ঈদসংখ্যার গল্প।। অপেক্ষা, তুমি কি পারস্যে থাকো।। রাসেল রায়হান

প্রেম শব্দের মানেই অপেক্ষা। অপেক্ষা; এই শব্দটি শুনলেই আমার সামনে ভেসে আসে অনন্ত প্রেমের কিছু চিত্র। রেলস্টেশন; ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে বসে আছে একটি মেয়ে, তার চেহারায় উদ্বেগ, উদগ্রীবতা। একটু পর পর বাইরে তাকাচ্ছে। যার আসার কথা, তার কোনো খবর নেই। মোবাইল বন্ধ। ট্রেন চলে আসছে। স্টেশন মাস্টার বাঁশি বাজাচ্ছে। ছোট্ট এই মফস্বলে ট্রেন থামে দু বার, ভোর এবং সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। দশ-পনেরো মিনিট দেরি করে রোজ। শুধু আজকেই কাঁটায় কাঁটায় ৬টায় ট্রেন আসলো। শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে লোহার ট্রেন লাইনের। ঐ তো, ট্রেন দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা বার বার বাইরে তাকাচ্ছে। না, সে আসছে না। যার জন্য সবকিছু ফেলে এই মানুষভর্তি একলা স্টেশনে অপেক্ষা, সে আসছে না।

ট্রেন চলে গেল। শুধু বসে রইল মেয়েটি, আর অপেক্ষা।

কিংবা, পারস্যে এক মেয়ে থাকে। বাংলাদেশের এক ছেলের সাথে তার ভারচুয়াল পরিচয়। ছেলেটি বিবাহিত। বাচ্চা আছে। তবু তারা দুজন কথা বলে। সম্পর্কটা বন্ধুত্ব নয়, প্রেমও নয়, দুটোর চেয়েই সামান্য বেশি। দুজনেই জানে, তাদের কোনোদিন দেখা হবে না। দেখা হলেও তাদের মধ্যেখানে যে সুতোটা আছে, তার মাঝখানে একটা গিঁট, সেই গিঁট অতিক্রম করা দুজনের কারও পক্ষেই সম্ভব নয় কিংবা অনুচিত… তবু তারা অপেক্ষা করে…

কিংবা, আমারই এক বন্ধু পিতা হচ্ছে। দু ফোঁটা ইউরিন টেস্ট তাকে জানিয়ে দিয়েছে এই সুসংবাদ। এরপর শুধুই অপেক্ষা। অপেক্ষা দশ মাসের। একেকটি দিন যাচ্ছে, মনে হচ্ছে অনন্তকাল। কবে আসবে সেই মুহূর্ত? কবে শুনতে পাওয়া যাবে নবজাতকের চিৎকার? পৃথিবীতে এই একমাত্র কান্নাই সুখবর। অজস্র মানুষ অজস্র নারীর পাশে উদ্বিগ্ন মুখে বসে থাকে একবার এই কান্না শোনার অপেক্ষায়। এই অপেক্ষা মধুময়।

আমরা অনেকেই জানি, অনেকে জানিও না, টোকিওর সেই বিখ্যাত সোনালি-বাদামি কুকুর হাচিকোর কথা, ১৯২৪ সালে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিভাগের অধ্যাপক হিদেসাবুরে উয়েনো যাকে পোষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। প্রতিদিন শিবুয়া স্টেশনে হাচিকো অপেক্ষা করত প্রভুর জন্য। ১৯২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত সবকিছু স্বাভাবিক চলছিল। একদিন অধ্যাপক মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা যান, সেদিন আর আসা হয় না তার। অথচ হাচিকো সেদিনও বসে আছে, অধ্যাপকের অপেক্ষায়। অধ্যাপক আসেন না। পরবর্তী টানা ৯ বছর ৯ মাস পনের দিনের প্রতিটি দিন হাচিকো অপেক্ষা করেছে উয়েনোর। ঠিক ট্রেন আসার মুহূর্তটিতে তাকে দেখা যেত স্টেশনে। একটি ব্রোঞ্জমূর্তি হয়ে আজও সে অপেক্ষা করছে অধ্যাপকের। এই অপেক্ষা কি মধুময়? নিশ্চয়ই। নইলে কে দিনের পর দিন বসে থাকে? পৃথিবীর কোনো প্রাণীই আনন্দ ছাড়া কিছু কিছু করে না। সেটা হতে পারে বই পড়া, হতে পারে ঘুমানো, হতে পারে সঙ্গম, হতে পারে হত্যা; আত্মহত্যাও। প্রতিটির পেছনে আছে আনন্দ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না মাঝে মাঝে। অন্তত আত্মহত্যা হতেই পারে না আনন্দের কোনো ফসল। কিন্তু সেটাতেও আপত্তি আছে আমার। মানুষ জীবনের এমন কোনো মুহূর্তে আত্মহত্যা করে, যখন তার আর কোনো পথ থাকে না। জীবন তাকে যন্ত্রণা দিতে থাকে নানাভাবে, নানা প্রকারে। তখন মানুষ বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র পথ মনে হয় তখন আত্মহত্যাকে। আর যন্ত্রণামুক্তির চেয়ে বড় আনন্দ কী হতে পারে? যেমন ধরা যাক একজন ড্র্যাগ অ্যাডিক্ট যুবকের কথা, যে অহরহ প্যাথেড্রিন নিচ্ছে। সারা শরীরে সুঁইয়ের দাগ। এই সুঁইয়ের ছোবল সে সানন্দে গ্রহণ করছে, আনন্দের জন্য। এই আনন্দের জন্য সে সুঁইয়ের যন্ত্রণাকে অগ্রাহ্য করছে। আত্মহত্যাকারীর কাছে আত্মহত্যার যন্ত্রণা আসলে সুঁইয়ের ঐ ছোবলটুকুর মতোই, সামান্য, পিঁপড়ের কামড়। জীবনের সমস্ত যন্ত্রণার থেকে মুক্তি পেতে মৃত্যুযন্ত্রণা তার কাছে ঐ সুঁইয়ের যন্ত্রণা, পিঁপড়ের কামড়সম।

এভাবে চলতে থাকে অপেক্ষা। আনন্দের অপেক্ষা। পার্কে একজন তরুণীর বসে থাকা, কখন তার তরুণ আসবে ক্লাস শেষ করে; কিংবা বাসায় এক নারীর চুলায় পানি চড়িয়ে বসে থাকা, তার পুরুষ বাসায় ঢুকে গোসল সেরেই এক কাপ চা খেতে চাইবে; কিংবা একজন মায়ের অপেক্ষা, কখন সন্তান স্কুল সেরে আসবে, আর তার নিরাময়তুল্য মুখ দেখতে পাবে; পরীক্ষার ফলের জন্য অপেক্ষা, সেটাও আনন্দময়। সবাইই তার রেজাল্ট আশার অধিক প্রত্যাশা করে। যে এ গ্রেড পাওয়ার মতো পরীক্ষা দিয়েছে, সে ভাবছে টেনেটুনে কি এ প্লাস এসে যেতে পারে না, কিংবা সবচে খারাপ ছাত্রটি অপেক্ষা করে এবার অন্তত পাশ মার্ক আসুক। ক্যামেস্ট্রি পরীক্ষা খারাপ হয়েছিল, তবু স্যার কি দয়াপরবশ হয়ে ৫টা গ্রেস মার্ক দিয়ে বসতে পারেন না!… এভাবে চলতে থাকে অপেক্ষার। অজস্র অপেক্ষা। যেমন পারস্যের মেয়েটি কিংবা বাংলাদেশের ছেলেটি বসে আছে, গিঁটটা কি আরেকটু সূক্ষ্ম হতে পারে না? আর একটু কাছে কি তারা আসতে পারে না?

সমস্ত অপেক্ষা একটি অন্তিম অপেক্ষার জন্য। মৃত্যু। এই অপেক্ষা ঐ খারাপ ছাত্রটির মতন। মহামহিম কি গ্রেস দিয়ে আর দুটি দিন আয়ু বাড়াতে পারেন না? যদি বাড়ান! আহা! যদি…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *