কাইয়ুম চৌধুরী লোকায়ত শিল্পের আশ্রয়ে বাংলার আধুনিক শিল্পধারায় নতুন যুগের সূচনা করেছেন

শেখ মেহেদী হাসান

শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বাংলাদেশে শিল্পকলা জগতের অন্যতম পথিকৃৎ। ছয় দশকের নিরন্তর শিল্প সাধনার পথ বেয়ে লােকায়ত শিল্পের আশ্রয়ে বাংলার আধুনিক শিল্পধারায় নতুন যুগের সূচনা করেছেন। কেবল চিত্রকলা নয়, আমাদের বইয়ের প্রচ্ছদ, অঙ্গসজ্জা, শিরােনাম, ইলাস্ট্রেশনসহ সামগ্রিক শিল্পরুচি বদলে দিয়েছেন এই মহান শিল্পী। তার জন্ম ফেনীতে, ১৯৩৪ সালের ৯ মার্চ। পিতা আবদুল কুদুস চৌধুরী ছিলেন সমবায় পরিদর্শক এবং পরে হয়েছিলেন সমবায় ব্যাংকের কর্মকর্তা। পারিবারিক পরিবেশ ছাড়াও তার সামাজিক যােগাযােগও ছিল বিস্তৃত। নােয়াখালীতে গােপাল হালদার, কুমিল্লার ধ্রুপদী গায়ক মােহাম্মদ হােসেন খসরু, শিল্পী শচীন দেববর্মণ ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ সুহৃদ। এমনকি চট্টগ্রামের খ্যাতিমান লেখক ও পুঁথিসংগ্রাহক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সঙ্গে তাদের পারিবারিক পরিচয় ছিল।

বাবার চাকরিসূত্রে পড়াশােনা করেছেন চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নড়াইল, সন্দ্বীপে, নােয়াখালী, ফেনী, ফরিদপুর এবং ময়মনসিংহে। এসব জেলায় থেকে এবং ঘুরে নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চার করেন কাইয়ুম। ছেলেবেলায় অঙ্কে তার ভীতি ছিল। তিনি বলেন- “আমার কাছে অংক ছিল একটি আতঙ্ক। পরীক্ষা দিলে সব বিষয়ে ভালাে ফল হয়। অঙ্কে হয় না! কখনাে অংক খাতায় ছবি এঁকে বসে থাকি একদিন আমার শিক্ষক রােহিনী বাবু বলেন, ‘অঙ্কের খাতায় ছবি আঁকা কেন?’ আমি বললাম, অঙ্ক পারি না বলেই তাে ছবি আঁকি। সমস্যা হলাে টেস্ট পরীক্ষায় পাস না করলে তাে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়া যাবে না। আমি তখন ময়মনসিংহের সিটি কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র। আসন্ন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার উদ্দেশে টেস্ট পরীক্ষা দিলাম কিন্তু অংক পরীক্ষা দিলাম না। পরীক্ষার পর স্কুলের হেড মাস্টার আমাকে ডেকে বললেন, ‘তুমি তাে সব বিষয়ে ভালাে করেছে, কিন্তু অংক পরীক্ষা দাওনি কেন?’ চুপ করে থাকলাম। তিনি বললেন, ‘তােমার বাবাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবে।’ আমি বাবাকে গিয়ে বললাম। বাবা তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন। হেড মাস্টার সত্যেন বাবুর ( আমাদের অঙ্কের শিক্ষক ) কাছে তিন মাস অঙ্ক শিখবার পরামর্শ দিলেন। এভাবে ম্যাট্রিকুলেশন উত্তীর্ণ হয়েছিলাম সেকেন্ড ডিভিশনে।”

বাবার প্রভাবে শৈশব থেকে সংগীতে ও গ্রন্থপাঠে আগ্রহী হয়ে ওঠেন কাইয়ুম চৌধুরী। তাদের বাড়িতে ছিল বইপত্রের বিশাল ভাণ্ডার। তা ছাড়া কলকাতা থেকে ডাকযােগে নিয়মিত বাংলা সাময়িকীপত্র আসত। প্রবাসী, ভারতবর্ষ, মানসী, মর্মবাণী, বঙ্গশ্রী এমনকি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বঙ্গদর্শন- এর পুরনাে অনেক সংখ্যাও ছিল পারিবারিক সংগ্রহে। এ ছাড়া গ্রামােফোন রেকর্ডের সংগ্রহ ছিল। স্কুলজীবন থেকে তার আঁকাআঁকির ঝোঁক ছিল। তখনকার দিনে আঁকাআঁকি শেখার জন্য যেতে হতাে কলকাতায়। কিন্তু তা ছিল পরিবারের সামর্থ্যের বাইরে। ময়মনসিংহের আকুয়ায় বসবাসকালে তার বাবার সঙ্গে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরিচয় হয়। সে সূত্রে কাইয়ুম ঢাকায় এসেছিলেন চারুকলায় ভর্তি হতে।

১৯৪৮ সালে গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস প্রতিষ্ঠিত হয় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের উদ্যোগে। ঢাকার জনসন রােডে একটি পুরনাে দালানের দুটি কক্ষ নিয়ে গড়ে উঠেছিল ঢাকা আর্ট স্কুল। এক সকালে ওই আর্ট স্কুলে হাজির হয়েছিলেন। তিনি কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘আমাকে দেখে বিশালদেহী বিহারি দারােয়ান হাঁক ছাড়লেন, ‘কেয়া মাংতা। আমি জয়নুল আবেদিনের কথা বলতেই তিনি তার বসার স্থান দেখিয়ে দিলেন। দোতলায় উঠতে আবেদিন সাহেবের সঙ্গে দেখা মৃদু হাসিতে তিনি বললেন, ‘ময়মনসিংহ থাইকা আইছ? আনােয়ার ( শিল্পী আনােয়ারুল হক ) সাব, এই যে আরেকজন ওরে বহাইয়া দেন। তারপর এক কক্ষে প্রবেশ করে দেখি, মাঝখানে একটি কলস। নবীন কিছু ছেলে তার ড্রয়িং করছে। এর মধ্যে একজন তরতরিয়ে আঁকছে আর পা দোলাচ্ছে। পরে তার নাম জানতে পারি মুর্তজা বশীর আমিও আঁকতে বসলাম। কিছুক্ষণ পর একজন বললেন, আর ঘষাঘষির দরকার নাই। তোমাদের ভর্তি পরীক্ষা শেষ। ছবি জমা দিয়ে দাও। কিছুক্ষণ পর ফল বের হলো। একজন ফেল তার নাম রশিদ চৌধুরী। রশিদ তাে রেগে আগুন, সে হল্লা শুরু করলো। তার হল্লা শুনে জয়নুল আবেদিন বললেন, ‘তুমারে তিন মাস সময় দিলাম। এর মধ্যে শিখ্যা ফালাইবা। ‘আবেদিন সাহেব আমাকে বলে দিলেন, কাইয়ুম, কার্টিজ পেপার, বাের্ড, পেন্সিল আর চায়নিজ ইঙ্ক কিনে ফেললা।’ ১৯৪৯ সালে শুরু হলাে আমার ছবি আঁকার নতুন জীবন।

আর্টস কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রহমান, আবদুর রহমান প্রমুখ। দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী, রশীদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, মুর্তজা বশীর, দেবদাস চক্রবর্তী, আলী হুমায়ুন প্রমুখ। প্রথম ব্যাচের ছাত্র আমিনুল ইসলাম তাদের নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তিনি অত্যন্ত প্রগ্রেসিভ ছিলেন। তারা দুজনই থাকতেন সিদ্ধেশ্বরী। আমিনুলের সাইকেলে ডাবলিং করে আসা- যাওয়া করতেন। তারা ছবি আঁকার জন্য আউটিংয়ে যেতেন রামপুরা, জিঞ্জিরা, বুড়িগঙ্গার পাড়ে। পুরানা পল্টনে ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসের লাইব্রেরিতে তাদের যাতায়াত ছিল। ওই লাইব্রেরিতে চিত্রকলাবিষয়ক স্টুডিও আর আর্ট অ্যান্ড আর্টিস্ট নামে দুটি পত্রিকা আসত। সারা দিন আউটিং করে বন্ধুরা মিলে সিনেমাও দেখতেন মুকুল ( বর্তমান আজান ), মানসী, নিশাত, ওয়াইজঘাটের মায়া হলে।

ঢাকা আর্ট গ্রুপের প্রথম প্রদর্শনীর আয়ােজন করা হয় ১৯৫১ সালে। তখনাে শিক্ষার্থীরা শিল্পের তালিম গ্রহণে সিদ্ধ হয়ে উঠতে পারেনি। এটি ছিল আর্ট কলেজের বার্ষিক প্রদর্শনী। কার্জন হলের পেছনকার লিটন হলে আয়ােজিত এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল চারুকলার শিক্ষকদের শিল্পকর্ম এবং সেই সঙ্গে নবীন ছাত্রদের কিছু কাজ। প্রদর্শনীতে টিকিট কেটে প্রবেশের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। লোক সমাগম হয়েছিল প্রচুর। ঢাকা আট গ্রুপের দ্বিতীয় বার্থিক প্রদর্শনীর উম্বােধনের দিন ধার্য হয়েছিল ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, নিমতলীর ঢাকা জাদুঘরে। ইতিহাসবিদ আহমদ হাসান দানী তখন ঢাকা জাদুঘরের পরিচালক। তার সঙ্গে জয়নুল আবেদিনের সুসম্পর্ক ছিল। ঢাকা জাদুঘরের কক্ষের ভারী ভারী মূর্তি সরিয়ে স্থান করা হয়েছিল প্রদর্শনীর। কথা ছিল গভর্নরের পত্নী মিসেস ভিকারুন নিসা নুন প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন। কিন্তু আগের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে সেই আয়ােজন পরিত্যক্ত হয়। শিল্পী আমিনুল ইসলাম, ইমদাদ হােসেন, মুর্তজা বশীর, দেবদাস চক্রবর্তী, কাইয়ুম চৌধুরীসহ অনেকেই সেই মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন আর্ট কলেজের শিক্ষার্থীদের সামাজিক সম্পৃক্ততা ও রাজনৈতিক অবস্থান যেন নিয়তি নির্দিষ্ট করে দিল।

১৯৫২ সালের শেষ দিকে সেগুনবাগিচায় বাগান ও মাঠসমেত বনেদি দোতলা ভবনে ইনস্টিটিউট স্থানান্তরিত হয়। এরপর শুরু হয় নিজস্ব ভবন নির্মাণের প্রয়াস। ১৯৫৩ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকী স্মরণে হাসান হাফিজুর রহমান ও মােহাম্মদ সুলতানের যৌথ উদ্যোগে যে ঐতিহাসিক সংকলন প্রকাশিত হয় তাতে লিনােকাট ও ড্রইং করেছিলেন মুর্তজা বশীর ও বিজন চৌধুরী। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন আমিনুল ইসলাম। আর সদরঘাট থেকে যে মিছিল বের হয়েছিল তার পুরােভাগে ছিলেন রশীদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুমসহ অনেকেই। ১৯৫৪ সালে আর্ট কলেজ থেকে পাস করার পর আগ থেকেই একাধিক পত্রিকায় ইলাস্ট্রেশন করতেন তিনি। এ সময় তার ঘনিষ্ঠতা হয় সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, বােরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। তার সঙ্গে পরিচয় ছিল কবি জসীমউদ্দীন, ফজলে লােহানী, জহির রায়হান, আবদুল গাফফার চৌধুরী, শিল্পী আবদুল লতিফ, শেখ লুৎফর রহমান, আবদুল আলিম প্রমুখ লেখক ও শিল্পীর সঙ্গে। ১৯৫৬ সালে প্রতিভাবান স্থপতি মাজহারুল ইসলামের নকশায় তকালীন ঢাকার আধুনিক স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনস্বরূপ বর্তমান ভবন নির্মিত হয়।

শিল্পাচার্য ছাত্রদের উৎসাহিত করতে ঢাকার বাইরে পিকনিকের আয়ােজন করেছিলেন। সেখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন কবি জসীমউদ্দীন ও শিল্পী আবদুল আলিম। তাঁর পরিকল্পনা ছিল দিনে ছাত্ররা ছবি আঁকবে রাতে বসবে গানের আসর। তখন ছিল বর্ষাকাল। টানা বৃষ্টিতে বাইরে বেরােতে পারছিল না কেউ। সিদ্ধান্ত হলাে কবিগানের আসর বসবে। শিল্পী রশিদ চৌধুরী বনাম কবি ও আবদুল আলিম। আবেদিন স্যার সবাই সজাক করে দিলেন, ‘কবির মান রাইখ্যা গাইবা মিয়ারা। ধুয়ার সময় বলবে, ও সাধের পল্লিকবি রে?’ জসীমউদ্দীন শুরু করলেন- ‘মরি হায় হায় / এই ছিল কপালে / পাঁচশ টাকার বাগান আইল পাচসিকার ছাগলে।’ রশিদ চৌধুরীর দল বলল- ‘ও বগা ঠগ দিও না কপালে। পাকিস্থান অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর আবেদিন সাহেব গভীর রাতে কাইয়ুমকে ডেকে এনে থাপ্পর দিয়ে বলেন, ‘মিয়া, পুরস্কার পাইয়া গেছ। লাহােরের অল পাকিস্তান অ্যাওয়ার্ড। আইজ বিকালে টেলিগ্রাম পাইয়া তােমারে খালি খুঁজতাছি। তিনি ছিলেন আমাদের প্রেরণার উৎস।

১৯৫৭ সালে কাইয়ুম চৌধুরী আর্ট কলেজে শিক্ষকতায় যােগ দেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি চলছিল তার ডিজাইন ও প্রচ্ছদ অঙ্কনের কাজ।
১৯৫৯ সালে বন্ধুবর গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের সন্ধানী প্রকাশনী শুরু হয় জহির রায়হানের শেষ বিকালের মেয়ে গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে। এই বছর বার্ডস অ্যান্ড বুকস প্রকাশ করেছিল কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্য প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে এ বইয়ের অনুপম প্রচ্ছদ আঁকেন তিনি। সচিত্ৰ সন্ধানী পত্রিকায়। গাজী শাহাবুদ্দিনের প্রধানতম সহায় ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন পত্রিকার বিন্যাস, অঙ্গসজ্জা, বিষয়-পরিকল্পনা, কার্টুন অঙ্কনসহ নানা কাজে। নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছেন আরও একাধিক পত্রিকা সাময়িকীতে। দৈনিক সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের নামলিপি তার সৃষ্টি। তার গ্রাফিকশৈলীর প্রভাব গভীর। প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে তার অবদান অতুলনীয়। তার ক্যালিগ্রাফির সৌন্দর্য গভীরভাবে আকর্ষণ করে পাঠকহৃদয়। তুলির আঁচড়ে বইয়ের কনটেন সাবলীলভাবে ফুটে ওঠে তার নান্দনিক প্রচ্ছদে। উপমহাদেশের প্রচ্ছদশিল্পের অন্যতম প্রধান রুপকার কাইয়ুম তার শিল্পকর্মের মতাে যত্ন নিয়ে প্রচ্ছদ আঁকতেন এবং প্রচ্ছদ অঙ্কনে তিনি যােগ করেছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক বিবেচনা। ১৯৫৩ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকী স্মরণে হাসান হাফিজুর রহমান ও মোহাম্মদ সুলতানের যৌথ উদ্যোগে একুশে ফেব্রুয়ারী নামে যে সংকলন প্রকাশের প্রয়াস নেওয়া হয় তার জন্য লিনােকাট ও ড্রইং করেছিলেন মুর্তজা বশীর ও বিজন চৌধুরী। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম।

১৯৫৫-৫৬ সালে তিনি নানা ধরনের ব্যবহারিক কাজ করেছেন, বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, আর করেছেন বইয়ের প্রচ্ছদ ও সচিত্রকরণের কাজ। কেবল প্রচ্ছদ অঙ্কনই নয়, পেছনের মলাটের লিপিবিন্যাস, নামপত্র, পৃষ্ঠাসজ্জা, বাধাই ইত্যাদি মিলিয়ে প্রকাশনাকে একটি সামগ্রিক শিল্পরুচির বাহক করে তোলেন।
১৯৬০ সালে শিল্পী তাহেরা খানমকে বিয়ে করেন। স্ত্রীর প্রেরণাদায়ক ভূমিকা সৃষ্টিশীল কর্মে উযুদ্ধ করেছে। ওই বছর আট কলেজ ছেড়ে যােগ দেন। কামরুল হাসানের নেতৃত্বে নবগঠিত ডিজাইন সেন্টারে। ১৯৬১ সালে ডিজাইন ছেড়ে যােগদান করেন অবজারভার হাউসে চিফ আর্টিস্ট হিসেবে।

১৯৫৪ সালে কাইয়ুম চৌধুরী অংশগ্রহণ করেন বর্ধমান ভবনে আয়ােজিত নিখিল পাকিস্তান শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে। ১৯৫৬ সালে সহশিল্পী মুর্তজা বশীর ও সৈয়দ জাহাঙ্গীরকে নিয়ে গড়ে তােলেন পেইন্টার্স ইউনিট। ঢাকা প্রেস ক্লাবে পেইন্টার্স ইউনিট এর প্রথম প্রদর্শনীর আয়ােজন করা হয়।
ওই গ্রুপের একটিমাত্র প্রদর্শনী হয়েছিল। প্রদর্শনী নিয়ে সৈয়দ শামসুল হক ১৯৬২ সালের জানুয়ারি মাসে অবজারভার পত্রিকায় কাইয়ুমঃ এ প্রোর্ট্রেট শিরােনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। ওই নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন,

‘Whereas his contemporaries worked, travelled and had their paintings exhinited in Pakistan and outside Qayyum gradually withdrew himself from the bursting scine. Within the four walls of his tin – roofed house in the suburd he exhibited his works to his only audience himself. He amused himself in the company of very few persons, read avidly the history and legend of art, wrote occasional poetry, drew book cover designs and illustrated periodicals for a living, went to cinema shows a passion with him since boyhood : and determinedly offerd nothing that would at least prove his brush was not idle Within a couple of years it did sink so well that, then, his aberrance seems not a grain conspicuous . Tall and lanky, shy in disposition, modest in outfit and uncertain in specech, he was not the image of a painter that was required of him by the public. He was given up by friends as a lost case. But few people know and ever still understan that underneath the surface a deep self – confidence worked, a nebula whirled, for it must give birth to a star. Qayyum burned not with the grief of impotency. He fought within himself to wrange a unique vision, a personal idiom, a coherency and continual of thought. Above all, he was trying to master himself.

প্রদর্শনী নিয়ে পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় শিল্পসমালােচক সাদেক খান ‘Qayyum Choudhury is the most design – conscious of the three and exhibit a more conspicuous love and sense of rhythm that in its turn forbids the saturation of formal maturity in his paintings. He also posses a knack of representing natural foliage atmosphere in regulated simple design added to the composition.

কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রকলায় পাওয়া যায় আবহমান বাংলার অবয়ব। ১৯৫৯ থেকে ২০১৪ এই ৬২ বছরে কত বই ও পত্রিকার প্রচ্ছদ, অলঙ্করণ করেছেন তার হিসাবে নেই। জয়নুল আবেদিনের মতোই বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির প্রতি টান ছিল তাঁর। মৌলিক চিন্তক হিসেবে নিজের জলরং, তেলরং, কালি ও কলমের ড্রয়িংয়ে তা তুলে ধরেছেন আন্তরিকভাবে। তাঁর অঙ্কনশৈলীতে চিরায়ত বাংলা এমন বিশিষ্টরুপে চিত্রিত হয়েছে, যা একান্তভাবে তারই স্বাক্ষর বহন করে। কাইয়ুমের ক্যানভাস দেখলেই তার নিজস্ব রুচি ও মৌলিক এক শিল্প আঙ্গিক ধরা পড়ে। রেখাচিত্রে তার অপূর্ব নৈপুণ্য। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘অবশ্যই আমি আমার ছবিতে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সচেতনভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করি।

আর বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমের সফল কর্মকাণ্ডে সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয় বৈকি।’ তার নিজের আঁকা ছবিতে ধৃত হয়েছে আবহমান বাংলার বিচিত্র রূপ।

সংগীতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগ্রাহক ছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। তাঁর সংগ্রহে ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজারের অধিক গানের রেকর্ড। সংগীত ও চলচ্চিত্রের সমজদার কাইয়ুমের পঠন-পাঠনের ব্যপ্তি ছিল ঈর্ষণীয়। তার ঐতিহ্যজিজ্ঞাসা সবাইকে বিস্মিত করত। আমৃত্যু সৃজনশীল কিন্তু অন্তর্মুখী মানুষটি কেবল নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন।

বাংলাদেশের চিত্রকলা আন্দোলনের অগ্রগণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর প্রধান অঙ্গীকার ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা। ৩০ নভেম্বর ২০১৪, ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়ােজিত উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে চতুর্থ দিনের উদ্বােধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যু গৌরবময়। সুন্দরের সাধনায় নিমগ্ন থেকে বিপুল শিল্পের সঙ্গীদের উপস্থিতিতে বিদায় নেন তিনি। হেমন্তের শেষ বেলায় ১ ডিসেম্বর ২০১৪ – এ তাঁকে আজিমপুর পুরনাে কবরস্থানে শ্বশুর খান সাহেব বদরুদ্দীন আহমেদের কবরে শাষিত করা হয়।

এই মহান গুণীর মৃত্যু দিনে কাব্যশীলনের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

One thought on “কাইয়ুম চৌধুরী লোকায়ত শিল্পের আশ্রয়ে বাংলার আধুনিক শিল্পধারায় নতুন যুগের সূচনা করেছেন

  • নভেম্বর ৩০, ২০২০ at ৪:২৮ অপরাহ্ণ
    Permalink

    অনেক অজানা তথ‍্য জানতে পারলাম। বিশেষ করে পঞ্চাশ হাজার গানের রেকর্ড। তাপ্পড় মেরে পুরস্কার প্রাপ্তির তথ‍্য জানান দেয়া। ধন্যবাদ লেখককে।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *