দাঁড়ায় না। সবার আগে আগে হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে পিকলু কখনো সামনে চলে যায়, কখনো পিছিয়ে পড়ে। পিছন থেকে চিৎকার করে পিংকিকে পিচ্চি বলে ডাকে, জাগিয়ে রাখতে চায়। হঠাৎ কোথা থেকে যেন হারানো উৎসাহ খুঁজে পায়। কাছাকাছি ছুটে এসে নানার কথা, বড়মামার কথা জিজ্ঞেস করে। কথায় কথায় মন্টু মামাকে

ও মনে পড়ে যায়, তখন শুধায়─ মন্টু মামাকে তো বাড়িতেই পাওয়া যাবে, তাই না আম্মু?

পিকলুর এই স্বতঃস্ফূর্ত চঞ্চলতা ভালোই লাগে ওর আব্বু- আম্মুর। ক্লান্তিতে তাদের হাত-পা ভেঙে আসছে। আম্মুর পায়ে ফোস্কা ওঠায় এরই মাঝে স্যান্ডেল হাতে নিতে হয়েছে। পিংকি কোল বদল করে এই ফাঁকে উঠেছে আব্বুর কোলে। তা নিয়েও পিকলুর কোনো হিংসা নেই। আহা, বেচারা জানেই না─ নানাবাড়ি এখনো কত দূরে। এই উদ্যম আর কতক্ষণ থাকবে কে জানে!

হঠাৎ পিকলুর ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে হোঁচট লেগে এক রাশ পথের ধুলো ছিটকে পড়ে। হোঁচটের ধাক্কা সামলাতে পারে না। ধুলোবালির মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় পিকলু। প্রাণপণ চিৎকার করে ওঠে─ আম্মু! দৌড়ে গিয়ে পিকলুকে

কোলে তুলে নেয় ওর আব্বু।কিন্তু পিকলুর তখন দুচোখে ঘন অন্ধকার। চিৎকার করে কাঁদছে, চোখের মধ্যে ধুলো পড়েছে। চোখ জ্বালা করছে। কিছু দেখতে পাচ্ছে না।

এরপরে দীর্ঘক্ষণ পানির ঝাপটা দিয়ে চোখ কিছুটা পরিষ্কার হয়ে এলেও বাকি পথ আর হেঁটে যাবার উদ্যম পায় না পিকলু।নাকমুখ মুছতে মুছতে চেপে বসে আব্বুর কোলে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পরপর পিকলুরা যখন বিধ্বস্ত অবস্থায় নানাবাড়িতে পৌঁছে, তখন সারা বাড়ি নিঝুম নিস্তব্ধ। যেনবা এ বাড়িতে রাত নেমে এসেছে অনেক আগেই। দীর্ঘ দুবছর পর বড় মেয়ে-জামাই

নাতি-নাতনি এসেছে, তবু কারো চোখেমুখে উচ্ছ্বাস নেই। এ সব দেখে শুনে পিকলুর খুব মন খারাপ করে। একটু পরে সে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। এই কান্না সবার মনের বাঁধ ভেঙে দেয়। পিকলুর নানি তার বড় মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ শুরু করে। পিংকিও অবিলম্বে যোগ দেয় এই কান্নাপ্রবাহে।

প্রাথমিক আবেগ সংহত হয়ে এলে জানা গেল, যশোরের মনিরামপুর থেকে খবর এসেছে, পিকলুর ছোটখালাকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে। খালুও তখন থেকে নিরুদ্দেশ। খবর শুনে এ বাড়ির সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। সেই মনিরামপুরের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছে পিকলুর বড় মামা। এরই মাঝে পিকলুরা এসে হাজির।

এদিকে মন্টুমামাও বাড়ি নেই। প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলতে চায় না। কিন্তু বড় মামার মেয়ে পারুল সব জানিয়েছে পিকলুকে। খুব গোপনে আর সাবধানে, কাউকে না বলার শর্তে জানিয়েছে – মন্টু মামা যুদ্ধে গেছে। পিকলুদের বাসা থেকে চলে আসার পর গ্রামের বন্ধুদের ডেকে সংগঠিত করে, তারপর সবাই মিলে ভারতে চলে যায় ট্রেনিং নিতে। যুদ্ধে যাবার ব্যাপারটা খুব স্পষ্ট করে বোঝে না পিকলু,তবু পারুলের কাছে খবরটা শুনে তার বেশ ভালো লাগে। মনের আকাশ থেকে কালো মেঘ কেটে যায় ধীরে ধীরে। ভেতরে ভেতরে সাহস আর আনন্দ খুঁজে পায়। একদিন খুব সতর্ক ভঙ্গিতে ফিসফিস করে বলে─ মন্টুমামার খবর জানো আম্মু?

মন্টু?

প্রথমে চমকে ওঠে পিকলুর আম্মু। যেন কোন মন্টু সেটা নির্ণয় করতেই সময় লাগে। তারপর ছেলের মুখে হাত চাপা দেয়। তবু পিকলু ঠিকই প্রশ্ন করে,

মন্টুমামা কার সঙ্গে যুদ্ধ করবে আম্মু,

বিহরিদের সঙ্গে?

আহ্ থাম তো! কে বলেছে এ সব কথা?

চাপা কণ্ঠে ধমকানি দেয় পিকলুর আম্মু। তবু কৌতূহল মেটে না পিকলুর,

বল না আম্মু─ কার সঙ্গে যুদ্ধ, মিলিটারির সঙ্গে?

ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় পিকলুর আম্মু র। ঠাস করে একটা চড় কষে অবশেষে ছেলের মুখ বন্ধ করে দেয়। পিকলু খানিক গাল ফোলায়, চোখ কচলায়, তারপর চলে যায় পারুলের সঙ্গে খেলতে। খেলা বলতে উঠোনের আমতলায় ধুলোবালি নিয়ে মিছেমিছি রান্নাবান্না খেলা, অথবা বারান্দার কোনায় বসে পুতুল নিয়ে ঘর সাজানোর খেলা, উঠোনের ধুলো ঘরে তুলে একাকার।

এই নিয়েই ওরা মেতে আছে আজ কদিন। এই খেলাতেই যেন কত আনন্দ।

এরই মাঝে একদিন মিলিটারি আসে কুসুমপুরে। রাতের আঁধারে নয়, প্রকাশ্যে দিবালোকে। ওদের আগমনের ধরণই আলাদা। গ্রামের শুরুতেই পরপর গোটা দশেক বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল, রাইফেলের গুলিতে লাশ ফেলে দিল পাঁচ সাতটা, তারপর লুটপাট করতে করতে চলল সামনে এগিয়ে।

পিকলু-পারুলরা সেদিন বারান্দার কোনায় খেলতে বসেছে। ওখানেই রান্নাবান্না, ওখানেই পুতুল-বিয়ে। বর-কনে উভয় পক্ষের একমাত্র নিমন্ত্রিত অতিথি পিকলুর নানা। বেশ জমেছে আনন্দের খেলা। কিন্তু হঠাৎ সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায় মিলিটারি আসার কারণে। ঐ যমদূতেরা এসে পিকলুর নানাকে এবং আব্বুকে খুব নির্যাতন করে। শ্বশুর-জামাই কেউ কারো মুখের দিকে তাকাতে পারে না। মিলিটারিরা অতি দ্রুত ঊর্দু ভাষায় গটমটিয়ে কী সব উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে দুজনকেই তালগোল পাকিয়ে দেয়। কেবল ‘মন্টু’ শব্দটি ছাড়া আর কিছুই বুঝতে পারে না পিকলু। রাইফেলের বাটের আঘাতে ওর নানা গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। তখনই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে পারুল। কিন্তু মিলিটারিরা সেদিকে না তাকিয়ে পিকলুর আব্বুকে ধরে নিয়ে যায় ওদের জলপাই রঙের গাড়িতে। পিকলু উঠে দাঁড়ায়। চিৎকার করে ডেকে ওঠে – আব্বু!

আব্বু ফেরে না।

বরং পিকলু তখনই দেখতে পায়– রান্নাঘর থেকে ওর আম্মুর চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসছে আরেক পাষন্ড মিলিটারি। পরনের কাপড় এলোমেলো লুটিয়ে পড়েছে। সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করতে করতে, হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বারান্দায় এসে আছড়ে পড়ে পিকলুর আম্মু। কিন্তু তাতেই কি সে রক্ষা পায়! চওড়া গোঁপঅলা লোকটি তখন জাপটে ধরে তাকে। আর দেরি না করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে পিকলু।একটুখানি পিছিয়ে এসে দুহাতের আঁজলায় ধুলোবালি ভরে নিয়ে ক্ষীপ্রহাতে ছুঁড়ে দেয় লোকটির চোখেমুখে। বিকট শব্দে চিৎকার করে ওঠে লোকটি। দুচোখে তার ঘোর অন্ধকার। কাজেই তার হাতের বাঁধন আলগা হয়ে আসে। সেই সুযোগে পিকলুর আম্মু এক দৌড়ে ছুটে চলে যায় উঠোনের পশ্চিমে আমবাগানের দিকে।

পারুলের হাত ধরে পিকলুও ছুটতে থাকে সেই দিকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *