দীর্ঘ কবিতা।। অলিখিত উচ্চারণ, প্রিয়তমা।। আলমগীর রেজা চৌধুরী

করতলে রক্ত, আমি ফিরে এসেছি প্রিয়তমা।
হাতে রক্তের দাগ, তার উষ্ণতা বুকের ধমনীতে
প্রবহমান, আমি তার বীর্যবান ধারক, তুমি বিশ্বাস করো।
পুনর্বার বিদীর্ণ স্মৃতির কাছে মেলে দিয়েছি আমাদের রক্তাক্ত দলিল─
অতীত ঐতিহ্য প্রতিদিন বেড়ে ওঠে বাক্যবিদ্ধ প্রাচীন মহীরুহ;
এক দীপ্রবর্ণ নগর থেকে যেন তীব্র ইশারায় ছুটে আসছে
আমার সুবর্ণ ভবিতব্য
আমাদের সুবিস্তৃত মানবিক আটচালা সংসার।
তুমি কি হাত বাড়িয়ে ফিরিয়ে দেবে আমাদের জয়ের প্রথম অভিবাদন
আমার ভালোবাসার দীপ্ত আহব্বান।
কালের কঠিন সাহসী প্রেমিক নজতানু, প্রিয়তমা।
করতলে রক্ত, আমি হাত উত্তোলিত করে
সান্দ্র উচ্চারণে বলে উঠলাম
এই তো আমার জমিন, প্রিয়তমা
এই তো আমার ভালোবাসার সবুজ সংসার।
গায়ের ছায়াতৃণ পথ আমাকে ডেকেছে বারবার
পুষ্পিত শস্যক্ষেত্র স্মরণে এনেছে আমার প্রপিতামহের দর্পিত পরিচয়
শস্যের সোনালী দানা আমাদের সবুজ উঠোন জুড়ে
বিছিয়ে দিয়েছে একজন ঘর্মাক্ত ফসল-শ্রমিক।
আমার রক্ত-মাংসে সেই সুবাতাস বইয়ে দিয়েছিলো
একজন বাঁশিওয়ালা রাখাল,
আমি তার ভালোবাসার প্রথম রাখালিয়া
আমি তার ফসলিম সবুজ অস্তিত্ব।
এই তো পরিচয়, এক ক্ষীণতোয়া বংশাইর আহব্বান
আমাকে অসীম মহাসাগরের দিকে ডাকছে
যেন ভালোবাসায় আমি জন্ম থেকে তোমার আকর্ষণে
তৃষ্ণার্ত ছিলাম,
তোমার কাছে নতজানু প্রিয়তমা।
আমাদের বিদায় বিচ্ছেদের রক্তিম দুঃখগুলো তোমার জলের
সাথে মিশে গিয়ে অনন্তকাল তোমার মধ্যে রয়ে গেলো─
হে শৈশবের পাহাড়ী নদী বংশাই !
আমার কিছুই রইলো না
আমি তোমায় ছেড়ে চলে এলাম
শীর্ণ স্মৃতির মতো তুমি কষ্টকর শৈশব-প্রেমিক।

রাস্তার মধ্যিখানে কিছু তরুবীথি তার দিকে টেনেছিলো
আমি যাইনি
বুনো সংসারের ঘনারণ্য ভেদ করে তার দিকে টেনেছিলো
আমি যাইনি
বুনো সংসারের ঘনারণ্য ভেদ করে তীর্যক আলোক চোখ
আমাকে তার দিকে ডাকছে,
ধাতব নাগরিক জনপদে আমি উন্মুল উন্মাতাল
হয়ে তোমার কথা ভাবিনি;
হে প্রিয় মানুষ
হে প্রিয় নদী বংশাই
হে প্রিয় তরুবীথি
তোমাকে অস্বীকার করে আমি নাগরিক মানুষ।
আমি তো সেই প্রথম থেকেই বলেছি─
অবাক এই নগর, নিয়নসাইন, কোলাহলমুখর বাহারী বিপণি বিতান,
ফালি ফালি করে দেয় আমার নব্য জীবন।
পত্রালির মতো ঝরতে থাকে শৈশবের স্বপ্ন দোলানো
মসৃণ কাল্পনিক ছবি।
যা আমাকে একদিন,
নতুন পথ এক নতুন বিশাল বিস্তৃতি
সবুজাভ বন্দরে নিয়ে গিয়েছিলো।
আমি কোনো পণ্যই নিজের জন্য রাখিনি
শুধু স্বপ্নে ভাসতে চেয়েছি।
এই নগরে এসে আমি সবকিছুই হারিয়ে ফেলেছি,
আমার কিছুই নেই।
শহরের নিঃসঙ্গ ল্যাম্পপোস্ট থেকে দুঃখিনি বেশ্যার জঠর যন্ত্রণা
আমি জেনেছি,
নপুংসক রাজনীতিবিদদের পলায়নরত গুপ্ত ফটক,
অলৌকিকভাবে পাল্টে যায় মুখোশের মুখ।
আহা, এতো তাড়াতাড়ি শেষ হলো পিতার আমল !
আমাদের শহর জুড়ে তখন প্রগতির হাওয়া; কাগজের হেড লাইনে
ভিয়েতনাম গেরিলাদের বিজয় উৎফুল্ল অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপ।
শহরের গা ঘেঁষে নদীর বুকে বিশাল এক সাঁকো হয়
ক্রেণ বোঝাই করে ভারি ভারি যন্ত্রাংশ আসে।
রিনিরা বদলি হয়ে এলো
আমরা তখন রিং রোডে থাকি।
আমাদের কী দিন ছিলো, রিনি !

মনে পড়ে কি, হাওয়ায় উড়ানো দিন, রিনি !

রঙিন স্বপ্ন আমাদের নতুন এক অস্তিত্বের দিকে নিয়ে গেছে।
আমরা সেখানে কি নিদারুণ অসহায় ছিলাম
আমাদের কৈশোরিক চঞ্চলতা-আবেগ পরস্পরের বুক ছুঁয়ে গেলো;
সেই তো শুরু।
সেদিনের প্রতিটি ভোরবেলায় নতুন এক সূর্য উঠেছে আমাদের নিয়ে
তোমার-আমার প্রথম প্রেম-প্রেম পাঠ। আহ !
ইটের নিসর্গ বারবার আমাকে গ্রাস করতে চায়,
ঠিক আমি তখন পরস্পর বিরোধী মানবিক আচরণ দেখে
শিউরে উঠেছি।
শহরে দাঙ্গা আসে, রাত ব্যেপে চলে হত্যার মচ্ছব
আমি ভেবে দেখলাম নিউট্রন বোমা তৈরি হয়, উড়ে শান্তির কপোত,
পারমাণবিক প্রকরণে গঠিত হবে মানুষের সবকিছু
যেন অলৌকিক প্রক্রিয়ায় পাল্টে নেবে সভ্যতার শরীর
আদ্যিকালের বিজ্ঞ যাদুকরের মৃত নগরীর মতো পড়ে থাক পৃথিবী;
এইভাবে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের নতুন সভ্যতা।
রিনি আমার রিনি। তোমার কি মনে আছে যেবার আমরা
প্রতিবাদ করে রাস্তায় নামলাম─
জানিয়ে দিলাম শতকে শতকে আমাদের দর্পিত পরিচয়
তোমাদের জানা উচিত,
তোমরা তোমাদের অধিকার ফিরিয়ে দাও।
তারপর কত কি ঘটে গেলো,
আমরা যাত্রা করলাম অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে।
বোমা ফাটানো তীব্র ঘর্ষণে একদিন নতুন ভোর উঠে এলো
তরুবীথিকার কচি পল্লবের চিৎকার শুনে
পাখির দল উড়ে গেলো মুক্ত আকাশে,
আমাদের শহরে পতাকা বদল হলো।
তখনো আমার করতল থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরছিলো।
জয়ের আনন্দ নিয়ে তোমার কাছে ফিরে এসে দেখলাম
বিদেশী যুবা তোমাকে নিয়ে আনন্দ-বিহারে মেতে আছে।
আহা ! আমি তখন প্রতিবাদ করতে পারিনি
কণ্ঠদেশে বিশাল এক সাঁড়াশি চেপে ধরে
আমাকে কথা বলতে দিলো না।
আমার সমস্ত হতাশা ব্যর্থতাগুলো
আমাকে ব্যাঙ্গ করে স্মরণ করিয়ে দিলো
আমাদের অতীতের বীর্যবান ইতিহাস।
আমি তখনো ভুলে যাইনি একদিন আমার হাত দিয়ে
ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিলো সহস্র জঞ্জাল
তিতুমীরের শাণিত কৃপাণ উদ্ধত শত্রুর গ্রীবার
রক্ত পান করে ক্ষান্ত হয়েছিলো,

তিব্বতের পর্বতশ্রেণী অতিক্রম করে ছুটে গিয়েছিলাম
সুদূর স্পেনে।
তারপর স্টেন হাতে লাফিয়ে পড়েছি বাংকার থেকে বাংকারে।
আহা ! মুক্ত স্বদেশের হাওয়া!
আমি কি জানতাম ?
আমি কি জানতাম ?
এভাবেই তোমার কাছে আমার প্রথম পরাজয় হবে !
আমাদের হৃদয়ের পরাজয়।
তারপরও আমি বলতে চেয়েছি এই জনপদের ধূলোরাশির সঙ্গে
আমার তপ্ত রক্ত কণিকা মিশে আছে,
মানুষের উত্তাল ভালোবাসা-সঞ্জাত আমি সেই বিজয়ী পুরুষ।
করতলে রক্ত নিয়ে এই শহরে ফিরে এসেছি প্রিয়তমা।
পিছনে পরে আছে আমার শৈশবের প্রিয় গ্রাম, প্রিয় বংশাই,
প্রপিতামহের স্বপ্ন-সৌধ প্রিয় নিবাস।

তোমার বিশ্বাস,
আমি তো একদিন ফিরে আসবোই
আমাদের শহর পুষ্প বরিষণে ভরে উঠবে
তোমার চুম্বনে জন্ম নেবে নতুন এক সময়
আগামী সন্তানের জন্যে স্বপ্নচ্ছন্ন নিকোনো উঠোন।

করতলে রক্ত, আমি ফিরে এসেছি প্রিয়তমা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *