ঈদসংখ্যার গল্প।। ভাঙনবাঁশি।। জব্বার আল নাঈম

০১
মাহাবুবকে বেঁধে রাখা হয়েছে বাগানের পূর্ব কর্নারে। একটা বড় গাছের সঙ্গে। কাপড় দিয়ে প্যাঁচিয়ে রাখা আছে মুখ। কিছু বলতে পারছে না। রাতের ঝোপঝাড় ঘুটঘুটে অন্ধকার, চেতন-অবচেতনের সংকটে ঝুলে আছে মাহাবুব। প্রথম দর্শনে যে কারো গা ছমছম করে উঠবে। এর মধ্যে ভীতিজাগানিয়া বৃষ্টি— যেন বহুকাল অঝোরে ঝরছে। থামার কোনো লক্ষণ নেই। থামতে বললেও থামবে না। বৃষ্টির জন্মই হয়েছে কান্নার জন্য। কান্নাই একমাত্র নিয়তি। এই কান্নার সঙ্গে মিশেছে মাহাবুবের চিৎকার। দুই শব্দ একত্র হয়ে অন্য রকম এক দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে। যা মানুষকে নিয়ে যায় মোহের জগতে।
মালিহার গলায় দড়ি লাগিয়ে অচেনা যুবক টানছে। গরুকে যেভাবে টানে রাখাল। মালিহার ক্লান্ত পা দাঁড়াতে চায়, বিশ্রাম নিতে চায়। অন্ধকারে তাকিয়ে চোখ দুটি বলতে চায়, ওহে পৃথিবী, আমাকে কার হাতে ছেড়ে দিয়েছ? কেনো জানতে পারছি না আমার দোষ! এখন অন্ধকারে হাঁটছি নাকি মুক্তির বন্দরে যাচ্ছি! কেউ কি নেই আমাকে বাঁচানোর?
মালিহার অনুমান, কয়েকজন মানুষ থাকার পরও সে একা। জীবনের হেঁচকা টানে গভীর উপলব্ধি করে মৃত্যুর কালো ভোল্টেজ! পায়ের আওয়াজ ছাড়া বাইরে কোনো শব্দ নেই, সংকেত নেই। মাঝেমধ্যে দু-একটি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে। হতে পারে এরাও গৃহপালিত কুকুর। অন্ধকারে তেড়ে যায়। তখন মালিক বা চোর চেনার সুযোগ থাকে কম। অস্বীকার করার উপায় নেই, কুকুর কারণ ছাড়া ঘেউ ঘেউ করে না। চক্রান্তকারীরা আলো-আঁধার উপেক্ষা করে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় এগিয়ে যায়। রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধ গাছ। কড়ই, কদম ও বাঁশঝাড়। এখানে রাতের পাখিরা নিশ্চিন্তে ঘুমায়।
অন্যদিকে কিছু বদমাশ সেতারে সুর তোলে আরামের ঘুমে বিঘ্ন ঘটায়। জাগিয়ে রাখতে চায় মাতাল মধ্যরাত। গাছতলায় হু হু ঠান্ডা। কান পাতলে শোনা যায় পাতাদের জিকির।…মালিহা অনুমান করে, পাঁচ-ছয় সদস্যের ছোট দলের কাছে সে বন্দী। মুখের গামছা সরিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করলেও পারে না, চিরস্থায়ী প্রথার মতো অবরুদ্ধ থাকে গর্জন। চিৎকার ফিরে আসে নিজের কানে। বাউণ্ডুলে বৃষ্টি নির্বিঘ্নে ঝরছে, যদিও যেতে পারে না বেশি দূর। উন্মাদনায় প্লাবিত করছে বদরপুর গ্রাম। টইটই করছে খাল, বিল ও পুকুর। সাতার দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না কূল। ভুলজলে ডুবে গেছে পা থেকে চুল।

০২
মালিহার চোখজুড়ে রাজ্যের অন্ধকার অথবা শীতলতা। বিলের চিল আকাশ দাপিয়ে উড়ছে ঘুরছে। ডানা ঝাপটানোর শব্দে বোঝা যায়, কত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। পথচারীর পায়ের আওয়াজ আর গাছ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া পাতার শব্দে একই ছন্দ। পার্থক্য করা কঠিন—বাতাসের তালে তালে পানিতে ঢেউয়ের নৃত্য, মালিহার কানে তুমুল বাজছে। অমার্জনীয় অপরাধীর মতো তার হাত দুটি পেছনে বাঁধা। ভয়-ভ্রান্তিতে অবিশ্বাসগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তন্ত্রে তন্ত্রে পৌঁছে গেছে। শরীরে বহন করা স্বগোত্রীয় প্রতিবেশী কোষগুলোও বড় অভিমানী। মাঝেমধ্যেই দারুণভাবে দাঁত ও জিহ্বার বৈরিতা ঘটে। লোকে শত্রুতা বলেই ইতিহাসে টুকে রাখে। অথচ প্রতিমুহূর্তে তাদের দেখা হয়। মানুষের সঙ্গেও মানুষের দেখা হয়। নিজের সঙ্গে নিজের দেখা হওয়াটা খুবই বিস্ময়কর! সঙ্গে থাকা, পারস্পরিক লেনদেন, হৃদয়ের বিনিময়, আবার হাঁটুর সঙ্গে হাঁটুর ধাক্কা লাগা। কাছাকাছি থাকার পরও মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব! বদরপুর গ্রামে যেন কেউ কারো নয়। পৃথক সংসারের মতো উদাসীন সতিন। বিপদে কিংবা উপকারেও একাল-সেকালের সম্পর্ক। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বসত করে বিভ্রান্তির ষোলো আনা। ডাকাত গ্রামের মতো স্বভাব ও চরিত্র হয়ে উঠছে সবার। হাত ও মুখ বাঁধা মালিহার গোঙানির শব্দ কেউ শোনেনি। অন্যদিকে মাহাবুবের চিৎকারেও এগিয়ে আসেনি সভ্যরা।
উঁচু-নিচু রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে মালিহা অর্জন করছে দীর্ঘ পাহাড় অতিক্রমের অভিজ্ঞতা। কোথাও কাদামাটি, কোথাও জল। আটকে পড়া জলের দুর্গন্ধ। কষ্ট হয় নিশ্বাস নিতে। সামনে যাওয়া যাচ্ছে না কিছুতেই। জীবনের গলি সাঁতরে নষ্ট সময়ের মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। দীর্ঘ পথচলার পর শক্ত ও মসৃণ মাটি স্পর্শ করে। বুঝতে অসুবিধা হয় না—শুকনা রাস্তা কিংবা বাড়ির পথ। তবে একেবারে কোলাহলমুক্ত। সিঁড়ি ভাঙার পথ পেরিয়ে ঘরেও প্রবেশ করতে হচ্ছে। ভয়ে শিউরে ওঠে মালিহা, শুকিয়ে যায় গলা।
চারপাশ বেশ অন্ধকার ও অস্পষ্ট মনে হলো চোখ ও মুখের বাঁধন খোলার পর। ভয়ে শরীর-আত্মার কম্পন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। স্বাভাবিকভাবে চোখ মেলার চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও নাকে আসে মদ ও মেয়েমিশ্রিত বোঁটকা গন্ধ! কানে আসে গোঙানির তীব্র শব্দ। অপরিচিতদের পায়ের আওয়াজ। আবার কারো কারো চোখ-মুখে খুশির ঝিলিক। সম্পাদনা গংদের ছুরির নিচে মালিহা আঁধার রাজ্যের সর্বশেষ সংকলন! দিশেহারা ভাবছে এমন সংকটের দিনে অনিচ্ছার গোপনঘরে মিশে যাবে, উদ্ধার করবে না সোহরাব-রুস্তম এসেও? সংগ্রাম ও সংকটে নিজেকে কনভার্ট ছাড়া বিকল্প পথ দেখছে না মালিহা। প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে. ছাড়িয়ে যেতে। ভয়ে ডাকছে, মাহাবুব! মাহাবুব, তুমি কোথায়? ফিনিক্স পাখির মতো এসে- আমাকে উদ্ধার করো। আমি অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছি। তলিয়ে যাচ্ছি। হারিয়ে যাচ্ছি। ভেসে যাচ্ছি দূরে; বহুদূরে।

০৩
দেয়ালে শব্দের উড়ন্ত প্রতিধ্বনি হয়। হয়তো ভয়ে এখানে আসবে না মাহাবুবের আত্মা। অস্ত্রের আঘাতের চেয়ে কথার আঘাত আরো তীব্র, তীক্ষ্ম ও ভয়ংকর! ক্ষুধার্ত শিয়াল জাপটে ধরে বনের হরিণ। চলছে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। প্রথমে চক্ষুদর্শন। এরপর বুকের পাহাড় পরিমাপ করতে গিয়ে মসৃণ সুন্দরে দুহাত চালায় অচেনা শেরপা। শেরপা পুরুষ বংশের লোক। মালিহা অনিচ্ছায় খোলে দক্ষিণের জানালা। হু হু করে বাতাস আসে। চোখ বন্ধ করে ডাকছে মাহাবুবকে। এখানে ঈশ্বর আর মাহাবুবের অবস্থান সমান দূরত্বে। মালিহাও নিজেকে দূরে পাঠানোর চেষ্টা করছে, পারছে না। অশুভের উপস্থিতিতে হৃদকম্প বাড়ে। একদিকে টেলিপ্যাথি, অন্যদিকে কালো রাতের ভয়ংকর উত্থান। যে রাতের শেষ নেই। শুরু নেই।
মালিহা কথার বাক্স খুলছে, মাহাবুব, তুমি কোথায়? কী করছ? অজানা আতঙ্কে মন খারাপ করে আছ? দুশ্চিন্তা কোরো না। ছায়ার মতো তোমার পাশে ছিলাম, থাকব আজীবন। আমাকে ভেবে অস্থির হয়ো না। দেখবে, একদিন বিল্ডিংয়ের দেয়াল অতিক্রম করে চলে আসব। তখন দুজনে বুনো আনন্দে নাচব। আকাশ-জমিন কাঁপিয়ে আগের মতো ছুটব, লং ড্রাইভে অথবা সমুদ্রদর্শনে। কসম, ওই গজবের গ্রামে আর যাব না। যেখানে ভুল মেশিনে বেরিয়ে আসে ভুল মানুষ। তারা জন্মের পর হয়ে যায় শুয়োরের বাচ্চা। ছুঁয়ে দেখে না সভ্যতা। সহায়তা করতে জানে না মানুষকে।
আকাশে তুমুল গর্জন। তবুও ভাবলেশহীন মাহাবুব। ভালো লাগে না কিছু বলতে, ইচ্ছা হয় আকাশে উড়ে—দূরে চলে যেতে। যেখানে মালিহার চরণ ছাপ স্পষ্ট মিলবে। ঘুরবে। ঘুমাবে। নাহ্, হলো না। ভয়ের গোডাউন শহুরে যুবকের অন্তর ঘিরে রেখেছে। রাতের বাগানে শোঁ শোঁ শব্দ, একবার বাড়ে একবার কমে। পাখির পাখা ঝাপটানোর শব্দ, ইঁদুরের দৌড়ঝাঁপ আর বাদুড়ের উচ্চবাচ্যের ভয়। জ্ঞানশূন্য মাহাবুব। এরপর কোনো ভয়ই তাকে স্পর্শ করতে পারল না।

০৪.
বদরপুরের কুকুর মাল্টিমিউচুয়াল কলোনির বাসিন্দা। শতভাগ জীবন বাজি রেখে একের বিপদে অপরের উপস্থিতি নিশ্চিত করে। দুদিন আগে মানুষের নির্মম প্রহারে যে জ্ঞাতি কুকুর অসুস্থ হয়েছিল, প্রতিবেশী কুকুরের খেদমতে সে খানিকটা সুস্থ ও সবল। দিব্যি হাঁটতে পারে। অংশগ্রহণ করতে পারে সামাজিক কার্যক্রমে। অন্যদিকে মিটিং প্রধান হিসেবে থাকে মাতবর কুকুর। সন্তান ও সঙ্গমের ক্ষতি ও উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করে। আবার বার্ষিক টেবিল ক্যালেন্ডারে পরিকল্পনা আঁকে। কার বাড়িতে কবে অতিথি আপ্যায়ন হবে। উৎসবের দায়িত্ব কার ওপর বর্তাবে। মিটিং শেষে সবাই একই সুর ও শব্দে ঘেউ ঘেউ করে, আকাশে-বাতাসে আনন্দ ছড়ায়। গ্রামের মাতবর কুকুর বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তারপরও তার প্রণীত দিকনির্দেশনা মেনে চলে রাজ্যের কুকুর। বৃদ্ধকে সঙ্গ দিতে গুহাঘরের সামনে থাকে একজোড়া যুবক কুকুর। পরামর্শের প্রয়োজনে দ্বারস্থও হয়। অমিলে যেন নিজেদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা না ঘটে। মিলেমিশে লক্ষ্যে পৌঁছার ইচ্ছা তাদের। এখানেই অপূর্ব মেলবন্ধন আর সুখ-সুন্দর খেলা করে।
জোড়পুল বাজারে মানুষ পক্ষ-বিপক্ষের খেলায় বেশ পারঙ্গম। এক দল মূর্খ আরেক দল আধা মূর্খ। শিক্ষিতেরা সাদা কাপড়ের আড়ালে নিজেকে ঢেকে রাখে যত্নে। ফলে মূর্খের সঙ্গে আধা মূর্খের ঝামেলা হওয়াটা স্বাভাবিক। ঘায়েল হয় একজনের আঘাতে অন্যজন। চোখের পর্দা উল্টে চলে পদাঘাতপর্ব। মাতবর কুকুর সংশোধনী মজলিশে সতর্কসংকেত দেয়, পারিবারিক ঝামেলা যেন বাজার পর্যন্ত না আসে। মিলেমিশে সমস্যার সমাধানে আসতে হবে আমাদের, মজমায় তৃতীয় পক্ষকে সুযোগ দেওয়া যাবে না বনের মধুর স্বাদ নিতে। এমন অসংখ্য সদুপদেশ আসে মাতবরের দপ্তর থেকে। কাজের কারণে গুহায় ব্যস্ত থাকতে হয় মাতবর কুকুরকে। খাবারের সময় হলে অন্যরা খাবার সংগ্রহ করে দেয়। তার প্রধান কাজ—প্রতিবেশী ও পরবর্তী প্রজন্মকে চেইন অব কমান্ড মানানো। এসব সামাজিক কাজেই যত ব্যস্ততা। এভাবেই ছোট-বড় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করতে হয়। গ্রামের সব কুকুরের জন্য একটাই প্রার্থনাঘর, যেখানে সবাই মিলে সপ্তাহে অন্তত একবার এবাদতে আসে। মিলিত হয়। ভালো-মন্দের ভাগ হয়, বিপদ-আপদে বিনিময় হয় সাহায্য-সহযোগিতা। সেদিন সবার মনে ঢেউ তোলে আনন্দোৎসব। প্রতিবেশী গ্রামের কুকুর কারো ওপর হামলা চালালে, একজোটে প্রতিবাদে নামে। আশপাশের দশ গ্রাম জানে বদরপুরের কুকুর কতটা সংগঠিত ও শক্তিশালী। প্রতিবেশী গ্রামের নাম কাশিমপুর। একজোট হলে শক্তি ও সাহস বাড়ে। বাইরের শত্রুপক্ষ ভয়ে থাকে।
গ্রামে গড়ে উঠেছে অবিচারের পাহাড়। বেয়াদবের আখড়া। বাবুলের বউ ভাতিজার ঘরে, দুই সন্তান রেখে সহেলের সঙ্গে সঙ্গম-সংসার মামুনের মামির! যেন ভুল অন্ত্যমিল। মা ও মেয়ের প্রেমিক এক গৃহশিক্ষক! অথচ তারাই সভ্যতা সংগ্রহের মাঠ-ঘাট চষে। ভুল ট্রিটমেন্টে মারা পড়ে মোহিতলালের সুন্দরী মেয়ে তনুশ্রী দেবী। যেখানে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আটকে পড়ে হাঁটুর চিপায়। এরপর সবাই মিলে খোঁজে মুক্তির উপায়। গ্রামের জাতীয় মসজিদে বাড়ছে দ্বিধা-বিভক্তি। মানুষের বিদ্বেষে উপাসনালয়গুলো অন্ধের মতোই একাধিক সন্তান জন্ম দেয়। এসবের জনক কাশিমপুরের ভজন রসিক মাস্টার। বদরপুর মাদ্রাসার মসজিদটি এখন সাত সন্তানের জননী। দাম্ভিকতার খোয়াড়ে খোয়াড়ে বিচ্ছেদনামা। নিচু মনসংসার! ভারাক্রান্ত বিবেক।
বদ মানসিকতার বড় ভাই মূর্খ মস্তফা ওরফে মাখন ও মজ্জেলের টাকার আড়ত চিলের পেটে। বোয়ালের সংসারে হাতি, ঘোড়া, কিস্তি মাত। যমজ ভাইয়েরা গরিবের সম্পদ ভাগাভাগিতে ব্যস্ত। বদমাশের বদ মতলব জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’র রাতের মতো বাড়তেই থাকে। ক্ষীণ হয়ে আসছে আলোর সম্ভাবনা। সহেল চোরা গ্রামের নব্য মাতবর। জাগছে মেম্বার হওয়ার শখ। হিসাব কষছে কোন খাত থেকে আসবে আগামী পাঁচ বছরের আয়।
গ্রামের কূটকৌশলের জনক আজম শফিউলও হিসাবের ঘরে দৌড়ঝাঁপ করে রোজ রোজ। দখল করতে চায় পরাজিতের গনিমত। ভাগাভাগি করতে চায় নামাজে-জায়নামাজে। মসজিদ-মন্দিরে। মাপামাপির দূরপাল্লায় শ্রাবণের বৃষ্টির মতো রক্তক্ষরণ হচ্ছে মনে। অথচ সবই অদেখা। কোদালের পর কোদাল মেরেও শান্তিরা দূরে ঘুমায়।

০৫
মালিহাকে খেতে দেয় মিষ্টি। কিন্তু সে মনের বিভাজনে ব্যস্ত। একজোড়া অশুভ হাত গোলাপের পাপড়ি স্পর্শ করে নিজেকে ধন্য ভাবে। তর্জনী দিয়ে আঁকে মানচিত্র। সেখানে মূত্র বিসর্জন করতে গিয়ে ইচ্ছারা অনিচ্ছার সঙ্গে ফিজিক্যালি পারে না। এভাবেই অর্থের দাম্ভিকতায় আলাদা হয় গ্রামের পুরোনো ঈদগাহ। বিভক্তি বাড়ছে, বিয়োগ হচ্ছে সম্প্রীতি। যোগ হচ্ছে দ্বন্দ্ব। ভাগ হচ্ছে মৌলিক অধিকার।
চলছে মালিহার ওপর বল প্রয়োগ। কমছে নিশ্বাসের দূরত্ব! মৌলভীর কান ভেদ করে চিৎকার ছিটকে পড়ছে দুনিয়ায়। মৌলভি বলে ওঠে, ‘তওবা তওবা’। বাড়িয়ে দেয় জিকির আসকার। পৃথিবীর বোধের ঘরের প্রদীপ জানে না, বিদ্যুতের উৎস কাপ্তাই! মৌলভি জানে মুক্তির জন্য লড়াই সংগ্রাম করতে হয়। জয় আসবে অথবা মুক্তির পথ তৈরি হবে। কিন্তু মৌলবি কোনো পথেই হাঁটতে রাজি না। মৌলভি অসভ্যের মতো বিচ্ছেদ শোনায় ঈদগাহ, মাদ্রাসা ও মসজিদের। প্রতিবাদে শামিল না হয়ে— সূরা ফাতেহার তরজমা মেলায়!
ধুতির মতোই ঠাকুর মহাশয় নিপাট ভদ্রলোক! অন্তর স্বচ্ছ। নেই ঝামেলার জমিনে, যার নুন খায় তার গুণ গায়! তাহলে পক্ষপাতহীন মালিহার পক্ষে কে দাঁড়াবে? আর কে চাইবে বিচার?

০৬
মালিহা পাচার হয় শহরের অন্ধকার মগজে। লাখো গলিতে ঘূর্ণি খাবে। পাহাড়ে চড়তে প্রতিযোগিতায় নামবে সভ্য সমাজ। মদ ও মাংস এক হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যোনিবমি হবে তার। বগলের উৎকট গন্ধে বাড়তে থাকবে পাপানন্দের রাত। ক্লান্ত শরীর দাঁড়াবে আত্মহত্যার মঞ্চে।
দুঃখের চিৎকার সর্বদাই দেয়ালবন্দী থাকে। বের হলেই ওলট-পালট হবে পৃথিবী। অস্বাভাবিক উত্তেজনায় উন্মাদ হবে মানুষ ও পশুপাখি। নারীর সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে স্নান সারবে পুঁজিপতিরা। কিছু পুরুষ মানুষ গোত্রের না। থাকে যোনির আনন্দে উত্তেজিত।
মেঘের গুঞ্জনে যখন আকাশের মন খারাপ, তখন কেউ কেউ গিটারের গোপন সুরের কথা ভাবে। যে সুর নিয়ে যায় অচেতন ঘুমের ঘোরে। তখন রাতের আকাশ ফাঁকা গোলপোস্ট। বল পাঠানোর অপেক্ষায় স্ট্রাইকার লিওনেল মেসি। পুঁজিপতিরা মাংসের ঘ্রাণে আমোদিত। তারা জানে, পৃথিবীতে সবচেয়ে দামি মাংস নারীর। মালিহার মাংস বিক্রি হবে উচ্চমূল্যে।
রক্ষক যখন ভক্ষক, তখন চব্বিশ ঘণ্টার অন্ধকার নামে। ক্রোধে দাঁত দিয়ে পাহাড় কাটে। তালগাছ দিয়ে খিলাল করে। শরীরের ভাঁজ খোলে তৃতীয় হাত, ঊর্ধ্বাংশে আঙুলের নাচ। ছোবলে ছোবলে ক্ষত হয় রাষ্ট্রের বিবেক। ভীষণ রক্তাক্ত শরীর। ভুলতে দূরের কথা ভেবে হাসছে মালিহা। কারো চোখ সেই হাসির মর্মার্থ বুঝে উঠতে পারল কি না, সেসবে খেয়াল নেই তার।
মাহাবুবের হিসাবের খাতায় মালিহা লিখেছিল প্রতিশ্রুতি-দ্বিতীয় শরীর আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। মাহাবুব, তুমি চুপ থাকলে দুনিয়ায় গজবের আতঙ্ক বাড়ে! বিশ্বাসের নৌকা ডোবে মরুভূমিতে, সমুদ্রে জ¦লে আগুন, পাহাড় ধসে বিমূঢ় বিস্ময়ে। দেখো মাহাবুব, বিশ্বাসের অবমূল্যায়ন হবে ভেবে তোমার কাছে ছুটে এসেছি। এই আমার ডান হাত। বাঁ হাতে বেহায়ার নগ্ননৃত্য। ইচ্ছা হলে গ্যালারিতে বসে শত ভঙ্গিমায় দেখো, কীভাবে ইউনিভার্সেল বস গেইলের দানবীয় চার-ছক্কা উপভোগ করেছে হাজারো দর্শক। আমি বোলার। উইকেট দখলে নিতে ব্যর্থ। নারীর দেহ কুকুর আর শকুন খাবে, মজা লুটবে। এসে দেখো, ব্যাটিং তাণ্ডব থামেনি। একবার গ্যালারিতে বসো। ব্যাটসম্যানের হাতে ছুরি। গোপন ঘরে রক্তাক্ত ছুরির শুশ্রƒষা চলছে। অন্যদিকে মজলিশে সুরাহার হাতে রক্ত। অসম প্রতিযোগিতার লড়াই। ইমাম আত্মগোপন করছে ঠাকুরঘরে। ঠাকুর মহাশয় দেবতাদের আশ্রয়ে, পানশালায়। পবিত্র ধর্মঘরে রক্তস্রোতের সাঁতার প্রতিযোগিতা। অথচ যাজকের মনে নেই জাজ।

০৭
মালিহার আত্মা ঝুলছে চিলেকোঠার কার্নিশে। আপন শরীরে লুটতরাজ আর ধ্বংসযজ্ঞের খেলা, অসহনীয় যন্ত্রণা কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না! মাহাবুবকে হাঁক ছাড়ে, নিদ্রা ভেঙে তাকাও আমার দিকে, ফিরে এসো আগুনের নৌকা ডুবিয়ে। আর পারছি না! সেই শব্দ পৃথিবীর আহিৃক ও বার্ষিক শব্দের ঘূর্ণনগতি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। বিচ্ছিন্ন রকমের সংগ্রাম চলে। অবিরত। আরেকজন কাটা-ছেঁড়া স্রোতে হাত ধুয়ে নেয়। নাকে-মুখে গন্ধ বিলায়। চলে ভাগ-ভোগ পর্ব। কাটা গলিতে একজনের মাথা পেয়ে চোখে-মুখে প্রাপ্তির উল্লাস। তৃতীয়জন গরম খুন্তি ডুবিয়ে দেয় রক্তঢেউয়ে। কপালে এঁকে দেয় বঞ্চনার তিলক। চতুর্থ ও পঞ্চমজন কামান মেরে উড়িয়ে দেয় প্রাণহীন দেহ। উড়ে যায় মায়াময়ীর আশ্রমঘর।
মাহাবুব কিছুটা সুস্থ। আকাশে হরেক রকম সংঘর্ষের কারণে টেলিপ্যাথি সংযোগ বিচ্ছিন্ন, দুর্বল নেটওয়ার্ক, মালিহাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। মনের ভেতরে বিতৃষ্ণার আসর। দেয়ালের এপারে-ওপারে আত্ম-আলোচনার মঞ্চ। আলো-আঁধারের গ্রামে সকল সম্পর্ক ঝুলছে চিকন সুতায়। চিড় ধরেছে আত্মরক্ষার আশ্বাসে। মাহাবুবের কাছে সবই অস্পষ্ট।
ভালো নেই মাতবর কুকুরটির শরীর। ভালো নেই মন। তারপরও ভ্রাতৃত্ব অটুটের কথা বলছে। আনন্দোল্লাসে কাটুক জীবন-সংসার। এমন মাল্টিমিউচুয়াল সম্পর্ক তার দীর্ঘদিনের চাওয়া।
বদরপুর গ্রামে ফিরে আসে মাহাবুব। কথা বলে না কারো সঙ্গে। ঘুরছে দিকহীন পথে। আওয়াজহীন হেঁটে যায় বহেরাতলী। আবার ছুটে যায় ঝাউবাগান বাজারে। কেউ কিছু জানতে চায় না। জানায় না সমবেদনাও। একজনের অপেক্ষায় মগ্ন থাকে মাহাবুুব। আসবে, অতি ধীরে-দিলের নগরে। একসঙ্গে ফিরে যাবে চেনা শহরে। একা ফিরলে মুখোমুখি হতে হবে মালিহার মা-বাবার। কী জবাব দেবে, জানে না। রাগে মগজ বের হতে চায়।
০৮
গ্রামের কুকুর আলোচনার আসনে বসে। সেখানে পশুপাখি ও মানুষের প্রসঙ্গ থাকে। শেষে প্রশ্ন পর্ব। কানে বাজে কুকুরের চিৎকার। ব্যতিক্রম স্বর ও শব্দ! শব্দের দিকে কান পাতে মাতবর কুকুর। এরপর বেরিয়ে আসে গুহাঘর ছেড়ে। ছোটে শব্দের উৎসের সন্ধানে। জোড়পুল বাজার থেকে ভেসে আসে সেই শব্দ। আশপাশের গ্রাম থেকে আসছে কুকুর। হেঁটে আসছে। দৌড়ে আসছে। লাফিয়ে আসছে। রাস্তায় কুকুরের মিছিল। আকাশের ভাঁজ খুলে তৈরি হয় চলন্ত সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে কুকুর। বাজারটি এখন কুকুরসমুদ্র। দিশেহারা মানুষ ভয়ে উন্মাদের মতো ছুটছে। কেউ চায়ের কাপ রেখে, হাতের বিস্কুট ফেলে, দোকানের ঝাঁপ খুলে, অসম্পূর্ণ কাজ রেখে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে ফেলে, বাবা কোলের সন্তান রেখে। কারো দিকে তাকানোর সময় নেই। বেঁচে থাকার অন্য রকম তাড়া।
বেদনার সাইরেন বাজিয়ে, মাতবর কুকুরের মতোই গম্ভীর হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মাহাবুব। ছুটে আসছে অসংখ্য কুকুর। হাজার হাজার কুকুর। মাহাবুব ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই বাজারে। কুকুরগুলোর বিষণ্ন চোখ তাকিয়ে আছে মাহাবুবের দিকে, এলাকার রন্ধ্রে রন্ধ্রে হিংস্রতা দমন করতে। যুদ্ধের মাঠে সেনাপ্রধানের হুকুমের অপেক্ষায় যেমন থাকে সৈন্যরা। পুরোনো সভ্যতা ভেঙে নতুন সভ্যতা গড়তে।
খবর চলে যায় গ্রামে গ্রামে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে মানবমনে। সবাই ছুটছে দিক-দিশাহীন হয়ে। কেউ চুলায় ভাত রেখে, ঘরের দরজা খুলে, দুধের বাচ্চা কোলে, গবাদিপশু মাঠে রেখে, জীবন বাঁচাতে। দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবছে, মাহাবুব তাহলে মানুষ নয়! জিন প্রজাতির কেউ। কুকুরগুলো তার রূপান্তর অথবা ছদ্মবেশ! সে ডেকেছে কুকুরদের। বোধ-বোধহীন আমরা এত দিন চিনতে পারিনি তাকে। চারপাশে আতঙ্ক! আতঙ্কে গ্রাম ছাড়ে মানুষ। মানুষশূন্য হয়ে পড়ে বদরপুর।
গ্রামের মাদ্রাসা মসজিদ মাঠে দাঁড়িয়ে আছে মাহাবুব। দেখছে— মাঠ-ঘাট, নতুন গজানো সবুজ ঘাস, সকালের কুয়াশায় সূর্যের বিকিরণ অথবা পারস্পরিক সোহার্দ্য-সম্প্রীতি। ঘাসের গায়ে মানুষের পায়ের ছাপ নেই। গরু-ছাগল চষে বেড়ায় মাঠঘাট। সকালের গাছে নতুন ফুল। ফুলের সুবাস, অথচ নেওয়ার কেউ নেই। গাছের নিচে ফলের স্তূপ। খাওয়ার কেউ নেই। ছড়িয়ে পড়ছে গন্ধ। দিলখোলা বাতাস বইছে। মাধুরী মিশিয়ে গাইছে পাখিরা। আবার গাছে গাছে ফুটছে ফুল। ধরছে ফল। সেই ফল ঝরে পড়ছে। কুড়ানোর কেউ নেই। জোড়পুল বাজারের দোকানগুলোও মালিকশূন্য। জনমানবহীন। খেলার মাঠে নেই সেই দুরন্ত-উড়ন্ত বালক। মাঠের কৃষক, পথের পথিক, ঘরের বউ—কেউ নেই। চারপাশে কেবল নেই আর নেই। অথচ মানুষের পদচারণা ছাড়া প্রকৃতিও বিষণ্নতায় থাকে। পাতাদের মাঝে তৈরি হয় কোমল উন্মাদনার কম্পন।
মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিন উধাও। মাদ্রাসায় মুফতি, মোহাদ্দিসরা নেই। মহাকালের সাক্ষী হয়ে— বদরপুর মাদ্রাসা মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আলতাফ মাহমুদ ওরফে রামরার হুজুরের রোপণ করা তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে জট হয়েছিল। হুজুরের দোয়ার বরকতে পরবর্তীতে তাল ধরে। সেই তালের দখল নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় দ্বন্ধ চলে। দ্বন্দ্বের রেশ এখনো কাটেনি। বিজ্ঞজনদের ধারণা, হুজুরের দোয়ার বরকতে কিছুটা টিকে আছে অলস পড়ে থাকা বদরপুর।
ঠাকুরবাড়ির তুলসীগাছটি পানির অভাবে কাঁদছে। জ¦লছে না সন্ধ্যাপ্রদীপ। পালিয়েছে ঠাকুর মহাশয়। যাদের মুখে জাত যাওয়ার বুলি লেগেই থাকত। এখন এর কোনো নামগন্ধ নেই। তফাত ভুলে হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে আছে ভাইয়ের মতো।
মসজিদে মোয়াজ্জিন নেই। মিম্বর খালি। ইমামের হাঁকডাক নেই। নেই মুসল্লির আনাগোনা। দরজা দেওয়ার মতো একজনও অবশিষ্ট নেই গ্রামে। দূর গ্রাম থেকে দেখা যায়, মসজিদের পাশে একটি কুকুর মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশ সুনসান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *