উপন্যাস

উপন্যাস─ চন্দ্রভানুর পিনিস। নাসিমা আনিস─ পর আট

৮ 

ততদিনে চন্দ্রভানুর জীবনে বড়ো বিচিত্র ঘটনা ঘটে গেছে আর সন্তানহীন জীবন তার কাছে যত না অসহনীয় তার চেয়ে বেশী সরকার পরিবারের কাছে সে। কালিপুরার মহিনউদ্দিন পীর সাহেব বড়ো কাজের লোক, তার হাতে যে একবার পড়বে তার মনোবাঞ্ছা পুরণ না হয়ে যায়ই না। পীর সাহেবের কথা মতো এবার চাঁদপুর ধনাগোদা দাউদকান্দি এই তিন জায়গায় দুই নদীর মোহনায় পর পর চেষ্টা চালানো হবে। যাবার সময় সঙ্গে নিতে বলেছেন বিশেষভাবে পড়ে দেয়া তাবিজ আর তেলপড়া। নদীর উপর কুয়াশার ধোঁয়া ওঠার সময়, গ্রাম জেগে ওঠে ঢেঁকির পাড়ের শব্দে কোন সকালে, তাই বলে খালপাড়ে কে যাবে! না, তবুও পাহাড়া বসে, এবং ক্ষীণকায় খালের উপর পিনিস এসে ভীড়ে আর তার পিছনে দুটো ছইওয়ালা ছোট নৌকা। চন্দ্রভানুর হারিয়ে যাওয়ার বেশ কয়েক বছর পর  তাকে বোঝানো হয়, জোয়ারের সময় মিলন হলে সন্তান না হয়েই যায় না, তো সেই যাত্রায় চন্দ্রভানুর কোন গরজ না থাকলেও আমেনাবিবির মনোভঙ্গি ছিল সহজ, পোলাপান আল্লার দান যহন দিব তহনই পাইবা, না আগে না পরে কিন্তু চেষ্টা করতে অসুবিধা কী?

বাপের বাড়ির লোক মোটেই ঘন ঘন নিতে আসে না, তা সত্ত্বেও কেউ এলেই মুখ ব্যাজার করে বলবে, ঘন ঘন বাপের বাড়ি কী? পিডাপুলি পরে খাইতে যাইব, এহন একটা তরিকার মিদ্যে আছে, খোদায় বাঁচাইলে পোলাপান কোলে কইরা যাইবনে। তারপর এক নৌকায় রাধুঁনি চালডালনুনতেলঘি, দাসদাসী, দোনলা বন্দুক, জুইত্যা টেডা বল্লম আর পিনিসে গুণে গুণে ছয়টা ট্রাংক ওঠে চ›ন্দ্রভানুর শাড়িকাপড় গহনাপত্র আর তেলসাবান নিয়ে। সচরাচর এভাবে সদরঘাট গেলেও এবার যায় মোহনায়। কুদ্দুস অবশ্য দু’একবার ‘ছদরগাট গেলেই অইতো’ বলে বাপের হাতে ধমক খায়, শরম নাই তো তর বেক্কল জানি কোহানকার! নদীর বাস্প উড়ে উড়ে বাতাসে মিলানোর কালে কোমড়ে বিছা, বাহুতে বাজু, কানে মাকড়ি, হাতে কঙ্কণ, গলায় সীতাহার পরে এসে নৌকায় ওঠে এক অচিন রাজকুমারি। কুদ্দুস বোকার মত ১০/১২ বছরের পুরানো বউকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, হয়ত নৌকায় উঠতে ভুলে যায় নতুবা নৌকায় উঠতে গিয়ে বরাবর পানিতে গিয়েই পড়ে।

পিনিসের ভিতর কক্ষ দুইটার একটায় থাকবে চন্দ্রভানু অন্যটায় কুদ্দুস মিয়া কি সরকার কি ভর্তৃরূপী বিদূষক। কেবল জোয়ার শুরু হয়েছে এ ঘোষনা যখন অন্য নৌকা থেকে  আসবে কেবল তখনই কুদ্দুস স্ত্রীর কক্ষে ঢুকতে পারবে। আর নৌকার দুলুনিই বলে দেয় সকালের জোয়ার আর ওরা জোয়ারের বিপরীতেই চলছে। এখন এই ভোরে জোয়ার এসে খাল টইটুম্বুর হয়ে উঠবে পানিতে আর থালবাসনহাড়িকুড়ি নিয়ে বউঝিরা এসে খালপার ছড়িয়ে বসে কত গল্প যে করবে, গল্পে হারিয়ে যাওয়ার চন্দ্রভানুর কাহিনী আর কুদ্দুসের কান্না যত না হয় তার চেয়ে আশ্চর্য এক গল্প বড়ো হয়ে ওঠে, শোনায় কেউ একজন, আর তখন নিজেদের কলবলি থামিয়ে শোনার জন্য সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লে জোয়ারের পানি তাদের মাজা কলাই ওঠা থাল ভাসিয়ে নিতে নিতে ফুটো দিয়ে পানি ঢুকিয়ে ডুবিয়ে দিতে চায়।

আর খাল পেরিয়ে এসে নৌকা গাঙে এসে পড়লে এমন একটা প্রহসনযাত্রার হাস্যকর আয়োজন নিয়ে চন্দ্রভানু একচোট হেসে নেয়। লুন্ঠিত হওয়ার পর বেশ কয়েক বছর অতিবাহিত হয়েছে, বয়সও এখন হয়েছে, ত্রিশ না হলেও বেশী বাকী নাই, বাল্যসখিদের অনেকেই দাদি না হলেও নানি হয়েছে, তো তার আর কিসে সম্ভবনা! একদিন তার কিছুই জানা ছিল না, কিন্তু এখন জীবন যৌবন যৌনতা সক্ষমতা সবই খোলা উন্মুক্ত প্রান্তরের মত স্পষ্ট। আর কোন আশা নাই, আর কোন কিছু পাওয়ার কি হওয়ার সম্ভবনা নাই। লুন্ঠিত হওয়ার সেই আলোআঁধারি ঘর, দম বন্ধ করা পাটের গুদাম আর চন্দ্রভানুর মত শুচিবায়ুগ্রস্থ রমণীকে শেষ পর্যন্ত জোর না করে গ্রাস করা সমর্থ পুরুষ, যে অত্যাচার করতে পারতো, জোর করে দখলে নিতে পারত। অথচ তা না করে নিয়ে যায় এক আশ্চর্য মহলে। মহলে তাকে দুদিন থাকতে দিয়েছে একদম নিজের মত, খেতে দিয়েছে সুস্বাদু সুগন্ধময় খাদ্য। মখমলের ঝালরওয়ালা বিছানা, রেশমি পর্দা ঝাড়বাতিতে সারারাত জ্বলে বড়ো বড়ো মোমবাতি। কারুকার্যময় আসবাব পারশিয়ান কার্পেট আর দামী পানীয়। সুর বাজে টুংটাং রিমঝিম আর চন্দ্রভানুর কারো কথাই মনে পড়ে না তখন। প্রথম দিনের পর পঞ্চম দিনে ফের আসে সেই সুপুরুষ, ঘন্টাখানেক মদ্যপান গান শোনা ব্যাস, ফিরে যায়। ষষ্ঠদিন একেই রকম, শুধু যাবার সময় একটি মাত্র দিন ভিক্ষা চায়, দিলে পর দিনই মিলবে মুক্তি। সেই রাতেই আসে এক অসামান্য বারবণিতা। নাম কমলিকা, দেয়া নাম। আসলে সে বারবণিতা না রক্ষিতা ঠিক বোঝা যায় না। এ ধরনের মেয়েমানুষ তো কখনো সত্যি বলতে পারে না, হয়ত সে সত্যি বলছে, হয়তো বলছে না। তবে সত্যি কথা এত সুন্দর নারী চন্দ্রভানু তার জীবনে কখনো দেখিনি। সে বলেছিল, একটা মাত্র রাত ভিক্ষা চায় রাজা সাহেব, দিলেই মিলবে মুক্তি কিন্তু সাবধান যদি ভালবাসার অভিনয় কর, আর যদি উনি টের পান তুমি তাকে ঠিক আপন ভাবছ না, তাহলে মুক্তি মিলবে না। আর পরিণাম সাঁচিবন্দর, কান্দুপট্টি কি কুমোরটুলি কি টানবাজার। এবার তুমিই সিদ্ধান্ত নাও। আর এখান থেকে যাওয়ার পর যদি তোমার স্বামী তোমাকে গ্রহণ করতে গররাজি হয় তো তুমি নিশ্চিন্তে এখানে ফিরে আসতে পারো, উপপত্নী হিসাবে কাটিয়ে দিবে কিন্তু রাজা সাহেব আর কোনদিন তুমি না চাইলে তোমাকে বিরক্ত করবেন না, আমি কথা দিচ্ছি, এখন তুমি দ্রুত সিদ্ধান্ত নাও। আমার মতো আরো গোটা পাঁচেক রক্ষিতা আছে ওনার, আসলে এই ঘটনার পর আমাদের কোন যাওয়ার জায়গা ছিল না, ফিরিয়ে নিতে গররাজি হয়েছে পরিবার।

 — আর আমি যদি রাজি না হই।
— তাহলে কী হবে আমি অনেক আগেই বলেছি।

 ছপাৎ ছপাৎ বৈঠা পড়ার শব্দ আর পানি কেটে কেটে নৌকা ঢুলুনি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার গতি। সূর্য্য সারা দুনিয়া আলো করে নরম একটা সোহাগ ছড়ায় আর নৌকা গাঙ ছেড়ে মেঘনায় এসে পড়ে। এখানে নৌকা কলাগাছের ভেলা।  নারিকেল আর গুড়ে জর্জরিত ধুপি পিঠার হাড়ি খুলে কাবান্নি এসে চন্দ্রভানুর দরজায় ধাক্কা দেয়। কেউ সারা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করে নাই, এখন চন্দ্রভানুর জানালা খুলে পানির সীমাহীন প্রবহমানতার দিকে তাকিয়ে জীবনকে একেবারে তুচ্ছ মনে করার সময় কিংবা সে বড়ো জোর পরিজনদের কথা ভেবে এক বিচিত্র বচন মনে আনতে পারে, আশায় থাকিল কাউয়া, পাকিলে খাইও ডেউয়া। আবার দরজায় ধাক্কাধাক্কি। তারপর চন্দ্রর মুখোমুখি হলে কাবান্নি অপরাধীর মত মুখ করে বলে, লাল বড়ো ট্রাংটায় পানিপড়া আছে, এহন খাইতে কইছে, সূয্য উটছে তো! চন্দ্রভানু রাগত চোখে তাকায়, বলে, খামু, আমি জানি। তারপর কবাট আটকে বসে এসে ছোট জানালায়। একবার ইচ্ছা হয় পানি পড়াটা বের করে ফেলে দেয় একবার মনে করে খেয়েই ফেলা যায়, শেষে কিছুই না করে পানি দেখেই হয়ত সময় কাটায়।

 আর কুদ্দুস তখন গলুইয়ে বসে সকালবেলার কালিপুরা বাজারে নৌকা ঠেকাতে বলে। আজ দুপুরে সে টাটকা পাঙ্গাশে কবজি ডুবিয়ে ভাত খাবে। এভাবে দুপুর নাগাদ নৌকা এসে ভীড়ে দাউদকান্দি। মেঘনা গোমতী এখানে পাশাপাশি শুয়ে থাকা দুই বোন। কাবান্নির ঈশারায় কুদ্দুস এখন চন্দ্রভানুর দরজায়। আকাশে তখন তেজহীন শীতের সূর্য্য কিন্তু চন্দ্রভানু মুখের দিকে তাকিয়ে এক মুর্হূত চমকে যায় কুদ্দুস। আলুলায়িত কেশ বিস্ফোরিত নেত্র আর অদ্ভুত দেহভঙ্গি দেখে ঘাবড়ে গেলে চন্দ্রই উঠে এসে তাকে বসতে দেয়, নিজ হাতে বানানো পান দেয় রুপার পানদানে। যাতে পীর সাহেবের পড়া শুপারি আর চন্দ্রভানুর কড়া জর্দ্দায় ঠাসা, যদিও কুদ্দুস কস্মিনকালেও জর্দ্দা খায় না। আর এগিয়ে গিয়ে পানটা ধরতে যাবে কি তখনি ঘটে বিপত্তি, কিসে পা আটকে গিয়ে উপুর হয়ে পড়ে চন্দ্রভানুর গায়ে। সেখান থেকে তড়িঘড়ি উঠতে গিয়ে বাড়ি খায় নৌকার আড়ায়, ফলতঃ নাকের হাড় ভেঙে রক্তারক্তি কারবার। গলগলিয়ে পড়া রক্তের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রভানুর কোন বিকার নাই, ঠোঁটের কোনে হয়তো এক চিমটি ক্রুর হাসি দেখে থাকবে কুদ্দুস কিংবা ব্যঙ্গ কিংবা মায়াহীন এক জ্যাস্তবের প্রতিচ্ছবি। তারপর রক্তাক্ত কুদ্দুসকে চন্দ্র যত বিছানায় টানে সে তত দূরে সরতে থাকে। এক সময় হতবিহবল কুদ্দুস ছিটকে বেরিয়ে আসে কক্ষ থেকে।

দাউদকান্দি ঘাটে নৌকা ভীড়ে থাকে দিনের পর দিন। কুদ্দুস হাবাকে নিয়ে হাটে যায়, গরম জিলাপি কিনে খায় আর হাট থেকে অকারণ খুঁজে খুঁজে কেনে কয়েকটা লুঙ্গি। আর প্রতিদিনই পিনিসে ফেরার সময় মনটা বিষাদে ভরে যায়। এভাবে সাত দিন পার করে শিমুলচরে ফিরে আসে পিনিস। আর ফিরার দিন কুদ্দুস শুধু ভয়ে ভয়ে একবার জানতে চাওয়ার মতো করে বলেছে, আপনের কি ছলিল খালাপ? বাড়ি ফেরার পর আমেনাবিবি ঠিক বুঝতে পারে না সে চন্দ্রকে কীভাবে যত্ন নেবে আর বড়ো ভয়ে ভয়ে উঁকি দেয় সেই দড়ি ঝোলা ছায়াচ্ছন্ন কক্ষটায়, যেন সেই স্যাঁতস্যাঁতে ছোপছোপ ধুমটগন্ধ ন্যাকড় আর দেখতে না হয়। কিন্তু অচিরেই তার বাসনা ভূমিসাৎ হয়, ঝোলে, ঝুলতেই থাকে সপ্তাহ জুড়ে। মাস কয়েক বাদে আবার রওয়ানা হয় ধনাগোদা কিন্তু রওয়ানা হওয়ার পরদিনই চন্দ্রভানু জানায় সে খুব দুঃস্বপ্ন দেখেছে তার পক্ষে নদীর বুকে ভেসে বেড়ানো সম্ভব না। আর গ্রামে ফেরার পর আমেনাবিবির আহাজারি গ্রামের মানুষ পর্যন্ত টের পায় কিন্তু টের পায় না চন্দ্রভানু। কারণ আহাজারি হয় চন্দ্রর আড়ালে, চন্দ্র কখনো হয়ত দেখতে পায় না শাশুড়ির অন্ধকার মুখ।

এখনো টাকা মাজার কাজে মাস্টারের বউ মানে ওমর সরকারের বোনকে ঠিকই আসতে হয়। কলস ভর্তি ভেজানো তেঁতুল আর ছাই আর ছোবড়া নিয়ে যখন বসে তখন কত কথা যে হয় ননদ আর ভাউজে। আগে কথা হত খাজনা নিয়ে, ভাউজ খাজনা মাইনষে তো ঠিক মতই দেয় দেহি! — না মাইনষে খারাপ হইয়া গেছে, সাহস বাইড়া গেছে, আগের মতো আর আদায় নাই। আগে প্রতি মাসে না হোক দু’এক মাসে নিশ্চয়ই একটা কলস বাড়তি পাওয়া যেত আর এখন বছরেও একটা কলসি বাড়ে না। মাজতে বেশী সময় লাগে না। আশংকা তাই ননদের হতেই পারে— ভাউজ, মার সাতলরি হারডা না মায় আমারে দিতে কইছিল, খালি আশা দিয়া রাখছেন, মায় মরছে পনরো বছর, কবে দিবেন? — আগো দিমু তো কইছিলাম কিন্তু কুদ্দুস আমার বড় পোলা, নায়-নাতকুর অইলে এইডা দিয়া মুখ চামু মানত করছি, তুই অন্য কিছু নে বইন, ঠকামু না। ভালো মানুষ ননদ মিষ্টি করে হাসে, কুদ্দুসের কি পোলাপাইন হইবো? আমেনাবিবি তাড়াতাড়ি অন্য কথা বলে। ননদ আশা দেয়, আল্লার হুকুম হইলে কতক্ষণ! তয় গয়না কিছু দিয়ো আমারে, মাইয়া গো কিছু দেয়া লাগব।

তারপর বৈশাখ মাসে শেষ চেষ্টা, যাবে চাঁদপুর। ঝড়বাদল কেউ তাদের থামাতে পারবে না। আর পীর সাহেবের কথা, তরিকায় থাকলে কিসির ঝড় কিসির তুফান! সেবার ধনাগোদায় নিয়ে যাবার সময় যেমন খুব পীড়াপীড়ি করে রাজি করিয়েছিল জা মর্জিনা, এবার কিন্তু তেমন কিছুই করা লাগেনি; বরং একটা স্বতস্ফূর্ততা ফুটে ওঠে গোছগাছের বেলায়। স্বপ্নগুলোর ব্যাখ্যা জানার জন্য পূবকান্দি থেকে রজবকে খবর দিয়ে আনানো হয় যাবার আগে। রজব গত তিন বছর ধরে পূবকান্দিতে নতুন তৈরী মসজিদের ইমাম। মিয়াবাড়ি থেকে লেখাপড়া শেষ করে তিন বছর এই গ্রামেই ছিল না। নতুন মসজিদ তৈরির সময় আবার ওর ডাক পড়লে ও এসে তদারকি করে মসজিদ দাঁড় করায়। লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান তোলা, কুরবানীর সময় চামড়ার টাকা তোলা, ঢাকায় থাকা গ্রামের বিত্তশালীদের ঢাকার বাসা খুঁজে টাকার জন্য ধরনা দেয়া সবই করেছে সে। প্রতিদানও দিয়েছে গ্রামবাসী। আরো দু’একজন গ্রামের মওলানা পাশ থাকা সত্ত্বেও কাজটা তারই জোটে।

বহু বছর আগে সে স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে পারলেও, এখন এসব কাজ করে না, এমনকি, ‘আসলে এসব বলতে পারার জিনিস না’ বলে কেটে পড়তে চায়। আর সরকারবাড়ি বহু বছর ধরেই তার আসা যাওয়া বন্ধ। কৈশোরে বোকার মত স্বপ্ন ব্যাখ্যা দেয়া এখন হাস্যকর একটা ব্যাপারই তার কাছে। মতির সঙ্গে সম্পর্ক তার আগে মতই আছে, পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে দিয়ে এখন ডিমের ব্যবসা করে। কালেভাদ্রে দেখা হয় আর নিজের বড়োত্ব জাহির না করেও বড়োত্বই প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু রজব যাই বলুক সরকারবাড়ির তলব তাকে পালন করতেই হয়। কি-না ভয়াবহ স্বপ্ন, ব্যাখ্যা না দিলে সে নৌকায় উঠতেই পারবে না। আর আশ্চর্য, আজকাল সরকারি কাজও বড়ো ঝিমানো হওয়ায়, সত্যি বলতে সরকারিই নাই তবুও খানেক হম্বিতম্বি তো রয়েছে। ওমর সরকারও চন্দ্রর স্বপ্ন নিয়ে বড়ো উৎকন্ঠা দেখায়, সত্যি সত্যি এসব ব্যাখ্যা জানা খুবই জরুরি। আর এ সুযোগে সে তার ছেলের বউর হারিয়ে যাওয়ার অদ্ভুত একটা ব্যাখ্যা খুঁজে পায়, সে হারায়ওনি তাকে কেউ ধরেও নেয়নি, জিন বা এ জাতিও কোন জিনিস তাকে কিছু দিন নিজের কাছে নিয়ে রেখেছিল। এ রকম সৌভাগ্য তো আর যার তার পক্ষে বোঝা সম্ভব না, এ সব বুজতে হলে তরিকায় থাকা লাগে। কী সে জিনিস সে সম্পর্কে কোন পরিষ্কার ব্যাখ্যা যদিও দেয় না তবু স্ত্রী বুঝতে চেষ্টা করলে শুধু বলে, তুমি কি দেখছ, ওর চেহারার মিধ্যে আশ্চর্য একটা জিনিস! আর তানাদের নিয়ে আলোচনা ঠিক না, মুক বন্দ রাহো।
তো স্বপ্নের ব্যাখ্যার জন্য লোক পাঠায় পূবকান্দি রজবের কাছে।

বৈশাখের আলো ঝলমলে সকালে দক্ষিণধারে এসে দাঁড়ালে রজবকে ইজ্জত করে বৈঠকখানায় বসতে দিলে রজবের আগের মতো আর জড়তা খেয়াল করে না কেউ। চন্দ্রভানু এসে বসে শাড়ি দিয়ে আড়াল করা ঘরের অন্য পাশে। স্বপ্নগুলো বলার আগে সবাইকে সরে যেতে বলে চন্দ্রভানু। বলা শুরু করে খুব নীচু স্বরে, ফিসফিস করে বলা কথার অনেক কিছুই রজবের শ্রবণে ঠিক মত ধরা পড়ে না। গত কয়েক মাসের অন্তত দশটা স্বপ্ন সে শোনায়। স্বপ্নগুলো বেশীর ভাগ পাখির বাচ্চা ফুটানো নিয়ে। সব কয়টা বলা শেষ করে সে একটা পুনরাবৃত্তি করে, বলে, একটা অদ্ভুত টিয়া পাখি তার ঘরের পালঙ্কের নিচে ডিম পেড়ে তা দেয়, মাসের পর মাস তা দিলেও বাচ্চা ফুটে বের হয় না। আর বাচ্চা ফুটে বের হয় না বলে টিয়া পাখিটাও আহার করে না। টিয়াটা যখন মরণাপন্ন তখন তার স্বপ্নটা ভেঙে যায়। এ স্বপ্নটা সে কয়েকবার দেখেছে, কতবার দেখেছে তা ঠিক মনে করতে পারে না, একবার ভেবেছিল লিখে রাখবে কিন্তু ঘরে কোন কাগজ কলম না থাকায় সে লিখে রাখতে পারে নাই। আর কাগজ কলম দিয়ে সে এখন কিইবা করবে! পিতার মৃত্যুর পর তো সে আর চিঠিপত্র লেখে না। বহু বছর আগে তার অভ্যাস ছিল কোন বিশেষ স্বপ্ন দেখলে পিতাকে লিখে জানান। এখন বার বার দেখা স্বপ্নটার ব্যাপারে রজব কী পরামর্শ দিবে! কিন্তু রজবের মন নাই স্বপ্নে, তাকে স্বস্তিহীন আদিঅন্তহীন এক মানুষের মত দেখায়। উঠানে দাঁড়ানো সরকার কী যেন ইশারা করলে রজব দোয়া পড়ে আড়াল থেকেই ফুঁ দেয়। রজবের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয় আর ঘাম মুছতে মুছতে তার মনে হয় আকাশে খুব মেঘ করেছে, এটা গুমোট দেয়া গরম, তো সকলেরই এই গরমে কষ্ট, বৃষ্টিটা খুব দরকার। তারপর চলে যাবার সময় শাড়ির পর্দার আড়াল থেকে কাপড়ে মোড়া কয়টা নাড়ু দিতে গেলে কঙ্কণের ঘষায় চামড়া ছড়ে গেলে রজব উুঁ করতে গিয়ে শব্দটা গিলে নেয়। উঠানে নামলে আমেনাবিবি চন্দ্রভানুকে না দেখার ভান করে অন্য দিকে চলে গেলেও সরকার বেশ আরাম চেহারা করে নিজের ঘরে যায়। কিন্তু রজব দক্ষিণধারে এসে হা করে হাওয়া টানে, হাওয়াশূন্য গ্রীস্মের সকালে যে কেউ তা-ই করতো। কিন্তু কারো সামনে পড়লে ভ্যাবাচেগা খাওয়া বিব্রত চেহারা বড়ো চোখে পড়ার মত।

সন্ধ্যা নাগাদ চাঁদপুর এসে পৌঁছাল ওদের পিনিস। হাইমচর নীলকমলে এসে যাত্রা বিরতি। সারাদিন কতবার যে ভাত খায় মাঝিমাল্লারা! বাড়ির রান্না করা বড়ো বড়ো হলুদ পাকা কইমাছ, খিড়াই দিয়ে ইচা মাছের তরকারি আর ইচামাছ ভর্তা, কুদ্দুসের জন্য ছিল মুরগী রান্না আর কইমাছ দিয়ে করল্লার ঝোল, সে খেলও পেট ভরে। এমনি সে খুব খাদক শ্রেণির লোক না কিন্তু নদীর বাতাস আর অজানা এক রোমাঞ্চ তার ক্ষুধাকে বড়ো চাঙ্গা করে তোলে। এখন শুরু রাতের রান্নার আয়োজন। পাশের নৌকা থেকে রান্নার ধোঁয়া আর ঝাঁঝ নদীর বাতাস গার্হস্থ্য করে তোলে। সন্ধ্যার আলোআঁধারি খেলায় সবাই যখন খুবই ব্যস্ত তখন কুদ্দুস গিয়ে ঢোকে চন্দ্রর ঘরে। হারিকেনের টিমটিমে আলো নদীর বাতাসে অস্থির আর অস্থির কুদ্দুস। চন্দ্রর রূপ যেন আজ কুয়াশাচ্ছন্ন মোহময়। বোকাসোকা কুদ্দুস যদি চন্দ্রভানুর রূপ না বুঝে এক আনা মন বুঝত তাহলে সেই রাতে সে পদ্মা মেঘনার সঙ্গম স্থলে সঙ্গম করতে গিয়ে কুলষিত না করে নিজেকে সংযত করত! কিন্তু কী রকম সে সঙ্গম কুদ্দুসের? ঝাঁপিয়ে পড়া আস্ফালনহীন এক ধোরা সাপ, না তেজ না বিষ, শুধু শুচিতা বিনষ্ঠকরা ছাড়া সে তো আর কোন কিছুই পারেনি। 

কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাছে ঘেঁষলে চন্দ্রভানু এক অভিনব আবদার করে, নায়ের গলুয়ে তারা সারা রাত শুয়ে থাকবে আর রাতের আকাশে নবমীর চাঁদ থাকবে আর কুদ্দুস তখন তাকে গান শোনাবে, তারপর যা হোক কিছু হবে। তারপর গলুই ফাঁকা করে বিছানা করা হয়। রাতের আহারের পর আকাশে এক স্তর মেঘও ভয় দেখিয়ে চলে যায়। হাবা আর কাবান্নি ছাড়া প্রায় সবাই আহারান্তে ঘুম যায়। আর রাত ফুরায় না। কিন্তু গান শোনাবে কুদ্দুস! সে তো কথাই উচ্চারণ করতে ঠোঁট তিনবার বাড়ি খায়। কিন্তু চন্দ্রর আবদার গান সে শুনবেই । – গানা করেন, একটা আবদার। কিসের গান, না কথা বোঝা যায়, না সুর, মনে হয় গায় কোন বিখ্যাত হিন্দি গান। বহুক্ষণ সে এসব চালায় আর চন্দ্র আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা গোনে কি কোন নতুন কথা বলার জন্য প্রস্তুতি নেয়।

 তারপর চন্দ্র আশ্চর্য কথা শোনায়, বলে আপনেরে একটা কথা বলি, আপনে তো আধা হিজড়া, আপনের কোন দিন সন্তান হবে না। কয়দিন বাদে বাদে ক্যান এই সব করেন?চন্দ্র যে কী ভাষায় কথা বলে কুদ্দুস তা বুঝতেই পারে না! বড়ো কঠিন দেখায় তাকে। রাতের অন্ধকারে অনেক সত্যিই এইভাবে বলে ফেলতে পারে চন্দ্র। মনে রেখেছে বছরের পর বছর, মোহনায় এসেছে বহু, জেনে ফেলার পর কুদ্দুসকেও কাছে আসতে দিয়েছে কিন্তু বলা গেলো আজ। বোকা কুদ্দুস ফ্যালফ্যাল করে তাকালে এবার মোহময় রূপ ধারণ করে; সলজ্জ হাসে, তারপর কোন ভণিতা ছাড়াই বলে, শোনেন, আমি স্বপ্নে দেখছি রজবের সন্তান আমার কোলে, ধরেন আল্লাপাকের আশ্চর্য লীলার মিধ্যে এই ঘটনাও একটা, হইতেও তো পারে, পারে না? কুদ্দুস বালকের মত মাথা নাড়ে, মানে হতে পারে।

  — সে আমার সব স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে পারে, সে ক্ষমতা যখন সে পাইছে, এইডাও সে পারবে। আপনে কাইল রজবরে আনাবেন। আপনে ভয় পাইয়েন না, সে আমাকে স্পর্শ করবে না, সে শুধু সারা রাত গলুইয়ে বইসা থাকবে আর আমি খোপের ভিতর থেইক্যা তার বরাবর হইয়া বইসা থাকুম, আপনে জাইগ্যা থাইক্যা কিন্তু রজবরে পাহারা দিবেন, কওয়া তো যায় না, পুরুষ মানুষ, কখন কী মতি অয়। চন্দ্র একটু মুচকি হাসে, কুদ্দুস বুঝতেই পারে না চন্দ্রর এটা কোন খেলা। নাকি সে স্বপ্ন দেখতে দেখতে পাগল হয়ে গেছে, নাকি তার উপর জিন আসর করছে, নাকি তার মধ্যে কোন শয়তান ভর করছে, নাকি…। তারপরও কুদ্দুস চন্দ্রকে বিশ্বাস করে এবং সে কথা দেয় সে কালই রজবকে শিমুলচর থেকে নিয়ে আসাবে। পরদিন মধ্যরাতে এসে পৌঁছায় রজব। রজবকে বলা হয়েছে, চন্দ্র খুবই অসুস্থ, তার পানিপড়ার জন্য তারা চাঁদপুর হাইমচরের নীলকমলে অপেক্ষা করছে। সে এতটাই অসুস্থ যে তাকে এত লম্বা ভ্রমণ দিয়ে গ্রামে ফিরিয়ে আনা যাবে না।

রাত যতই গভীর হোক চন্দ্রভানু কিন্তু অপেক্ষা করে বসে থাকে। রজব আসবে, সূরা পড়ে তার সারা শরীর বাইন্ধা দিবে, পানিপড়া দিবে, ঘানির সরিষার তেলে ফুঁ দিয়া দিয়া সেই তেলে বলক আনাইয়া ঘন করবে, বলকানো ঘন তেল তার তালুতে ঠেসে ধরে আবার সূরা নাস পড়বে, বলবে, এই সূরার কী গুণ যদি একবার ধইরা যায় কার সাধ্যি তোমার অনিষ্ঠ করে। আর এই ফাঁকে রজবের অদ্ভুত উন্মোল চোখ জোড়া বুকের মধ্যে গেঁথে নিয়ে বলবে এইবার তোমরা গলুইয়ে গিয়া বসো, আকাশের তারা গোন, আমি ভালো আছি। আবার এমনও হইতে পারে, রজব যখন তার করণীয় কার্যাদি সম্পন্ন করতে ব্যস্ত থাকবে চন্দ্র দেখবে বৈশাখের শেষ রাতের অল্প ঠান্ডা বাতাসে নৌকার গলুইয়ে মাথা রেখে কখন কুদ্দুস ঘুমায় গেছে আর সে সুযোগে চন্দ্রভানু রজবকে তার শরীরের উপর তুলে নিলে রজব স্তনের ভাঁজে মুখ রেখে বলে উঠবে, আমার ধর্মকর্ম, হাদিসকুরআন সব, সব তুমি আমার শেষ কইরা দিলা চন্দ্র, খালি একটা সন্তানের জন্য! — না তো কি, এইসবই তো সন্তানের জন্য, তবু এর বাইরেও উদ্দেশ্য ছিল, নিজেরে একদিনের জন্য সুখি করা, কেবল একদিন…তারপর তারা ক্লান্ত হয়ে গলুইয়ে চারিদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে আর কুদ্দুসের হঠাৎ ঘুমের মধ্যেই জেগে থাকার কথা মনে হলে জেগে উঠবে এবং কোন কথা না বলে মেঘনায় ঝাঁপিয়ে পড়বে…

 কিন্তু এসব কিছুই হয় না। রজব গভীর রাতে নৌকায় পৌঁছা মাত্র অসুস্থ হয়ে পড়ে, আর সেই রাতেই নীলকমলে কোন কবিরাজের খোঁজে রজবকে নিয়ে যাওয়া হয়। ভোরের দিকে রজব সেরে উঠলে নৌকায় ফিরিয়ে এনে নিজেদের বিছানায় শুতে দিয়ে নিজেরা গলুইয়ে গিয়ে বসে থাকে। সকালে ঘুম ভাঙলে রজব দিব্যি সুস্থ মানুষ। বৈশাখ মাসের নদী না অতি দূরন্ত না শান্ত। প্রতিদিনের দেখা নদী যে এত সুন্দর হয় তা রজব জানতই না। ভরা নদী টলটলে পানি আজলা ভরে ভরে অনেকক্ষণ ধরে সে পানি খায় আর ভাবে গ্রামের নাম নীলকমল হয় তা সে এখানে না এলে জানতই না! সারাদিন রজবের কোন দেখা নাই, যাওয়ার সময়ও কেউ দেখে নাই। সকালে পাশের নৌকায় তাদের জন্য মুরগি জবাই হয় সশব্দে, কৈ মাছের বিরন হয় আর চিংড়ি মাছ পোড়ার সুগন্ধ নদীর বাতাস মো মো করে। রজবের ভাগ্যে এসবের কিছুই জোটে নাই। বিকাল পর্যন্ত কুদ্দুসসহ আর দু‘জন, সারা নীলকমল গ্রাম হন্যে হয়ে খোঁজে। সাতদিনের মিশন থাকলেও চন্দ্রভানুর পীড়াপীড়িতে চারদিনের মাথায় নৌকার সবাইকে ব্যথিত করে ফিরে আসে। ব্যথিত হওয়ার কারণ, নৌকার দিনগুলি যথার্থ অর্থেই সকলের জন্য আরামের দিন, রাধো আর খাও, ব্যাস। এমন সুখের সময় কমই আসে তাদের জীবনে।

Series Navigation<< উপন্যাস─ চন্দ্রভানুর পিনিস। নাসিমা আনিস─ পর্ব সাত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *